- বইয়ের নামঃ মাউসট্রাপ
- লেখকের নামঃ আগাথা ক্রিস্টি
- বিভাগসমূহঃ অনুবাদ বই, উপন্যাস
মাউসট্রাপ
১. হিমেল হাওয়া
হিমেল হাওয়া দেহের হাড় কাঁপাচ্ছে। চারদিকে তখন নেমে এসেছে সন্ধ্যার আঁধার, আকাশের বুকে তখন ভেসে বেড়াচ্ছে পেঁজা পেঁজা বরফ। তার ফলেই চারদিকে অন্ধকার ঘন হয়ে উঠেছে।
এবার দেখা গেল কালো ওভারকোট পরা লোকটিকে। মাফলারটা গলার ওপর দিয়ে থুতনিরও এক অংশ ঢাকা দেওয়া। চোখের কোণ পর্যন্ত টানা কালো টুপি। কার্লভার স্ট্রীট ধরেই পায়ে পায়ে এগিয়ে লোকটি চুয়াত্তর নম্বর বাড়ির সামনে এসে থামল। বন্ধ দরজা সংলগ্ন কলিংবেলের লাল বোতামটি হাত বাড়িয়ে টিপে দিল। দূরে কোথায় একটা অস্বস্তিকর ক্রিরিং…ক্রিরিং শব্দ বাতাসে শোনা গেল। কান পেতে শোনা গেল সেই আওয়াজ।
শ্ৰীমতী ক্যাসির দুহাতই তখন কাজে জোড়া, অথচ বেলের দাবি না মানলেই নয়। ক্যাসি আপন মনে গজগজ করে বলতে থাকে, জাহান্নামে যাক ঘন্টি। সারা জীবনটা জ্বালিয়ে পুড়িয়ে মারবে। দরজা খুলে বাইরে উঁকি মারল।
দরজা খুলতেই শোনা গেল খসখসে ও মৃদু কণ্ঠস্বর। নিকষ অন্ধকারের মধ্যে লোকটা যেন একটা পটে আঁকা ছবি। মিসেস লিয়ন…?
ক্যাসি কাটছাঁট উত্তর দিল, তিন তলায় পাবেন। তার মনের ঝাল এখনো মেটেনি। সে আবার বলল–এই সোজা সিঁড়ি। আপনার আসবার কথা কি তার আগে থেকে জানা আছে?
কোনো কথা না বলে আগন্তুক শুধু ঘাড় ঘোরালো একবার ডাইনে, তারপর বাঁয়ে।
ক্যাসি আবার বলল তাহলে এই সিঁড়ি বেয়ে ওপরে চলে যান। দরজায় নক করলেই তার সাড়া পাবেন। মলিন কার্পেট পাতা সিঁড়ি বেয়ে অপরিচিত আগন্তুক যখন ওপরে উঠে গেল তখন পেছনে থেকে তার দিকে তাকিয়ে ছিল ক্যাসি। পরে অবশ্য ক্যাসি স্বীকার করেছিল– প্রথম দর্শনে আগন্তুককে দেখে তার একটু কেমন কেমন ঠেকছিল ঠিকই, তবে ও ভেবেছিল হয়তো ঠান্ডা লাগার জন্যেই গলা বসে গেছে আগন্তুকের। সেইজন্যেই কণ্ঠস্বর এত মৃদু আর খসখসে। তাছাড়া আবহাওয়া এমন ছিল যাতে এই ধরনের ঠান্ডা লাগা কিছুমাত্র বিচিত্র নয়। সিঁড়ির বাঁক নেবার সঙ্গে সঙ্গেই কিন্তু নরম সুরে শিস দিতে শুরু করে ছিল আগন্তুক। অনেক দিনের পুরনো ছেলে ভোলানো ছড়ার সুরই ধ্বনিত হলো তার শিসের মাধ্যমে। তিনটে ইঁদুর অন্ধ, ডাহা তিনটে ইঁদুর অন্ধ।
মলি ডেভিস গেটের সামনে দাঁড়িয়ে নতুন লাগানো ঝকমকে সাইন বোর্ডটার দিকে চোখ তুলে তাকালো।
.
মঙ্কসওয়েল ম্যানর অতিথিশালা
মলি প্রসন্ন খুশিখুশি ভঙ্গিতে মাথা দোলালো। হ্যাঁ, এতক্ষণে কিছুটা পেশাদারী ভাব ফুটে উঠলো; সকলেই স্বীকার করবে সে কথা। তবে অতিথি শব্দের মাঝের অক্ষরটা একটু যেন বড় হয়ে গেছে আকারে। ম্যানরের শেষ অংশটুকুও কেমন যেন ঘেঁষাঘেঁষি। তাহলে মোটের উপর খুব ভালোই দেখাচ্ছে সাইন বোর্ডটা। জিল সত্যিই বেশ ভাল কাজ করেছে। সব ব্যাপারেই জিল বেশ চালাক চতুর। আর তাছাড়া কত রকমের কাজই যে ও করতে পারে। প্রতিদিনই মলি যেন নতুন করে আবিষ্কার করছে তার এই স্বামীটিকে। সত্যিই তার পতিদেবতাটি অসংখ্য গুনের আধার। আর নিজ সম্বন্ধে সে এত কম কথা বলে জিল যে তার প্রতিটি গুণ নিদর্শনগুলিকে খুঁজে খুঁজে বের করতে হয়। নৌ-বাহিনীর লোকেরা খুবই কাজের অন্ততঃ স্বামী হিসাবে– এমন একটা প্রবাদ সে শুনে আসছে বহুদিন ধরেই, এখন সে এই কথাটা হৃদয় দিয়ে উপলব্ধি করলো।
অবশ্য তারা যে নতুন ঝুঁকি নিতে চলেছে তাতে জিলের মত এমন একজন সর্বগুণসম্পন্ন লোকের একান্ত প্রয়োজন। কারণ হোটেল চালাবার ব্যাপারে অভিজ্ঞতা জিল এবং তার মধ্যে নেই। এ বিষয়ে তারা একেবারেই অজ্ঞ। তবে এর মধ্যে একধরনের মজাও আছে। এবং বর্তমান গৃহ-সমস্যা সমাধানেরও একটা ভূমিকা এর মধ্যে আছে।
মলির মাথায় এই প্রথম একটা অভিনব পরিকল্পনার উদ্ভব এল। বেমক্কা একদিন যখন তার অশীতিপর বৃদ্ধা পিসি ক্যাথারিন মারা গেলেন এবং পিসির অ্যাটর্নি তাকে খবর পাঠালেন যে বৃদ্ধা তার একমাত্র আদুরে ভাইঝিকে তার প্রাসাদের মত বিশাল মঙ্কসওয়েল ম্যানরটা দিয়ে গেছেন তখন স্বাভাবিকভাবেই এই দম্পতি ভেবেছিল সেটাকে বিক্রি করে দেবে। ঠাট্টার সুরে তখন জিল বলেছিল, ওঃ সে এক বিরাট প্রাসাদ বললেই চলে। সাবেকী আমলের আসবাবপত্র সেখানে ঠাসা, তার ওপর বাড়ির চারদিকে কি বিরাট বাগান। তবে সে বাগানের হাল যা হয়েছে তা চোখে দেখা যায় না। আগাছায় চারদিকে ভর্তি কারণ মালীদের যা আকাল। গতযুদ্ধের পর থেকে অবশিষ্ট আছে শুধু একজন মাত্র বুড়ো মালী। তার একার পক্ষে বাগানের ওপর নজর দেওয়া দুষ্কর।
সেইজন্য দুজনের সংসারে ব্যবহারের উপযোগী সামান্য কিছু হালকা ধাঁচের আসবাবপত্র সরিয়ে রেখে পুরো বাড়িটাই তারা বিক্রি করে দিতে মনস্থ করল। সেই টাকা থেকে অনায়াসে একটা ছোটখাটো ফ্ল্যাটও কিনে নেওয়া যাবে। কিন্তু অসুবিধা দেখা দিল দুটো।
প্রথমতঃ বাজারে তাদের মনোমত কোনো ছোট ফ্ল্যাটবাড়ী খুঁজে পাওয়া গেল না। আর দ্বিতীয়তঃ বুড়ি পিসির ভিক্টোরিয়ান যুগের আসবাবপত্রগুলো সমস্তই এত বেশি ভারী আর জবরজং তাদের নাড়াচাড়া দুঃসাধ্য ব্যাপার। তার ওপর সন্দেহ আছে সেগুলো লোকেরা কিনবে বিনা।
মলি বললো, তাহলে। সে বলল –আমার মনে হয় আসবাবপত্র যেখানে যা আছে সেই সমেত পুরো বাড়িটাই তো আমরা বিক্রি করে দিতে পারি, এতে খদ্দেরের অভাব হবে না।
সলিসিটার তাদের এ বিষয়ে ভরসা দিয়েছিলেন। সবকিছুই আজকালকার দিনে বিক্রি হয়। এমনকি হোটেল বা অতিথিশালার জন্যেও কেউ হয়তো বাড়িটা কিনতে চাইবে। তখন ফার্নিচারগুলোও দরকার হবে। তার ওপর স্বগীয়া মিস মরি যুদ্ধের আগে বিস্তারিত ভাবে বাড়িটা মেরামত করে নিয়েছিলেন। তিনি আধুনিক সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যেরও নানা রকম ব্যবস্থা করেছিলেন। সমস্ত বাড়িটা এখন খুব ভালো অবস্থাতেই আছে।
তারপরেই মলির মাথায় মতলবটা খেলে গেল। সে বলল, জিল, আমরা নিজেরাই তো একটা অতিথিশালা চালু করতে পারি। জিল প্রথমে উড়িয়েই দিয়েছিলো মলির এই আষাঢ়ে ধ্যান-ধারণা। মলি কিন্তু নাছোড়বান্দা। কেন প্রথম প্রথম আমরা না হয় দু-চার জন অতিথি নেবো। একেবারে গোড়াতেই বেশি বাড়াবাড়ি করবার কোনো দরকার নেই, বাড়িটা এমনিতেই বেশ ঝকঝকে তকতকে। প্রতিটি শয়নকক্ষে ঠান্ডা এবং গরম দুরকম জলের বন্দোবস্ত আছে, ঘর গরম রাখবার জন্যে বড় বড় চুল্লি, তাছাড়া রান্নাঘরে গ্যাসের ব্যবস্থা খুব ভালো, বাগানের একপাশে হাঁস-মুরগীও পুষতে পারি আমরা, বাগানটায় নানা ধরনের তরিতরকারিও লাগানো যায়।
এতসব ঝামেলা ঝক্কি সামলাবেটা কে? চাকর-বাকর পাওয়া যে কি দুঃসাধ্য ব্যাপার সে তো তুমি জানোই।
হাঁ সে কথা ঠিক। কাজ আমাদের কিছু করতে হবে বটে তবে আমরা নিজেরাও যদি বাড়ি কিনে বাস করি সেখানেও তো সেই একই কাজের ঝামেলা এসে পড়বে। অবশ্য এক্ষেত্রে কাজের চাপ একটু বাড়বে এই যা। সেটা আর এমন কি?
ব্যবসাটা পুরোদমে চালু হবার পর দু-একজন ঝি-দাসীও আমরা নিশ্চয় পেয়ে যাবো। তার ওপর মনে করো আমরা যদি প্রথমে পাঁচজন অতিথি নিয়ে হোটেল চালু করি এবং তাদের প্রত্যেকের কাছ থেকে সপ্তায় সাত গিনি করে পাই…মাঝপথে কথা থামিয়ে মলি মনে মনে তার কল্পিত ব্যবসার লাভ-লোকসানের অঙ্ক নিয়ে মেতে উঠলো। তাছাড়া আর একটা কথা আছে, মলি আবার বোঝাতে চেষ্টা করলো জিলকে, বাড়িটাতো আমাদের থাকবে। আসবাবপত্রে সুসজ্জিত এমন একটা বাড়ি থাকাও কম কথা নয়। আমাদের দুজনের বাসের উপযোগী কোনো ছোট বাসাবাড়ি দু-এক বছরেও খুঁজে পাওয়া যাবে কিনা সন্দেহ। মলির এই শেষের যুক্তিটা জিল উড়িয়ে দিতে পারলো না।
বিয়েটা তার খুব তাড়াতাড়িই সেরে নিয়েছিলো কিন্তু তারপর থেকে দুজনে ঘর বেঁধে বাস করবার মতো তেমন কোনো অখণ্ড অবসর খুঁজে পায়নি। এখন একটা ছোট সংসার পাতবার জন্য হন্যে হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে ওরা দুজন। তার মনে প্রথম সূত্রপাত এই বৃহৎ প্রচেষ্টার স্থানীয় সংবাদপত্রে এবং লন্ডন টাইমস-এ বিজ্ঞাপনও দেওয়া হয়েছিল। তার উত্তর নানারকম ভাবে এল।
আজকেই উদ্বোধন হবে, অতিথিশালার প্রথম অতিথিটিরও আসবার কথা আজ। সাত সকালেই গাড়ি নিয়ে বেরিয়েছে জিল। সেনাবাহিনীর ব্যবহৃত কিছু পুরোন তারের জাল নিলামে বিক্রি হবে, তাই যদি সুবিধা দামে পাওয়া যায় এই ছিল তার আশা। নিলাম ঘরটি এখান থেকে বেশ কিছুটা দূরে। শহরের অপর প্রান্তে। মলি জানিয়ে রেখেছিল ও একবার পায়ে পায়ে গ্রামের দিকে যাবে। শেষবারের মত প্রয়োজন আছে কিছু কেনাকাটার।
ওদের কাছে এখন প্রতিকূল আবহাওয়া বইছে। গত দুদিন ধরে যা ঠান্ডা পড়ছে তা বলার নয়। তার সঙ্গে আবার নতুন উপদ্রব যুক্ত হল–তুষারপাত। মেঠো পথ ধরে মলি দ্রুত পা চালালো। তার একরাশ উজ্জ্বল কোকড়া চুলের ফাঁকে ফাঁকে শুভ্র তুষার জড়িয়ে আছে। বাহারি ওয়াটারপ্রুফের খাঁজে খাঁজেও পেঁজা তুলোর মত বরফের কুচি পড়ে আছে। আবহাওয়া সম্বন্ধে রীতিমত বেতারে আশঙ্কাজনক ভবিষ্যৎবাণী করা হয়েছে। শীগগিরই নাকি প্রবল বেগে পড়তে থাকবে বরফ।
জলের পাইপগুলোর মধ্যে যদি বরফ জমে যায় তাহলে তো প্রচণ্ড সর্বনাশ। মলি ক্ষণে ক্ষণে উদ্বিগ্ন হয়ে উঠল। প্রারম্ভিক সূচনাতেই এধরনের বিপর্যয় অশুভ নিদর্শনের সূচনা। হাতের ঘড়িটা একপলক দেখ নিল সে। বৈকালিক চায়ের সময় পেরিয়ে যাচ্ছে। তার একবার মনে পড়ল জিল কি ইতিমধ্যে ফিরে এসেছে। তাকে না দেখতে পেয়ে জিলের একটু ভাবনা চিন্তা হচ্ছে।
সে ভাবছিল জিল যদি প্রশ্ন করে কি করব বল, কতগুলো দরকারী জিনষ ভুলে যাবার জন্য আবার আমাকে গ্রামের দিকে ছুটতে হল। তাহলে মলি ভেবেই রেখেছিল কি দেবে সে এর উত্তর, সে ভাবছিল উত্তরটা শুনে হয়ত জিল একটু ঠাট্টা করবে। বলবে, তোমার সেই টিনের খাবার তো?
টিনের খাবার নিয়ে প্রায় সময়ই জিল ঠাট্টা তামাশা করে। এ বিষয়ে বাতিক আছে বলা চলে মলির। রাশিকৃত খাবারের প্যাকেট ঘরের মধ্যে জমা করা হয়। কখন কোনোটার দরকার পড়বে তার কি ঠিক আছে। তাছাড়া দুজনের ঘর গৃহস্থালির পক্ষে টিনের ভালো খাবার তো আছেই। বিশেষ ঝামেলা পোহাতে হয় না রান্নাবান্নার ব্যাপারে।
মলি অপ্রসন্ন অবস্থায় আকাশের দিকে একবার তাকালো। সত্যিই পরিস্থিতিটা খুব ঘোরালো মনে হচ্ছে তার।
বাড়িতে এসে দেখল, এখনো জিল পৌঁছয়নি। আগের মতই ঘর এখন ফাঁকা হয়ে পড়ে আছে, রান্নাঘরে গিয়ে ঢুকল মলি। যদিও করবার কিছুই ছিল না, তবু বাসনগুলোকে একবার নেড়েচেড়ে গুছিয়ে রেখে দিল। তারপর উঠে গেল চওড়া সিঁড়ি বেয়ে। সমস্ত শোবার ঘরগুলো এখন নিখুঁতভাবে সাজানো গোছানো। দক্ষিণ দিকের বড় ঘরটা মিসেস বয়েলের জন্যে নির্দিষ্ট আছে। ঘরের মধ্যে একটা পালঙ্ক আছে মেহগনি কাঠের। পালঙ্কের চারকোণে মশারি টাঙাবার জন্য ছাতা লাগানো। আকাশী রঙের বাহারি কাগজে মোড়া ঘরটায় মেজর মেটকাফ থাকবেন বলেছেন। পশ্চিম দিকের বড় খোলামেলা ঘরটা হল মিঃ রেনের। সমস্ত ঘরগুলোই এখন খুব ছিমছাম পরিপাটি দেখায়। তার ওপর বৃদ্ধা ক্যাথারিনের যে এত লিনেনের স্টক ছিল তার জন্য কৃতজ্ঞ থাকবে মলি। এখন সেগুলো খুব কাজে লাগছে।
হাত দিয়ে বিছানার চাদরটা মলি ঝেড়ে দেয়। তারপর আবার সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে এল। ইতিমধ্যে অন্ধকার নেমে এসেছে। বাড়িটা যেন তার কাছে বড় ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। খুব বেশি নির্জন ঘরটা। এখান থেকে নিকটবর্তী গ্রামের দূরত্ব দু-মাইল মত। শহরে যেতে গেলেও এই দু-মাইল পেরিয়েই যেতে হয়। অর্থাৎ দু-মাইলের মধ্যে কোনো লোকালয়ের চিহ্ন নেই।
এর আগেও সে এই বাড়ির মধ্যে অনেকবার একা একা কাটিয়েছে। কিন্তু আজকের এই নির্জনতা তার কাছে বড় অস্বস্তিকর মনে হচ্ছে। স্নায়ুর ওপর বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হচ্ছে তার।
কাঁচের জানালার ওপর বরফ এসে পড়ায় এক ধরনের মৃদু খসখসে শব্দ হচ্ছে। একনাগাড়ে কেউ যেন ফিসফিস করে কথা বলছে। অস্বস্তিতে মলি কেঁপে উঠল, যদি জিল কোনো কারণে পৌঁছতে না পারে। এই ভয় তার মনের কোণে উঁকি মারে। সে ভাবতে থাকে তুষার পাতের ফলে যদি রাস্তা দিয়ে গাড়ি চালানো অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায় তাহলে? যদি সত্যিই তাকে এই নির্জন বাড়িতে একা একা থাকতে হয়? ঈশ্বর না করুন, যদি প্রকৃতই সেই রকম অবস্থা হয় তবে কদিনের জন্যে যে তাকে এখানে বন্দী হয়ে থাকতে হবে তার কি কোনো অনিশ্চয়তা আছে? একদিনের মধ্যে যে রাস্তাঘাট পরিষ্কার হবে, এমন আস্থাও সে রাখতে পারছে না।
মলি একবার রান্নাঘরটার মধ্যে চোখ বোলাল। আকারে প্রকারে বেশ বড় ঘরটা। বিরাট চেহারার একজন পাঁচক না হলে এ ঘর মানায় না। শক্ত কেকের সঙ্গে দুধবিহীন কালো চা পান করতে করতে মনে মনে এই কথাটাই ভাবছিল। আর পাঁচকের একজন সাহায্যকারীও চাই, সে হবে একজন বয়স্কা। সেই সঙ্গে একজন ছিপছিপে চেহারার তরুণী ঝিও চাই।
তাছাড়া রান্নাঘর পরিষ্কারের জন্য আরো একজন বুড়ি ঝি-এরও একান্ত প্রয়োজন, যে বাবুদের খাওয়া দাওয়ার সময় দূরে দাঁড়িয়ে ভয়ের চোখে লক্ষ্য করবে সবকিছু। কিন্তু এখন মলি সম্পূর্ণ একা। এবং তাকে যে ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে হচ্ছে সেটাও তার কাছে সম্পূর্ণ অপরিচিত নতুন এই মুহূর্তে তার সমস্ত জীবনটাই ঠেকছে অস্বাভাবিক ও অবাস্তব। এমন কি জিলও এখন যেন স্বাভাবিক নয়। মলি যেন শুধু একটা নির্দিষ্ট ভূমিকায় অভিনয় করে যাচ্ছে, নিছকই অভিনয়।
জানলার ওপাশে কার যেন কালো ছায়া পড়ল; মলি চমকে লাফিয়ে উঠলো। তুষারের ওপর দিয়ে একজন অপরিচিত আগন্তুক দ্রুত পায়ে এগিয়ে আসছে। সদর দরজায় মলি শুনতে পেল কে যেন ঠকঠক শব্দ করছে। অপরিচিত আগন্তুক এখন উন্মুক্ত দরজার সামনে দাঁড়িয়ে বর্ষাতির ওপর থেকে হিমের কুচিগুলো ঝেড়ে ফেলছে। তারপর সে বাড়ির মধ্যে বেশ ধীরে সুস্থে ঢুকে পড়ল।
মলির পলকের মধ্যে দৃষ্টি বিভ্রম হল। আনন্দে প্রায় চেঁচিয়ে উঠল। ওঃ জিল। তুমি ফিরে এসেছে, জেনে বা দেখে আমার খুব ভালো লাগছে।
আজকের আবহাওয়াটা এত জঘন্য যে, আমি ঠান্ডায় প্রায়ই জমে গেছি বললেই চলে।
জিল ভেতরে ঢুকে সানবাঁধানো মেঝের ওপর পা ঝাড়ল জোরে জোরে। হাত দিয়ে হাতটা ঘষে শরীরের মধ্যে উষ্ণতা সঞ্চারে ব্যর্থ প্রয়াস করল সে।
সহজাত অভ্যাস বলেই মলি জিলের ছুঁড়ে দেওয়া কোটটা হ্যাঁঙ্গারে টাঙ্গিয়ে রাখলো। কোটের পকেট থেকে একগাদা জিনিষপত্র বের করে টেবিলের ওপর গুছিয়ে রাখল। একটা মাফলার, ঘরের কাগজ, এক বাণ্ডিল গুলিসুতো আর সকালের ডাকে আসা কয়েকটা চিঠি পত্র। তারপর রান্নাঘরে গিয়ে গ্যাসের উনুনে কেটলি করে জল চাপালো।
মলি প্রশ্ন করল, তুমি কি তারের জাল পেয়েছ? সামান্য একটা জিনিষ কিনতে গিয়ে যেন একটা যুগ কাটিয়ে ফিরে এলে।
না যে ধরনের জালের কথা ভেবেছিলাম এগুলো সেরকম নয়, এতে আমাদের কাজ হবে না, খবর পেয়ে অন্য আরেক জায়গাতেও খোঁজ করলাম। কিন্তু সেগুলোও দেখতে একই রকম। এদিকে তুমি এতক্ষণ কি করছিলে? ইতিমধ্যে নিশ্চয় কেউ আসেনি?–জিল প্রশ্ন করল মলিকে।
মিসেস বয়েল সকালের আগে এসে পৌঁছচ্ছেন না।
মেজর মেটকাফ আর মিঃ রেনের তো আজকেই আসার কথা ছিল।
মেজর ভদ্রলোক চিঠি দিয়ে জানিয়েছেন, তিনিও কাল সকালের আগে আসছেন না।
তাহলে তো ডিনারের জন্য কেবল মিঃ রেনই অবশিষ্ট রইলেন। তিনি কেমন লোক হবেন বলে তোমার ধারণা? আমার তো মনে হয় ভদ্রলোক কেমন গম্ভীর প্রকৃতির অবসরপ্রাপ্ত সরকারী কর্মচারী।
উত্তর এল, না না, আমার মনে হয় তিনি একজন শিল্পী।
ঠাট্টার সুরে জিল বলল। তোমার আশঙ্কাই যদি সত্য হয় তবে তার কাছ থেকে আমরা একসপ্তার অগ্রিম নিয়ে রাখবো।
মলি বলল, তুমি যে কি বোকার মত কথা বল। আমাদের এত ভাবনার কি আছে? তিনি তো শুধু হাতে এখানে থাকছেন না। মালপত্র নিশ্চয় কিছু সঙ্গে থাকবে। যদি সত্যিই বিল তিনি মেটাতে না পারেন তবে আমরা তার মাল আটকে রাখব।
কিন্তু ধর যদি দেখা যায় যে তার মালপত্র কেবল পুরনো খবরের কাগজে মোড়া বড় বড় পাথরের টুকরো তাহলে? জিল বলল। তারপর আবার বলতে শুরু করে আসল সমস্যাটা হচ্ছে এই ব্যবসার নাড়িনক্ষত্র আমরা কিছু জানি না। কোনো অভিজ্ঞতাই আমাদের নেই। আরেকটা কথা, আমরা যে সম্পূর্ণ অজ্ঞ, সেটাও যেন আমাদের অতিথিরা বুঝতে না পারেন।
সন্দেহের সুরে মলি বলল, মিসেস বয়েলের কাছে কিন্তু ব্যাপারটা গোপন রাখা খুবই কষ্টকর হবে। কেননা তিনি হচ্ছেন সেই প্রকৃতির মহিলা…।
জলি বলল, কি করে তুমি টের পেলে? এখনও তো চোখে দেখনি তুমি তাকে।
মলি কোনো উত্তর দিল না। টেবিলের ওপর পরিষ্কার কাগজ পেতে তার ওপর কতকগুলো মশলা দেওয়া ছানার কেক সাজিয়ে রাখলো। তারপর একটা পাথরের সাহায্য পিষতে লাগলো। সেগুলো দেখে–এগুলো আমার কি কাজে লাগবে? বিস্ময়ের সুরে প্রশ্ন করলো জিল।
গরম টোস্টের ওপর এই কেকের গুঁড়োগুলো পুরু করে লাগিয়ে দেওয়া হবে। ঠোঁটের ফাঁকে রহস্যময় হাসি ছড়িয়ে জবাব দিল মলি।
প্রথমে নরম রুটির টুকরোর সঙ্গে সেদ্ধ আলুর টুকরো মিশিয়ে স্যাণ্ডউইচ তৈরি করবো।
তারপর গরম স্যাণ্ডউইচের ওপর এই কেকের গুঁড়ো গুলো পুরু করে মাখালে এক নতুন ধরনের খাবার তৈরি হবে।
সত্যিই তুমি একজন পাকা রাঁধুনী। প্রশংসার সুরে বলে উঠলো জিল।
এ বিষয়ে আমার মাঝে মাঝে সন্দেহ জাগে।
যে-কোনো একটা দিকে মন দিলে আমি সেটা খুব ভালোই করতে পারি।
কিন্তু অনেকগুলো ঝামেলা এক সঙ্গে ঘাড়ে এসে চাপলে তখনই দুচোখে অন্ধকার দেখতে হয়।
বিশেষ করে ব্রেকফাস্টের জোগান দেওয়া তো আমার কাছে খুবই পরিশ্রম সাধ্য ব্যাপার।
কেন?
কারণ তখন দশভূজা রূপ না ধরলে সমস্ত কিছু সামাল দেওয়া যায় না।
একই সঙ্গে ডিম সেদ্ধ, শুয়োরের মাংস, গরম দুধ, কফি, টোস্ট সবই দরকার।
দুধটা হয়তো উথলে উঠলো, কিংবা টোস্টটা বোধহয় পুড়ে গেলো
আবার মাংসটা যেন বেশি ভাজা না হয় বা ডিমটাও সেদ্ধ হতে হতে শক্ত না হয়ে যায় সেদিকেও সজাগ লক্ষ্য রাখতে হবে।
শিকারী বেড়ালের মতো ক্ষিপ্ত এবং তৎপর না হলে এঁটে ওঠা দুঃসাধ্য।
তাহলে একই সঙ্গে তোমার দশভূজা রূপ আর বিড়ালমূর্তি দেখে নয়ন সার্থক করবার জন্য কাল সারাদিনই আমি অলক্ষ্যে থেকে রান্নাঘরের আশেপাশে ঘোরাফেরা করব।
মলি বলল, জল ফোঁটানোর সময় হয়েছে, আমি কি জিনিষপত্র লাইব্রেরী ঘরে নিয়ে যাবো? খবর তো এক্ষুনি হবে। টি. ভি. তে খবর শুনতে শুনতেই না হয় আজকের চা খাওয়া পর্বটা শেষ করবো দুজনে।
জলি বলল, তুমি আজকাল যে পরিমাণে রান্নাঘরে কাটাতে শুরু করেছ তাতে ওখানেও একটা টিভির বন্দোবস্ত করলে মন্দ হয় না।
মলি বলল, তা ঠিকই বলেছো এই রান্নাঘরটা আমি খুব ভালোবাসি। এতবড় রান্নাঘর কোথায় পাবো? সমস্ত কিছুর জন্যেই কেমন সুন্দর পরিপাটি ব্যবস্থা আছে এবং আর একটা ব্যাপার এই ঘরটা বেশ বড়সড়ও আছে। এত বড় একটা রান্নাঘরের মধ্যে আমি ঢুকলে বেশ একটা স্বচ্ছলতা অনুভব করি। মনে হয় জীবনে যেন কোনো কিছুরই আর অভাব নেই। তবে এখনো পর্যন্ত নিজে হাতে যে রান্না করতে হয়নি তা ভাগ্য অনেক ভালো।
জলি বলল–আমার ধারণা এতবড় রান্নাঘর ব্যবহার করলে রেশনে এক বছরে যে জ্বালানি বরাদ্দ করা হয়েছিল তা এখানে একদিনেই শেষ হয়ে যাবে।
মলি বলল, সে তো হবেই। আপনি আর মলির সংসারের জন্যে তো আর এ রান্নাঘর তৈরি। হয়নি। এখানে যজ্ঞ বাড়ির রান্না বাঁধা যাবে। সেইসব দিনগুলোর কথা একবার ভাবো তো। এখানে ঘরে ঘরে ভেড়ার রাঙ আর গোরুর নিতম্ব ঝলসানো হচ্ছে। বিরাট কাঁচের পাত্রে সুরক্ষিত রাখা আছে চিনির আরকে জরানো ঘরে তৈরি সুস্বাদু স্ট্রবেরির আচার। ভিক্টোরিয়ান যুগের লোকেরা কি সুখেই না কাটিয়ে গেছে তাদের দিনগুলো। দোতলায় আসবাবপত্রগুলো দেখিয়ে দিও, সমস্ত কেমন মজবুত আর আরামদায়ক। ব্যবহার করা যায় সেগুলো কত সহজেই। আর সেই সঙ্গে আমাদের ভাড়া করা ফ্ল্যাটের কথাও চিন্তা কর।
আসবাবপত্রগুলোও কত হাল্কা। ঠিক মতো ব্যবহারের উপযোগীও নয়। কোনো ড্রয়ার যদি একবার বন্ধ করা যায় তাহলে হাজার টানাটানিতেও তা আর খোলা যাবে না। জানলাটা খুলতে গেলে দেখা যায় যে তার গায়ে ছিটকিনির ব্যবস্থা নেই।
জিল বাধিত ভঙ্গিতে মাথা নাড়িয়ে বলল, হ্যাঁ, তা অবশ্য ঠিক। সময় সময় খুবই বিরক্তি ধরিয়ে দেয়।
চল, খবর শুনতে যাই। বোধ হয় খবর শুরু হয়ে গেছে।
প্রাত্যহিক খবরে আবহাওয়া সম্বন্ধে উদ্বেগজনক ভবিষ্যদ্বাণী করা হল। বৈদেশিক পররাষ্ট্র নীতিতে আগের মতোই অনড় অচল অবস্থা। পার্লামেন্টের ওপর দিয়ে বির্তকের ঝড় বইছে বাত-প্রতিবাদিমূলক। প্যাডিংটন অঞ্চলে কার্লভার স্ট্রীটে সংঘটিত হয়েছে একটা নৃশংস হত্যাকাণ্ড। শিকার হয়েছেন এই দুর্ভাগ্য এক মহিলা।…
মলির কণ্ঠে ক্ষুণ্ণ অভিযোগের সুর বেরিয়ে এল, আঃ! হাত বাড়িয়ে অফ করে দিল সুইচটা। কেবল অভাব আর অভিযোগের একঘেয়ে ক্লান্তিকর ধারাবিবরণী। আমি কিন্তু ওদের কম জ্বালানি কাজে লাগান আবেদনে আর কোনো কর্ণপাত করবো না। এই কনকনে ঠান্ডায় ওরা কি আমাদের জমে যেতে অনুরোধ জানাচ্ছে। তবে আমাদের যে মস্ত একটা বড় ভুল হয়েছে মানতেই হবে সেটা প্রথম সূত্রপাত হিসেবে শীতকালটা বেছে নেওয়া উচিত হয়নি। বসন্তকালে আরম্ভ হলে ভালো হত। মলি একটু চুপ করে আবার ভিন্ন সুরে বলল, যে মেয়েটা খুন হয়েছে। ভাবতেই অবাক লাগে তার কথাটা।
কে? মিসেস লিয়ন?
ওর নাম কি লিয়ন? কে যে মেয়েটাকে খুন করল আর তার উদ্দেশ্যই বা কি ছিল?
হয়ত ওর ঘরের মেঝেয় অনেক ধন সম্পত্তি লুকনো ছিল।
আচ্ছা, রেডিওতে বললো যে ঘটনাস্থলের আশে পাশে ওই সময় এক জন সন্দেহভাজন লোককে ঘোরাফেরা করতে দেখা গেছে, তার সন্ধান পাবার চেষ্টা করছে পুলিস। তার মানে কি, ওই লোকটাই মেয়েটাকে খুন করছে?
তাই হয়তো হবে তবে নিশ্চিত কোনো প্রমাণ পাবার আগে এই রকম ভদ্র ভাষাই প্রয়োগ করা বিধেয়। ঝনঝনিয়ে কলিংবেল বেজে উঠলো।
সঙ্গে সঙ্গে লাফিয়ে উঠলো দুজনে। সদর দরজার বেল বাজছে। জিল বললে, এখন একজন মুনীর অনুপ্রবেশ! রহস্যময় ভঙ্গিতে শেষ করলো কথাটা।
হ্যাঁ, এটা কোনো নাটকের দৃশ্য হলে সেই রকমই ঘটতো!
মন্তব্য করলো মলি।
তাড়াতাড়ি চল, বোধহয় মিঃ রেন এসেছেন। এখন দেখা যাক কার কথা শেষ পর্যন্ত সত্যি হয়। তোমার না আমার।
এক ঝলক তুষারের সঙ্গে সঙ্গে মিঃ রেন ভেতরে ঢুকলেন।
লাইব্রেরীর ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে মলি তাকে স্পষ্ট করে দেখতে পেলো না। শুধু বাইরের রুপোলি তুষারের পটভুমিকায় একজন অচেনা ব্যক্তির কালো অবয়বটুকুই সে প্রত্যক্ষ করলো।
সভ্য মানুষের পোশাক-আশাক সর্বদাই কেমন একই রকমের হয়।
মনে মনে চিন্তা করলো মলি।
কালো ওভার কোট, মাথায় ধুসর রঙের টুপি। গলায় জড়ানো পশমের মাফলার।
মিঃ রেন ভেতরে প্রবেশের পর জিল আবার সদর দরজাটা বন্ধ করে দিল।
পোশাক পরিচ্ছদের ওপর থেকে ব্যস্ত হাতে তুষার ঝাড়তে লাগলেন রেন।
হাতে ধরা স্যুটকেসটার ওপর পুরু হয়ে তুষার জমে আছে। সেগুলোও ঝেড়ে ঝেড়ে মাটিতে ফেলে দিলেন। সেই সঙ্গে বকে চললেন এক নাগাড়ে। তার গলার স্বর কিছুটা সরু ও তীক্ষ্ণ। দূর থেকে শুনলে মনে হয় কেউ যেন ঝগড়া করছে।
আলোয় আসতে দেখা গেল ভদ্রলোক এখনো যুবক।
রোদে পোড়া তামাটে চুল। ছোট ছোট চোখে জ্বলজ্বলে অশান্ত দৃষ্টি।
কি ভয়াবহ, কি সাংঘাতিক আবহাওয়া! অসুখী কণ্ঠে বিড়বিড় করলেন তিনি। শীতকালীন ইংলণ্ডের এমন চরম দপ আর কখনো দেখা যায়নি।
মনে হয় যেন ভিকেন্সের সে বিখ্যাত ক্রিস্টমাসের বর্ণনাকে ছাপিয়ে গেছে। বাইরে দাঁড়িয়ে এর ধকল সামলানো সহজ কথা নয়।
আপনারাও নিশ্চয় তা স্বীকার করবেন? আমাকে ওয়ে থেকে এতটা পথ পাড়ি দিয়ে এখানে আসতে হয়েছে। আপনিই কি মিসেস ডেভিস?
বাঃ–খুবই চমৎকার!
দ্রুত হাত বাড়িয়ে মলির সঙ্গে করমর্দন করলেন তিনি।
আমি কিন্তু মনে মনে আপনাকে যেভাবে কল্পনা করেছিলাম বাস্তবের সঙ্গে কোনো মিল নেই তার। ভেবেছিলাম ভারত প্রত্যাগত সেনাবাহিনীর কোনো অধিনায়কের বিধবা স্ত্রী বা ওই জাতীয় কেউ হবেন। আচার ব্যবহারও একেবারে খাঁটি মেমসাহেবের মত কড়া আর রাশভারী। পান থেকে চুন খসলেই মুস্কিল। কিন্তু এখন আপনাকে দেখে খুব আনন্দ হচ্ছে আমার। কেমন একটা স্বর্গীয় মনোরম পরিবেশ মনে হচ্ছে। আপনি কি মোমের তৈরি রংবেরঙের ফুল দিয়ে সাজিয়ে রেখেছেন ঘরদোর। অথবা স্বর্গের পাখিদের খাঁচায় ভরে বাগানে রেখে দিয়েছেন? যদিও তার প্রয়োজন ছিল না, কারণ এমনিতেই আমার জায়গাটা খুব ভালো লেগেছে। আমার ধারণা ছিল এটা হয়তো ভিক্টোরিয়ান যুগের কোনো জরাজীর্ণ সাবেকী প্রাসাদ। কড়ি-বরগা জানলা সব খুলে খুলে পড়ে যায়। কিন্তু ভেতরে পা দিয়ে আমার ধারণা সম্পূর্ণ পালটে গেছে। বাড়িটার অবস্থা তো বেশ ভালোই, উপরন্তু হাল আমলের যাবতীয় সুখ সুবিধেরও ব্যবস্থা আছে এখানে। আচ্ছা শোবার ঘরে নিশ্চয় বনেদী আমলের মেহগনি কাঠের পালঙ্ক পাতা আছে। — যার গায়ে নানা রকমের ফুল-পাতা লতাপাতার ছবি থাকে আঁকা?
একটু ফাঁক পেয়ে মলি বলল, সত্যি কথা বলতে কি আমাদের অতিথিদের জন্য বিলাসবহুল মেহগনি খাটের বন্দোবস্ত করে রেখে দিই।
বিস্ময় মেশানো সুরে তিনি বলে উঠলেন–তাই নাকি? কি আশ্চর্য! দয়া করে একবার দেখাবেন আমায়?
ভদ্রলোক এত ব্যগ্রস্বরে কথাটা বলে উঠল যে মলি কিছুটা লজ্জা পেয়ে গেল। ইতিমধ্যে দরজার হাতল ঘুরিয়ে ডাইনিং হলের মধ্যে মিঃ রেন পা দিয়েছেন।
নিজের হাতে তিনি সুইচ টিপে আলো জ্বালালেন। মলি তার পেছন পেছন চলল। পিছনে ফিরে দেখল জিল বিরক্তি মুখে বসে আছে।
মিঃ রেন ক্ষুব্ধ দৃষ্টিতে নিরীক্ষণ করতে লাগল ঘরের আসবাবপত্রগুলো। অবশেষে ঈষৎ অভিযোগের সুরে সে মলিকে বলল–কিন্তু বনেদী ধাঁচের বড়সড় ডাইনিং টেবিল তো দেখতে পাচ্ছি না। তার বদলে আধুনিক ফ্যাশানের এই ছোট টেবিল পাতলেন কেন?
নিরাসক্ত সুরে মলি জবাব দিল, আমাদের মনে হল, আজকালকার লোকেরা এই ধরনের ডাইনিং টেবিলই বেশি পছন্দ করে।
রেন ডাইনে-বাঁয়ে ঘাড় দুলিয়ে বলল, তা অবশ্য ঠিক! আমি আমার নিজের স্বপ্নেই বিভোর। শুধুমাত্র মেহগনির টেবিল থাকলেই চলে না, টেবিলের চারপাশের বনেদী সম্ভ্রান্ত পরিবারের জমকালো উপস্থিতিরও একটা প্রয়োজন। বিরাট একটা চেয়ার জুড়ে পরিবারের কর্তা বসে থাকবেন। তার গালে সাদা দাড়ি। লম্বা চওড়া চেহারার মানুষ হবেন তিনি। পাশের চেয়ারে মূর্তিমতী করুণার প্রতীক থাকবেন তার স্ত্রী। তাদের আশেপাশে তাদের দশ-বারোজন ছেলেমেয়ে। গম্ভীর মুখের একজন পরিচারিকাও সেখানে থাকা আবশ্যক। পরিবারের অন্যান্য দাসীরাও আশেপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকবে। এইরকম পরিবেশের মাঝখানেই মেহগনি কাঠের ডাইনিং টেবিল শোভা পায়।…
রেনের বক্তৃতার মাঝখানে জিল গম্ভীর কণ্ঠে বলে উঠল, আমি আপনার স্যুটকেসটা ওপরে নিয়ে যাচ্ছি। সিঁড়ি দিয়ে উঠে পশ্চিম দিকের বড় ঘরটাই ঠিক করা হয়েছে আপনার জন্যে।
মলিও মাথা নেড়ে বলল : হ্যাঁ, তাই ভালো।
স্যুটকেসটা হাতে নিয়ে জিল সিঁড়ি বেয়ে পরে উঠে গেল। ততক্ষণে রেন আবার বাইরে এসে দাঁড়িয়েছেন হল ছেড়ে। রেন বলল–আচ্ছা খাটের চারপাশে নিশ্চয় মশারি টাঙিয়ে দেওয়া হয়েছে, আর মশারিটাও নিশ্চয় বাহারি ধরনের? মশারির মাথায় সুতো দিয়ে নিশ্চয় ফুলের নকশা করা।
ওপরে উঠতে উঠতে জিল জবাব দিল–না, না, ওসব কিছুই করা নেই।
জিল চলে যাবার পর মিঃ রেন বলে, আমার বিশ্বাস, আপনার স্বামীটি আমায় খুব একটা ভালো নজরে দেখেন না। উনি আগে কি করতেন? ও নিশ্চয় নৌবাহিনীর লোক।
ছোট্ট করে মলি জবাব দিল–হ্যাঁ।
মিঃ রেন বলেন, আমি ঠিকই আন্দাজ করেছি তাহলে। স্থলবাহিনী বা বিমানবাহিনীর লোকেদের চেয়ে স্বভাবতই ওদের সহনশীলতা কিছু কম থাকে।… আচ্ছা কতদিন হলো আপনাদের বিয়ে হয়েছে? আপনি কি আপনার স্বামীকে গভীরভাবে ভালোবাসেন?
মলি বলল চলুন আপনাকে ঘরটা দেখিয়ে দিই, আপনি নিশ্চয় ঘরটা দেখবার জন্য উদগ্রীব হয়ে আছেন।
মিঃ রেন বললেন–হ্যাঁ, একটু কৌতূহল তো আছেই। কিন্তু এই প্রশ্নটার জবাব পেতেও আমি আগ্রহী খুব। এটা আমার একধরনের নেশাও বলা যেতে পারে। একধরনের বাহ্যিক পরিচয়টুকু যথেষ্ট নয় আমার কাছে। তারা কি অনুভব করছে বা চিন্তা করছে সে সম্বন্ধেও আমার একটা অপরিসীম আগ্রহ করছে।
গম্ভীর কণ্ঠে মলি প্রশ্ন করল, মনে হয় আপনিই মিঃ রেন।
যুবকটি মাঝপথে থমকে দাঁড়িয়ে সহজাত অভ্যাসবশতঃ নিজের মাথার ঝাঁকড়া চুলটা কয়েক বার আঁকালেন।
কি আশ্চর্য আমার নিজের পরিচয়টাই এখনো ভালোভাবে জানানো হয়নি। অথচ এটাই তো সবচেয়ে জরুরী। এই অধমের নামই ক্রিস্টোফার রেন। দয়া করে নামটা শুনে হেসে উঠবেন না। আমার বাপ-মা ছিলেন কিছুটা রোমান্টিক ধাঁচের। তাদের স্বপ্ন ছিল বড় হয়ে আমি একজন উঁচুদরের শিল্পী হব। সেইজন্য বিশ্ববিখ্যাত স্থপতির অনুসরণে তারা আমার নাম রেখেছিলেন ক্রিস্টোফার। যেন কেবলমাত্র এই নামের জোরেই আমার স্থপতি হবার পৃথ একেবারে সুগম হয়ে উঠবে। অবাস্তব ধ্যান-ধারণা একবার ভেবে দেখুন তো?
মলি মৃদু হেসে জিজ্ঞেস করল–আপনি কি একজন সত্যিই স্থপতি? অনেক চেষ্টা করেও সে তাদের হাসিটুকু দমন করতে পারল না।
বেশ গর্বের সুরে মিঃ রেন বলল–হ্যাঁ, নিশ্চয় অন্ততঃ কিছুটা তো বটে। অবশ্য পুরোপুরি স্থপতি হবার মত যোগ্যতা এখনো অর্জন করিনি। কিন্তু মনে মনে কল্পনা করতে ক্ষতি তো কিছু নেই। তবে দয়া করে একটা কথা মনে রাখা উচিত। পিতৃদত্ত এই নামটাই আমার স্থপতি হবার পথে প্রধান অন্তরায়। কারণ হাজার চেষ্টা করলেও ঐ স্থপতি রেনের সমতুল্য হতে পারা যাবে না। তবে ক্রিস্টোফার রেনের স্বকৃত পথই হয়ত একদিন আমাকে খ্যাতির শীর্ষে পৌঁছে দেবে।
জিল ইতিমধ্যে নিচে নেমে গেছে। মলি রেনকে তাড়া দিয়ে বলল–আপনার ঘরটা দেখবেন চলুন। মিনিটকয়েক বাদে মলি যখন নিচে নেমে এল জিল জিজ্ঞেস করল-ব্যাপার কি, ওক কাঠের ছোট ছোট আসবাবপত্রগুলো কি ভদ্রলোকের পছন্দ হয়েছে?
মলি বলল, ভদ্রলোক ছাতা লাগানো মেহগনি কাঠের জন্য খুব ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল। ফুলের নকশা করা মশারি তার চাই। তাই একরকম বাধ্য হয়েই পাশের ঘরটাই বন্দোবস্ত করে দিয়েছি।
বিরক্ত কণ্ঠে জিল গজগজ করে বলতে থাকে–যত সব বখাটে চ্যাংড়াদের দল!
মলি তাকে যুক্তি দিয়ে বোঝানোর চেষ্টা করল–শোন জিল, আমার কথাটা মন দিয়ে শোন। আমরা এখানে কোনো নিমন্ত্রিত অতিথি আদর আপ্যায়নের ব্যবস্থা করিনি এটা ব্যবসা আমাদের। এখন প্রশ্ন এই ভদ্রলোককে অর্থাৎ ক্রিস্টোফার রেনকে তুমি পছন্দ কর কিনা।
অকপটে জিল বললনা, মোটেই পছন্দ করি না।
মলি বলল–কিন্তু আমার মতে ব্যক্তিগত পছন্দ অপছন্দের উপর খুব একটা জোর দেওয়াটা আমাদের উচিত নয়, ভদ্রলোক সপ্তাহের শেষে সাত গিনি দিতে রাজী হয়েছেন– এইটুকুই আমাদের পক্ষে যথেষ্ট।
হ্যাঁ তিনি যদি ঠিকঠিক পাওনা গণ্ডা মিটিয়ে দেন তাহলেই–জিল বলল।
মলি বলল–তাকে তো আমাদের সাপ্তাহিক চার্জের কথা বলা হয়েছে এবং তাতে তিনি রাজীও আছেন বলে আমাদের চিঠি দিয়ে জানিয়েছেন। সে চিঠি আমাদের কাছে আছে।
জিল বলল–তুমি কি নিজের হাতে ভদ্রলোকের স্যুটকেসটা পাশের ঘরে রেখে এসেছ?
মলি বলল–না। তিনি তার স্যুটকেসটা উঠিয়ে নিয়ে গেলেন।
জিল বলল–খুব ভালো কথা। তবে আমার পক্ষে এটা বওয়া খুব একটা অসুবিধা হত না। ওর মধ্যে যে পাথরের নুড়ি ভরা নেই এ বিষয়ে নিশ্চিত আমি। জিনিষপত্র আছে কিনা সে সম্বন্ধে এখন সন্দেহ জাগছে আমার মনে!
মলি ইশারায় সচেতন করে দিয়ে জিলকে বলে উঠল স.স.. চুপ ভদ্রলোক বোধহয় নেমে আসছেন।
ক্রিস্টোফার রেন নিচে নেমে লাইব্রেরীর ঘরের দিকে এগিয়ে এলেন। এই লাইব্রেরী ঘরটা নিয়ে একটা গর্ব আছে মলির। ঘরটা বেশ প্রশস্ত এবং খোলামেলা। চেয়ারগুলোও ছিল বেশ মজবুত আর বড়সড়। উষ্ণতা সঞ্চারের জন্য দুধারে চুল্লীর ব্যবস্থা মনোরম। আধঘণ্টার মধ্যে ডিনার পরিবেশন করা হবে বলে জানিয়ে দেওয়া হল। রেন ছাড়া বর্তমানে অন্য কোনো অতিথি নেই সে কথাও মলি বলল। ভদ্রলোক জানালেন যে সে ক্ষেত্রে তিনি রান্নাঘরে এসে মলির কাজের সাহায্য করতে পারেন।
রেন বেশ সাগ্রহে বলে উঠল, প্রয়োজন হলে আমি ওমলেটও ভেজে সাহায্য করতে পারি। মলিও বিশেষ কোনো আপত্তি দেখালো না। রান্না ঘরে ঢুকে কাপপ্লেট ধোয়া পোঁছার, কাজেও যথেষ্ট সাহায্য করলেন ভদ্রলোক। যদি ব্যাপারটা ঠিক প্রথাসিদ্ধ নয়, রাত্রে নিজের বিছানায় শুয়ে মনে মনে চিন্তা করলো মলি।
অতিথিশালার রীতিনীতি ঠিকমতো পালিত হলো না। এবং জিলও এজন্যে খুবই অপ্রসন্ন। তবে আগামীকাল অন্যান্য অতিথিরা উপস্থিত হবার পর তখন তো আর এ ধরনের বেনিয়মের কোনো সুযোগ থাকবে না।
সবকিছু নির্দিষ্ট আইন ধরেই চলবে। এই কথা ভাবতে ভাবতেই তার দুই চোখ জুড়ে ঘুমের খোলা বন্য নেমে এলো। সকালেও কিন্তু তরুণ সূর্যের সপ্তরঙ উদ্ভাসিত হয়ে উঠলো না।
ঘন মেঘে সমাচ্ছন্ন হয়ে রইলো সারা আকাশ। তার সঙ্গে শুরু হলো অবিশ্রান্ত তুষারপাত। জিলের মুখচোখ গম্ভীর হয়ে উঠলো। মলির মুখে ব্যাপ্ত হলো বিষাদের মলিনতা।
সমস্ত আবহাওয়াটাই যেন তাদের এক ভয়াবহ প্রতিকূল পরিস্থিতির দিকে ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে। স্থানীয় ট্যাক্সিতে চেপেই মিসেস বয়েল হাজির হলেন।
তুষার কেটে পথ চলার জন্যে এই ট্যাক্সির চাকাগুলোয় বিশেষ এক ধরনের চেন লাগানো থাকে।
ট্যাক্সিড্রাইভারও রাস্তাঘাটের বিপর্যস্ত অবস্থার আশঙ্কাজনক বর্ণনা দিল। এই তুষারপাত বন্ধ হবার আপাতত কোনো সম্ভাবনা নেই। প্রকৃতি দেবী কবে যে শান্ত হবেন একমাত্র ঈশ্বরই তা বলতে পারেন। গম্ভীর কণ্ঠে ভবিষ্যৎবাণী করলো ড্রাইভার।
মিসেস বয়েল নিজেও এই বিষাদ বিধুর পারিপার্শ্বিকের মাঝখানে কোনোরকম উজ্জ্বলতার দীপ্তি ফোঁটাতে পারবেন না। তার আকৃতি বেশ লম্বা চওড়া দশাসই ধরনের, দেখলেই বুকের মধ্যে গুরগুর করে ওঠে, কণ্ঠস্বরও বেশ চড়া আর কর্কশ।
আচার আচরণ পুরুষালি ঢঙের। রীতিমতো দাপটের সঙ্গে আশেপাশের সবকিছুকে দাবিয়ে রাখাই যেন তার সহজাত অভ্যাস।
যদি আমি এটা একটা চালু প্রতিষ্ঠান বলে ধারণা না করতাম, তাহলে কখনোই এখানে আসতে রাজী হতাম না।
বেজার কণ্ঠে শুরু করলেন তিনি। স্বাভাবিক ভাবেই আমি ভেবে ছিলাম নিশ্চয় কোনো সুপ্রতিষ্ঠিত অতিথিশালা।
যথারীতি বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে এই হোটেল পরিচালিত হয়, আপনাকে যে এখানে থাকতেই হবে তারও কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। ক্ষোভের সুরে জবাব দিল জিল। যদি জায়গাটা আপনার সত্যিই মনে না ধরে তবে অনায়াসে অন্যত্র চলে যেতে পারেন।
সে তো অবশ্যই।
আমার পছন্দ না হলে থাকতেই বা যাবো কেন? হোটেলের কি কোনো অভাব আছে দুনিয়ায়?
আবার মুখ খুললো জিল, আমার মনে হয়, মিসেস বয়েল, আপনার জন্যে কোনো ফিরতি ট্যাক্সির বন্দোবস্ত করে দিলেই আপনি সব থেকে স্বস্তিবোধ করেন।
রাস্তাঘাট এখনো সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যায়নি। যদি প্রকৃতই কোনো ভুল বোঝাবুঝি ঘটে থাকে। তবে বেশিদূর গড়াতে দেবার আগেই, তার প্রতিকারের চেষ্টা করা বাঞ্ছনীয়।
একটু থেমে বাকিটা শেষ করলো জিল, এত বেশি আবেদন পত্র আমরা পেয়েছি যে আপনার জন্যে নির্দিষ্ট ঘরটা অন্য কাউকে বন্দোবস্ত করে দিতেও আমাদের কোনো অসুবিধে হবে না।
তাছাড়া অদূর ভবিষ্যতে আমাদের ঘরের দৈনন্দিন ভাড়া কিছুটা বাড়িয়ে দেবো ঠিক করেছি।
মিসেস বয়েল জিলের দিকে এক ঝলক ক্রুদ্ধ দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন।
সে দৃষ্টিতে খরতর দহনের দীপ্তি।
এখানকার রীতিনীতি ভালো করে বুঝে না নিয়েই আমি অন্য কোথাও উঠে যাবার চেষ্টা করছি না–দয়া করে এ কথাটাও স্মরণ রাখবেন।
আর হ্যাঁ, স্নান ঘরে আমার জন্যে বড়সড় তোয়ালের বন্দোবস্ত করে দেবেন।
রুমালের মতো ছোট সাইজের তোয়ালে দিয়ে গা মুছতে আমি আদপেই অভ্যস্ত নই।
মিসেস বয়েল সামনের দিকে কয়েক পা অগ্রসর হবার পর জিল মলির দিকে তাকিয়ে চোখ মটকালো।
সত্যিই জিল, তুমি অদ্ভুত।
চাপা খুশিখুশি কণ্ঠে মলি বললো, যে ভাবে তুমি পরিস্থিতির হাল ধরলে.., ভদ্রমহিলার মুখে আর কথাটি নেই। একবারে ফাটা বেলুনের মতোই চুপসে গিয়েছে।
ঠিকমতো দাওয়াই পড়লে সব ফোঁস-ফাসই ঠান্ডা হতে বাধ্য। মন্তব্য করলো জিল।
আমি ভাবছি, মলির কণ্ঠে নতুন করে আশঙ্কার সুর ঘণীভূত হলো, ক্রিস্টোফার রেনকে ভদ্রমহিলা কি ভাবে গ্রহণ করবেন?
তিনি যে সুনজরে দেখবেন না–এ কথা বলাই বাহুল্য। জিলের ধারণা যে কত অভ্রান্ত সেদিন বিকেলেই তার প্রমাণ পাওয়া গেল।
ভদ্রমহিলা মলিকে ডেকে বললেন, ভদ্রলোকের চালচলন কেমন যেন কিম্ভুত প্রকৃতির। তার রীতিমতো বিরক্তির সুর সহজে কানে বাজে। রুটি বিক্রেতা যখন রুটি দিতে এলো তখন তার চেহারা দেখে মনে হলো যেন কোনো মেরু অভিযাত্রী। এবং আগামী দুচার দিন তার পক্ষে হয়তো আর রুটিন মাফিক রুটি ফেরি করা সম্ভব হবে না সে কথাও সবিনয়ে জানিয়ে দিলো।
চারদিকের রাস্তাঘাট বরফ পড়ে বন্ধ হয়ে গেছে, ঘোষণা করলো লোকটি।
ভালো চান তো এই বেলা বেশি পরিমাণ পাঁউরুটি ভাঁড়ারে মজুত করে রাখুন।
হ্যাঁ, নিশ্চয়।
মলিও মাথা নেড়ে সায় দিলে সে প্রস্তাবে। এখানে খালি টিনের অভাব নেই।
রাখবার কোনো অসুবিধে হবে না। তুমি বরং কিছু বেশি পরিমাণেই দিয়ে যাও। যদি সত্যিই সেরকম বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয় তবে শুধু পাঁউরুটির সাহায্যে কি কি খাদ্যদ্রব্য প্রস্তুত করা যায় আপনা থেকে সে চিন্তাও তার মাথার মধ্যে উদয় হলো। সঙ্গে সঙ্গে তার একটা তালিকার মনে মনে প্রস্তুত করে নিল মলি।
দৈনিক খবরের কাগজটা সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিল রুটিওলা কাগজটা টেবিলের ওপর রেখে একবার চোখ মেলল। সবকটি পররাষ্ট্রের নীতিই সবার আগে প্রাধান্য পেয়েছে। মোটামোটা হরফে হেডিং-এর নিচে বিস্তারিত ভাবে সরবরাহ করা হয়েছে সেই সমস্ত কূটকচালি ইত্যাদি। তারপর আবহাওয়ার খবর। প্রথম পাতার নিজের দিকে নগ্ন ছবিসহ মিসেস লিয়নের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের সম্পূর্ণ বিবরণ।
কাগজের পাতায় যদিও ছবিটা ভালো করে ফুটে ওঠেনি। কেমন যেন অস্পষ্ট। সেই দিকে মলি অস্পষ্টভাবে তাকিয়ে ছিল। এমন সময় পেছন থেকে ক্রিস্টোফার রেনের ডাকে চেতনা ফিরে এল।
ছবি দেখে মনে হয় নিম্নশ্রেণীর অসৎ চরিত্রের কোনো মহিলা তাই নয় কি? বেশ্যাদের মুখের চেহারা সাধারণত এই রকমই হয়ে থাকে। তাছাড়া পাড়াটাও খুব নোংরা। এই হত্যাকাণ্ডের পেছনে কোনো নিগূঢ় তথ্য আছে বলে তো আমার মনে হয় না।
বিরক্তি সহকারে নাক কুঁচকিয়ে মিসেস বয়েল বললেন–মেয়েটা যে তার যোগ্য শাস্তিই পেয়েছে এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।
মিঃ রেন বেশ আগ্রহের সুরে কথা বলে মহিলার দিকে তাকালেন। পরে বললেন, তাহলে আপনার ধারণা এটা কোনো যৌন অপরাধমূলক ঘটনা?
মহিলা উত্তর দিলেন, সে বিষয়ে আমি কোনো উত্তর বা ইঙ্গিত করিনি, মিঃ রেন।
তিনি বললেন কিন্তু মেয়েটাকে তো গলাটিপেই মারা হয়েছে তাই নয় কি? আমি ভাবছি –ভদ্রলোক তার দীর্ঘ সাদা হাতদুটো সামনে মেলে ধরে বললেন, কাউকে গলা টিপে খুন করার সময় হত্যাকারীর মনের মধ্যে কেমন প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়।
তাই নাকি মিঃ রেন?–ভদ্রমহিলা বললেন।
ক্রিস্টোফার রেন ভদ্রমহিলার দিকে দুপা এগিয়ে গিয়ে বললেন–আচ্ছা মিসেস বয়েল, আপনাকে কেউ যদি খুন করে তাহলে আপনার মনে কি ধরনের প্রতিক্রিয়া হবে সে বিষয়ে কোনোদিন চিন্তাভাবনা করেছেন?
মিসেস বয়েল আগের মত উদ্ধত সুরে বলে উঠলেন, তাই নাকি মিঃ রেন? আপনি তো খুব…
মলি এবার বাকি অংশটুকু খবরের কাগজ থেকে পড়লেন। এই ব্যাপারে জোর জিজ্ঞাসাবাদ করার জন্য পুলিস কর্তৃপক্ষ যে ব্যক্তির সন্ধান করছে তার গায়ে কালো ওভার কোট, মাথায় হোমবার্গ টুপি, উচ্চতা মাঝারি, গলায় একটা পশমের মাফলার জড়ানো।
রেন মন্তব্য করলেন, প্রকৃতপক্ষে চেহারার বর্ণনা শুনে মনে হচ্ছে লোকটিকে দেখতে আর পাঁচজন সাধারণ মানুষের মতই। তার ঠোঁটের ফাঁকে মৃদু হাসির রেখা দেখা দিল।
মলি মাথা নেড়ে সায় দিয়ে বলল- হ্যাঁ, সাধারণ যে কোনো লোকের চেহারার সঙ্গেই এ বর্ণনা অবিকল মিলে যায়।
ইনসপেকটর পারমিন্টার স্কটল্যাণ্ডের ইয়ার্ডে তার নিজের ঘরেই বসে ছিলেন। সামনের চেয়ারে বসে ছিলেন ডিটেকটিভ সার্জেন্ট কেন।
পারমিন্টার বলনে আমি ঐ শ্রমিক দুজনকে ডেকে কিছু জিজ্ঞাসাবাদ করতে চাই।
হা স্যার, আমি খবর পাঠাচ্ছি আর্দালিকে।
পারমিন্টার প্রশ্ন করলেন, ওদের চালচলন কেমন?
উত্তরে বললেন– দেখলে মনে হয় শ্রমিক হিসাবে খুবই দক্ষ। হঠাৎ উত্তেজিত হয়ে পড়ে না। তাছাড়া ওদের ওপর নির্ভর করা যায়।
গম্ভীর ভাবে পারমিন্টার মাথা নাড়িয়ে বললেন।
অনতিবিলম্বে দুজন শ্রমিক ঘরের মধ্যে ঢুকল। তাদের পোশাক পরিচ্ছদ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন, চোখেমুখে একটা ইতস্ততঃ ভাব। পারমিন্টার একনজরে দুজনের আপাদমস্তক দেখলেন। লোকের মনে আস্থা ফিরিয়ে আনতে তিনি অসাধারণ দক্ষতা অর্জন করেছেন।
মৃদু সুরে পারমিন্টার প্রশ্ন করলেন তাহলে তোমাদের বিশ্বাস মিসেস লিয়নের হত্যাকাণ্ডের ব্যাপারে তোমরা কিছু প্রয়োজনীয় খবরাখবর দিতে পারবে? তোমাদের সুবিবেচিত মতামতের জন্য ধন্যবাদ। তারপর তিনি একটা চেয়ারের দিকে তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করিয়ে বললেন বসতে। খোলা সিগারেটটাও তাদের সামনে এগিয়ে দিলেন।
শ্রমিক দুজন চেয়ারে বসে সিগারেট ধরাবার আগে পর্যন্ত স্থিরভাবে অপেক্ষা করলেন এবং তারপর বললেন–কি জঘন্য আবহাওয়া।
হা স্যার, যা বলেছেন! গাছ পাথর সব জমে যাওয়ার অবস্থা।
আচ্ছা এখন কাজের কথা শুরু হয়ে যাক। তোমরা কে কি দেখেছ বল?
শ্রমিক দুজন এবার কিছুটা ইতস্ততঃ বোধ করল। দুজনের চোখেই একটা কুণ্ঠিতভাব দেখা গেল। ঘটনার যথাযথ বর্ণনা দেওয়াটা তাদের কাছে যেন ছিল এক দুঃসাধ্য ব্যাপার।
মোটাসোটা লোকটা তার সঙ্গীকে অনুরোধের সুরে বলল–তুমিই না হয় বলনা জো!
অল্প কেশে জো বলল–না… মানে আসল ব্যাপারটা হচ্ছে তখন আমাদের কাছে কোনো দেশলাই ছিল না।
প্রশ্ন করা হল–তোমরা তখন কোথায় ছিলে?
উত্তর দিল– জারম্যান স্ট্রীটে। রাস্তার ধারে গ্যাস সরবরাহের পাইপ মেরামত করছিলাম।
মাথা দোলা দিলেন ইনসপেক্টর পারমিন্টার। পরে তিনি স্থান এবং কালের নিখুঁত বিবরণ সংগ্রহ করতে পারবেন। জারম্যান স্ট্রীট যে অকুস্থলের খুব কাছে তা তিনি জানেন।
উৎসাহ দেবার সুরে তিনি বললেন, তোমাদের কাছে তখন কোনো দেশলাই ছিল না?
উত্তর দিল না স্যার। আর যখন আমার দেশলাইটা ফুরিয়ে গিয়েছিল, বিলের লাইটারটাও তখন জুলছিল না। সেইজন্য একজন পথচারী ভদ্রলোককে ডেকে তার কাছে দেশলাই আছে কিনা তা জানতে চাইলাম। তখন তাকে দেখে বিশেষ কিছুই মনে হয়নি… নেহাৎ একজন সাধারণ ভদ্রলোক বলেই মনে হল।…
আবার মৃদুভাবে মাথা নাড়লেন পারমিন্টার।
তিনি পকেট থেকে দেশলাই বার করে এগিয়ে দিলেন। কিন্তু মুখে কোনো কথা বললেন না। বিল-ই ভদ্রতার খাতিরে বলল–কি জঘন্য ঠান্ডা। হাত পা যেন সব অসাড় হয়ে যাচ্ছে। হ্যাঁ তা বটে। ছোট্ট করে জবাব দিলেন তিনি। তার কণ্ঠস্বরের মধ্যে যেন একটা রুক্ষস্বর। মনে হল বুকে সর্দি জমেছে। অগ্রিম ধন্যবাদ জানিয়ে ভদ্রলোককে দেশলাইটা দিলাম ফেরত। তখনই আমার নজরে পড়ল তার পকেট থেকে কি যেন একটা মাটিতে পড়ে গেছে। কিন্তু তাকে ডেকে সে বিষয়ে কিছু বলবার আগেই দ্রুত পায়ে সামনের দিকে এগিয়ে গেলেন ভদ্রলোক। তবু আমি পেছন থেকে কয়েকবার তাকে ডাকাডাকি করলাম, তবে তিনি ততক্ষণে বাঁদিকে মোড় ঘুরিয়ে চোখের বাইরে চলে গেলেন। তাই না বিল?
বিল ঘাড় নেড়ে বলল, হ্যাঁ ঠিকই তো, তাড়া খাওয়া খরগোসের মতই ছুটছিলেন ভদ্রলোক। একটু থেমে আবার বলল, তিনি তখন হ্যাঁরো রোড ধরেই যাচ্ছিলেন এবং এত দ্রুত গতিতে হাঁটছিলেন যে পেছন থেকে দৌড়ে গিয়ে তার নাগাল পাওয়া খুবই অসম্ভব মনে হল। তাছাড়া ভাবলাম মানিব্যাগ বা ওই জাতীয় কিছু নয়, হয়ত সামান্য একটা নোটবই মাত্র…হয়তো এটা তার বিশেষ কোনো কাজেই লাগবে না। কিছুক্ষণ থেমে দম নিল জো। তারপর আবার বলতে শুরু করল-ভদ্রলোকের চালচলনও যেন কেমন একটা ঠেকছিল। টুপিটা চোখের কোল পর্যন্ত নামানো ছিল। ওভার কোটের বোতামগুলোও আঁটা ছিল। সিনেমায় ঠক-জোচ্চরদের যেমন চেহারা হয় ঠিক তাকে তেমনই অনেকটা লাগছিল। এ সম্বন্ধে বিলের কাছে তখন কি একটা মন্তব্য করেছিলাম।
বিল সায় দিয়ে বলল-হা হা, মনে আছে আমার।
তবে কেবলমাত্র মতলববাজ ভদ্রলোক ছাড়া এবিষয়ে তখন আর কিছু মনে হয়নি। ভাবলাম, বাড়ি ফেরবার জন্য হয়ত খুব তাড়া আছে তার। এই জন্যেই তাকে কোনো দোষ দেওয়া যায় না। কারণ যা তখন ঠান্ডা পড়েছে।…
বিলও সঙ্গে সঙ্গে মাথা নেড়ে বলল–দারুণ ঠান্ডা।
সেইজন্য বিলকে বললাম, নোটবইটা খুলে দেখ ভেতরে কোনো দরকারী কাগজপত্র আছে কিনা। কিন্তু দু-একটা ঠিকানা ছাড়া আর কিছুই পাওয়া গেল না। তার মধ্যে একটা হচ্ছে চুয়াত্তর নম্বর কার্লভার স্ট্রীট, আর একটা কোনো হতচ্ছাড়া ম্যানর হাউসের।
মুখ বেঁকিয়ে বিল উচ্চারণ করল বিটজি।
বুকের মধ্যে জো এবার আস্থা ফিরে পেয়েছে। কণ্ঠস্বরের দৃঢ়তার আভাস শোনা গেল।
সে বলল, চুয়াত্তর নম্বর কার্লভার স্ট্রীটে, ঠিকানাটা পড়ে আমি বিলকে শোনালাম। যে রাস্তায় আমরা কাজ করছিলাম সেখান থেকে জায়গাটা বেশি দূরত্ব ছিল না। দুজনে পরামর্শ করে নিলাম, ফেরবার পথে ঐ বাড়িতে না হয় একবার খোঁজ নেওয়া যাবে। পাতা উলটে দেখা গেল ভেতরে এক জায়গায় কি একটা লেখা আছে মজার কথা। বিল আমার হাত থেকে নোটবইটা কেড়ে নিয়ে চেঁচিয়ে পড়তে লাগল সেই জায়গাটা। ছেলে ভুলনো একটা ছড়ার লাইন। তিনটি ইঁদুর অন্ধ… নিশ্চয় তামাশা করেই কেউ লিখে রেখেছে। এবং ঠিক সেই মুহূর্তেই…হা স্যার ঠিক সেই মুহূর্তে একটা গোলমাল, একটা চেঁচামেচি আমাদের কানে এল একজন স্ত্রীলোক খুন –খুন বলে চীৎকার করছে। চীৎকারটা আমাদের কাছ থেকে খুব একটা দূরে ছিল না। কয়েকটা রাস্তার পরেই।
জো কিছুক্ষণের জন্য চুপ করল। যেন রহস্য নাটকের চরমতম উত্তেজনার মুহূর্তে এসে শ্রোতাদের উৎকণ্ঠিত চিত্তে যেন সুড়সুড়ি দিয়েছে–এরকম যেন একটা পরিস্থিতি।
আমি তখন বিলকে ব্যাপারটার খোঁজ আনতে পাঠালাম। অল্প পরে ও ফিরে এসে খবর দিল যে কিছু দূরে একটা বাড়ির সামনে অনেক লোকের ভিড় জমে গেছে। কয়েকজন পুলিসও সেখানে দাঁড়িয়ে গেছে। সেই ফ্ল্যাটবাড়ির একজন ভাড়াটে মহিলা খুন হয়েছেন। বাড়ির কত্রীই ঘটনাটা জানতে পারেন সর্বপ্রথম। তিনিই লোক জড়ো করেন চেঁচামেচি করে আর পুলিসকে খবর দেয়। বিলকে আমি প্রশ্ন করলাম খুনটা কোনো রাস্তায় হয়েছে। বলল, কার্লভার স্ট্রীটে। তবে বাড়ির নম্বরটা দেখে আসতে ও ভুলে গেছে।
অস্বস্তিতে নড়েচড়ে উঠল চেয়ারের মধ্যে বিল। দুবার শব্দ করে আসতে করে কাশলো বিল। তার দুচোখে একটা নির্বোধ অসহায় ছায়া। যেন তার কাছে এই কাজটা খুবই অপরাধজনক হয়ে গেছে।
জো আবার বলতে শুরু করল আমি তখন বললাম, আমাদের নিশ্চিত হওয়া দরকার। ডিউটি শেষ করার পর, বাসায় ফেরার পথে ওদিকটা ঘুরে যাবো। খোঁজ নিতে গিয়ে জানলাম বাড়িটার নম্বর চুয়াত্তর। এই ভদ্রলোকের নোট বইয়ের মধ্যে ঐ ঠিকানাটা লেখা ছিল। বিলের ধারণা ছিল খুনটার সঙ্গে এর হয়তো কোনো সম্পর্ক নেই। নেহাতই একটা কাকতালীয় ব্যাপার। কিন্তু পরে শুনলাম যখন পুলিস কোনো এক ভদ্রলোককে খোঁজ করছে যাকে খুনের ঘটনার কিছু আগে ওই বাড়িতে ঢুকতে দেখা গিয়েছিল–তখন আর চুপচাপ বসে থাকা যুক্তিযুক্ত মনে হল না। যিনি এই মামলার তদন্তের ভার নিয়েছেন তার সঙ্গে যোগাযোগ করবার চেষ্টা করলাম।….
বোধহয় আমি শুধু শুধু বাজে বকে আপনাদের মূল্যবান সময় নষ্ট করছি না?
নাঃ নাঃ তোমরা উচিত কাজই করেছে।
পারমিন্টার ভরসা দিলেন তাদের।
তোমরা যে বুদ্ধি করে নোটবইটা সঙ্গে নিয়ে এসেছে এ জন্যেও অনেক ধন্যবাদ। পেশাদারী দক্ষতা সহকারেই তিনি দুজনকে খুঁটিয়ে প্রশ্ন করলেন।
স্থান এবং কালের সম্বন্ধে ও অবহিত হলেন সবকিছু। কেবল পাত্রর বিবরণ সম্বন্ধেই তিনি তাদের কাজ থেকে বিশেষ কিছু আদায় করতে পারলেন না। হিস্টিরিয়া গ্ৰস্তা গৃহকত্রী যে বর্ণনা দিয়েছিল এরাও তার পুনরাবৃত্তি করলো, চোখ পর্যন্ত নামানো টুপি, ওভার শেটের বোতামগুলো আটা, থুতনি পর্যন্ত মাফলারটা ঢেকে দিয়েছে। কণ্ঠস্বর ছিল তার রুক্ষ এবং দুই হাতে ছিল দস্তানা যেটা ছিল পশমের।
যখন শ্রমিক দুজন চলে গেলেন তারপর পারমিন্টার চেয়ারে গা এলিয়ে বসে রইলেন। পালিশ করা ঝকঝকে টেবিলের উপর ময়লা রংচটা খোলা অবস্থায় পড়ে আছে নোটবইটা। সেটা বিশেষজ্ঞের কাছে পাঠানো হবে ফিঙ্গার প্রিন্ট-এর জন্য।
তাদের সাহায্যে এর মধ্যে গুপ্ততথ্য আবিষ্কৃত হতে পারে। কিন্তু এখন তার দু-চোখের দৃষ্টি কালো কালিতে লেখা দুটো ঠিকানার দিকে নিবদ্ধ। দরজা ঠেলে সার্জেন্ট কেন্-কে ঘরে ঢুকতে দেখে পারমিন্টার ঘাড় ফিরিয়ে তাকালেন। এদিকে এসো কেন্ জিনিসটা একবার নিজের চোখে পরীক্ষা করে দেখে যাও।
খাতার দিকে তাকিয়ে মৃদু শিস দিয়ে উঠল কেন্। নিজের মনে বলতে থাকে তিনটি ইঁদুর অন্ধ আশ্চর্য! আমি তো একেবারে বেকুব বনে যাচ্ছি।
পারমিন্টার গম্ভীর চালে মাথা দুলিয়ে বললেন, হ্যাঁ, সামনের টানা থেকে একটুকরো কাগজ বের করে কেনের দিকে দিলেন এগিয়ে, মৃত মহিলার পোশাকের সঙ্গে পিন দিয়ে আটকানো ছিল এই কাগজটা।
কাগজটায় লেখা আছে–এই প্রথম। নিচে শিশুসুলভ অপটু হাতে তিনটি ইঁদুরের আঁকা ছবি। তারপরে বাদ্যসঙ্গীতের একটা লাইনের স্বরলিপি।
শিস দিয়ে কেন সুরটা ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করল। তিনটে ইঁদুর অন্ধ…জানলা কপাট বন্ধ?
ঠিক আছে, ঠিক আছে। তোমাকে আর সুর মেলাতে হবে না। ওটা যে এই গানের স্বরলিপি সেটা আমার কাছে জলের মত পরিষ্কার।
সে জিজ্ঞেস করল–কোনো পাগলের কাণ্ড তাই না স্যার?
পারমিন্টার ভ্রু কুঁচকে বললেন, হু মেয়েটার সম্বন্ধে যে সব খোঁজখবর পাওয়া গেছে তার মধ্যে কোনো ভুল নেই তো?
সে বলল, না স্যার সমস্তই খাঁটি। ফিঙ্গারপ্রিন্টের বিশেষজ্ঞের রিপোর্টটা একবার পড়ে দেখলেই সব জানা যাবে। মিসেস লিয়ন বলে যে মেয়েটা তার পরিচয় দিয়েছে তার আসল নাম মউরীন গ্রেগ। মেয়েটা দুমাস আগে জেল থেকে ছাড়া পেয়েছে। ওই সময় তার জেলের মেয়াদও শেষ হয়ে গিয়েছিল।
পারমিন্টার চিন্তান্বিত কণ্ঠে বললেন–ছাড়া পাবার পর মেয়েটা চুয়াত্তর নম্বর কার্লভার স্ট্রীটে গিয়ে উঠল। নিজের নাম রাখল মউরীন লিয়ন। কখনো কখনো মদ খেয়ে বেহুশ হয়ে পড়ে থাকত। সপ্তায় এক-একদিন দু-একজন পুরুষ অতিথিও ওর ঘরে আনাগোনা করত। তবে ও বিশেষ কাউকে যে ভয় পেত তা কিন্তু নয়। নিজের আসন্ন বিপদ সম্বন্ধেও ওর কোনো ধারণা ছিল না। এই লোকটা প্রথমে এসে কলিংবেলের বোতাম টেপে। তার ঝি-এর কাছে মিসেস লিয়নের ঘর কোনোটা জেনে নেয়। সেও যদিও লোকটার বর্ণনা দিতে পারেনি। শুধু জানিয়েছে সে মাঝারি ধরনের উচ্চতা, আর গলার স্বর কিছুটা ভাঙ্গাভাঙ্গা। তারপর কাজ সারতে ঝি নিচের তলায় চলে যায়। কিন্তু সন্দেহজনক কোনো চেঁচামেচি তার কানে এসে পৌঁছায়নি। এমন কি লোকটা কখন নিঃশব্দে বেরিয়ে গেছে তাও বলতে পারে না সে।
মিনিটদশেক বা আরো কিছু পরে ও যখন মিসেস লিয়নের জন্য চা নিয়ে যায় তখনই দেখতে পায় মেয়েটাকে কে গলা টিপে মেরে গেছে।
হঠাৎ বেঁকের মাথায় কেউ এ খুন করেনি কেন্। খুবই সুচিন্তিত পরিকল্পনায় কাজটা শেষ করা হয়েছে। কিছুক্ষণ চুপ করে পারমিন্টার আবার বললেন, ইংলণ্ডে মঙ্কসওয়েল ম্যানর নামে কটা বাড়ি আছে…?
কেন জবাব দিল, খুব সম্ভবতঃ একটাই।
তাহলে তো বলতে হয় আমরা অসীম সৌভাগ্যবান। তবে এ বিষয়ে খোঁজ খবর নেওয়া উচিত। বেশি দেরী করা উচিত হবে না।
সার্জেন্টের চোখের দৃষ্টিও এবার নোটবইয়ের পাতার ওপর স্থির হয়ে রইল। দুটো ঠিকানা লেখা আছে সেখানে একটা চুয়াত্তর নম্বর কার্লভার স্ট্রীট, অন্যাটা মঙ্কসওয়েল ম্যানর।
আপনি কি তাহলে মনে করেন…?
পারমিন্টার দ্রুত চোখ তুলে তাকালেন। তোমারও কি সেইরকম সন্দেহ হচ্ছে না…।
মঙ্কসওয়েল হতে পারে তাই না? কিন্তু…কিন্তু দু-চার দিনের মধ্যেই যেন নামটা কোথায় দেখলাম। আমি খুব নিশ্চিত ভাবেই বলতে পারি… অল্প কয়েক দিন আগেই?…
দেখলে কোথায়?
সেটাই তো মনে রাখবার চেষ্টা করছি। এক মিনিট ধৈৰ্য্য ধরুন… সম্ভবতঃ কোনো খবরের কাগজের পাতায়…বোধহয় দৈনিক টাইমসে। একেবারে শেষের পাতায় সেদিনের ক্রসওয়ার্ড পাজলটা সমাধানের চেষ্টা করছিলাম। তখনই যেন এক জায়গায় ছোট্ট করে নজরে পড়ল…
কেন্ কথা বলতে বলতে দ্রুত পায়ে ঘর ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে গেলেন। একমুহূর্ত পর যখন ফিরে এলেন তখন তার চোখে মুখে জয়ের হাসি। বলল– এই যে স্যার, এখানে দেখুন, কয়েকদিন আগের দৈনিক পত্রিকার একটা পাতা এগিয়ে দিলেন পারমিন্টারের দিকে। পারমিন্টার চোখ বোলান তার ওপর।
মঙ্কসওয়েল ম্যানর হারগ্লেডন, বার্কস।–এই পড়ে আসতে আসতে চোখ তুললেন তিনি। তারপর বললেন, তুমি আমাকে বার্কায়ারের পুলিশ অফিসারের লাইনটা ধরিয়ে দাও।
মেজর মেটকাফের আগমনের সঙ্গে সঙ্গে মঙ্কসওয়েল ম্যানর একটা যেন রীতিমত হোটেলের মত পরিণত হল। কাজকর্ম চলতে লাগল সেই ভাবে। তিনি অবশ্য মিসেস বয়েলের মত উগ্রচণ্ডী স্বভাবের ছিলেন না, আর ক্রিস্টোফার রেনের মত অস্থির প্রকৃতিও তিনি ছিলেন না। শক্তসমর্থ চেহারার মাঝবয়সী সুপুরুষ ছিলেন তিনি।
চালচলনে মিলিটারি ভঙ্গি। চাকরি জীবনটা অধিকাংশ সময় ভারতবর্ষতেই কাটিয়েছেন তিনি। তার জন্য নির্দিষ্ট ঘর এবং ঘরের আসবাবপত্র দেখেও তিনি সন্তুষ্ট হলেন। মিসেস বয়েলের সঙ্গে তার আগে পরিচয় না থাকলেও ভদ্রমহিলার দু-একজন দূর সম্পর্কের ভাইকে তিনি চিনতেন। দু-দুটো নরম চামড়ার দামী স্যুটকেসে ভরা তার মালপত্র দেখেও মনে মনে জিল আশ্বস্ত হল। আর যা হোক বিল না মিটিয়ে কেটে পড়ার মানুষ নন মেটকাফ।
সত্যি কথা বলতে কি মলি এবং জিলও অতিথিদের সম্বন্ধে তাদের পারস্পরিক মনোভাব আদানপ্রদান করবার মতো কোনো নিশ্চিন্ত অবসর ইতিমধ্যে খুঁজে পায়নি। সারাদিনটা তাদের কেটে গেছে কাজের মধ্যে। লাঞ্চ এবং ডিনার তৈরি করা, পরিবেশন করা, কাপ ডিস ধোওয়া- আরও কতরকম যে কাজের ঝামেলা তার ঠিক ঠিকানা নেই কোনো। মেজর মেটকাফ অবশ্য কফির প্রশংসা করলেন খুব। এবং মলি ও জিল যখন সমস্ত কাজ শেষ করে রাত্রে বিছানায় শুতে এল তখন তারা রীতিমত ক্লান্ত হলেও দুজনের চোখে তখন ফুটে উঠছিল সাফল্যের দীপ্তি। বিজয়গর্বে তাদের বুক ফুলে উঠেছিল। কিন্তু উষ্ণ শয্যার মদির আরামও বেশিক্ষণ জুটলো না তাদের কপালে। দুটো বাজতে না বাজতেই কলিংবেলের মর্মভেদী আর্তনাদে উঠে পড়তে হল বিছানা ছেড়ে।
জিল বিরক্তিসুরে বলে উঠল–দূর ছাই। এটা তো সদর দরজার ঘণ্টার আওয়াজ! এতরাত্রে আবার কে…।
ব্যস্ত সুরে মলি বলল-তাড়াতাড়ি উঠে গিয়ে দেখো।
২. ভৎর্সনার দৃষ্টি
মলির দিকে ভৎর্সনার দৃষ্টিতে তাকিয়ে অনিচ্ছুক ভঙ্গিতে উঠে দাঁড়াল জিল। তারপর ড্রেসিং গাউনটা গায়ের ওপর জড়িয়ে সিঁড়ি বেয়ে নেমে গেল নিচে। মলি সদর দরজা খোলার শব্দ পেল। কার মৃদুকণ্ঠের আওয়াজও কানে ভেসে এল তার। মলি ধৈর্য রাখতে পারল না। আস্তে আস্তে বিছানা ছেড়ে সিঁড়ির উপর দাঁড়িয়ে উঁকি মারার চেষ্টা করল। জিল একজন অপরিচিত দাঁড়িওলা ভদ্রলোককে গায়ে ওভারকোট খুলতে সাহায্য করছে। ভদ্রলোকের আপাদমস্তক পেঁজা পেঁজা বরফে আপদমস্তক ছেয়ে গেছে। তারপর সেই সঙ্গে তাদের কথাবার্তার দুচারটে শোনা গেল। একটা ঘন নিঃশ্বাস ছেড়ে ভদ্রলোক বললেন–উফ। কথার সুরে বিদেশী সুরটা কানে লাগলো। তারপর বলল–হাতের সমস্ত আঙুলগুলো অসাড় হয়ে গেছে। ওগুলো আমার যে শরীরের অংশ তা বোঝাই যায় না। পায়ের অবস্থা তার চেয়েও খারাপ। শান বাঁধানো মেঝের ওপর শোনা গেল জোরে জোরে পা ঠোকার শব্দ।
আসুন… ভেতরে আসুন। এই বলে জিল লাইব্রেরী ঘরের দরজাটা খুলে দিল। তারপর বলল, ঘরটা এখনও বেশ গরম আছে। দুঃপাঁচমিনিটের মধ্যেই আপনার জন্য একটা ঘরের বন্দোবস্ত করে দিচ্ছি। ততক্ষণ এখানে আপনি অপেক্ষা করুন।
বিনীত কণ্ঠে আগন্তুক বলল, আমাকে সত্যিই ভাগ্যবান বলা যায়।
মলির কৌতূহল আরো উদগ্রীব হয়ে উঠেছে। সিঁড়ির মাথা থেকে দুধাপ নেমে এসে ও এবার জাফরিকাটা রেলিংয়ের ফাঁক দিয়ে অপরিচিত আগন্তুককে ভালোভাবে দেখতে লাগল। বয়স হয়েছে ভদ্রলোকের, গালের দুপাশে কালো চাপদাড়ি। দীর্ঘ, ঘন কালো ভূজোড়া ধনুকের মত বাঁকা। গ্রীক পুরাণে বর্ণিত প্রজ্ঞাবান শয়তানের চেহারার সঙ্গে কোথায় যেন একটা মিল পাওয়া যায়। রগের দুপাশের চুলে অল্প পাক ধরেছে, কিন্তু হাঁটা চলার মধ্যে আছে তারুণ্যের সাবলীল ভঙ্গি।
লাইব্রেরীর দরজাটা টেনে দিয়ে জিল দ্রুত পায়ে সিঁড়ি টপকে উঠে এল ওপরে। মলিও আড়িপাতা বন্ধ করে উঠে দাঁড়াল সোজা হয়ে।
মলি জানতে চাইল–ভদ্রলোকটি কে?
জিল মৃদু হেসে বলল–আমাদের অতিথিশালারই আরেক অতিথি বরফ ঝড়ের ধাক্কায় রাস্তার মাঝখানে গাড়ি খারাপ হয়ে গেছে ভদ্রলোকের। কোনোরকমে গাড়ি থেকে নেমে এক হাঁটু বরফ পেরিয়ে অন্ধের মত সামনের দিকে এগোচ্ছিলেন, যদি কোনো আশ্রয় খুঁজে পাওয়া যায় এই আশা করে। এমন সময় আমাদের টাঙানো সাইনবোর্ডটা ওনার চোখে পড়ল। প্রথমে উনি ঠিক বিশ্বাস করতে পারেননি। সকাতর অনুনয়ে সাড়া দিয়ে ভগবান যেন এটা মিলিয়ে দিয়েছেন বলে এটা তার মনে হয়।
মলি প্রশ্ন করল, কোথাও কোনো গণ্ডোগোল নেই তো?
জিল বলল–আরে না না। এসব রাতে সিঁদেল চোরেরা রাস্তায় ঘুরে বেড়ায় না।
মলি বলল–মানে আমি বলতে চাই…একজন বিদেশী তো বটে?
জিল বলল–হ্যাঁ তা ঠিক। নাম বললেন প্যারভিসিনি, তবে ভদ্রলোকের মানিব্যাগটা আমি দেখেছি। মনে হল শুধুমাত্র আমাকে দেখাবার জন্যই ইচ্ছে করে উনি বার করলেন ব্যাগটা পকেট থেকে। করকরে ক্যারেন্সি নোটে ঠাসা। ভদ্রলোককে কোনো ঘরটা দেওয়া যায় বল তো?
মলি বলল–কেন, সবুজ ডিসটেম্পার করা ঘরটাই দাওনা। সবকিছুই আছে সাজানো গোছানো। কেবলমাত্র বিছানাটা পেতে দিলেই হয়।
আমার মনে হয় ভদ্রলোককে গোটা দুয়েক পাজামাও ধার দিতে হবে। কেননা গাড়িতেই আটকে আছে ওনার সব মালপত্র। আমাকে বললেন, কোনোরকমে গাড়ির জানলা দিয়ে তিনিই শুধু নেমে আসতে পেরেছেন।
মলি বিছানার চাদরটা আর বালিশের ওয়াড় আর তোয়ালে আনতে ভেতরে গেল। তারপর দুজনে মিলে আবার দ্রুত হাতে শয্যা তৈরি করতে লাগল।
আকাশের যেরকম অবস্থা তাতে মনে হয় পথঘাট সব চাপা পড়ে যাবে বরফে। এই বরফ কেটে রাস্তা বার করতেও সময় লাগবে অনেক। আমরা দু-চার দিনের জন্য হয়তো বাইরের পারিপার্শ্বিক জগৎ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বো। ব্যাপারটা তাহলে খুব মজার হবে তাই না?– সম্পূর্ণ এক নতুন ধরনের রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা!–জিল বলল।
সন্দেহের সুরে মলি জবাব দিল–আমার বাপু অত কিছু মনে হচ্ছে না, কেবলমাত্র পাউরুটি দিয়ে নানা ধরনের খাবার তৈরি করা যা অসুবিধেজনক…। আচ্ছা জিল, আমার পাউরুটির কেক আর মিষ্টিটা তোমার খেতে খারাপ লাগে না তো?
জিল তাকে ভরসা দিয়ে বলল–কি যে বল! একেবারে অমৃত! অতিথিরা খেলে বর্তে যাবে। তবে রুটিওলা যে কি রকম রুটি দিয়ে গেছে সেটাই প্রধান চিন্তার বিষয়। পথঘাট বরফে ঢেকে গেলে অন্য কোনো রুটিওলাও আসবে না এদিকে।
শুধু রুটিওলা না, মাংসবিক্রেতাকেও তুমি দেখতে পাবে না। না আসবে কোনো পিওন, না আসবে কোনো হকার। এমনকি টেলিফোন যোগাযোগ পর্যন্ত হয়ে যেতে পারে বিচ্ছিন্ন।
তখন একমাত্র সম্বল হবে রেডিও তারাই আমাদের কাছে কর্তব্যের নির্দেশ পাঠাবে।
তবে একটাই আমাদের ভরসা আছে যে আমাদের জেনারেটার আছে। জেনারেটারের সাহায্যেই আমরা নিজেদের ইলেকট্রিক লাইনগুলো চালু করতে পারব।
কাল সকালে উঠে প্রথমেই আমাদের জেনারেটারটা প্রস্তুত রাখা দরকার। তাছাড়া কয়লা ভর্তি করতে হবে চুল্লীটাতে।
তবে আমার বিশ্বাস আগামী দুচার দিনের মধ্যে নুতন করে কয়লা পাবার কোনোও সম্ভাবনা নেই। মজুত কমে যায়নি তো?
চারদিকে এখন উপস্থিত হচ্ছে নানা ঝামেলা। কি যে শুরু হল এই দুর্যোগ…। তাড়াতাড়ি কর জিল, এই ভদ্রলোক কি যেন নাম তার প্যারা-না কি তাকে ডেকে আন। আর আমি দাঁড়াতে পারব না। ঘুম পাচ্ছে। মলি বলল কথাগুলো।
জিলের আশঙ্কা যে ভুল নয় তার প্রমাণ পাওয়া গেল রাস্তার ওপর পাঁচ ফুট বরফ জমে আছে। অনেক ক্ষেত্রে দুঃসাধ্য বাপার হল জানলা দরজা খোলা। তুষারপাতের কোনো থামার চিহ্ন নেই ঝরছে তো ঝরছেই। সারা পৃথিবীটাই এখন নিরাবরণ বিধবার মতো সাদা পোষাকের মত জড়ানো। তার বুকের মধ্যে নিঃশব্দ মৃত্যুর হিমেল বিস্তার!
মিসেস বয়েল সকালের প্রাতঃকালীন খাবারে ব্যস্ত ছিলেন। এই মুহূর্তে ডাইনিংরুমে উপস্থিত ছিল না কেউই। পাশের টেবিলটা মেজর মেটকাফের জন্য ছিল নির্দিষ্ট। তিনি কিছু আগেই প্রাতঃরাশ সেরে উঠে গেছেন। তার ব্যবহৃত কাপপ্লেটগুলো পরিষ্কার করার জন্য নিয়ে যাওয়া হয়েছে। মিঃ রেনের টেবিলটা সাজানো গোছানো আছে অবশ্য। কিন্তু ভদ্রলোকের এখনো দেখা পাওয়া যায়নি। একজন নিশ্চয় খুব সকালেই বিছানা ছেড়ে উঠে গেছেন। আরেকজনের সূর্য মাথার ওপর না উঠলে তার ঘুমই ভাঙে না। কিন্তু মিসেস বয়েল জানেন একটিমাত্র সঠিক সময় আছে প্রাতঃরাশের জন্য। সেই সময়টা হচ্ছে সকাল নটা।
মিসেস বয়েল এসব ভাবতে ভাবতেই সুস্বাদু ওমলেটটা শেষ করলেন। দুপাটি মজবুত শক্ত দাঁতের সাহায্যে শেষ করলেন হাতে গরম টোস্টগুলোও। তার মনে একটা রাগ রাগ ভাব ফুটে উঠছে। অভিযোগ করার মত কিছু খুঁজে না পাওয়ায় তার মধ্যে একটা আছে বিচলিত ভাব। মঙ্কসওয়েল ম্যানরকে যেমনটি হবে বলে তিনি ভেবেছিলেন, এসে দেখলেন তার ভাবনার সঙ্গে ওনার কোনো মিলই নেই। তিনি ভেবেছিলেন যে যেখানে হয়ত প্রত্যেকদিন তাস খেলার আসর বসে। কয়েকজন বর্ষিয়সী রমণীরও দেখা পাবেন বলে তার ধারণা ছিল। তাদের কাছে তিনি আড়ম্বর সহকারে তার সামাজিক খ্যাতি ও প্রতিষ্ঠার গল্প করতে পারবেন। কত গণ্যমান্য উচ্চপদস্থ ব্যক্তির সঙ্গে যোগাযোগ ছিল তার। সেকথা সকলের মনে শুনিয়ে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন। এছারা সামরিক দপ্তরের অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য যে তার নখদর্পণে সে কথাও শুনিয়েছেন তিনি।
যুদ্ধ পরিসমাপ্তি তার মনে এক নিঃসঙ্গতা এনে দিয়েছে। তিনি যেন এক নির্জন দ্বীপে পরিত্যক্ত কোনো নাবিক। যুদ্ধ চলাকালীন তিনি ছিলেন একজন কর্মব্যস্ত মহিলা। চারদিকে তার হাঁকডাকে তটস্থ হয়ে থাকত। সমস্ত অফিসটাই সেই মেজাজের ভারে থরথর করে কাপতো? তার চেয়ে উচচপদস্থ কর্তাব্যক্তি এই মহিলাটিকে ভয় পেতেন বিশেষভাবে। আর অধীনস্ত কর্মচারীরা তার সামনে পড়ে গেলে ভয় পেয়ে এদিক ওদিক ছোটাছুটি করত। এমনকি প্রকৃতই তার কোনো সাংগঠনিক ক্ষমতা আছে কিনা সে বিষয়ে কেউ মাপার সাহস করত না। কিন্তু এই উত্তেজনার মধ্যে বছরগুলো কেমন করেশেষ হয়ে গেছে। তিনি আবার কর্মস্থল থেকে সরে এসে ব্যক্তিজীবনে ফিরে এসেছেন। যুদ্ধের আগে তার যে নিজস্ব ব্যক্তিগত জীবন ছিল এখন যেন তার কোনো অস্তিত্বই নেই। এতদিন মিলিটারিরা তার বাড়িটা দখল করে রেখেছিল। সম্পূর্ণ না সারিয়ে নিলে তার মধ্যে বাস করা অসম্ভব হয়ে পড়ে।
তার যে সব পুর্বপরিচিত বন্ধুবান্ধব ছিল তারা প্রায় কে কোথায় রয়েছে তার ঠিক নেই। অবশ্য নতুন পাড়াপড়শিরাও ঠিকই খুঁজে যোগাড় করে নেবেন, তবে তার জন্যও কিছুটা সময় চাই! সেইজন্য কোনো হোটেল বা বোর্ডিং হাউসই সব সমস্যার সমাধান বলে আপাততঃ মনে হয়। এই সব ভেবেই মঙ্কসওয়েল ম্যানরকে তিনি নির্বাচিত করেছিলেন।
মিসেস বয়েল রাগতদৃষ্টিতে চারপাশে দেখলেন। বিড় বিড় করে মনে মনে বললেন, খুবই অসাধুতার পরিচয়। এরা যে সবেমাত্র শুরু করতে যাচ্ছে, সে কথাটা আগে আমাকে জানানো উচিত ছিল।
তিনি হাত দিয়ে ডিসটা একটু দূরে ঠেলে দিলেন। প্রাতঃরাশের প্রতিটি খাবার যে সুস্বাদু এবং সুপরিবেশিত এইজন্যেই তার রাগটা একটু বেশি। বিশেষ করে কমলালেবুর মোরব্বা এবং কফি, দুটোই প্রসংসার যোগ্য। মিসেস বয়েলের মনে হল, অভিযোগ জানাবার ন্যায়সঙ্গত অধিকার থেকে অন্যায়ভাবে তাকে বঞ্চিত করা হয়েছে। এমনকি তার বিছানাটাও পরিপাটি করে গোছানো। ওপরের চাদরটারও চারদিকে নক্সা করা। মাথার বালিশটাও ছিল খুব নরম এবং মোলায়েম। মিসেস বয়েল এই ধরনের আরাম ও সুখস্বাচ্ছন্দ্য পছন্দ করেন। কিন্তু অন্যের কাজের খুঁত ধরাটাও ছিল তার বিলাসের অঙ্গ। আর দুটোর মধ্যে তুলনামূলকভাবে দ্বিতীয়টির প্রতি তার বেশি আসক্তি।
সম্রাজ্ঞীর মত মহিমান্বিত ভঙ্গিমায় চেয়ার ছেড়ে উঠে তিনি দাঁড়ালেন। তারপর ডাইনিংরুম পেরিয়ে পা দিলেন বারান্দায়। লাল-চুল বিশিষ্ট অস্বাভাবিক স্বভাবের যুবকটির সঙ্গে তার মুখোমুখি দেখা হয়ে গেল। যুবকটির গলায় ঝুলছে এক পশমের টাই। কি-ই বা তার রঙের বাহার। গাঢ় রঙের সবুজের ওপর কালো লাইন দিয়ে চেককাটা।
মিসেস বয়েল মনে মনে ভাবলেন অস্বাভাবিক….। সম্পূর্ণ অস্বাভাবিক। তার ওপর পাশ কাটিয়ে যাবার সময় যুবকটি যেরকম তির্যক দৃষ্টিতে তাকালেন সেই তাকানোটাও তার একদম পছন্দ হল না। তার এই তির্যক দৃষ্টির মধ্যেই আছে এক অস্বস্তিকর অস্বাভাবিকতা– মনে মনে ভাবলেন তিনি।
মিসেস বয়েল নিজে নিজে সিদ্ধান্ত নিলেন যে তিনি নিশ্চয় মানসিক ভাবে অসুস্থ। তাছাড়া অন্য কিছু হতে পারে না। একটু থেমে ছোকরার নিয়ম মাফিক মাথা নেড়ে অভিবাদন ফিরিয়ে দিলেন। ঘরটি বেশ আয়তনে বড়। দেওয়াল ঘেষে সারি সারি সুন্দর চেয়ার পাতা। বিশেষ করে গেলাপী রঙের বড় চেয়ার যে খুবই আরামদায়ক সেটা আর কাউকে বলার অপেক্ষা রাখে না। ওই গোলাপী চেয়ারটিই যে তার হবে সেটা মনে মনে ঠিক করে নিলেন তিনি। পাছে অন্য কোনো দাবিদার এসে ঝামেলা করে সেইজন্য দখল-স্বত্ব কায়েম করবার জন্য বোনার সাজসরঞ্জাম ভরা ব্যাগটা তার ওপর নামিয়ে রাখলেন। তারপর ডানদিকে থাকা বৈদ্যুতিক চুল্লীর সামনের দিকে এসে দাঁড়ালেন।
হ্যাঁ, তিনি যা সন্দেহ করেছিলেন, ঠিক তাই। চুল্লীটা নিজে উত্তপ্ত হলেও এর উষ্ণতা সঞ্চারের ক্ষমতা খুবই সীমিত। মিসেস বয়েলের চোখদুটো কিছুক্ষণের জন্য গোলাকার হয়ে উঠলো। এ বিষয়ে তার কোনো বক্তব্য রাখা উচিত।
বিরক্তি চোখে তিনি এবার বন্ধ জানলার সার্শি ভেদ করে বাইরের দিকে তাকালেন। খুবই জঘন্য আবহাওয়া। খুবই ভয়ঙ্কর। তবে তিনি যে এখানে বেশিদিন থাকবেন না, সেটা সুনিশ্চিত। অবশ্য আরো দু-চারজন নতুন অতিথির আগমন ঘটলে জায়গাটা যে বাসযোগ্য হয়ে উঠবে তখন নতুন করে না হয় চিন্তা করা যাবে।
কেউ যেন চাপা গলায় পেছন থেকে হেসে উঠল। তারপর তাড়াতাড়ি মিসেস বয়েল ঘুরে দাঁড়ালেন। যুবক রেনই দরজার দিকে দাঁড়িয়ে তার দিকে চোখ তুলে তাকিয়ে আছে। তার দৃষ্টির মধ্যে সেই একই ভাবে হাসির আভাস।
মেজর মেটকাফ খিড়কির দরজায় বরফ দূর করার জন্য সাহায্য করছিলেন জিলকে। ভদ্রলোক রীতিমত পরিশ্রমী। জিলও আনন্দভরা মনে আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছিলেন সেজন্য।
মেজর মেটকাফ মাথা নেড়ে মন্তব্য করলেন, সত্যিই এটা একটা ভালো ব্যায়াম। দেহের যন্ত্রপাতিগুলো ঠিক রাখার জন্য রোজ এধরনের কোনো না কোনো শরীরচর্চা করা উচিত।
জিল মনে মনে এটাই চিন্তা করছিলেন যে মেটকাফ নিশ্চয় নিয়মিত স্বাস্থ্যচর্চা করেন! কেননা সকাল সাড়ে সাতটায় জিল প্রাতঃরাশ সেরে ফেলেন, তার সম্বন্ধে এই ধরনের চিন্তাই সবার আগে আসবে।
জিলের মানসিক চিন্তাভাবনার আঁচ ধরেই যেন মেজর বললেন–আমার জন্য আপনার স্ত্রী যে প্রাতরাশের ব্যবস্থা করে রেখেছিলেন এর জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ। ডিমটাও খুব সুন্দর খেতে হয়েছিল।
জিলকে হোটেলের নানারকম কাজকর্মের জন্য সকাল সাতটার আগে বিছানা ছেড়ে উঠে পড়তে হয়। এবং সে ও মলি দুজন মিলে ডিম সেদ্ধ করে চা তৈরি করল। তারপর সবকিছু বসবার ঘরে এনে রাখলো সাজিয়ে গুছিয়ে। প্রতিটি বস্তুই নিখুঁত ও পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। জিল। একটা কথা মনে মনে না ভেবে পারেনি।
সে যদি এই হোটেলের কোনো অতিথি হত তবে এমন বরফ ঝরা সকালে বিছানার গরম জায়গা ছেড়ে কেউই তুলতে পারত না তাকে। শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত সে বিছানা আঁকড়ে পড়ে থাকত।
তবে এই মেজর ভদ্রলোক খুব সকালেই বিছানা ছেড়ে উঠে পড়েছেন। প্রাতঃরাশও সেরে ফেলেছেন সকাল সকাল। তারপর সারা বাড়িময় ঘুরে বেড়িয়েছেন। দেখলেই বোঝা যায় অদম্য প্রাণশক্তিতে ভরপুর সুস্থ সবল মানুষ তিনি।
জিল আড়চোখে সাহায্যকারীর দিকে একবার তাকালো। ভদ্রলোকের প্রকৃতির সঠিক হদিশ পাওয়া শক্ত। পরিশ্রমী বয়স পেরিয়ে গেছে মনে হয় পঞ্চাশ। তবে তার দুটো চোখই যেন কেমন কেমন। সর্বদাই যেন একজোড়া তীক্ষ্ণ অনুসন্ধান দৃষ্টি মেলে সকলের ভাবগতিক লক্ষ্য করছেন। কিছুই যেন তার নজর এড়িয়ে যায় না। কি উদ্দেশ্য নিয়ে যে তিনি মঙ্কসওয়েল ম্যানরে এসে উঠেছেন জিল সেই কথাই চিন্তা করছিল। যুদ্ধ শেষ হবার ফলেই হয়তো তাকে সেনাবাহিনী থেকে নিতে হয়েছে অবসর এবং হাতে এখন আর কোনো কাজ নেই।
ঘুম থেকে দেরীতে উঠলেন মিঃ প্যারাভিসিনি। কফি আর এক টুকরো টোস্ট ছাড়া কিছুই খেলেন না তিনি। প্রাতঃরাশেও ইউরোপের স্বভাবজাত মিতব্যয়িতার পরিচয় দিলেন। তবে মলির সঙ্গে প্রথম দর্শনেই তার যেন বিনয়ের বাঁধ ভেঙে গেল। মলিও রীতিমতো অপ্রতিভ হয়ে উঠলো। ভদ্রলোক দু পায়ে ভর দিয়ে ব্যগ্রভঙ্গিতে উঠে দাঁড়িয়ে মাথা নত করে তাকে অভিবাদন জানালেন। বললেন, আসুন আসুন, আমাদের মহীয়সী গৃহকত্রী…সুপ্রভাত! সত্যিই আপনি অসামান্য। বলুন আমি ঠিক বললাম কিনা?
মলি মাথা নেড়ে ইতস্ততঃ ভাবে সায় দিল। প্রকৃতপক্ষে এই প্রসঙ্গ দীর্ঘতর করবার তার কোনো ইচ্ছা ছিল না। এখন ভনিতা করবার মত একচুল সময় নেই।
ভাড়ার ঘরে তদারকি করতে করতে মলি বিড়বিড় করে বলল, আর কেন যে….প্রত্যেকে নিজের খেয়াল খুশিমত প্রাতঃরাশের সময় বেঁধে রাখে ঝক্কি-ঝামেলা সামলানো সত্যি বড় কঠিন কাজ।
মলি ডিসগুলো মুছে রেখে তাড়াতাড়ি সিঁড়ি বেয়ে উঠে এল দোতলায়। তাকে এখন যাবে না। জিল এখন সারা বাড়ির বরফ সাফ করতে ব্যস্ত।
মলি দ্রুত হাতে কাজ সারল। তবে তার মধ্যে যত্নের কোনো অভাব ছিল না। অতিথিদের স্নানঘরে জলের ঠিকমতো সরবরাহ করা হয়েছে কিনা সেদিকেও চোখ দেওয়া প্রয়োজন। মলি এবারে স্নানঘরগুলো ঘুরে দেখতে লাগল। এই সময় বেজে উঠল টেলিফোন। এত কাজের মধ্যে নতুন উপদ্রব যুক্ত হলে স্বভাবতঃই মনটা একটু বিগড়ে যায়। মলির বুকে জমতে শুরু করেছিল বিরক্তি। কিন্তু এই ঘোর দুর্যোগের দিনে টেলিফোনের লাইনটা ঠিক চালু আছে — এই কথা ভেবেও শান্তি পেল সে আবার কিছুটা। মলি যখন ছুটতে ছুটতে লাইব্রেরী ঘরে এসে পৌঁছলো তখন সে রীতিমতো হাঁপাচ্ছে।
সেই অবস্থাতেই তুলে নিলো রিসিভারটা।
হ্যাঁ..বলুন, দূরভাষের অপর প্রান্ত থেকে একটা ভরাট গম্ভীর স্বর ভেসে এলো, মঙ্কসওয়েল ম্যানর…?
হ্যাঁ, এটা মঙ্কসওয়েল ম্যানর অতিথিশালা।
আমি কম্যান্ডর ডেভিসের সঙ্গে কথা বলতে চাই।
অনুগ্রহ করে যদি একটু খবর দেন…
কিন্তু তিনি এখন ফোন ধরবার মতো ফুরসৎ পাবেন কিনা বলতে পারি না। জবাব দিলো মলি।
আমি তার স্ত্রী মিসেস ডেভিস।… আপনি কে কথা বলছেন?
বার্কায়ারের পুলিস-সুপারিন্টেন্টে হবেন।
আচমকা ধাক্কা খেয়ে মলি যেন চমকে উঠলো কিছুটা।
ও…তাই বুঝি..?
শুনুন মিসেস ডেভিস, একটা গুরুতর পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে।
টেলিফোনে অবশ্য সমস্ত ব্যাপারটা খুলে বলতে চাই না, তবে আমি ডিটেকটিভ সার্জেন্ট ট্রেটারকে মঙ্কসওয়েল ম্যানর-এর ঠিকানায় পাঠিয়ে দিয়েছি। যে কোনো মুহূর্তেই ট্রেটার আপনাদের ওখানে পৌঁছে যেতে পারে।
কিন্তু মনে হয় না ভদ্রলোক আসতে পারবেন বলে। পথঘাট সমস্তই বন্ধ হয়ে গেছে বরফে। রাস্তা দিয়ে চলাফেরা করাই দুঃসাধ্য ব্যাপার।
হগবেনের কণ্ঠস্বরে সুগভীর আশ্বাসের ধ্বনি। ট্রেটার যেভাবেই হোক পৌঁছে যাবে। সেজন্য চিন্তা করবেন না। তবে আপনার স্বামীকে জানিয়ে রাখবেন দয়া করে, ট্রেটারের কথা যেন শোনেন মন দিয়ে। এবং সে যা বলবে সেই নির্দেশই যেন মেনে চলেন। ব্যস্ আর কিছু নয়।
কিন্তু সুপরিনটেণ্ডেট হগবেন…. কেনই বা…।
মলি মাঝপথে থেমে গেল। হগবেন ইতিমধ্যে লাইন কেটে দিয়েছেন। তার অর্থ, তিনি বললেন যা এর বেশি তার আর কোনো বক্তব্য নেই। তবুও কয়েক মুহূর্ত বোকার মতন ফোন ধরে দাঁড়িয়ে থাকল। তারপর রিসিভারটা ধীরে ধীরে নামিয়ে রাখল। ইতিমধ্যে দরজা ঠেলে জিল ভেতরে ঢুকে পড়েছে।
মলির বুক থেকে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস পড়ল। সে বলল –যাক তাহলে এসে পড়েছ তুমি।
জিলের লম্বা চুলের ফাঁকে ফাঁকে সাদা বরফ জড়িয়ে আছে। গালে ও কপালে কয়লার কালি। চোখে মুখে রয়েছে ব্যস্ততার ছাপ। বলে উঠল সে –তোমার ব্যাপারটা কি মলি? আমি কয়লার ঝুড়িগুলো সব বোঝাই করে রেখেছি, ঠিকমতো কাঠের ব্যবস্থাও রেখে দিয়েছি। এখন গিয়ে মুরগির ঘরটা দেখতে হবে। তারপর ব্রয়লারটা সুবন্দোবস্ত করতে পারলেই এ বেলার মত আমার ছুটি। কিন্তু তোমাকে যেন কিছুটা চিন্তিত মনে হচ্ছে….
মলি বলল –পুলিস কর্তৃপক্ষ ফোন করেছিলেন, জিল।
জিল অবিশ্বাসের সুরে বলল– পুলিস?
মলি ম্লান মুখে বলল, হ্যাঁ। তারা একজন ইনসপেক্টর না সার্জেন্ট –কাকে যেন এখানে পাঠচ্ছেন।
জিল বলল –কিন্তু কেন? কি আমাদের অপরাধ?
মলি বলল –তা বলতে পারব না। আচ্ছা আমরা যে দুই পাউণ্ড আইরিশ মাখন আনিয়েছি তার জন্যে শুল্কবিভাগ কোনো আপত্তি তোলেনি তো?
জিল ভ্রূ কুঁচকে কিছুক্ষণ চিন্তা করল তারপর বলল –টি.ভি-র লাইসেন্সটা ঠিক সময় রিনিউ করা হয়েছে তো, তাই না?
মলি বলল –হ্যাঁ, হ্যাঁ, সে সমস্ত ঝামেলা অনেক দিন আগেই মিটে গেছে। তবে সামনের বাড়ির বাসিন্দা মিসেস বিভূলকের কাছে আমি আমার পুরনো কোটটা দিয়ে নিয়েছিলেন পাঁচটা রেশনের কুপন। নিশ্চয় সেটা খুব একটা দোষের নয়, কারণ আমি যখন আমার পুরানো কোটটা থেকে বঞ্চিত হচ্ছি তখন পাঁচটা রেশনেরই বা কুপন ভোগ করতে পারবো না কেন?…কিন্তু…কিন্তু…এ ছাড়া কি-ই বা হতে পারে আর? কিছুই বোঝা যাচ্ছে না ঠিক!…
দু-একদিন আগে খুব বড় একটা অ্যাকসিডেন্টর হাত থেকে আমি অল্পের জন্য বেঁচে গিয়েছিলাম। তবে সে ব্যাপারে কোনো দোষ নেই আমার। অন্য গাড়িটাই হুড়মুড়িয়ে আমার গাড়ির ওপর এসে পড়েছিল। এমন কি তার আগে হর্ণ পর্যন্ত দেয়নি।
অপ্রসন্ন সুরে গুণ গুণ করলো মলি, বলল –নিশ্চয় আমরা কিছু একটা করেছি।
আজকাল মুস্কিল হচ্ছে, তুমি যা কিছু করতে যাও সমস্তই বেআইনি। –জিলের গলায় রাগের সুর ছিল। সে আবার বলতে শুরু করল সেইজন্য সব সময়ই নিজেকে কেমন অপরাধী অপরাধী মনে হয়। তবে আমার বিশ্বাস এই অতিথিশালা সংক্রান্তই কিছু হবে। বিনা অনুমতিতে এ ধরনের কোনো ব্যবসা পরিচালনাটাই হয়তো আইনের চোখে দণ্ডনীয় অপরাধ!
আমার ধারণা কেবলমাত্র পানীয় পরিবেশনের ক্ষেত্রেই কিছু কিছু বাধানিষেধ চালু আছে। কিন্তু আমরা তো অতিথিদের টেবিলে কোনোরকম পানীয় সরবরাহ করিনি। তাহলে কেন নিজেদের ইচ্ছেমতো ব্যবসা চালাতে পারব না?
হ্যাঁ, আমি জানি! তোমার কথার মধ্যে যুক্তিও আছে যথেষ্ট। তবে ওই যা বললাম, আজকাল হয়ত সমস্ত ক্ষেত্রেই সরকারী বাধা নিষেধ আরোপ করা হয়েছে।
হায় ভগবান! মলি দীর্ঘশ্বাস ফেললো, কেনই বা মরতে আমরা এই হোটেল খুলে বসতে গেলাম! প্রথম দিনই বরফ চাপা পড়ে — পথঘাট সব বন্ধ হয়ে গেলো। তার ফলে অসময়ের জন্যে যে সমস্ত টিনের খাবার আমরা মজুত করে রেখেছিলাম সে সবই অতিথিরা দুদিনে শেষ করে দেবে।
অল্পেতেই তুমি বেশি নার্ভাস হয়ে পোড়ো না। সান্ত্বনার সুরে জিল বললো, আমাদের হয়তো, এখন কিছুটা দুদিন যাচ্ছে, কিন্তু শীগগিরই দুর্যোগের মেঘ কেটে যাবে। অন্যমনস্ক ভাবে মলির কপালে আলতো করে ঠোঁট ছোঁয়ালো জিল। তাপর একটু থেমে সম্পূর্ণ ভিন্ন সুরে বলে উঠলো, একটা কথা কি জানো মলি, আমার কেবলই মনে হচ্ছে বিষয়টা নিশ্চয় খুব গুরুতর কিছু হবে। তা না হলে খামোকা একজন পুলিস সার্জেন্টকেই বা তারা এখানে পাঠাতে যাবে কেন? চোখ তুলে জানলা দিয়ে বাইরের দিকে ইঙ্গিত করলো জিল, খুব জরুরী কিছু না হলে এমন দিনে…
মলিও কোনো কথা বললো না। দুজনে দুজনের দিকে উল্কণ্ঠিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। ভেজানো দরজা ঠেলে মিসেস বয়েল ভেতরে প্রবেশ করলেন।
এই যে..আপনি এখানে মিঃ ডেভিস? মিসেস বয়েলের কণ্ঠস্বরে সুগভীর কাঠিন্য। ড্রয়িং রুমের তাপচুলল্লীটা যে ঠান্ডা পাথর হয়ে গেছে সে খবর কী আপনার কানে এসে পৌঁছেছে?
আমি খুবই দুঃখিত মিসেস বয়েল। আমাদের কয়লার মজুতটা একেবারে ফুরিয়ে এসেছে, তাই…
মিসেস বয়েল নির্দয় কণ্ঠে মন্তব্য করলেন, কিন্তু আমি সস্তায় সাত গিনি করে দিচ্ছি, সে কথাও ভুলে যাবেন না। সাতসাতটা গিনি! সেটাও নিশ্চয় ঠান্ডায় জমে যাবার জন্যে নয়।
জিল লজ্জিত গলায় বলে উঠল, এক্ষুনি গিয়েই আমি ওটা জ্বালাবার বন্দোবস্ত করে দিচ্ছি।
জিল দ্রুতপায়ে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল। মিসস বয়েল এবার ফিরে তাকালেন মলির দিকে। একটা কথা আপনাকে বলছি বলে কিছু মনে করবেন না মিসেস ডেভিস। তবে এই যে যুবকটি এখানে আছে তার চালচলন খুবই অস্বাভাবিক। তার কথাবার্তা…এমন কি গলায় বাঁধা টাইটা পর্যন্ত…সব কিছুই খুব অদ্ভুত ধরনের। তার ওপর চুলটুল আঁচড়ানোর কোনো অভ্যাসও বোধহয় ওর নেই।
মলি জবাব দিল –কিন্তু যুবকটি তো একজন ভালো স্থপতি।
মাপ করবেন, আপনার কথার অর্থ…
ক্রিস্টোফার রেন একজন স্থপতি, এবং….
মিসেস বয়েল মাঝপথে বাধা দিয়ে বললেন– শুনুন শুনুন, মিসেস ডেভিস স্যার ক্রিস্টোফার রেনের নাম আমি শুনেছি। তিনি যে সত্যই একজন প্রথম শ্রেণীর স্থপতি, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। সেন্টপল ইত্যাদি তাঁর অনেক কীর্তির কথাই সকলের জানা আছে। কিন্তু আপনারা মনে করেন যে দুদিন কোনো আর্ট স্কুলে পড়লেই শিল্পতত্ত্বের সবকিছু অনায়াসে শিখে ফেলা যায়।
আমি এখন এই যুবকটির কথাই বলছি। এর নামও ক্রিস্টোফার রেন। যুবকটির বাপ-মা চেয়েছিলেন বড় হলে তাদের ছেলে একজন নাম করা স্থপতি হবে। সেইজন্যেই ওরকম নামকরণ দেওয়া হয়েছিল এবং তাদের সেই স্বপ্নও প্রায় সত্যি হয়েছে বলা চলে।
মিসেস বয়েল নাক কোঁচকালেন বললেন, তবে আমার কাছে সমস্ত বিষয়টা খুবই সন্দেহজনক বলে মনে হচ্ছে। আমি যদি থাকতাম আপনার জায়গায় তাহলে ছেলেটির সম্বন্ধে রীতিমত খোঁজখবর না নিয়ে ছাড়তাম না। ওর সম্বন্ধে আপনিই বা কতটুকু জানেন?
আপনার সম্বন্ধে যতটুকু জানি ঠিক ততটুকুইমিসেস বয়েল। সেটা হচ্ছে এই যে আপনারা দুজনেই সস্তায় সাত গিনি করে দেবেন। এবং এইটুকু জানলেই চলে যাবে আমার, তাই নয় কি? কারণ সেটাই শুধু আমার জানার বিষয়। সত্যিই আমি আমার অতিথিদের পছন্দ করি কি…মলি চোখ তুলে তাকালেন সোজাসুজি। তারপর বলল–করি না, তাতে কিছু এসে যায় না।
মিসেস বয়েল এবার একটু রেগে গেলেন। বললেন– আপনার বয়স এবং অভিজ্ঞতা, দুটোই খুব কম। সেই কারণে কোনো অভিজ্ঞ ব্যক্তির পরামর্শ গ্রহণ করাই এ ক্ষেত্রে সমীচিন। আচ্ছা, ওই অদ্ভুত-দর্শন বিদেশী ভদ্রলোকটিই বা কে? কখনই বা হাজির হলেন তিনি।
উত্তর দিলেন–মাঝরাতে।
তাই নাকি, ভারি অদ্ভুত তো। কোনো নতুন জায়গায় এসে ওঠবার পক্ষে সময়টা নিশ্চয় উপযুক্ত নয় খুব একটা?
মিষ্টি করে মলি ফোড়ন কেটে বলল–কিন্তু প্রকৃত ভ্রমণকারীকে ফিরিয়ে দেওয়া নীতিবিরুদ্ধ, মিসেস বয়েল। আপনি হয়ত এই আইন সম্পর্কে ঠিক অবহিত নন?
মিসেস বয়েল বললেন–আমার বক্তব্য হচ্ছে, এই যে ভদ্রলোক, প্যারাভিসিনি না কি যেন নাম–খুব সুবিধের বলে…
সাবধান…সাবধান ম্যাডাম। যদি আপনি শয়তানের সম্বন্ধে কোনো মন্তব্য করেন এবং ঘটনাচক্রে সে যদি…
মিসেস বয়েল সামনে ভূত দেখার মতই আচমকা লাফিয়ে উঠল। সাক্ষাৎ শয়তানই যেন এখন তাকে করছে সম্বোধন। নিঃশব্দ পায়ে মিঃ প্যারাভিসিনি যে কখন সেখানে হাজির হয়েছেন দুজনের কারুরই সেটা নজরে পড়েনি এতক্ষণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভদ্রলোক বিনম্রভঙ্গিতে হাত কচলাচ্ছিলেন। তার ঠোঁটের আগায় শয়তান সুলভ কুটিল হাসির উল্লাস।
মিসেস বয়েল বিব্রত ভঙ্গিতে মন্তব্য করে বললেন–আপনি আমায় চমকে দিয়েছিলেন, কখন যে চুপিসারে আমাদের পেছনে এসে দাঁড়িয়েছেন, একেবারে টের পাইনি।
প্যারাভিসিনি জানালেন–হ্যাঁ, আমি নিঃশব্দ পায়েই চলাফেরা করি। কেউ আমার পায়ের আওয়াজ শুনতে পায় না। ব্যাপারটা আমার কাছে খুবই মজার লাগে। তার ফলে কখনো সখনো আমার কানে অপরের আলাপ-আলোচনা এসে পৌঁছায়। তাতেও আমি খুব মজা পাই। একটু থেমে আবার বলতে শুরু করলেন, কিন্তু একবার যানি তা কিন্তু আমি কোনোদিন ভুলি না।
মিসেস বয়েল দ্বিধার সুরে বলে উঠলেন–তা তো বটেই। আমি আমার সাজসরঞ্জাম বোধহয় ড্রেসিংরুমেই ফেলে এসেছি যাই… দ্রুতপায়ে স্থান ত্যাগ করলেন মিসেস বয়েল। মলি কিছুটা বিমূঢ় চোখে বিদেশী ভদ্রলোককে দেখছিলেন। বেশ লাফিয়ে ঝাঁপিয়েই ভদ্রলোক এবার তার দিকে এগিয়ে এলেন।
তিনি বললেন–আমার মহীয়সী গৃহকত্রীকে যেন কিছুটা বিচলিত লাগছে! এর কারণ কি ম্যাডাম? মলি কোনো বাধা দেওয়ার আগেই ভদ্রলোক তার একটা হাত নিজের মুঠোর মধ্যে টেনে নিয়ে তালুর উল্টোদিকে মৃদু চুম্বন এঁকে দিল।
মলি একপা পিছিয়ে গেল। মিঃ প্যারাভিসিনিকে সে সত্যিই পছন্দ করে কিনা এ বিষয়ে সে সম্পূর্ণ নিশ্চিত হতে পারল না। ভদ্রলোকের দুর্বোধ্য বাঁকা চোখে যেন এক পাশবিক লালসার আভাস দেখা যাচ্ছে।
হালকা সুরে মলি জবাব দিল–আজকে সকাল থেকেই নানারকম অশান্তির উপদ্রব দেখা দিয়েছে। হতচ্ছাড়া তুষারপাতই তার প্রধান কারণ।
মিঃ প্যারাভিসিনি মাথা নাড়তে নাড়তে জানলা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে বললেন– হ্যাঁ, তা ঠিক। এই বরফই যত নষ্টের গোড়া, তাই সে কথা অস্বীকার করা যায় না।
আপনি কি বলতে চাইছেন, আমি ঠিক বুঝতে পারছি না!
প্যারাভিসিনি চিন্তান্বিত সুরে জবাব দিল বলল–সেটা খুব অস্বাভাবিক নয়। পৃথিবীতে অনেক কিছুই আছে যা আপনি জানেন না। এবং একটা বিষয় সম্বন্ধে আমি নিশ্চিন্ত অতিথিশালার পরিচালনার ব্যাপারে আপনার খুব একটা অভিজ্ঞতা নেই।
মলির গাল লজ্জায় রাঙা হয়ে উঠল বলল–তা হয়তো সত্যি, তবে আমাদেরও উৎসাহের শেষ নেই। আমরা এর পেছনে লেগে থাকবো স্থির করেছি। প্যারাভিসিনি বললেন– বাহবা…বাহবা। এই তো চাই।
রাঁধুনি হিসাবে আমি মন্দ নই, বলুন? মলির কণ্ঠে উদ্বিগ্নতার সুর চাপা রইলো না।
না না, আপনার রাঁধুনির হাতে জাদু আছে। ঠিক আপনার মতো মোহনীয়।
উৎসাহিত ভাবে সায় দিলেন প্যারাভিসিনি। এই বিদেশীরা কি জঘন্য প্রকৃতিরই না হয়, মনে মনে চিন্তা করলো মলি।
প্যারাভিসিনি যেন মলির মনের কথা বুঝতে পারলেন। সঙ্গে সঙ্গে তার আচার আচরণও সম্পূর্ণ বদলে গেলো। তিনি আবার রীতিমতো গম্ভীর ভাবেই বললেন, আমি কিন্তু একটা বিষয়ে আপনাকে সাবধান করে দিতে চাই মিসেস ডেভিস। আপনারা দুজনে বাইরের লোকদের খুব বেশি বিশ্বাস করবেন না।
এখানে যারা অতিথি আছেন, তাদের সবার পরিচয় কি আপনি জানেন?
এটা কি সত্যিই খুব প্রয়োজনীয়? মলিকে কিছুটা বিচলিত বোধ হতে হলো।
আমার ধারণা, অতিথিরা সাধারণত এমনিই এসে থাকেন… যাকে আপনি ছাদের নিচে আশ্রয় দিয়েছেন, তার সম্বন্ধে যতটা সম্ভব খোঁজখবর নেওয়াই কি সুবিবেচকের পরিচয় নয়?
সামনের দিকে সামান্য ঝুঁকে পড়ে কিছুটা ভয় দেখানো ভঙ্গিতেই মলির কাঁধে দু-একটা টোকা দিলেন ভদ্রলোক। এই যেমন আমার কথাই ধরুন না! মাঝরাতে হুট করে আবার আবির্ভাব ঘটলো। আমি আপনাকে জানালাম, তুষারপাতের ফলে রাস্তার মধ্যিখানে আমার গাড়িটা আটকে পড়েছে। তাহলে প্রকৃতপক্ষে আপনি আমার সম্বন্ধে কতটুকু জানতে পারলেন?
একেবারে কিছুই না। এবং আমার দৃঢ় বিশ্বাস, অন্যান্য অতিথিদের সম্বন্ধেও আপনার অভিজ্ঞতা ঠিক একরকম!
মলি বলল কিন্তু মিসেস বয়েল তো… মলিকে মাঝখানে থেমে যেতে হল। কেননা মিসেস বয়েলই তার বোনার সাজসরঞ্জাম হাতে নিয়ে সেখানে এসে আবার হাজির হলেন।
ভদ্রমহিলা মৃদুস্বরে মন্তব্য করে তাপচুল্লীর পাশে একটা চেয়ারের দিকে এগিয়ে বললেন ড্রয়িংরুমটা বড় বেশি ঠাণ্ডা। তার চেয়ে এখানকার আবহাওয়া অনেক উষ্ণ আছে।
দ্রুত পায়ে মিসেস বয়েলকে অতিক্রম করে সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন প্যারাভিসিনি। তিনি বললেন–যদি ম্যাডাম অনুমতি দেন, আমি আপনার জন্যে তাপচুল্লীর আগুনটা একটু উস্কে দিতে পারি।
মিঃ প্যারাভিসিনির হাঁটাচলার মধ্যে একটা ক্ষিপ্রতাভাব আছে যা সহজেই সবার নজর কাড়ে। গতরাত্রেও তার এই বিশিষ্ট ভঙ্গিটি লক্ষ্য করেছিল মলি। ভদ্রলোক যখন হাঁটু গেড়ে বসে তাপচুল্লীর আগুনটা উস্কে দিতে ব্যস্ত ছিলেন তখন আরো একটা জিনিষ চোখে পড়ল মলির। এই বিদেশী অতিথি সব সময় তার পেছনের অংশটাই আলোর দিকে ফিরিয়ে রাখেন। তার কারণটাও এখন মনে মনে মলি উপলব্ধি করল। প্যারাভিসিনির সমস্ত মুখটাই যেন কৃত্রিমভাবে সৃষ্টি করা হয়েছে।
তাহলে এই ক্লান্তিকর বোকা বুড়োটা বরাবর ছোকরা সেজে থাকবার জন্যেই এমনভাবে ভোল ধরেছে। তবে ভদ্রলোকের উদ্দেশ্য যে সিদ্ধ হয়নি সে কথা বোঝা যায় স্পষ্ট ভাবে। বয়সের ছাপ মুখ থেকে লুকোতে পারেনি। এমন কি সময় সময় প্রকৃত বয়সের অনুপাতে ছাপটা ফুটে উঠেছে একটু বেশি মাত্রায়। কেবলমাত্র হাঁটাচলার মধ্যে যৌবনোচিত ভঙ্গীটুকু কেমন যেন অসঙ্গতিপূর্ণ। মনে হয় একটা সযত্নলালিত কৃত্রিম আবরণ এটা তার।
হন্তদন্ত হয়ে মেজর মেটকাফের আগমনই অনুমান-নির্ভর কাল্পনিক জগৎ থেকে রূঢ় বাস্তবে মলিকে টেনে আনলো। তিনি বলেন–মিসেস ডেভিস, আমার ভয় হচ্ছে… ভয় হচ্ছে… তারপর চারদিকে তাকিয়ে নিজেকে সংযত করে গলার স্বর নামিয়ে মেজর বললেন–নিচের তলায় বাথরুমের জলের পাইপগুলো বোধহয় ঠান্ডায় জমে গেছে।
মলি বিড়বিড় করে বলল–হ্যায় ভগবান! আজকেই একের পর এক যত দুর্ভোগ শুরু হয়েছে। প্রথমে পুলিস,… তারপর এই পাইপ…।।
মিঃ প্যারাভিসিনি রীতিমত শব্দ করে লোহার খোঁচানিটা নামিয়ে রাখলেন পাশে। মিসেস বয়েলের বোনার কাজ হয়ে গেল বন্ধ। অবাক চোখে মলি তাকিয়ে দেখল, মেজর মেটকাফের সারা মুখ থেকে কে যেন রক্ত শুষে নিয়েছে। মুখের মাংসপেশীগুলোও শক্ত হয়ে উঠেছে অদ্ভুতভাবে। ভাবলেশহীন কাঠের মূর্তির মতো এখন যেন তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে।
চকিত সুরে প্রশ্ন করলেন তিনি–পুলিস? আপনি কি পুলিসের কথা বললেন?
মলি মনে মনে বুঝতে পারল, ভদ্রলোকের এই আপাত ভাবলেশহীন মুখের পেছনেই একটা ঘটে চলেছে প্রচণ্ড রকমের আলোড়ন। অথবা তীব্র উত্তেজনাও এর উৎস হওয়া এমন কিছু বিচিত্র নয়। কিন্তু কিছু একটা যে আছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। এই লোকটা…বিড়বিড় করে মলি বলল, আসলে ভয়ঙ্কর প্রকৃতির লোক হতে পারে।
ভদ্রলোক আবার প্রশ্ন করলেন। এবার তার কণ্ঠস্বরে শুধু একটা সামান্য কৌতূহলের সুরই প্রকাশ পেল–পুলিস কেন?
মলি জবাব দিল–দুচার মিনিট আগে পুলিস কর্তৃপক্ষ একটা ফোন করেছিলেন। তারা নাকি একজন সার্জেন্টকে এখানে পাঠাচ্ছেন। এবার তার জানলা দিয়ে বাইরের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ হল। চোখে মুখে দেখা গেল আশার আলো। তিনি বললেন– তবে এই দুর্যোগের মধ্যে তিনি এখানে পৌঁছতে পারবেন বলে আমার বিশ্বাস হয় না।
মলির দিকে আরেক পা এগিয়ে এসে মেজর বললেন–কিন্তু একজন পুলিসকেই বা তারা পাঠাচ্ছে কেন এখানে? মলি জবাব দেবার আগেই দরজা খুলে ভিতরে ঢুকলো জিল।
রাগের সুরে জিল বলল, ওঃ কয়লার চাওড়গুলো যেন বিশমনের ওপর ভারী। তারপর সবার দিকে তাকিয়ে অবাক সুরে প্রশ্ন করল–ব্যাপার কি? সবাইকে এত বিচলিত লাগছে কেন?
মেজর মেটকাফ তার দিকে এবার ঘুরে দাঁড়ালেন। বললেন– শুনলাম, এখানে নাকি পুলিস আসছে। এর কারণ কি?
মাথা নেড়ে জিল বলল–তাতে ব্যস্ত হওয়ার কিছু নেই। কেউই এসে পৌঁছতে পারবে না এখানে। বরফ এখন পাঁচফুট উঁচু। সমস্ত পথঘাট বরফের তলায় চাপা পড়ে গেছে। সবরকম যানবাহন এখন বন্ধ।
সেই মুহূর্তে জানলার সার্শিতে কেউ ঠকঠক করে যেন শব্দ করল। শব্দটা পরিষ্কার শোনা গেল। প্রথমেই এক্সঙ্গে ঘরের প্রত্যেকেই চমকে উঠল। প্রথমে কেউই বুঝতে পারল না শব্দটা কোথা থেকে ঠিক আসছে। একটা অদৃশ্য ভৌতিক সঙ্কেতের মতো মনে হল।
তারপরই মলি গরাদহীন বড় ফ্রেঞ্চ জানলাটার দিকে ইঙ্গিত করে চেঁচিয়ে উঠল। একজন লোক বাইরে দাঁড়িয়ে সার্শির ওপর টোকা দিচ্ছে। লম্বা কাঠের স্কী জুতো পায়ে আছে বলেই যে তার পক্ষে বরফ ভেঙ্গে এতদূর আসতে পেরেছে সে রহস্যটা বুঝে নিতে অসুবিধা হয় না।
জিল বিস্ময়সূচক অস্ফুট একটা শব্দ করেই দ্রুত এগিয়ে এসে ছিটকিনিটা খুলে দিল।
আগন্তুক ঘরের মধ্যে ঢুকেই জিলকে অভিবাদন করে বলল–ধন্যবাদ স্যার, আমি ডিটেকটিভ সার্জেন্ট ট্রেটার। তার চোখে মুখে উজ্জ্বল তারুণ্যের দীপ্তি। সকলের দিকে একবার চোখ তুলে তাকিয়ে নিজের পরিচয় তিনি নিজেই দিলেন।
মিসেস বয়েল তার বোনা বন্ধ করে একটু নড়েচড়ে বসলেন। তারপর মৃদু প্রতিবাদের ভঙ্গিতে বলল–আপনাকে দেখে তো ঠিক সার্জেন্ট বলে মনে হয় না। বয়স যেন খুবই কম।
ভদ্রলোক বয়সে যদিও নিতান্তই নবীন তবুও এই মন্তব্য শুনে রীতিমত অপমানিত বোধ করলেন। তার উত্তরের মধ্যে রাগের আভাস ফুটে উঠল–আমাকে দেখে যতটা অল্পবয়সী মনে হয়, আসলে কিন্তু ততটা ছেলেমানুষ আমি নই ম্যাডাম।
আগন্তুক ভদ্রলোক আরেকবার সকলের দিকে তাকিয়ে জিলের দিকে শেষে তার দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখলো। তারপর বলল।–আপনিই তো মিঃ ডেভিস, তাই না? আমি আমার ধরাচুড়ো সব খুলে কোথাও রেখে দিতে চাই!
হা… নিশ্চয়। আমার সঙ্গে আসুন…।
জিল আগন্তুককে ডেকে নিয়ে ভেতরে চলে যাবার পর মিসেস বয়েল রুক্ষ্ম ব্যাজার মুখে মন্তব্য করলেন–এই জন্যেই আমরা সরকারকে পুলিস পোষবার ট্যাক্স গুণে দিই। আর এদিকে বেতনভুক পুলিস কর্মচারীরা বরফের ওপর শীতকালীন খেলাধুলা এবং আমোদ প্রমোদ নিয়ে ব্যস্ত।
মলির মুখোমুখি এবার দাঁড়ালেন প্যারাভিসিনি। তাঁর কণ্ঠস্বরে এবার ক্রুদ্ধ মাপের গর্জন শোনা গেল। কেন আপনি পুলিস ডেকে পাঠিয়েছেন মিসেস ডেভিস?
প্যারাভিসিনির এই রক্তবর্ণ মূর্তির সামনে দাঁড়িয়ে কয়েক মুহূর্ত বিভ্রান্ত হয়ে পড়ল মলি। ভদ্রলোকের এ চেহারা যেন সম্পূর্ণ নতুন। একটা ভয়ের ছায়া ঘনিয়ে উঠল বুকের মধ্যে তার। অসহায় ভাবে জবাব দিল–কিন্তু…আমি তো ডেকে পাঠাইনি ওদের…
মলির কথা শেষ হতে না হতেই উত্তেজিত ভঙ্গিতে ক্রিস্টোফার রেন ঘরে এসে দাঁড়ালেন। তার কণ্ঠস্বরে তীক্ষ্ণ প্রশ্নের খোঁচা, বড় হলঘরটায় যে ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে আছেন উনি কে? কোথা থেকেই বা উনি হাজির হলেন? এদিককার রাস্তাঘাট তো সব বন্ধ।
এ প্রশ্নের জবাব দিলেন মিসেস বয়েল। তার কণ্ঠে ক্ষোভ ও ভর্ৎসনা দুয়ের মিল। তিনি বললেন–বিশ্বাস করুন বা না করুন, সে আপনার খুশি–তবে এই ভদ্রলোক একজন পুলিস কর্মচারী। ব্যাপারটা একবার ভেবে দেখবেন। কর্তব্যরত পুলিস কর্মচারী স্কী পায়ে দিয়ে মাঠে ময়দানে ঘুরে বেড়াচ্ছে!…
সরকারী কর্মচারীরা আজকাল কিভাবে ফাঁকিবাজ ও উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে সেই কথাটা ভালো করে বুঝিয়ে দেওয়াই যেন এই বক্তব্যের মূল উদ্দেশ্য। মেজর মেটকাফ মৃদুসুরে মলিকে প্রশ্ন করলেন, মাপ করবেন মিসেস ডেভিস, আমি কি এখানকার ফোনটা একবার ব্যবহার করতে পারি।
হা হা, যতবার খুশি!
এতে অনুমতি নেবার কোনো প্রয়োজন নেই! ফোনের দিকে এগিয়ে গেলেন মেজর।
ক্রিস্টোফার রেনের তীক্ষ্ণকণ্ঠ মন্তব্যও তার কানে এলো। ভদ্রলোকের চেহারাটা ভারী সুন্দর।
আপনারাও কি তাই মনে হয় না?
অবশ্য প্রত্যেক পুলিস কর্মচারীই কমবেশি স্মার্ট ও হ্যাণ্ডসাম।
হ্যাল্লো …হাল্লো…, রিসিভারটা তুলে নিয়ে দুচার মুহূর্ত নাড়াচাড়া করলেন মেজর, তারপর মলির দিকে ফিরে তাকালেন।
মিসেস ডেভিস, আপনার ফোনটা তো অচল হয়ে পড়ে আছে! নিশ্চয় কোথাও লাইনের কিছু গণ্ডগোল হয়েছে।
কিন্তু এতক্ষণ তো লাইন ঠিকই ছিলো। এইমাত্র.. ক্রিস্টোফার রেনের উচ্চকণ্ঠ সুরেলা হাসিই তাকে মাঝপথে থামিয়ে দিলো।
বিকারগ্রস্ত রুগীর মতোই হাসতে লাগলেন ভদ্রলোক। অবশেষে বাইরের পৃথিবীর সঙ্গে আমাদের সবরকম যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হলো। হাসির ফাঁকে ফাঁকেই সরস ভঙ্গিতে মন্তব্য করলেন তিনি, ব্যাপারটা খুবই মজার…ভারি মজার….
কিন্তু এতে এত হাসির কি ব্যাপার ঘটলো কিছুই আমার মগজে ঢুকছে না। মেজরের কণ্ঠস্বরে কাঠিন্যের আভাস।
হ্যাঁ, ঠিকই তো। মিসেস বয়েলও সায় দিলেন মাথা নেড়ে। ক্রিস্টোফারের হাসি তখনও থামেনি।
না না, আপনারা কিছু মনে করবেন না। এটা আমার একটা ব্যক্তিগত রসিকতা। …চুপ…চুপ… ঠোঁটের ওপর তর্জনী রাখলেন তিনি, গোয়েন্দাপ্রবর এদিকেই আসছেন।
জিলের সঙ্গে সঙ্গেই সার্জেন্ট ট্রেটার হাজির হলেন। ভদ্রলোক এখন তার বদখদ স্কী দুটোর হাত থেকে মুক্তি পেয়েছেন।
শুভ্র তুষারের কুচিগুলোও ঝেড়ে ফেলেছেন গা থেকে। তার হাতে ধরা একটা লম্বা নোট বই আর পেনসিল। চালচলনে সুগভীর পুলিস গাম্ভীর্যটুকুও ফুটে উঠেছে নিখুঁত ভাবে।
মলি, জিলের কণ্ঠে ব্যস্ততার আভাস, সার্জেন্ট ট্রেটার আমাদের সঙ্গে আলাদা ভাবে দু একটা কথা বলতে চান।
দুজনকে অনুসরণ করে মলি ঘরের বাইরে এসে দাঁড়ালো। জিলই তাদের পথ দেখিয়ে স্টাডিরুমের দিকে নিয়ে গেলো। বড় হলঘরটার ঠিক পেছনেই সাজানো-গোছানো ছোট আকারের স্টাডিরুম। সকলে ভেতরে ঢোকবার পর বাইরেটা একবার দেখে নিয়ে সন্তর্পণে দরজা ভেজিয়ে দিলেন ট্রেটার।
আমাদের অপরাধটা কি সার্জেন্ট…?
মলি আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলো না। একরাশ উৎকণ্ঠাই ঝরে পড়লো তার কণ্ঠস্বরে। অপরাধ! সার্জেন্ট ট্রেটার কয়েক মুহূর্ত অপলক দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে রইলেন। ধীরে ধীরে তার ওষ্ঠাধরে চওড়া হাসি ফুটে উঠলো। না না, আপনারা সম্পূর্ণ ভুল বুঝেছেন। এই ভুল বোঝাবুঝির জন্যে আমি দুঃখিত। কিন্তু প্রকৃত ঘটনাটা একেবারেই আলাদা।
এটাকে এক ধরনের পুলিসি সাহায্যও বলা যেতে পারে। আমার আগমনের তাই হল মূল উদ্দেশ্য।
এবারেও সার্জেন্টের বক্তব্য তাদের বোধগম্য হয়েছে বলে মনে হয় না। দুজনেই তাকিয়ে রইল অবাক দৃষ্টিতে আগন্তুকের মুখের দিকে।
ট্রেটার আবার বলতে শুরু করলেন মিসেস লিয়ন মিসেস মউরীন লিয়নের নাম ইতিমধ্যে নিশ্চয় আপনারা শুনে থাকবেন? দুদিন আগে লণ্ডনের এক ভাড়াটে ফ্ল্যাট বাড়িতে ভদ্রমহিলা খুন হয়েছেন।
মলি মাথা নেড়ে বলল–হ্যাঁ।
ট্রেটার বলল–আমার প্রথম প্রশ্ন হচ্ছে, এই ভদ্রমহিলা কি আপনাদের পরিচিত ছিলেন? জিল বিড়বিড় সুরে বলল–না আগে কোনোদিন এর নাম পর্যন্ত আমরা শুনিনি। মলিও সেই কথায় সায় দিল।
ট্রেটার শান্ত গলায় বলল–আমাদেরও ধারণা সেইরকম। তবে মহিলাটির আসল নাম মনে হয় লিয়ন ছিল না। পুলিসের রেকর্ড বইয়ে আঙুলের ছাপ দেখে প্রকৃত সত্যটা জানা গেছে। তার আসল পদবী হচ্ছে গ্রেগ। মউরীন গ্রেগের মৃতস্বামী জন গ্রেগ ছিলেন একজন কৃষক। তাই হাতে তৈরি লরিজ ফাটাও। ফার্মটাও এখান থেকে বেশি দূরে নয়। নামটাও হয়তো আপনার এবং আপনাদের কাছে পরিচিত।
পড়ার ঘরের ভেতর একটা থমথমে পরিবেশ। কেবল ছাদ থেকে বাইরের উঠোনে বরফ ঝরে পড়ার টুপটাপ শব্দই মাঝে মাঝে এই মৌনতা ভেঙ্গে দিয়েছে। এই শব্দটার মধ্যেও কেমন এক ধরনের অশুভ অশরীরী সঙ্কেত।
ট্রেটার কোনো উত্তর না পেয়ে মুখ খুললেন। বললেন–তিনটে অনাথ শিশুকে এই ফার্মে রেখে মানুষ করার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। তাদের সরকারই খরচ জোগাতেন। এসব ১৯৪০ সালের ঘটনা। অল্প কয়েকদিন পর এদের একটি ছেলে মারা যায়। অত্যাচার এবং অবহেলাই যে ছেলেটির মৃত্যুর কারণ, সেটাও জানাজানি হতে দেরি হয়নি বিশেষ। অনেক পত্রপত্রিকাতেও ব্যাপারটা নিয়ে খুব লেখালেখি হয়েছিল। তার ফলেই আদালতের বিচারে জন আর মউরীনের যাবজ্জীবন জেল হয়ে যায়। কারাবাসের অল্প কিছুক্ষণকালের পর জন পুরনো একটা গাড়ি চুরি করে জেল থেকে পালিয়ে গিয়েছিল কিন্তু নিজের নিয়তিকে এড়াতে পারেনি। পালাবার পথেই বেচারা মোটর দুর্ঘটনায় প্রাণ হারায়। মাস দুয়েক আগে মউরীনের মেয়াদ শেষ হয়ে যায়।
জিল প্রশ্ন করল, তিনিই কি সম্প্রতি খুন হয়েছেন? এটা কার কীর্তি বলে আপনারা সন্দেহ করছেন?
উত্তর দেবার জন্য কোনোরকম ব্যস্ততা দেখা গেল না ট্রেটারের মধ্যে। তিনি তার নিজের প্রশ্নেই অবিচল। তিনি বললেন–লরিজের ঘটনাটা নিশ্চয় আপনাদের মনে আছে?
জিল ঘাড় নাড়ল। সে বলল–১৯৪০ সালের কথা বলছেন? আমি তো তখন জাহাজে চাকরি নিয়ে ভূমধ্যসাগরের বুকের ওপর ঘুরে বেড়াচ্ছি। পৃথিবীর সঙ্গে তখন আমার খুব একটা যোগাযোগ ছিল না।
ট্রেটার এবার প্রশ্নভরা দৃষ্টিতে মলির দিকে ফিরে তাকালেন। আমতা-আমতা করে মলি বলল –আমার… আমার অবশ্য কিছু কিছু মনে পড়ছে। কিন্তু আপনিই বা সে বিষয়ে প্রশ্ন তুলছেন কেন? তার সঙ্গে আমাদের সম্পর্কই বা কি?
আপনার সামনে মস্ত বিপদ, মিসেস ডেভিস। এই মুহূর্তে নিরাপত্তার একান্তই প্রয়োজন।
জিলের কণ্ঠে শোনা গেল অবিশ্বাসের সুর। বলল–বিপদ…কিসের বিপদ?
ট্রেটার বলল–তাহলে সমস্ত ঘটনাটা শুনুন মন দিয়ে। মিসেস লিয়ন যেখানে খুন হন সেই অকুস্থলের কাছেই পাওয়া গেছে একটা নোটবই। তার মধ্যে লেখা ছিল দুটো ঠিকানা। তার মধ্যে একটা হচ্ছে চুয়াত্তর নম্বর কার্লভার স্ট্রীট।
মলি তীক্ষ্ণ স্বরে প্রশ্ন করল–ওই ফ্ল্যাট বাড়িতেই তো ভদ্রমহিলা খুন হয়েছেন, তাই না?
তরুণ সার্জেন্ট আত্মগত ভঙ্গিতে মাথা দুলিয়ে বললেন, অন্য ঠিকানাটা হচ্ছে মঙ্কসওয়েল ম্যানর।
মলি দু চোখ বিস্ময় মেশানো দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল–কি বললেন..মঙ্কসওয়েল ম্যানর। কিন্তু সমস্তটাই কেমন যেন অবিশ্বাস্য!
সেইজন্যেই সুপারিন্টেন্টে হগবেন আমাকে এখানে পাঠিয়ে দিলেন এত তাড়াতাড়ি। এই ঘটনার সঙ্গে আপনাদের কোনো যোগাযোগ আছে কিনা সেটাই এখন জানার বিষয়।-ট্রেটার কথাগুলো বলে ফেললেন।
জিলের কণ্ঠে অকপট অভিব্যক্তি শোনা গেল–কোনো সম্পর্ক নেই। কোনো সম্পর্কের আভাস পর্যন্ত নেই। এটা হয়ত কোনো কাকতালীয় ব্যাপার।
শান্ত স্বরে ট্রেটার উত্তর দিলেন-সুপারিন্টেন্টে এই ব্যাপারটাকে এত তুচ্ছ বলে মনে করে না। তার মতে এ ব্যাপারে সাধ্যমত ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। আর যেহেতু বরফের ওপর স্কী পায়ে দিয়ে হাঁটা-চলা করতে আমি বিশেষ অভিজ্ঞ সেজন্য আমাকেই প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিয়ে পাঠালেন। আমি এখানকার সমস্ত তথ্য সংগ্রহ করে তার সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করব। সকলের নিরাপত্তার জন্যও যথাসাধ্য তিনি ব্যবস্থা নেবার নির্দেশ দিয়েছেন।
জিল জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে ফিরে তাকিয়ে বলল–নিরাপত্তা…? হায় ভগবান! আপনি কি মনে করেন কারুর এখানে খুন হওয়ার আশঙ্কা আছে?
ট্রেটার বিনীত কণ্ঠে বললেন–আমি আপনাদের বিচলিত করতে চাই না। তবে সুপরিনটেন্ডেট হগবেন সেই রকম একটা কিছুর আশঙ্কা করছেন।
জিল প্রশ্ন করল–কিন্তু কেনই বা…
মাঝপথে জিলকে থামিয়ে দিয়ে ট্রেটার বলল– সেই কারণটার খোঁজেই আমি এখানে এসেছি।
তবে সমস্ত ব্যাপারটাই কেমন যেন উদ্ভট।
হ্যাঁ তা ঠিক, তবে উদ্ভট বলেই বেশি বিপজ্জনক হয়ত!
মলি এবার মন্তব্য করল, বলল, আমার বিশ্বাস, আপনি নিশ্চয় সমস্ত ব্যাপারটা এখনো আমাদেরকে খুলে বলেননি। কিছু একটা বাকি থেকে গেছে!
ট্রেটার বলল– হ্যাঁ ম্যাডাম, আপনার অনুমান অভ্রান্ত। নোটবইয়ে ঠিকানা লেখা পাতাটার উপর দিকে ছেলে ভুলানো একটা ছড়ার লাইন লেখা ছিল। তিনটে ইঁদুর অন্ধ। নিহত মহিলার পেপাশাকের সঙ্গেও পিন দিয়ে একটা আটকানো কাগজের টুকরো পাওয়া গেছে। তাতে লেখা আছে– এই প্রথম এবং কাগজটার নিচের অংশে তিনটে ইঁদুরের ছবি আঁকা। ছবির তলায় ওই ছড়াটার প্রথম দুলাইনের স্বরলিপি।
ঘুম পাড়ানি মৃদুস্বরে মলি বিড়বিড় করল।
তিনটে ইঁদুর অন্ধ।
জানলা কপাট বন্ধ
বন্ধ ঘরে তারা।
ছুটতে ছুটতে সারা….
আচমকা বন্ধ হয়ে গেল তারা। সত্যিই কি ভায়বহ– কি বীভৎস ব্যাপারটা! তিনটে অনাথ শিশু ছিল, তাই বললেন না?
হ্যাঁ তিনজন, একটি পনেরো বছরের ছেলে, আর একটি চোদ্দ বছরের মেয়ে আর একটি বারো বছরের ছেলে। এই ছেলেটিই মারা গিয়েছিল শেষ পর্যন্ত।
কি ঘটলো অন্য দুজনের ভাগ্য?
যতদূর খোঁজ পাওয়া গেছে, প্রৌঢ় দম্পতির এক নিঃসন্তান মেয়েটিকে নিজেদের পালিতা কন্যা হিসেবে গ্রহণ করেছিল। আমরা এখনও পাইনি সঠিক সন্ধান। অন্য ছেলেটির তেইশ বছর হবে এখন। আমরা তারও কোনো খোঁজ জানি না। তবে ছেলেবেলা থেকেই অদ্ভুত প্রকৃতির ছেলেটা ছিল। সেনা বিভাগে যোগ দেয় আঠারো বছর বয়সে, এবং বছর খানেক বাদেই সে নিরুদ্দেশ হয় সেনাবাহিনী ছেড়ে। সেনাবাহিনীর চিকিৎসক খুব জোরের সঙ্গেই বলেছিলেন: ছেলেটার মানসিক গঠন স্বাভাবিক নয়।
জিল প্রশ্ন করল– তাহলে আপনি কি মনে করেন সেই ছেলেটিই মিসেস লিয়নের হত্যাকারী? আর যেহেতু সে একজন বিকৃত মস্তিষ্কের, কোনো অজ্ঞাত কারণে সেইজন্যে এখানেও এসে পড়তে পারে সশরীরে?
আমাদের বিশ্বাস, এখানকার কোনো একজন বাসিন্দার সঙ্গে ওই মামলার কোনো সংযোগ আছে লঙরিজ ফার্মের সঙ্গে। এই যোগসূত্রটা জানতে পারলে বিষয়টা সহজ হয়ে আসত অনেকটা। এই যোগসূত্রটার সঙ্গে আপনার কোন যোগাযোগ নেই তাহলে মিঃ ডেভিস, মিসেস ডেভিস, আপনার কি এই একই বক্তব্য?
মলি বলল- আমি! ও…হ্যাঁ, নিশ্চয়…
এখানে কে কে অতিথি আছেন আর?
নামগুলো মলি একে একে বলে গেল। মিসেস বয়েল, মেজর মেটকাফ, মিঃ ক্রিস্টোফার রেন এবং মিঃ প্যারাভিসিনি। সমস্ত কিছুই ট্রেটার নোটবই খুলে লিখলেন।
ট্রেটার জিজ্ঞেস করলেন : চাকর-বাকর?
মলি জবাব দিল- আমাদের কোনো কাজের লোক নেই। এই দেখ, অনেকক্ষণ আগে আলুগুলো উনুনে চড়িয়ে এসেছিলাম সেদ্ধ করার জন্য, বেমালুম ভুলে গেছি সে কথাটাই। ভাগ্যিস মনে পড়ল আপনি চাকর-বাকরদের প্রসঙ্গটা তুললেন বলে।
দ্রুত পায়ে মলি বেরিয়ে গেল পড়ার ঘর ছেড়ে।
জিলের দিকে তাকিয়ে ট্রেটার প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলেন–এই সমস্ত অতিথিদের সম্বন্ধে আপনি কি জানেন?
জিল ইতঃস্তত সুরে বলল– আমি…মানে আমরা…সত্যি বলতে কি, এদের সম্বন্ধে আমাদের খুবই সীমিত জ্ঞান। মিসেস বয়েল বোর্নমাউথের এক হোটেল থেকেই চিঠি পাঠিয়েছিলেন আমাদের এখানে। মেজর মেটকাফ লিমিংটন থেকে এসেছেন। কেনসিংটনের একটা প্রাইভেট হোটেলে থাকতেন মিঃ রেন। একমাত্র প্যারাভিসিনিই যেন আকাশ থেকে এসে পড়লেন। কিংবা বলা যেতে পারে বরফের জটিল আস্তরণ ভেদ করেই আবির্ভাব হয়েছিল তার। ভদ্রলোকের গাড়িটা আটকে পড়েছিল মাঝরাস্তায় বরফে।…তবে আমরা ধারণা, প্রত্যেক অতিথিই তাদের পরিচয়পত্র বা ওই জাতীয় কিছু নিশ্চয় সঙ্গে করে নিয়ে এসেছেন।
ট্রেটার বললেন–হ্যাঁ, সেই সমস্ত ব্যাপারে আমি ঠিকসময়ে খোঁজখবর নেব।
জিল সহজ কণ্ঠে মন্তব্য করল– তবে একদিক দিয়ে আমাদের ভাগ্য ভালো। এই প্রচণ্ড দুর্যোগের মধ্যে সহজসাধ্য হবে না খুনীর আবির্ভাব।
ট্রেটার বললেন- হয়তো তার প্রয়োজন নেই আর মিঃ ডেভিস। জিল বড় বড় চোখে চেয়ে রইল। তারপর বলল– তার মানে? আপনি কি…?
দুদিন আগে মিসেস গ্রেগ মারা গিয়েছেন। আপনার প্রত্যেক অতিথি তো উপস্থিত হয়েছেন তারপরে, তাই নয় কি?
তা অবশ্য ঠিক। কিন্তু একমাত্র মিঃ প্যারাভিসিনি ছাড়া প্রত্যেকেই তো আগে থেকে বুক করে রেখেছিলেন খবর দিয়ে।
সার্জেন্ট ট্রেটার গভীর নিঃশ্বাস ফেলেন একটা। তার কণ্ঠস্বরেও যেন একটা ক্লান্তির ছাপ। তিনি বললেন– এই খুনগুলোও আগে থেকেই ঠিক করা ছিল।
খুনগুলো সম্বন্ধে আপনি কি বলতে বা বোঝাতে চাইছেন? আমি তো একটা খুনের কথাই জানি। আরও খুনের সম্বন্ধে বা আপনি কিভাবে এতটা নিশ্চিত হচ্ছেন?
ট্রেটার বলল– কথাটা আপনি একপক্ষে ঠিকই বলেছেন। আগামী খুনটা আমর উচিত ছিল প্রতিরোধ করা। অন্ততপক্ষে তার জন্য চালিয়ে যাওয়া উচিত প্রচেষ্টা!
জিলের চোখমুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল উত্তেজনায়। সে বলল– তবে…তবে আপনার আশঙ্কা সত্যি হয় যদি, এখানে একজন অতিথির সঙ্গেই ওই ছেলেটির বয়স মিলে যায় খুব। তিনি হলেন ক্রিস্টোফার রেন।
স্টাডিরুম থেকে সার্জেন্ট বেরিয়ে রান্নাঘরের দিকে এগোলেন।
ট্রেটার বলল–মিসেস ডেভিস, আপনি আমার সঙ্গে একবার লাইব্রেরী ঘরে এলে আমি খুব খুশি হব। আমি সকলের সামনে বক্তব্য রাখতে চাই কতগুলো। অতিথিদের খবর দেবার জন্য মিঃ ডেভিসকে আমি পাঠিয়ে দিয়েছি।
ওয়ালটার র্যালে কি কুক্ষণেই যে এই বস্তুটির অবিষ্কার করেছিলেন, সেই কথা ভাবলেই আমি অবাক হয়ে যাই মঝে মধ্যে!
সার্জেন্ট ট্রেটার রসিকতাটি ঠিকমতো বুঝতে পারল না। তার মুখ ব্যাজার হয়ে এল বিরক্তিতে। মলিও নিজেকে সামলে নিল। কণ্ঠে ক্ষমা প্রার্থনার বিনীতভঙ্গি। সে বলল– আমি যেন এখনও ব্যাপারটা বিশ্বাস করতে পারছি না সম্পূর্ণভাবে।…ভাবতে গেলে এত অবাস্তব বলে মনে হয়…
এর মধ্যে অবাস্তবতা বলে কিছু নেই, মিসেস ডেভিস। সমস্তটাই যেন নিখুঁত পরিকল্পনা।
মলি জিজ্ঞাসার সুরে বলল- আচ্ছা লোকটার চেহারার বিবরণ নিশ্চয়ই আপনারা জানতে পেরেছেন?
ট্রেটার বলল- উচচতা মাঝারি, স্বাস্থ্যও খুব ছিপছিপে। গায়ে গাঢ় কালো রঙের ওভারকোট, বেশির ভাগটা মাফলারে ঢাকা। নিশ্চয় আপনি বুঝতে পারেন, যে কোনো সাধারণ লোকের চেহারার সঙ্গে এ বর্ণনা সম্পূর্ণ মিলে যায়। কিছুক্ষণ থেমে ট্রেটার বললেন আপনাদের বড় হলঘরটাতেও তো আমি তিনটে কালো ওভারকোট আর তিনটে হাল্কা বাদামী টুপি দেখলাম।
কিন্তু লণ্ডন থেকে তো কেউই আসেননি এখানে?
ট্রেটার বললেন– সত্যিই কি তাই, মিসেস ডেভিস? তারপরেই ট্রেটার দ্রুত পায়ে এগিয়ে গিয়ে কোণের দিকে বড় টেবিল থেকে একটা খবরের কাগজ নিয়ে বললেন- এটা হচ্ছে উনিশে ফেব্রুয়ারীর ইভনিং স্ট্যাণ্ডার্ড। অর্থাৎ দুইদিন আগের লণ্ডনের সংস্করণ। নিশ্চয় পত্রিকাটি কেউ এখানে নিয়ে এসেছেন– তাই না?
মলি চোখদুটো বড় বড় করে তাকিয়ে বলল– কি আশ্চর্যের ব্যাপার। কোথা থেকেই বা এখানে এটা আসতে পারে। মনের অবচেতনে অস্পষ্ট এক স্মৃতির অনুরণন ঘটল তার।
ট্রেটার বললেন– লোকের মুখের কথাই সব সময় ঠিক বলে জেনে নেওয়া উচিত নয়। তাছাড়া যে সমস্ত অতিথিদের আপনি আশ্রয় দিয়েছেন এখানে তাদের সম্বন্ধে প্রায় কিছুই জানেন না আপনি একটুখানি থেমে ট্রেটার আবার বললেন আমার ধারণা, ব্যবসার ক্ষেত্রে দুজনেই একবারে আপনারা নবাগত।
ঘাড় নেড়ে মলি সায় দিয়ে বলল– হ্যাঁ আপনি ঠিকই ধরেছেন। এই মুহূর্তে তার নিজেকে আরো বেশি অনভিজ্ঞতা আর বেশি ছেলেমানুষ বলে মনে হচ্ছে।
ট্রেটার বলল- আপনাদের বিয়েটা খুব বেশিদিন হয়নি বলে মনে হচ্ছে।
মলির গলায় লজ্জার সুর ফুটে উঠল। সে বলল– সবে এক বছর এবং সেটাও ছিল খুব হঠাৎ!
অনুকম্পার ভঙ্গিতে ট্রেটার বলল– প্রথম দর্শনেই প্রেম, ওই জাতীয় কিছু তাই তো?
এ ধরনের ব্যক্তিগত ব্যাপারে নাকগলার জন্য মলি জানাতে পারল না কোনো তিরস্কার। শান্তভাবে মাথা দুলিয়ে বলল- হ্যাঁ। তারপর হারানো আত্মবিশ্বাস ফিরে পাওয়ার জন্য দৃঢ় স্বরে বলল– বিয়ের আগে পনের দিনের পরিচয় আমাদের।
বিয়ের আগের উজ্জ্বল স্মৃতিতে তার চোখ দুটো আনন্দে নেচে উঠল। মধুর আবেশে তার বুকটা ভরে উঠল। তারা দুজনেই দুজনকে চেনে, জানে, এর মধ্যে কোনো ভুল নেই। দুঃখ দুর্দশায় ভরা পৃথিবীর বুকের ওপর তাদের দুজনের এই সাক্ষাৎটা খুব আশ্চর্যের হওয়াই স্বাভাবিক। একে অন্যের হৃদয়ে কি গভীর সুখই না বয়ে চলে। নিজের অজান্তেই একটা পাতলা হাসির রেখা সারা মুখে ছড়িয়ে পড়ল।
চমকে উঠে মলি নিজেকে সংযত করল। সার্জেন্ট ট্রেটার বেশ প্রশ্রয়পূর্ণ দৃষ্টিতেই তাকে দেখছিলেন?
ট্রেটার জিজ্ঞেস করলেন– আপনার স্বামী এ অঞ্চলের নিশ্চয় বাসিন্দা নন।
মলি হালকা ভবে মাথা নেড়ে বলল–না, ওর বাড়ি লিঙ্কনশায়ারে।
মলি জানালো তবে জিল ছেলেবেলায় কোথায় কিভাবে মানুষ হয়েছে তা সে জানে না, জিলের বাবা-মা এখন আর বেঁচে নেই– এইটুকুই সে জানে আর পুরনো দিনের কথা উঠলেই এড়িয়ে যায় জিল। মলির ধারণা, জিল খুব অসুখী ছিল ছেলেবেলায় তাই সেদিনগুলোকে সে ভুলে হকতে চায়।
ট্রেটার আবার মুখ খুললেন– কিছু মনে করবেন না, তবে হোটেল ব্যবসা চালাবার পক্ষে আপনাদের খুব অল্প বয়স।
বেশ! এ ব্যাপারে সে সম্বন্ধে কোনো রারি বিধিনিষেধ আছে কি? আর তাছাড়া বয়স বাইশ বছর হতে চলল আমার।
ট্রেটার আনন্দ মনে মহা দুলিয়ে বলল– হ্যাঁ, তাহলে মিসেস ডেভিস, আপনি নিশ্চয় এর জন্য প্রস্তুত? সার্জেন্ট ট্রেটার লাইব্রেরী ঘরে পা রাখতে না রাখতে সবাই যে যার বক্তব্য পেশ করতে ব্যস্ত হয়ে উঠল।
ক্রিস্টোফার রেনের তীক্ষ্ণ গলাই প্রথমে তীরের মত বিদ্ধ করল কানে। তিনি যে এই বিষয়ে কিছুটা উত্তেজিত হয়ে উঠেছেন এবং রাতভোর তিনি যে আজ দু-চোখের পাতা এক করতে পারেননি সেই কথাই বললেন তিনি দৃঢ়স্বরে। আনুপূর্বিক সমস্ত বৃত্তন্ত শোনার জন্যও তার আগ্রহ কিছুমাত্র কম দেখা গেল না।
মিসেস বয়েলের মেদবহুল গলা ভেদ করে একথা চাপা ক্রদ্ধ ঘরঘরে আওয়াজ বের হল। অপদার্থ। সম্পূর্ণ অপদার্থ! এইভাবে একজন খুনে পাগলকে রাস্তায় চলাফেরা করতে দেওয়া যে কতটা বিপজ্জনক তা দায়িত্বজ্ঞান পুলিস কর্তৃপক্ষের বোঝা উচিত।
মিঃ প্যারভিসিনি স্বগতোক্তির সুরে হাত নেড়ে বলল। কিন্তু অঙ্গভঙ্গিই তার সার হল। মিসেস বয়েলের মোটা ঘরঘরে গলার নিচে তার সমস্ত বক্তব্যই চাপা পড়ে গেল। মেজর মেটকাফের হাবভাবেও একটা অধৈর্য্যের ছাপ লক্ষ্য করা যায়। তিনি মূল তথ্যগুলো ঠিকভাবে বুঝে নিতে চাইছিলেন।
ট্রেটার কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল। তারপর সকলকে থামিয়ে দেবার জন্য হাত তুললেন। তার চালচলনে পরিপূর্ণ কর্তৃত্বের আভাস। আর সবচেয়ে আশ্চর্যের ব্যাপার, সঙ্গে সঙ্গেই সকলে থেমে গেল। ঘরের মধ্যে এখন শুধু নীরবতা।
ট্রেটার মুচকি হেসে বলল– ধন্যবাদ। মিঃ ডেভিসের কাছে আপনারা নিশ্চয় এতক্ষণে আমার আসার কারণটা শুনেছেন? আমি সঠিক উত্তরটা আপনাদের কাছ থেকে জানতে চাই। লরিজ ফার্মের ওই মামলাটার সঙ্গে কি আপনারা কেউ কোনোভাবে জড়িত ছিলেন?
ঘরের মধ্যে আবার দেখা দিল নীরবতা যেটা ছিল খুবই স্বস্তিকর। ভাবলেশহীন চারটে মুখ ট্রেটারের চোখের দিকে চোখ রাখল। কিছুক্ষণের পর উত্তজনা ও চাঞ্চল্যটুকুও যেন ব্লটিং পেপারের মত সবার মুখ থেকে শুকিয়ে গেল।
৩. নীরবতা ভাঙ্গল
পুনরায় ট্রেটার নীরবতা ভাঙ্গল, তার গলায় গম্ভীর আবেদনের সুর। তিনি বললেন, দয়া করে আমার বক্তব্যটা বোঝাবার চেষ্টা করুন মন দিয়ে। পুলিস কর্তৃপক্ষের বিশ্বাস আপনাদেরই কোনো একজন এখন গভীর বিপদের মুখোমুখি দাঁড়িয়েছেন এসে। মনে রাখবেন আপনারা, খুবই সাংঘাতিক ধরনের বিপদ। কার ভাগ্যে এই দুর্ঘটনা ঘটতে যাচ্ছে, সেই প্রশ্নের মীমাংসা করাই এখন সবার আগে প্রয়োজন।
তবুও কথা শোনা গেল না কারুর মুখে।
প্রশ্নটা শুরু করি। মিঃ প্যারাভিসিনি, আপনি…?
মিঃ প্যারাভিসিনি ঠোঁটের কোণে হাসির ঝিলিক টেনে দিল যেটা ছিল সাময়িক। প্রতিবাদের ইঙ্গিতে হাত নাড়তে লাগলেন। তার আচার-আচরণে বিদেশী ঢং সহজেই চোখে লাগে।
এ অঞ্চলে আমি যে একজন নবাগত বিদেশী, সে কথা সার্জেন্ট ভুলে যাবেন না। এখানকার স্থানীয় কোনো ঘটনার সঙ্গেই আমার যোগ ছিল না কোনো কোনোদিন ছিলোও না।
মিঃ রেন?
ক্রিস্টোফারের শানিত কণ্ঠ বেজে উঠল। সে বলল– ওই ঘটনার আমার বয়স ছিল খুবই কম। এমন কি সমস্ত ঘটনাটাও এখন আমি আবছাভাবে মনে করতে পারি না।
মেজর মেটকাফ…এ বিষয়ে আপনার বক্তব্য কি?
ভদ্রলোক উত্তর দেবার জন্য ঠিক প্রস্তুত ছিলেন না। তাই তাড়াতাড়ি বলে উঠলেন– দৈনিক পত্রিকার মারফৎ আমি সমস্ত ঘটনাটাই, জানতে পারি, কিন্তু তখন আমি চাকুরীসূত্রে এডিনবুয়োয় থাকতাম।
ট্রেটার বললেন, এই আপনাদের শেষ কথা তাহলে? কেউ কিছু বলবেন আর?
আবার সেই আগের মত নীরবতা নেমে এল।
আস্তে আস্তে ট্রেটার তার বুকের মধ্যে একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ছাড়লেন। বললেন– যদি আপনাদের মধ্যে কেউ মারা যান–কথাটা থামিয়ে সকলের দিকে তাকিয়ে আবার বললেন তবে তার জন্য তিনিই দায়ী থাকবেন। এই বলে তাড়াতাড়ি ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন তিনি।
আপন মনে রেন চেঁচিয়ে উঠে বললেন– কি আশ্চর্যের ব্যাপার! ঠিক যেন কোনো রোমাঞ্চকর নাটকের দৃশ্য। …তবে ভদ্রলোকের চেহারাটা যে রীতিমতো সুন্দর সন্দেহ নেই তাতে। এইজন্য পুলিস কর্মচারীদের এত পছন্দ করি আমি। কত শক্তসমর্থ আর দৃঢ়চেতা, সমস্ত পরিবেশটার মধ্যেও একটা ভয়ার্ত শিহরণের ঘনঘটা। ছেলেভুলানো ছড়াটাও বেশ মজার তাই না। তিনটে ইঁদুর অন্ধ…জানলা কপাট বন্ধ…
শিস্ দিয়ে ছড়ার সুরটা ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করল রেন।
মলি এবার বিমূঢ় চিত্তে চেঁচিয়ে উঠে বলল– দোহাই আপনার, থামুন..থামুন।
রেনের চোখেমুখে হাসির ছটা। বলল– কিন্তু ম্যাডাম এটাকে আমার স্বতঃস্ফূর্ত আনন্দেরই প্রকাশ বলে মেনে নেবেন। জীবনে কখনো কোনো খুনের মামলায় জড়িয়ে পড়ার সৌভাগ্য হয়নি। এ অভিজ্ঞতা একেবারে নতুন। সেই কারণে বুকের মধ্যে অস্থির একটা উত্তেজনা অনুভব করছি।
মিসেস বয়েল গর্জে উঠে বললেন, নাটক না ছাই। আমি এর একবর্ণ বিশ্বাস করি না।
ক্রিস্টোফারের চোখে আনন্দের ঝিলিক দিয়ে উঠল। সে বলল–তাহলে মিসেস বয়েল, এক মিনিট অপেক্ষা করুন আপনি, মৃদুস্বরে ফিসফিস করে সে বলল–আমি নিঃশব্দে পেছনে দাঁড়িয়ে আপনার গলাটা…
মলির ভয়ার্ত গলা ভেদ করে একটা যন্ত্রণাকাতর শব্দ বেরিয়ে এল। রাগের ঝঝও দেখা গেল জিলের গলায়। সে বলে উঠল–মিঃ রেন, আপনার পৈশাচিক ঠাট্টার জন্য আমার স্ত্রী অসুস্থ হয়ে পড়ছেন। সম্ভবতঃ সভ্য সমাজের রীতিনীতিগুলো…
মেজর মেটকাফ ব্যাজার মুখ করে বললেন–যদিও এটা কোনো ঠাট্টাতামাশার ব্যাপার নয়।
প্রতিবাদে মুখর হয়ে রেন বলল–কিন্তু মেজর সত্যিই কি তাই? পাগলদের তো ঠাট্টা তামাশা এরকমই হয়ে থাকে। আর সেইজন্যই তো সমস্ত পরিস্থিতিটির মধ্যে একটা অদ্ভুত মাদকতা মিশে আছে।
তার দুটো চোখ সবার চোখের উপর দিয়ে ঘুরে গেল আস্তে আস্তে। ঠোঁটের ফাঁকে লেগে রয়েছে তার হালকা হাসির রেখা। সে বলল–একবার যদি আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেদের বর্তমান চেহারাগুলো আপনারা দেখতেন…।
ট্রেটারের মতোই সঙ্গে সঙ্গে ঘর থেকে অদৃশ্য হয়ে গেলেন তিনি।
মিসেস বয়েলই এই চেতনা ফিরে পেলেন। তিনি বললেন–সভ্যতা ভব্যতার লেশটুকুও নেই ওর মধ্যে। কথাবার্তাগুলো শুনলে মনে হয় বিকৃত মস্তিষ্কের লোক। কিন্তু এমন ভাব দেখায় যেন তার খুব টনটনে জ্ঞান।
চিন্তার সুরে মেজর বলল–ভদ্রলোক বলেছিলেন, গত যুদ্ধের সময় একবার বিমান দুর্ঘটনার মুখে পড়ে তাকে নাকি পুরো আটচল্লিশ ঘণ্টা থাকতে হয় মাটির নিচে কবরস্থ হয়ে। আমার দৃঢ় বিশ্বাস ঘটনাটা যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ।
মিসেস বয়েল তার গলায় কাঠিন্যের ছোঁওয়া রেখে বললেন, লোকে তাদের স্নায়ুদূর্বলের কারণ হিসাবে এত বাজে অজুহাত দেখায়… আমি জোর গলায় বলতে পারি যে এই যুদ্ধের ধকল আমাকেও খুব একটা কম সামলাতে হয়নি। অনেকের চেয়ে আমারই অভিজ্ঞতা বেশি। তবে তার জন্য স্নায়ুবিক বৈকল্য আমার ঘটেনি।
তির্যক সুরে মেটকাফ বললেন–আমার মনে হয় বর্তমানে যা কিছু সমস্যা সব আপনাকে ঘিরে মিসেস বয়েল!
তার মানে? কি বলতে চান আপনি? মিসেস বয়েল জিজ্ঞেস করলেন।
মেটকাফ শান্ত গলায় বললেন–১৯৪০ সালে আপনিই তো এ অঞ্চলের রিফিউজি পুনর্বাসন দপ্তরের ভারপ্রাপ্ত অফিসার ছিলেন। কথার মাঝখানে ভদ্রলোক এক নজর তাকালেন মলির দিকে। বিষাদগ্রস্ত ভঙ্গিতে মলি মাথা নাড়ল, তিনি আবার প্রশ্ন করলেন-বলুন তো, কথাটা কি সত্যি নয়?
মিসেস বয়েলের চোখে মুখে দেখা গেল রাগের ছাপ। তিনি বললেন–তাতে কি অন্যায়টা হয়েছে? ঝাঝালো সুরে তিনি জানতে চাইলেন।
মেটকাফ গম্ভীর গলায় বলল–তিনটে অনাথ শিশুকে লরিজ ফার্মে পাঠানোর জন্য আপনিই মুখ্যত দায়ী।
কিন্তু মেজর মেটকাফ ওইরকম শোচনীয় ঘটনার জন্য কেনই বা দায়ী থাকবো আমি বলতে পারেন? আমি ওই ফার্মের কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথাবার্তা বলে সন্তুষ্ট হয়েছিলাম। তারাও তিনটে বাচ্চাকে সবিশেষ আগ্রহ দেখিয়েছিল মানুষ করবার দায়িত্ব নিয়ে। তবে আমি কেন মাঝখানে দোষের ভাগীদার হব, বা এর দায়-দায়িত্ব সমস্তই আমার উপর বর্তাবে…? শেষের দিকে তার গলার স্বর ম্লান হয়ে গেল।
জিল তীক্ষ্ণকণ্ঠে চেঁচিয়ে বলল–সার্জেন্ট ট্রেটারকে আপনারা এ সম্বন্ধে সবকিছু জানালেন না কেন?
চড়া সুরে বয়েল উত্তর দিলেন–এটা পুলিসের কোনো ব্যাপার নয়, আমি নিজেই দেখাশোনা করতে পারি নিজেদের।
মেটকাফ মৃদুস্বরে তার মন্তব্যটা ছুঁড়ে দিয়ে বাইরে বেরিয়ে গেলেন। তিনি বললেন– আমরাও দেখবার একটা সুযোগ পাব।
জিল প্রশ্নের বান ছুঁড়ে দিল মলির দিকে–তুমি কি ভদ্রমহিলাকে আগে থেকে জানতে?
বাজারের সামনেই বড় রাস্তার উপরেই তো আপনাদের দোতলা বাড়ি ছিল তাই না?
সেটা সামরিক কর্তৃপক্ষ জরুরী প্রয়োজনে দখল করে নিয়েছিলেন। বয়েল কথার উত্তর দিলেন। তারপর আবার বিরাজপূর্ণ স্বরে আবার বললেন–এখন একেবারেই অবস্থা ভেঙ্গে গেছে! জানলা বরগাগুলোরও আর চিহ্ন নেই কোনো, হয়ত খুঁজে পাওয়াই যাবে না। এটাতো একধরনের ডাকাতি বললেই হয়।
অকারণে হাসতে শুরু করেন মিঃ প্যারাভিসিনি। তাঁর হাসির ভঙ্গিটাও সম্পূর্ণ আলাদা। পেছন দিকে মাথা হেলিয়ে চোখ দুটো বুজে দুর্বল বেগে তিনি হেসে চললেন।
হাসির ফাঁকে ফাঁকে তিনি সকলের কাছ থেকে ক্ষমা চেয়ে নিয়ে বললেন–তামাকে মাপ করুন। কিন্তু সমগ্র ঘটনাগুলো এতই মজার যে হাসিটাকে আমি কিছুতেই আর সামলাতে পারছি না। হ্যাঁ, সত্যিই পরিবেশটাকে খুব ভালোভাবে আমি উপভোগ করছি!
সার্জেন্ট ট্রেটার ভেতরে পা দিলেন। তার দু চোখের বিরূপ দৃষ্টি হাস্যরত প্যারাভিসিনির মুখের উপর কয়েক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে রইল। বিরক্তিতে তার দীর্ঘ ভজ জোড়া কুঁচকে গেল। তারপর বললেন, প্রত্যেকে যে বর্তমান পরিস্থিতির জন্য একটা মজার ইন্ধন খুঁজে পেয়েছেন এজন্য বিশেষ আনন্দিত আমি।
আমি দুঃখিত ইনসপেক্টর! সত্যিই খুবই অনুতপ্ত আমি, এর জন্য আপনার সাবধান বাণীই কিছুটা হালকা হয়ে যেতে বসেছে।
ট্রেটার হাল্কাভাবে নিজের বঁটা বাঁকিয়ে বললেন–সমস্ত পরিবেশটা আপনাদের চোখের সামনে ফুটিয়ে তোলার যথাসাধ্য চেষ্টা করছি আমি। যদিও, আমি ইনসপেক্টর নই সামান্য একজন সার্জেন্ট মাত্র। ট্রেটার মলির দিকে একবার ঘুরে দাঁড়ালেন। বললেন–মিসেস ডেভিস, আমি এখনকার ফোনটা একবার ব্যবহার করতে চাই।
প্যারাভিসিনি নিজের মনেই বিড়বিড় করে বলল–সত্যিই আমি ব্যাপারটাকে বড় বেশি ঘু করে তুলেছি। এখানে তার বেশিক্ষণ না থাকাই ভালো।
তবে তার চালচলনে কোনো চিহ্নই ছিল না আত্মগোপনের জন্য, সহজাত বলিষ্ঠ পদক্ষেপেই তিনি বিদায় নিলেন সেখান থেকে।
জিল মন্তব্য করলেন–ভদ্রলোক সত্যিই গভীর জলের মাছ।
ট্রেটার বললেন–হ্যাঁ, কেন যেন অপরাধী সুলভ মনোভাব, এক বিন্দুও বিশ্বাস করা উচিত নয়।
মলি চেঁচিয়ে বলল–তাই বুবি : তাহলে…তাহলে আপনি কি মনে করেন.কিন্তু বয়সটাতো বেশি দেখায় অনেকটা। অবশ্য এই বয়সটাই সত্যি কিনা সেটা জানা খুবই কঠিন। মেকআপ করেও অনেকসময় বয়স বাড়িয়ে নেওয়া যেতে পারে তবে ভদ্রলোক যখন চলাফেরা করেন তখন মনে হয় যেন এক যুবকই হেঁটে যাচ্ছে। সত্যিই সার্জেন্ট, খুব সম্ভবতঃ মিঃ প্যারাভিসিনি গোপন করতে চায় তার আসল বয়সটা। সত্যিই কি আপনি ওনাকে সন্দেহ করছেন।
সার্জেন্ট ট্রেটার বিরক্তি সহকারে মলির উত্তরটা বা সিদ্ধান্তটা ভেঙ্গে দিয়ে বললেন ঐভাবে শুধুমাত্র কল্পনার উপর নির্ভর করে আমরা সঠিক জায়গায় গিয়ে পৌঁছতে পারব না, মিসেস ডেভিস। তবে সুপারিন্টেন্টে হগবেনকে সব খুলে বলতে হবে। কথা বলতে বলতেই তিনি টেলিফোনটার দিকে এগিয়ে গেলেন।
মলি মাথা নেড়ে বলল–কিন্তু এখন আর তা সম্ভব নয়। কারণ ফোন এখন অচল।
ট্রেটার চমকে চোখ তুলে তাকিয়ে বললেন–কি বললেন? ফোন অচল? কখন থেকে? তার গলার স্বরের তীক্ষ্ণতায় সকলে চমকে উঠলেন।
একটু আগেই মেজর মেটকাফ রিং করছিলেন তখনই ধরা পড়ল ব্যাপারটা।
কিন্তু সকালে তো লাইন চালু ছিল! সুপারিন্টেন্টে হগবেনের জরুরী নির্দেশও পেয়েছেন। আপনারা!
হা, সে কথা ঠিক। বোধ হয় সকাল দশটা নাগাদই ফোনটা বিকল হয়ে যায়, বাইরে যা অবস্থা, কোথাও হয়ত তার ছিঁড়ে গেছে!
ট্রেটারের গম্ভীর মুখটা তাও কাটলো না। তিনি বললেন–খুবই আশ্চর্যের ব্যাপার! তিনি যেন নিজেকে শুনিয়েই বললেন, কেউ ইচ্ছে করেই লাইন কেটে দিতে পারে।
মলির দুচোখে দেখা গেল অবাকের ছাপ। সে বলল–আপনার কি ধারণা?
ঐ বিষয়ে প্রয়োজন নিশ্চিত হওয়া–ট্রেটার কথাটা বলতে বলতে দ্রুত পায়ে বেরিয়ে গেল। জিল দু-এক মুহূর্ত ইতস্ততঃ করল। এর পর সার্জেন্টের পেছন পেছন সেও একসময় চোখের বাইরে চলে গেল।
মলি করুণ সুরে আর্তনাদ করে বলল–হ্যায় ভগবান, লাঞ্চের সময় তো প্রায় হয়ে এল। আমাকে এখনি গিয়ে সব কাজ শেষ করতে হবে। তা না হলে অতিথিদের আর খাওয়া জুটবে না।
মলি ঘর ছেড়ে দৌড়ে চলে যাওয়ার পর মিসেস বয়েল ক্রুদ্ধ কণ্ঠে বলে উঠলেন–পদে পদেই অযোগ্যতার চূড়ান্ত নিদর্শন! এটা কি একটা হোটেল। আমি কখনও এর জন্য সপ্তায় সাত গিনি দিতে রাজী নই।
সার্জেন্ট ট্রেটার টেলিফোনের লাইন ধরে সামনের দিকে এগিয়ে চললেন। তিনি বললেন এর সঙ্গে কোনো অন্য সংযুক্ত লাইন আছে নাকি? তিনি জিলকে প্রশ্ন করলেন।
হ্যাঁ, দোতলায় শোবার ঘরে এর লাইনটা টেনে নিয়ে যাওয়া হয়েছে! আমি কি দেখে আসব ওপরে গিয়ে?
যদি কিছু মনে না করেন…?
ট্রেটার জানলার সার্শি খুলে মাথা ঝুঁকিয়ে দেখতে লাগলেন বাইরেটা। সার্শির গায়ে জমে থাকা বরফের টুকরোগুলো ঝরিয়ে দিলেন ঠুকে ঠুকে। জিত দোতলায় উঠে গেল সিঁড়ি বেয়ে!
বড় ড্রইং রুমটার মধ্যে ছিলেন প্যারাভিসিনি। দেওয়ালের গা ঘেঁষে বিরাট লম্বা ধাঁচের সাবেকী আমলের পিয়ানো, তিনি আস্তে আস্তে পায়ে এগিয়ে গিয়ে সাদাকালো রীডের ওপর হাতটা রাখলেন। ক্ষিপ্ত আঙ্গুলগুলো তার সঞ্চালনের সঙ্গে সঙ্গে সারা হলটা করে উঠল গমগম। ছেলেভুলানো ছড়ার সুরটা যেন বুকের মধ্যে বয়ে আনলো রহস্যের মাদকতা।
তিনটে ইঁদুর অন্ধ।
জানলা কপাট বন্ধ
বন্ধ ঘরে তারা
ছুটতে ছুটতে সারা…
একটি সোফায় গা এলিয়ে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন শোবার ঘরে ক্রিস্টোফার রেন। যন্ত্রসঙ্গীতের বাজনা তার কানে এল, কিছুটা আনন্দ সহকারে রেন সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে ঘরের বাইরে পায়চারি করতে লাগল। গানের তালে তালে শিস্ দিতে শুরু করল মৃদুস্বরে। আচমকাই বন্ধ হয়ে গেল তার শিস্। রেন এবার পায়ে পায়ে এগিয়ে গিয়ে বসে পড়লেন শৌখিন মেহগনি। খাটের প্রান্তে। তার সারা দেহটা অস্থির একটা আবেগে থরথর করে কেঁপে উঠল। ক্রিস্টোফার দুহাতে মুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। কান্নার ফাঁকে ফাঁকে বিড়বিড় করে বলল আর পারছি না! আমি আর পারছি না…
পরক্ষণেই তার স্বভাবে ঘটল এক আমূল পরিবর্তন। কান্নার আবেগটুকু শক্ত হাতে মুছে দিয়ে তিনি দৃঢ় পায়ে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন–পারতেই হবে।…নিয়তি নির্দিষ্ট এই পথ দিয়েই আমাকে চলতে হবে। তার গলায় দেখা গেল প্রত্যয়ের সুর।
জিল তার নিভৃত শোবার ঘরে টেলিফোনটার পাশে দাঁড়িয়েছিলো। দেওয়ালের ধারে সরু কাঠের জানলায় মলির পোশাক পরিচ্ছদ সাজানো আছে। একটা পশমের দস্তানা গড়াগড়ি যাচ্ছে মেঝের ওপর। জিল হেঁট হয়ে দস্তানাটা তুলে নিয়ে টাঙ্গিয়ে রাখল আলনার হুকের ওপর। একটা গোলাপী রঙের বাসের টিকিট উড়তে উড়তে এসে পড়ল জিলের কোটের গায়ে। টিকিটটা যে দস্তানার মধ্যে থেকেই বেরিয়ে এসেছে সেটা তার নজরে এড়ায়নি। কিছুক্ষণ একদৃষ্টে তাকিয়ে কোটের উপর সেঁটে থাকা ডাকটিকিটটা কাগজের টুকরোর দিকে জিল তাকিয়ে রইল। আস্তে আস্তে তার মুখের স্বাভাবিক রঙটা গেল বদলে। কিছুক্ষণ আগে যে লোকটা এখানে এসেছিল, এ যেন সে নয়। স্বপ্নের মত আস্তে আস্তে এসে যে দরজা ঠেলে বেরিয়ে এল সে বোধহয় অন্য কেউ। ও বাইরে বেরিয়ে এক মিনিটের জন্য থমকে দাঁড়াল। লম্বা টানা বারান্দার বিপরীত দিকে এক পলক দেখে নিল চওড়া সিঁড়িটা।
মলি একে একে সমস্ত আলুর খোসা ছাড়িয়ে রাখলো একটা পাত্রের মধ্যে। তারপর তাতে নুন-মশলা ছড়িয়ে উনুনের উপর বসিয়ে দিল। তার বাঁপাশে জ্বলছে আরো দুটো গ্যাসের উনুন। তাদের প্রত্যেকটির মাথার ওপরে বসানো বিভিন্ন রকম আয়তনের পাত্র। একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস মলি ফেলল। যেন সব কিছুই এগোচ্ছে পরিকল্পনা মতো।
কিছুটা দূরেই টেবিলের ওপর দুদিনের পুরোন ইভনিং স্ট্যাণ্ডার্ডটাও নজরে পড়ল, তবে তার ক্রু জোড়া আপনা-আপনি কুঁচকে গেল। শুধু যদি ঘটনাটা মনে রাখতে পারত…
হঠাৎ যেন তার মাথায় বজ্রপাত হল। দু-হাতে চোখ ঢেকে ভয়ার্ত সুরে চেঁচিয়ে উঠল মলি, না…না…কখনই না…।
আবার আস্তে আস্তে মলি হাত নামাল। তার দুচোখে রয়েছে একটা বিভ্রান্তির ছাপ। এমন ভাবে সে সবদিকে চোখ মেলে চাইল মনে হল এ পরিবেশে সে যেন নতুন। অথচ ঘরটার মধ্যে আবহাওয়াটা এতই গরম ও আরামদায়ক, কত খোলামেলা। তার সঙ্গে মনের মত খাদ্যবস্তুর তৃপ্তিকর গন্ধ।
চাপা কণ্ঠে মলি আবার ফিসফিস করে বলল–না..না…এ হতে পারে না।
স্বপ্নের মতোই মলি পায়ে পায়ে এগিয়ে গেল। রান্নাঘরের বাঁদিকের দরজা পার হয়ে দাঁড়াল বড় হলঘরটার মধ্যে। সমস্ত বাড়িটার মধ্যে বিরাজ করছে এক অদ্ভুত নীরবতা। কেবলমাত্র অনেক দূরে মনে হচ্ছে কেউ যেন একনাগাড়ে শিস্ দিয়ে চলেছে। তার খুব পরিচিত সুরটা। কান পেতে ভালোভাবে শোনার চেষ্টা করল সেই সুরটা মলি। কিছুক্ষণের পর এক তীব্র অস্বস্তিতে তার সর্বাঙ্গ শিউরে উঠল। সেই ছেলেভুলোনো সুরটা।
মলি ভয়ে ভয়ে তার রান্নাঘরে ফিরে গেল। পরিচিত পরিবেশের মধ্যে দাঁড়িয়ে নিজের মনটা কিছুটা স্বস্তি পেল। হ্যাঁ, সুশৃঙ্খলভাবেই যেন সবকিছু এগিয়ে চলছে।
মেজর মেটকাফ পিছনের সিঁড়ি বেয়ে বড় হলঘরটার মধ্যে ঢুকলেন। চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলেন এক মিনিট। তারপর সিঁড়ির নিচে বাসনপত্র রাখবার জন্য কাঠের আলমারীর দিকে গেলেন এগিয়ে। চারদিকে শেষবারের মত একবার চোখ তুলে তাকাল। কেউ নেই আশেপাশে। কোনো সাড়াশব্দও পাওয়া যাচ্ছে না। কাজকর্ম সব সেড়ে নেবার এটাই হল উপযুক্ত সময়।…
একা একা ঘরের মধ্যে পশমের মাফলার বুনছিলেন মিসেস বয়েল। বোনার কাজটা বন্ধ রেখে রেডিওর সুইচটা অন্ করে দিলেন হাত বাড়িয়ে। চোখেমুখে তার যেন লেগে রয়েছে। বিরক্তির ছাপ। মেয়ে গলার সুন্দর প্যানপ্যানানি তার বিরক্তিকে আরো যেন বাড়িয়ে তুলল। ছেলেভুলোনা ছড়াটার মানে নিয়েই ভদ্রমহিলা বক্তব্য দিয়ে যাচ্ছিলেন। একটু অধৈর্য হয়ে মিসেস বয়েল রেডিওর নবটা আবার ঘোরালেন। এখানেও পুরোদমে চলছে বক্তৃতা। তবে সুরটা ছিল পুরুষ মানুষের। এবং গলাটাও ছিল বেশ ভরাট ও মার্জিত। মানসিক কীর্তির বিচিত্র গতিপ্রকৃতি বিষয়েই তিনি আলোচনা করছিলেন।
বক্তা বলছিলেন, ভয়ের দিকটাই প্রথমে ভালোভাবে লক্ষ্য করতে হবে। মনে করুন নিঃশব্দে আপনার পেছনের দরজাটা খুলে গেল…
সত্যি সত্যি পেছন দিকের একটা দরজা নিঃশব্দে গেল খুলে।
মিসেস বয়েল ভীষণ ভাবে চমকে উঠে পেছন দিকে তাকালেন। তারপর বললেন, ওঃ আপনি? তারপর বয়েল একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন, তারপর আবার বললেন কি ক্লান্তিকর অনুষ্ঠানই যে রেডিওর মাধ্যমে প্রচার করা হয়। আমি তো দুদণ্ড ধৈর্য্য ধরে শোনার মত কিছুই খুঁজে পাই না।
আজকাল আমি রেডিও নিয়ে খুব একটা মাথা ঘামাই না মিসেস বয়েল।
মিসেস বয়েল একটু রেগে গেলেন। বললেন–কিন্তু তাছাড়া এখানে করার মত কী-ই আছে। সম্ভাব্য খুনির সঙ্গে বাস করা অবশ্য যদিও আমি ওইসব আজগুবি নাটকের একবিন্দুও বিশ্বাস করি না…
আগন্তুক বললেন–সত্যিই বিশ্বাস করেন না, মিসেস বয়েল?
মিসেস বয়েল বললেন–আপনার এ প্রশ্নের অর্থ…?
আগন্তুকের বর্ষাতির বেল্টটা এত দ্রুত গতিতে মিসেস বয়েলের গলায় জড়িয়ে গেল, তিনি এর ভেতরকার মর্মার্থটা ঠিকমত বুঝে উঠতে পারলেন না। রেডিওর আওয়াজটা আরও বেশি করে বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। সারা ঘরটা বিদগ্ধ বক্তার গমগমে হয়ে উঠেছে তার বক্তৃতায়।
তবে মিসেস বয়েল গণ্ডগোল করতে পারেনি শেষ সময়ে। কারণ হত্যাকারী সত্যিই দক্ষ এবং তৎপর। সকলেই বড় রান্নাঘরে জমায়েত হল। গ্যাসের আগুনে টগবগ করে ফুটছে আলুগুলো। মাংসের ডেকচি থেকে বের হয়ে আসছে রসনার তৃপ্তিকর সুগন্ধি।
সন্দেহের চোখে একে অপরকে দেখে চলছে। মলি পাঁচপায়ার চেয়ারে গা এলিয়ে বসেছিল। তার সমস্ত মুখটা ফ্যাকাসে হয়ে গেছে ভয়ে। তার দুচোখে রয়েছে উদভ্রান্ত দৃষ্টির ছাপ। সার্জেন্ট ট্রেটার খুব জোরের সঙ্গে মলিকে বীয়ার খাবার নির্দেশ দিলেন।
সার্জেন্ট ট্রেটারের মুখে একটা থমথমে রাগের আভাস। তিনি তাকালেন সবার দিকে। পাঁচ মিনিট আগে মলির ভয়ার্ত চীৎকারে সবাই ছুটে এসেছিল লাইব্রেরি ঘরে।
ট্রেটার বললেন–আপনি যখন মৃতদেহটা দেখতে পেলেন, খুব সম্ভব তার দু-এক মিনিট আগেই ভদ্রমহিলা খুন হয়েছেন। আচ্ছা, লাইব্রেরি ঘরে ঢোকার কারুর পায়ের আওয়াজ শুনতে পাননি?
ক্লান্ত গলায় মলি জবাব দিল–একটা শুধু মৃদু শিশের শব্দ শুনতে পেয়েছিলাম। তবে সেটা কিছুক্ষণ আগে। আমার…আমার মনে হচ্ছে যেন…অবশ্য সে বিষয়ে যদিও আমি সম্পূর্ণ নিশ্চিত নই…দরজা বন্ধ করার একটা শব্দও আমার কানে এসে পৌঁছেছিল। তখন আমি লাইব্রেরি ঘরের দিকেই এগিয়ে যাচ্ছিলাম।
ট্রেটার জিজ্ঞেস করল–কোনো দরজা?
নিৰ্দ্ধিধার সুরে মলি বলল–ঠিক বলতে পারব না।
ট্রেটার জিজ্ঞেস করলেন মিসেস ডেভিস, একটু ভেবে দেখুন। ওপরে না নিচে..আপনার বাঁ দিকে না ডান দিকে…?
মলি বিরক্তিতে মাথা ঝাঁকিয়ে বলল–আমি, সত্যিই জানি না সার্জেন্ট। এমন কি ঠিক শব্দ শুনেছি কিনা সে নিয়েও আমার মনে যথেষ্ট সন্দেহ আছে!
জিল রাগের সুরে ঝাঁঝালো গলায় বলল–এইভাবে উৎপীড়ন করাটা খুব অন্যায়। ও যে এখনো রীতিমত অসুস্থ সেটা কি আপনার চোখে পড়ছে না?
ট্রেটার বললেন–আমি যে একটা হত্যাকাণ্ডের তদন্ত করতে এসেছি সেকথা আপনি ভুলে যাবেন না কম্যাণ্ডার ডেভিস।
জিল বলল-নামের আগে আর আমি ম্যাণ্ডার শব্দটা ব্যবহার করি না, সার্জেন্ট।
ট্রেটার মাথা নেড়ে বললেন–সে তো ঠিকই। তবে ওই যে বললাম আমি এখানে একটা খুনের তদন্ত করতে এসেছি। এবং এই ঘটনার আগে কেউ আমার কথা শোনেননি। আপনারা ভালো ভাবেই জানেন যে মিসেস বয়েলও আমার কথাটা বিশেষ গুরুত্ব দেখাননি। তিনি আমার কাছে খুব জরুরী খবরটাই গোপন করেছিলেন। আপনারাও তাই করেছেন। তাহলে আর কিছু আমার বলার নেই। মিসেস বয়েল মারা গেছেন এবং খুব তাড়াতাড়ি এই রহস্যের উদ্ঘাটন না করলে আরও একটা খুন হওয়ার সম্ভাবনা আছে।
আর একটা…? যত সব অর্থহীন ধ্যানধারণা! … কেন আরেকটা খুন হতে যাবেই বা কেন?
বিমর্ষ মনে ট্রেটার জবাব দিলেন–কারণ, কাগজের টুকরোর মধ্যে আঁকা ছিল তিনটে ইঁদুরের ছবি।
জিলের গলায় শোনা গেল অবিশ্বাসের সুর। সে বলল–প্রতিটি ইঁদুরই কি এক একটা মৃত্যুর প্রতীক। কিন্তু…কিন্তু তার মধ্যে তো একটা সংযোগ থাকবে? মানে…মানে আমি বলতে চাই, ওই মামলাটার সঙ্গে কেউ কি জড়িত ছিলেন?
ছিলেন নিশ্চয়। বর্তমানে যা পরিস্থিতি তাই দেখে তো এটাই মনে হচ্ছে!
কিন্তু আরেকটা হত্যাই বা এখানে ঘটবে কেন?
ট্রেটার উত্তর দিলেন তার কারণ, ওই নোটবইটাতে দুটো মাত্র ঠিকানারই উল্লেখ ছিল। একটা ছিল চুয়াত্তর নম্বর কার্লভার স্ট্রীট এবং অন্যটি মঙ্কসওয়েল ম্যানর। কালর্ভার স্ট্রীটে একটি মাত্র সম্ভাব্য শিকারের সন্ধান আমরা পেয়েছি। তিনি মারা গেছেন। কিন্তু মঙ্কসওয়েল ম্যানরের কথা সম্পূর্ণ আলাদা। এখানের ক্ষেত্রটা হল অনেক বড়।
এই সমস্ত চিন্তা ভাবনা ভিত্তিহীন ট্রেটার। লরিজ ফার্মের কুচক্রিরা যে পাকেচক্তে এখানে এসে হাজির হবেন, এরকম সম্ভাবনা খুব একটা ম আশা করা যায় না।
ট্রেটার বললেন–তবে কোনো কোনো পরিস্থিতিতে সম্ভাবনাটা এবারে উড়িয়ে দেয়া যায় না। আপনি নয় নিজেই বিষয়টা একবার ভালোভাবে দেখুন! ট্রেটার এবার সমবেত অতিথিদের দিকে দৃষ্টিপাত করলেন। তারপর আবার বললেন মিসেস বয়েলের মৃত্যুর সময় কে কোথায় ছিলেন তার বিবরণ আপনারা আমাকে দিয়েছেন। যদিও সেটা আমি যাচাই করে নেব। মিঃ রেন, মিসেস ডেভিস যখন চীৎকার করে ওঠেন, তখন তো আপনি আপনার ঘরেই ছিলেন তাই তো?
মিঃ রেন সম্মতিসূচক চিহ্নে মাথা নাড়লেন।
ট্রেটার বললেন–মিঃ ডেভিস, আপনি দোতলায় শোবার ঘরে পরীক্ষা করছিলেন এক্সটেনশনটা–তাই তো?
জিল জবাব দিল, বলল–হ্যাঁ।
মিঃ প্যারাভিসিনি আপনি ড্রয়িংরুমে বসে পিয়ানো বাজাচ্ছিলেন তাই তো? যদিও আপনার বাজানা কেউই শুনতে পাননি!
প্যারাভিসিনি বললেন আমি খুব আস্তে আস্তে বাজাচ্ছিলাম। একেবারে নিচু পর্দায়, শুধুমাত্র একটা আঙ্গুল দিয়েই টোক মারছিলাম।
ট্রেটার জিজ্ঞেস করলেন–কোনো সুরটা বাজাচ্ছিলেন আপনি?
মিঃ প্যারাভিসিনি উত্তর দিলেন–তিনটে ইঁদুর অন্ধ। দোতলায় মিঃ রেন তখনও এই সুরটার শিই দিচ্ছিলেন, প্রত্যেকের মাথায় তখন এই একটিমাত্র সুরই খেলা করছে। হাসতে হাসতে বললেন প্যারাভিসিনি।
ব্যাজার মুখে মলি বলল–সুরটা যেমন অস্বস্তিকর, তেমনি সাংঘাতিক।
মেটকাফ প্রশ্ন করলেন–টেলিফোন অচল হওয়ার কারণটাই বা কি? তারটা কি ইচ্ছাকৃতভাবে কাটা হয়েছে?
আপনার ভয়টাই সত্যি মেজরডাইনিং হলের জানলার ঠিক পাশেই খানিকটা তার কেউ কেটে দিয়েছে। মিসেস ডেভিস যখন মৃতদেহটা আবিষ্কার করে চেঁচিয়ে উঠলেন তখনই এই ব্যাপারটা আমি আবিষ্কার করলাম।
তীক্ষ কণ্ঠে জিল জানতে চাইল–সমস্ত ব্যাপারটাই যেন কেমন অদ্ভুত। এর পেছনে হত্যাকারীর কি উদ্দেশ্য থাকতে পারে বলে মনে হয়?
ট্রেটার জিলের আপাদমস্তক নিরীক্ষণ করে বললেন–মিঃ ডেভিস, এই মুহূর্তে সেই প্রশ্নের উত্তর দেওয়া কঠিন। খুনী হয়ত মনে করেন বাইরের পৃথিবীর সঙ্গে তার যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হলে কাজের পক্ষে সেটা সহজ হবে। কিংবা হয়ত এর পেছনে কোনো উদ্দেশ্যই নেই। আমাদের চিন্তাকে বাড়িয়ে তোলা বা আমাদেরকে ভুল পথে চালনা করাই হয়ত তার কারসাজি। অল্প একটু হেসে ট্রেটার আবার বললেন–প্রত্যেক খুনীই নিজেকে খুব চালাক আর বুদ্ধিমান বলে মনে করে। নিজেদের প্রতি আছে তাদের অগাধ আস্থা। কাজের ক্ষেত্রে অপরাধীদের মানসিক দিক নিয়ে আমাদের পরীক্ষা করতে হয়। এটা আমাদের ট্রেনিংয়ের একটা দিক। এই সমস্ত মানসিক বিকারগ্রস্ত অপরাধীদের কাৰ্যসূচী খুবই কৌতূহলোদ্দীপক।
জিলের কণ্ঠে শোনা গেল ব্যঙ্গের ঝাঁঝ–আমরা কি বড় বড় বক্তৃতা বন্ধ করে বর্তমান সমস্যা নিয়ে আলোচনা করতে পারি?
ট্রেটার বললেন–হ্যাঁ, নিশ্চয় মিঃ ডেভিস। আমাদের কাছে এখন প্রধান আলোচ্য বিষয় দুটো। একটা হল-খুন, আর দ্বিতীয়টা হল বিপদ। এই দুটো শব্দের মধ্যে আমাদের লক্ষ্যটা নিয়ে যেতে হবে।…মেজর মেটকাফ, আপনার গতিবিধি সম্পকে আমাকে আগে পরিষ্কার হতে দিন। আপনার বক্তব্য এই হত্যাকাণ্ডের সময় মদের বোতল মজুত রাখবার জন্য মাটির নিচে যে চোরাকুঠরিটা আছে সেখানে ছিলেন আপনি। কি জন্য আপনি সেখানে গিয়েছিলেন?
মেটকাফ জবাব দিলেন– তেমন কোনো উদ্দেশ্য আমার ছিল না : ইতস্ততঃ ঘুরে বেড়াতে বেড়াতে ওদিকে ছোট্ট দরজাটা আমার চোখে পড়ল। দরজাটা খুলতেই দেখলাম একটা সরু সিঁড়ি নেমে গেছে নিচের দিকে। ওই সিঁড়ি বেয়ে নামতে নামতেই চোরকুঠরিটার সন্ধান পেলাম।
মেটকাফ এবার জিলকে লক্ষ্য করে বললেন–আপনাদের মাটির নিচে ভাড়ার ঘরটা সত্যিই খুব সুন্দর। প্রাচীন মঠে মন্দিরে এরম গুপ্ত স্থান পাওয়া যায় সন্ধান করলে।
ট্রেটার বললেন–আমরা এখানে প্রাচীনকালের স্থাপত্য শিল্প নিয়ে গবেষণা করতে বসিনি, মেজর মেটকাফ এখানে একটা হত্যাকাণ্ডের তদন্ত চলছে।…মিসেস ডেভিস, আপনি আমার কথা শুনুন। আমি দরজাটা খোলা রেখেই বাইরে যাচ্ছি… কথাটা বলতে বলতেই তাড়াতাড়ি বেরিয়ে গেল ট্রেটার। কয়েক সেকেণ্ড পর কোথায় দরজা ভেজানো একটা শব্দ কানে এল। যদিও শব্দটা ছিল খুবই ক্ষীণ। সঙ্গে সঙ্গে তিনি ফিরে এসে জিজ্ঞেস করলেন– এই শব্দটাই কি আপনার তখন কানে এসেছিল?
মলি বলল হ্যাঁ, অনেকটা যেন এই রকমই।
ট্রেটার বললেন–এটা সিঁড়ির নিচে কাঠের আলমারির দরজা বন্ধ করার শব্দ। ঘটনাটা হতে পারে যে খুনী মিসেস বয়েলকে খুন করার পর হলঘরের মধ্যেই ফিরে যাচ্ছিল। এমন সময় মিসেস ডেভিসের পায়ের শব্দ শুনতে পেয়ে তাড়াতাড়ি ওই আলমারির মধ্যে ঢুকে পাল্লাটা টেনে নেয়।
রেন উত্তেজিত ভাবে বললেন–তাহলে নিশ্চয়ই আলমারির গায়ে খুনীর আঙুলের ছাপ পাওয়া যাবে?
মেজর মেটকাফ বললেন কিন্তু ওই আলমারির হাতলের মধ্যে আমার আঙুলের ছাপও রয়ে গেছে।
ট্রেটার মাথা নাড়িয়ে বললেন–তা ঠিকই, তবে তার একটা সন্তোষজনক উত্তর আমরা পেয়েছি, তাই নয় কি?
জিল দৃঢ় কণ্ঠের সুরে বলল- দেখুন সার্জেন্ট, একথা ঠিকই যে বর্তমান পরিস্থিতিটা সামলানোর সব ভার সরকারীভাবে অর্পণ করা হয়েছে আপনার ওপরেই। তবে বাড়িটা যে আমার সে কথাও ভুলে গেলে চলবে না এবং আমারও একটা নৈতিক কর্তব্য আছে অতিথিদের নিরাপত্তার ব্যাপারে। দুর্ঘটনা এড়াবার জন্য আমাদের তো কিছু সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।
সার্জেন্ট সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন–যেমন…?
মানে…আমি বলতে চাই। এই অপকীর্তির প্রধান হোতা হিসেবে যার পর প্রথমেই সন্দেহ জাগে তাকে কি আপাতত আটক করে রাখা যায় না?
কথা থামিয়ে জিল এবার সোজাসুজি ক্রিস্টোফার রেনের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করলো।
আসন ছেড়ে লাফিয়ে উঠলেন ক্রিস্টোফার। উত্তেজনার আধিক্যে তার সুর কণ্ঠস্বর আরো তীক্ষ্ণ শোনালো। এটা সত্যি নয়। কখনোই সত্যি নয়।
আপনারা সকলে মিলে আমার পেছনে লাগছেন! প্রত্যেকেই আমাকে বিরূপ দৃষ্টিতে দেখে! আপনারা মিলে যুক্তি করে আমার উপর দোষটা চাপিয়ে দিচ্ছেন।
কিন্তু এটা তো উৎপীড়ন…
নির্মম নিষ্ঠুর উৎপীড়ন….
অমন ভেঙে পড়বেন না। শান্ত স্বরে উপদেশ দিলেন মেটকাফ।
শক্ত হোন…দৃঢ় হোন…নিজেকে সংযত করুন।
আপনার দুঃশ্চিন্তার কোনো কারণ নেই, মিঃ রেন। ধীর পায়ে এগিয়ে এলোে মলি।
উত্তেজিত রেনের পিঠে হাত দিয়ে তাকে আশ্বস্ত করবার চেষ্টা করলো।
আমরা কেউই আপনার বিরুদ্ধে যাইনি। মলি ব্যাকুল দৃষ্টিতে ট্রেটারের দিকে তাকালে ভদ্রলোককে সে ভরসা দিল।
আমরা আগে থেকে কাউকেই অপরাধী হিসেবে ধরে নিয়ে, এইভাবে মামলা সাজিয়ে চেষ্টা করব। জবাব দিলেন ট্রেটার।
আপনি সেটা বুঝিয়ে বলুন, যে আপনি ভদ্রলোককে গ্রেপ্তার করতে যাচ্ছেন না।
না না, আপাতত কাউকেই গ্রেপ্তারের কোনো ইচ্ছা নেই।
তার জন্যে সুনিশ্চিত সাক্ষী প্রমাণের প্রয়োজন। এক্ষেত্রে তার কোনো আভাসই পাওয়া যাচ্ছে না।
জিল চেঁচিয়ে উঠলো, মনে হচ্ছে তোমার মাথাটা খারাপ হয়ে গেছে, মলি।
সার্জেন্টের অবস্থাও সেইরকম।
ঠিক মতো বিচার বিবেচনা করে দেখা গেল, অপরাধীর চেহারার সঙ্গে একজনের মিল খুঁজে পাওয়া গেছে, এবং জিল শোনে…
ঈশ্বরের দোহাই একটু শান্ত হও…
মলি বিধ্বস্ত অসহায় ভঙ্গিতে মিনতি করল। বলল, সার্জেন্ট ট্রেটার, আড়ালে আমি আপনার সঙ্গে একটা কথা বলতে চাই। যদি অনুগ্রহ করে এক মিনিট সময় দেন?
জেদের সুরে জিল বলল–আমিও থাকবো তোমার সঙ্গে।
মলি বলল–না জিল…তুমিও না! আমার অনুরোধ…
জিলের চোখে মুখে বজ্রের মেঘের মতই কালো ছায়া নেমে এল। বলল, কি যে আছে তোমার মাথায় তা আমি বুঝতে পারছি না!
অন্য সকলের সঙ্গে জিলও ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল। যাবার সময় খুব জোড়ে দরজাটা বন্ধ করে দিল।
হ্যাঁ বলুন মিসেস ডেভিস, কি আপনার বক্তব্য?
মলির মুখ থেকে কিছুক্ষণের জন্যও উদ্বেগ ও বিভ্রান্তির ছায়াটাও সম্পূর্ণ মিলিয়ে যায়নি। গলার সুরে দেখা গেল অস্বস্তির ছোঁয়া। বলল–সার্জেন্ট ট্রেটার, বর্তমানের ঘটনার প্রসঙ্গে আপনি আমাদের কাছে লঙরিজের ওই মামলাটার উল্লেখ করেছিলেন। আপনার কি ধারণা, ভাগ্যহত ওই তিনটি অনাথ শিশুর মধ্যে এই সমস্ত খুনের জন্য দায়ী বড় ছেলেটিই? কিন্তু সে বিষয়ে আপনি নিশ্চিত করে কিছু বলতে পারেন না।
মিসেস ডেভিস, আপনার বক্তব্যটা খুবই যুক্তিসঙ্গত। তবে যাবতীয় সম্ভাবনা ইঙ্গিত করছে সেই দিকেই। মানসিক অস্থিরতা, সেনাবাহিনী থেকে পলায়ন, চিকিৎসকের রিপোর্ট….
মলি বলল হ্যাঁ, আমি জানি, ক্রিস্টোফারকে সন্দেহ করার প্রধান কারণ সেটাই। কিন্তু ওই ভদ্রলোকের দ্বারা এ কাজ সম্ভব বলে আমার মনে হয় না। নিশ্চয় আড়াল থেকে কেউ তাকে ইন্ধন জুগিয়েছে। আচ্ছা, ওই তিনটি বাচ্চার বাবা মা বা অন্য কোনো আত্মীয় স্বজনের সন্ধান পাওয়া যায়নি?
ওদের মা মারা গিয়েছিল অনেকদিন আগেই। যুদ্ধকালে দরকারী কাজে ওই তিনটে বাচ্চাকে বাবার দেশে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।
সেই ভদ্রলোকেরই বা কি খবর? এখন তিনি কোথায়?
আমাদের কাছে কোনো খবর নেই। যুদ্ধের প্রয়োজন মিটে যাওয়ায় এক বছর আগে সেনাবাহিনী থেকে তাকে ছুটি দিয়ে দেওয়া হয়।
ছেলের যদি মানসিক ভারসাম্য বজায় ঠিক না হয় তবে তার বাবার ক্ষেত্রেও এই একই ব্যাপার ঘটতে পারে?
হা নিশ্চয়!
তাহলে আমাদের বর্তমান হত্যাকারী যে মাঝবয়সী বা বৃদ্ধলোক এ ধারণা কিছু অসম্ভব নয়? এই প্রসঙ্গে আমার একটা কথা খুব মনে পড়ছে। মেজর মেটকাফ যখন প্রথম জানতে পারেন যে পুলিস কর্তৃপক্ষ এখানে আসছেন তখন খুব বিচলিত হয়ে পড়েছিলেন তিনি।… হ্যাঁ তিনি সত্যিই খুব ভয় পেয়েছিলেন।
সার্জেন্ট ট্রেটার শান্ত গলায় বললেন–আমাকে বিশ্বাস করুন মিসেস ডেভিস। প্রথম থেকে সবরকম বিচার-বিবেচনা করেছি আমি। জিম নামে ওই ছেলেটা বা তার বাবা–এমন কি তার বোনের সম্ভাবনাও বাদ দেওয়া যায় না। আমাদের বর্তমান হত্যাকারী একজন মহিলাও হতে পারেন–তা জানেন? কোনো কিছুই আমার নজর থেকে এড়িয়ে যায়নি। আমি মনে মনে নিশ্চিত, তবে নির্ভরযোগ্য কোনো প্রমাণের খুবই অভাব। বর্তমানে কোনো ব্যক্তি বা বস্তুর সম্বন্ধে সম্পূর্ণ তথ্য জানা খুবই কঠিন কাজ।
আমাদের এই কর্মজীবনে অনেক বিচিত্র অভিজ্ঞতারই মুখোমুখি হতে হয় সে সম্বন্ধে কোনো ধারণা নেই আপনার। যদিও অধিকাংশ মামলাই বিবাহ-সংক্রান্ত। কিছুদিনের পরিচয়েই বিয়ে, বা যুদ্ধকালীন পরিস্থিতির মধ্যে তাড়াতাড়ি করে বিবাহ–এ সমস্তই খুব বিপজ্জনক। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই স্বামী-স্ত্রী একে অপরকে চেনে না, এমন কি তাদের আত্মীয় স্বজন বন্ধু বান্ধবের কোনো পাত্তা নেই। একে অন্যের মুখের কথাতেই বিশ্বাস করে। হয়ত ছেলেটা বলল–যে সে একজন পাইলট, কিংবা সেনাবাহিনীর কোনো মেজর। ব্যস্ মেয়েটাও তাই বিশ্বাস করে নেয়। তারপর বছর দুই পার হতে না হতেই বিবাহিত জীবনযাপনের পর জানা গেল– ছেলেটা কোনো পালিয়ে আসা ব্যাঙ্ক কর্মচারী। তার নামে বিরাট একটা অঙ্কের বিল কুলছে মামলার জন্য। তার অন্য কোনো সংসার থাকাটাও বিচিত্র কিছু নয়। অথবা হতে পারে সে আসলে একজন যুদ্ধ পলাতক কোনো সৈনিক। সামরিক বিভাগ তার নামে হুলিয়া জারি করেছে…।
ট্রেটার একটু থেমে আবার বলতে শুরু করল, আপনার মনের মধ্যে যে কি হচ্ছে তা আমি বেশ ভালোই বুঝতে পারছি। তবে মিসেস ডেভিস একটা কথা মনে রাখবেন আমাদের বর্তমান হত্যাকারী সমস্ত পরিবেশ-পরিস্থিতিটা ভালো করেই বেশ উপভোগ করছে।…হ্যাঁ, এ বিয়ে আমি নিশ্চিত।
আস্তে আস্তে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে গেল ট্রেটার। মলি কিছুক্ষণ পাথরের মত নিশ্চল অবস্থায় রইল। তার হাত-পাগুলো যেন অসাড় হয়ে গেছে। তার চোখের কোণে দেখা দিয়েছে চিন্তার ছাপ। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে এগিয়ে গেল জ্বলন্ত গ্যাসের দিকে। পরিচিত মসলার সুগন্ধে মলি যেন নিজেকে নতুন করে ফিরে পেল। গুরুভার হৃদয়টা অনেকটা যেন হাল্কা হল। অনেকক্ষণ পরে সে তার নিজের ঘরের গৃহস্থালীর নিবিড় নীড়ে একটা আশ্রয় খুঁজে পেয়েছে। রান্নাবান্না সংসারের খুঁটিনাটি দায়দায়িত্ব–এইসব হাসি-কান্না নিয়েই তার গদ্যময় জীবন। এবং অনেক অনেক বছর আগে থেকে নারীরাই এর ঝামেলা-ঝক্কি সামলে এসেছে। বিপদসঙ্কুল উন্মত্ত পৃথিবীর বুকে এই রান্নাঘরটাই নিরাপদ আশ্রয় নারীদের।
বন্ধ করা দরজাটা একটুখানি খুলল। ঘাড় ঘুরিয়ে মলি তাকিয়ে দেখল ক্রিস্টোফার রেন ঢুকল। ভদ্রলোক এখনও বেশ হাঁপাচ্ছেন।
রেনের তীব্র গলা শোনা গেল–এদিককার খবর সব শুনেছেন। কি ভুতুড়ে কাণ্ডকারখানাই না চারদিকে ঘটে চলেছে–সার্জেন্ট ট্রেটার তার স্কী দুটো খুঁজে পাচ্ছেন না।
মলি বলল–চাকা লাগানো স্কী দুটোর কথা বলছেন? কেন…সে-দুটো চুরি করেছে কে? আর কি লাভ সে-দুটো চুরি করে?
খবরটা আমারও ভাবনার বাইরে চলে যাচ্ছে…মানে..আমি বলতে চাই, সার্জেন্ট ট্রেটার সত্যিই যদি আমাদের ছেড়ে যেতে চান তাহলে খুনীরই তো সব থেকে বেশি লাভ হবে। সেই জন্য এই ঘটনার মধ্যে আমি সুনির্দিষ্ট কোনো মানে খুঁজে পাচ্ছি না।
জিল তো নিজেই সিঁড়ির নিচে কাঠের আলমারিতে স্কী দুটো রেখে এসেছিল।
রেন মৃদু হেসে বললেন–ভালো, কিন্তু এখন সেদুটো সে জায়গায় নেই। ব্যাপারটা সত্যিই আমাকে খুব ভাবাচ্ছে। আমাদের সার্জেন্ট কিন্তু খুব রেগে গেছেন–জানেন! রাগী কচ্ছপের মত সারা বাড়িটা তিনি এখন ঘুরে বেড়াচ্ছেন। হতভাগ্য মেজরকে তো জেরার পর জেরা করে কাহিল করে ছাড়ছেন। কিন্তু মেজর একটা কথাই বলে চলেছেন। তিনি যখন কাঠের আলমারিটা খুলছিলেন তখন স্কী দুটো আছে কি নেই ভালোভাবে তিনি সেটা লক্ষ্য করেননি। এ বিষয়ে কোনো খেয়ালই তার ছিল না। ট্রেটারের বক্তব্য এতবড় জিনিষটা ভদ্রলোকের নজর এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। কোনো রহস্যময় কারণেই তিনি এখন সত্যি কথাটা গোপন করছেন। রেন আরেক পা এগিয়ে এসে বললেন–এই সমস্ত ব্যাপারটা সার্জেন্ট ট্রেটারকে বেশ খানিকটা দমিয়ে দিয়েছে।
ব্যাজার মুখে মলি বলল–আমিও খুব এতে বিব্রত বোধ হচ্ছি। প্রত্যেকের স্নায়ু এখন অসুস্থ হয়ে উঠেছে।
রেন মাথা নেড়ে বললেন–আমাকে নয়, আমি বরং উদ্বুদ্ধ হয়ে যাচ্ছি বলতে পারেন। সমস্ত ব্যাপারটা এত বেশি অস্বাভাবিক….
মলি তীক্ষ্ণ স্বরে চেঁচিয়ে বলল–আপনি যদি মিসেস বয়েলের মৃতদেহটা প্রথম আবিষ্কার করতেন, তাহলে…তাহলে আপনি এরকম কথা বলতে পারতেন না। দৃশ্যটা যেন আমার চোখের সামনে ভাসছে…কিছুতেই যেন সেটা আমি ভুলতে পারছি না। সারা মুখটা বিশ্রীভাবে ফুটে উঠেছে, তার মধ্যে একটা গাঢ় বেগুনি আভা…
আপনা-আপনি কণ্ঠস্বর রুদ্ধ হয়ে এল মলির। ওর সারা শরীর যেন কেঁপে উঠল থরথরিয়ে। ক্রিস্টোফার এগিয়ে এসে মলির পিঠে হাত রাখলেন। বললেন–সত্যিই, আমি বাস্তবিকপক্ষে খুব নির্বোধ। আমার উচিত ছিল বোঝা, আমি দুঃখিত মিসেস ডেভিস, আমি এতটা ভেবে দেখিনি।
একটা বোবা কান্না যেন মলির গলাকে আটকে ধরল। সে বলল–এইমাত্র সবকিছু যেন কিরকম সহজ ও স্বাভাবিক মনে হচ্ছিল। এই রান্নাঘর…সমস্ত জিনিষপত্র..মলি অস্পষ্ট ধরা গলায় বলে গেল–কিন্তু…কিন্তু আবার হঠাৎই দুঃস্বপ্নের ছায়াগুলো পুনরাবির্ভাব ঘটল!
রেন মলির দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে ছিল। তার চোখেমুখে দেখা গেল এক অদ্ভুত অভিব্যক্তি। সব বুঝতে পেরেছে এরকম ভান করে মাথা নাড়িয়ে বার কয়েকবার বললেন হ্যাঁ আমি বুঝতে পারছি। তাহলে…তাহলে এখন আমি যাই। এখন আপনাকে বিরক্ত না করাই ভালো!
অনুরোধের সুরে মলি বললনা, আপনি যাবেন না।
ততক্ষণে রেন দরজার কাছে পৌঁছে গেলেন। সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তিনি ঘাড় ঘুরে তাকালেন। তারপর পায়ে পায়ে এগিয়ে গিয়ে বললেন–আপনি কি সত্যিই তাই চান?
মলি বলল–কি চাওয়ার কথা বলছেন?
মানে আমি এখানে থাকি সেটাই কি আপনি চান?
মলি বলল হ্যাঁ, নিশ্চয়, আমি এখন একলা থাকতে চাই না। একলা থাকলেই আমায় ঘিরে ধরছে হাজার রকমের দুশ্চিন্তা।
একটা চেয়ার টেনে বসলেন ক্রিস্টোফার রেন শান্ত ভঙ্গিতে। মলিও তার হাতের কাজ শেষ করে একটা চেয়ার টেনে বসল।
ক্রিস্টোফার বিড়বিড় করে বলল সত্যিই খুব আশ্চর্যের ব্যাপার!
মলি বলল–কি আশ্চর্যের ব্যাপার?
আপনি যে আমার সঙ্গে একা থাকতে ভয় পাচ্ছেন না সেইজন্য খুব অবাক লাগছে। আচ্ছা সত্যিই আপনি ভয় পাচ্ছেন না তো?
মলি মাথা নাড়ল, জোরে বলল–না, মোটেই না।
এই ভয় না পাওয়ার কারণ কি, মিসেস ডেভিস?রেন প্রশ্ন করল।
আমি জানি না ঠিক, তবে এটা সত্যি।
কিন্তু অপরাধী হিসেবে আমার ওপরেই তো প্রথম জাগে সন্দেহটা। আমার সঙ্গে মিলে যায় সবকিছুই।
মলি দৃঢ়কণ্ঠে জানাল–না। সন্দেহভাজন আরো অনেকেই আছে। সার্জেন্ট ট্রেটারের সঙ্গে কথাবার্তা হচ্ছিল সেই বিষয়ে।
তিনি কি বিশ্বাস করেছেন আপনার কথা?
ধীরে ধীরে মলি উত্তর দিল–অবিশ্বাসও করেননি।
কতগুলো টুকরো টুকরো শব্দ তার মাথার মধ্যে বার বার ভেসে আসছে। বিশেষ করে ট্রেটারের সেই অমোঘ উক্তি–আপনার মনের মধ্যে এমন কি ধরনের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ঘটে চলেছে আমি তার কিছুটা বুঝতে পারি, মিসেস ডেভিস!
সব কিছুই কি তিনি জানতে পেরেছেন? আরও একটা গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য তিনি করেছেন। প্রকৃত হত্যাকারী নাকি সমস্ত পরিস্থিতিটা বেশ তাড়িয়ে তাড়িয়ে উপভোগ করছেন? এটাও কি সত্যি!
ঈষৎ উদ্বিগ্ন কণ্ঠেই রেনকে প্রশ্ন করলো মলি, আপনি নিশ্চয়ই এই বিপদসঙ্কুল পরিবেশটা মনে মনে বুঝতে পারছেন না। মুখে আপনি যাই বলুন না কেন।
আসল ব্যাপারটা নিশ্চয় তা নয়।
না না, নিশ্চয় না, অবাক হয়ে মলি তাকিয়ে রইল ক্রিস্টোফারের দিকে।
এ ধরনের একটা ঘটনা আপনার মাথায় ঢুকলো কি করে?
এটা আমার বক্তব্য নয়, সার্জেন্ট ট্রেটারের। আমি…আমি…ওই লোকটাকে ঘৃণা করি।
কিভাবে আপনার মাথায় ঢুকলো এই ধরনের একটা ধারণা? যা একদমই সত্যি নয়…যা একেবারেই অসম্ভব…
মলির কণ্ঠস্বর ভাঙা ভাঙা।
তার শরীরটা অবসাদে এখন ভেঙে পড়েছে।
কান্নার ভারে চোখ দুটো বুজে আসছে।
মলি টেবিলে মাথা রেখে মুখ ঢাকলো। ক্রিস্টোফার এগিয়ে এসে মলির পিঠে হাত রাখলো।
তার কণ্ঠে গভীর সমবেদনার স্পর্শ। ক্রিস্টোফার ডাকলেন, মলি মুখ তোলো, এই প্রথম নাম ধরে ডাকলেন।
তোমার কি হয়েছে?
ধীরে ধীরে মলি সংযত করলো নিজেকে। ক্রিস্টোফারের আচার আচরণের ছেলেমানুষ সুলভ প্রগলভতার কোনো চিহ্ন নেই।
কি ব্যাপার মলি?
ক্রিস্টোফার পুনরায় প্রশ্ন করলেন।
মলি অপলখ চোখ তুলে রেনের দিকে তাকিয়ে রইলো কয়েক মুহূর্ত।
তার দৃষ্টির গভীরে একটা স্থির আলোর উদ্ভাস। ক্রিস্টোফার আমাদের এই পরিচয়টা কত দিনের?
দু দিন মাত্র…?
প্রায় সেই রকমই। কিন্তু তোমার কি মনে হচ্ছে না পরস্পরকে আমরা জানি অনেকদিন আগেই?
হ্যাঁ, ব্যাপারটা খুব অদ্ভুত! তাই না?
ঠিক বলা যায় না। তবে আমরা যেন পরস্পরের হৃদয়টা গভীরভাবে বুঝতে পারছি। দুজনেই আমরা এখন একই বিপদের মুখোমুখি এসে পড়েছি বলেই হয়ত এমন একটা সহমর্মিতা গড়ে ওঠা সম্ভব হয়েছে।
ক্রিস্টোফারের গলায় কোনো প্রশ্নের আভাস ছিল না। সহজ সরল বিবৃতির মতই শোনাল কথাটা। এর উত্তর দেওয়ার জন্যও মলির মধ্যে কোনো আগ্রহ দেখা গেল না। একটু থেমে অন্য প্রসঙ্গ শুরু হল। তার কথার সুরেও ঝঝ নেই প্রশ্নের। স্বাভাবিক একটা সত্যকে সে নির্বিঘ্নে বলেছে। বলল তোমার আসল নামটা নিশ্চয় ক্রিস্টোফার রেন নয়…?
উত্তর দিলনা।
মলি বলল–তবে তুমি কেন…।
নাম বদলিয়ে ছদ্মবেশে ঘুরে বেড়াচ্ছি এই তো? আমার এটাকে একটা ব্যক্তিগত খেয়ালও বলা যায়। ছোটবেলায় আমার সহপাঠীরা আমাকে ক্রিস্টোফার রবিন বলে ডাকতো। সেখান থেকেই এই নামটা মাথায় এসেছে আমার।
মলি জিজ্ঞেস করল–তাহলে তোমার আসল নামটা কি?
শান্ত গলায় ক্রিস্টোফার জবাব দিলেন-আসল নামটা শুনে তোমার কোনো উপকার হবে না। তবে স্থপতি আমি নই। প্রকৃতপক্ষে আমি একজন পলাতক সৈনিক।
কিছুক্ষণের জন্য মলির দু চোখে একটা ভয় ও উদ্বেগের ছায়া ঘনিয়ে এল।
সেটা ক্রিস্টোফারের নজর এড়াল না, বলল–হ্যাঁ,…ঠিক আমাদের অজ্ঞাতকুলশীল হত্যাকারীর মত। সেইজন্যেই তো বললাম, আমার সঙ্গে খুব ভালো মিশে যায় খুনীর বৈশিষ্ট্যগুলো।
মলি ধমকে উঠে বলল–বোকার মত কথা বলো না। আগেই জানিয়েছি, হত্যাকারী বলে আমি তোমাকে বিশ্বাস করি না, ঠিক আছে আগাগোড়া খুলে বল তোমার কাহিনীটা। সেনাবাহিনী থেকে পালাতে গেলে কেন? ভয়…?
ভয় পেয়ে পালিয়েছি কিনা সে বিষয়ে জিজ্ঞেস করছো? না। ব্যাপারটা অদ্ভুত হলেও সত্যি। তেমন কোনো ভয় ছিল না আমার। অন্ততপক্ষে সাধারণ অন্যান্য সৈনিকদের চেয়ে আমার সাহস কিছু কম ছিল না। এমন কি গোলাগুলি চলাকালীনও আমার মেজাজ শান্ত থাকত আশ্চর্যভাবে। সেজন্য আমার একটা বিশেষ সুনাম ছিল সেনাবাহিনীতে। এই সব তুচ্ছ কারণে আমি সেনাবাহিনী থেকে পালিয়ে আসিনি। প্রকৃত কারণ হল আমার মা।
মলি বলল–তোমার মা?
রেন বলল–হ্যাঁ, গত যুদ্ধের সময় নাৎসী বিমানবাহিনীর আক্রমণে আমার মা মারা যায়। তিনি যে বাড়িতে ছিলেন, বোমার আঘাতে সেই বাড়িটা একেবারে ধ্বংস হয়ে যায়। সেই ধ্বংসস্তূপের মধ্যে থেকে মৃতদেহটা বার করে আনতে হয়েছিল। খবরটা শোনার পরই কেমন যেন তালগোল পাকিয়ে গেল মাথাটা। সাময়িকভাবে আমি বোধহয় পাগলই হয়ে গেলাম। আমার মনে হল–মা নয়, আমিই যেন সেই ধ্বংসস্তূপের মধ্যে চাপা পড়ে আছি। আমাকে সেই মুহূর্তে উদ্ধার না করলে আমি শ্বাস বন্ধ হয়ে মারা যাব।–অসহায়ভাবে ক্রিস্টোফার মাথা ঝাঁকালেন। অপরিসীম ক্লান্তিতে বুজে আসতে চাইছে কণ্ঠস্বর। দুঃস্বপ্নে ভরা সেই দিনগুলির কথা কেউ বোঝে না। শিবির ছেড়ে রাতের অন্ধকারে পালিয়ে গেলাম।
৪. উদভ্রান্তের মতো
উদভ্রান্তের মতো বনে জঙ্গলে পাহাড় পর্বতে ঘুরে বেড়ালাম। তারপর যখন সম্বিৎ ফিরে এলো তখন অনেক দেরী হয়ে গেছে। শান্তি ফেরাতে পুনরায় শিবিরে গেলেও ওড়াতে পারলুম না। কারণ ইতিপূর্বেই আমার নাম ফেরারীদের তালিকায় উঠে গেছে। এই সাময়িক অন্তর্ধানের কোনো সন্তোষজনক কৈফিয়ৎ আমার জানা নেই। তখন থেকে আমি কেবল পালিয়ে পালিয়েই বেড়াচ্ছি। ক্রিস্টোফার এক জোড়া শূন্য হতাশ চোখে মলির দিকে তাকিয়ে রইলেন।
তোমার ধারণাটাই সম্পূর্ণ ভুল। সান্ত্বনার সুরে মলি বললো, তুমি আবার নুতন করে সব কিছু আরম্ভ করতে পারো।
কারোর পক্ষেই কি তা আর সম্ভব? নিশ্চয়! তাছাড়া তুমি তো এখনও যুবক! তোমার বয়সও কম।
হ্যাঁ তা ঠিক। তবে আমি একবারে জীবনের শেষ প্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছি। সব কিছুই আজ আমার নিঃশেষ হয়ে গেছে।
নাঃ, দৃঢ় কণ্ঠে প্রতিবাদ জানালো মলি। তোমার কিছুই ফুরিয়ে যায়নি। এর সমস্তটাই তোমার কল্পনাপ্রসূত। আমার বিশ্বাস, প্রত্যেকের জীবনেই একবার করে এই ধরনের একটা অনুভূতির জোয়ার আসে। তখন মনে হয়, দিগন্ত জুড়ে গভীর অন্ধকার ঘনিয়ে আসছে। পায়ের নিচে মাটিটুকু তো আর খুঁজে পাব না। সবকিছুর চরম পরিসমাপ্তি বুঝি আসন্ন।….
তুমি নিশ্চয় কোনো এক সময় এমন পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছিলে? তা না হলে তো এত নিখুঁত ভাবে বর্ণনা দিতে পারতে না?
অকপটে মাথা দুলিয়ে বলল–হ্যাঁ, তা হয়েছিলাম বৈকি।
তোমার সমস্যাটা কি ছিলো?
সমস্যাটা যদিও কিছু নতুন নয়। অনেকের ভাগ্যেই সেরকম ঘটতে দেখা গেছে। আমি যে যুবকটির বাগদত্তা ছিলাম সে একজন পাইলট ছিল। আগের যুদ্ধে সে মারা যায়।
শুধু এই…আর কিছু নয়তো?
সে বলল–হ্যাঁ, আরো আছে। ছেলেবেলায় আমি একটা প্রচণ্ড মানসিক আঘাত পাই। আমাকে হিংস্রতা ও নিষ্ঠুরতার সম্মুখীন হতে হয়েছিল। তখন থেকেই একটা বিরূপ ধারণা ছিল বুকের মধ্যে। জ্যাকও যখন তারপর দুর্ঘটনায় মারা গেল, তখন মনে হল–সমস্ত জীবনটাই বুঝি এইরকম ক্রুর বিশ্বাসঘাতকতায় ভরা ছিল। মানুষের কোনো স্বপ্নই সত্যি হয় না।
হা…পেরেছি বুঝতে। আর তারপরে বুঝি… রেন মলির দিকে চোখ তুলে প্রশ্ন করল জিলের সঙ্গে বুঝি পরিচয় হল?
মলির পাতলা ঠোঁটে হাসির রেখা ছড়িয়ে গেল। বলল–হ্যাঁ এবং জিলের আসার সঙ্গে সঙ্গে নতুনভাবে যেন আমার জীবনটা বইতে শুরু করল। এ যেন সম্পূর্ণ নতুন অভিজ্ঞতা। আগের যাবতীয় ভয় আর দুর্ভাবনা কোথায় যেন একমুহূর্তে মিলিয়ে গেল। জিল নামটার মধ্যে যেন লুকিয়ে আছে সুখ আর নিরাপত্তার আস্বাদ।
তার ঠোঁট থেকে যেন হঠাই হাসির রেখাটুকু মিলিয়ে গেল। চোখে মুখে দেখা গেল ঝড়ের পূর্বাভাস। প্রচণ্ড ঠান্ডার জন্যও তার শরীরটা বারকয়েক কেঁপে উঠল।
সে বলল–সত্যিকারের ঘটনাটা কি? কিসের জন্য তুমি এত বিচলিত হচ্ছো মলি? সত্যিই তুমি মনে মনে খুব অস্থির হয়ে পড়েছে। বল কথাটা ঠিক কিনা?
মলি আস্তে করে মাথা নেড়ে বলল–হ্যাঁ। জিলের সঙ্গে নিশ্চয় কিছু-এর সম্পর্ক আছে? ও কি তোমায় কিছু বলেছে বা এমন কোনো কাজ করেছে…
না আসলে জিল নয়। ওই লোকটা…ওই লোকটা ভয়ঙ্কর…
ক্রিস্টোফার চমকে উঠে বলল–কাকে তুমি ভয়ঙ্কর বলছো? প্যারাভিসিনি?
মলি বলল-না না, সার্জেন্ট ট্রেটার!
রেন বল সার্জেন্ট ট্রেটার?
মলি বলল-হা, ওই ভদ্রলোকই ইঙ্গিত করলেন এমন কতগুলো ব্যাপার…জিলের ব্যাপারে এমন কতগুলো বাজে ধারণা ঢুকিয়ে দিলেন আমার মাথায়। আমি কোনোদিন সে সমস্ত বিষয়ে চিন্তা পর্যন্ত করিনি! এমন কি তাদের অস্তিত্বের কথাও জানা ছিল না আমার! লোকটি সত্যিই খুব ভয়ঙ্কর। ঘৃণা করি আমি…এই ধরনের লোকদের ভীষণ ঘৃণা করি আমি…
চিন্তার ভাঁজ পড়ল ক্রিস্টোফারের ভূ দুটিতে। বিস্ময়ের আভাস ছিল তার কথার সুরে। জিল? …জিল। হ্যাঁ দুজনেই আমরা প্রায় সমবয়সী। যদিও ওকে বয়সে কিছুটা বড় দেখায় তবে তা নয় আসলে। হ্যাঁ, ঠিকই। জিলের সঙ্গেও নাকি অনেক মিল আছে অজ্ঞাত হত্যাকারীর। তবে মলি–এ সব চিন্তা খুবই হাস্যকর। ভিত্তিহীন অলীক কল্পনামাত্র। কারণ, কার্লভার স্ট্রীটে যেদিন ওই মেয়েটা মারা যায়, সেদিন জিল সারাক্ষণ তোমার সঙ্গেই ছিল এখানে?
মলি চুপ করে রইল। তার আড়ষ্ট চোখমুখ। মলির ভাবগতিক তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে লক্ষ্য করল ক্রিস্টোফার। বলল–তবে কি জিল এখানে ছিল না?
মলি এবার উত্তর দিল। জড়িত গলায় বলল– সেদিন সারাক্ষণই জিল বাড়ীর বাইরে ছিল। খুব সকালেই সে বেরিয়েছিল গাড়ী নিয়ে। আমি জানতাম, শহরের অপরদিকে একটা নিলাম ঘর থেকে ও কিছু তারের জাল কিনতে গেছে। সেই কথা জানিয়ে গিয়েছিল আমাকে। এর মধ্যে এতটুকু অবিশ্বাস ছিল না, কিন্তু…
রেন প্রশ্ন করল–সেখানে কি ও যায়নি?
মলি ম্লানমুখে এগিয়ে গেল টেবিলটার দিকে, তারপর টেবিলের ওপর থেকে দুদিনের আগের ইভনিং স্ট্যাণ্ডার্ডটা তুলে আনল।
ক্রিস্টোফার কাগজটা সাগ্রহে নিয়ে বলল–এটা তো দেখছি দুদিনের পুরনো একটা লণ্ডন সংস্করণ?
জিল যখন ফিরে এলো তখন এই পত্রিকাটা ওর কোটের পকেটে ছিলো।
তাহলে…তাহলে ও নিশ্চয় লণ্ডনে গিয়ে থাকবে।
ক্রিস্টোফারের দৃষ্টিতেও সন্দেহের ছায়া। একবার মলির দিকে আর একবার কাগজটার দিকে ফিরে তাকালেন ক্রিস্টোফার।
ঠোঁট বেঁকিয়ে শিস্ দিতেও শুরু করলেন মৃদু সুরে। পরমুহূর্তে সংযত করলেন নিজেকে। এখন ওই সুরটার উপযুক্ত সময় নয়।
মলির চোখের দিকে একবারও না তাকিয়ে এবং খুব সুনির্বাচিত শব্দ সাজিয়েই তিনি তার বক্তব্যটা উপস্থিত করলেন।
কতটুকু জানো জিলের সম্বন্ধে তুমি?
থামো…থামো, চুপ করো!
আর্ত সুরে চেঁচিয়ে উঠলো মলি।
শয়তান ট্রেটারও আমাকে এই একই প্রশ্ন করেছিলেন।
অথবা এমন ধরনেরই একটা কিছুর ইঙ্গিত দিয়েছিলেন তিনি। বললেন, মেয়েরা প্রায়শই কিছু না জেনে সম্পূর্ণ অপরিচিত অজ্ঞাত কুলশীল কোনো পুরুষকে জীবনসঙ্গী হিসেবে বেছে নেয়। তাদের পূর্ব জীবন সম্বন্ধে তাদের স্ত্রীদের সঠিক কোনো ধারণা থাকে না।
যুদ্ধের সময়েই এমন ঘটনা বেশি ঘটে।
কেবলমাত্র পুরুষদের মুখের কথা বিশ্বাস করেই মেয়েরা বিবাহ-বন্ধনে আবদ্ধ হয়। তিনি খুব একটা মিথ্যে বলেননি। এ ধরনের অনেক কাহিনীই ইদানীং শোনা গেছে।
তুমিও আবার এই একই কথা বলতে শুরু করো না।
আমি আর সহ্য করতে পারছি না! আমরা ভাগ্যচক্রে এক অস্বাভাবিক পরিস্থিতির মধ্যে পড়ে গেছি বলেই এই সমস্ত চিন্তা-ভাবনা মনের মধ্যে উদয় হচ্ছে। যত অবিশ্বাস্যই শোনাক না কেন, যে কোনো অশুভ ইঙ্গিতই এখন আমরা অতি সহজে বিশ্বাস করে নেবো।
কিন্তু সেটা সত্যি নয়…আদপেই সত্যি না! আমি…
আচমকাই মলির বাক্যস্রোত মাঝপথে রুদ্ধ হয়ে এলো। ধীরে ধীরে উন্মুক্ত হলো ভেজানো দরজাটা, ঘরের মধ্যে প্রবেশ করল জিল।
থমথমে মুখ চোখ। তোমাদের অন্তরঙ্গ আলাপ-আলোচনায় কোনোরকম বাঁধা দিলাম না তো?
বিশেষ কাউকে উদ্দেশ না করেই তির্যক কণ্ঠে প্রশ্নটা ছুঁড়ে দিলো জিল।
রেন অপ্রস্তুতভাবে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। আমি আপনার মিসেসের কাছ থেকে কয়েকটা রান্নার টুকিটাকি শিখে নিয়েছিলাম।
তাই নাকি? ভালো ভালো!…দেখুন মিঃ রেন বর্তমান পরিস্থিতিতে এই ধরনের আজগুবি গল্প করে বেড়ানো খুব একটা উচিত নয়। দয়া করে আপনি এখন রান্নাঘর থেকে বাইরে যান… কি আমার কথাটা কি আপনার মাথায় ঢুকল না?…
হ্যা..নিশ্চয়!
আর একটা কথা মনে রাখবেন। মলির কাছ থেকে দূরে থাকার চেষ্টা করবেন। আমার স্ত্রী পরবর্তী শিকার হোক, এটা আমি চাই না!
ক্রিস্টোফার শান্ত গলায় বলল– সেইজন্যই, আমি মনে মনে এত উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছি।
এই সহজ কথাটার মধ্যে কোনো গূঢ় অর্থ আছে কিনা, সেটা গ্রাহ্য করল না জিল। তার মুখচোখ আরো পাঁশুটে হয়ে উঠল। জিল কঠিন স্বরে মন্তব্য করল–চিন্তা-ভাবনার দায়িত্বটা আমার উপর ছেড়ে দেন না কেন! আমিই আমার স্ত্রীকে দেখাশোনা করতে পারবো। যদি ভালো চান তো এখান থেকে আপনি চলে যান!
মলি নিবেদন জানাল–দয়া করে তুমি চলে যাও রেন!
রেন দরজার দিকে এক পা-এক পা করে এগোলেন। এগোতে এগোতে বলে গেলেন– তবে আমি কাছাকাছি আছি। তার এই বক্তব্যটা যে যথেষ্ট ইঙ্গিতপূর্ণ সেটা বলাবাহুল্য।
জিল অধৈৰ্য্য ভঙ্গিতে বলল–আপনি কি যাবেন দয়া করে?
ক্রিস্টোফার শিশুর মত সরল হাসি হেসে বলে-হা…হ্যাঁ, কম্যাণ্ডার, নিশ্চয়… তিনি বাইরে বেরিয়ে দরজাটা সশব্দে বন্ধ করে দিলেন। সোজাসুজি জিল এবার ফিরে তাকালো মলির দিকে। তারপর বলল–মলি, তোমার কি একটুও কাণ্ডজ্ঞান নেই? ওই খুনে পাগলটার সঙ্গে ঘর বন্ধ করে বসে আছো?
বক্তব্যটা গুছিয়ে নিয়ে মলি বলল–তবে ওই লোকটা খুব একটা ভয়ঙ্কর প্রকৃতির নয়, তাছাড়া আমি নিজেই খুব সাবধান হয়ে আছি। যে কোনো বিপজ্জনক পরিস্থিতির সঙ্গে আমি মোকাবিলা করতে পারব।
জলি মুচকি হেসে বলল–মিসেস বয়েলও এই একই কথা বলেছিলেন।
মলি বিরক্ত সুরে বলল–ও…জিল, আবার তুমি সেই একই কথা বলতে শুরু করেছ?
আমি দুঃখিত মলি, কিন্তু সব কেমন যেন আমার গণ্ডগোল হয়ে যাচ্ছে। এই বাজে প্রকৃতির লোকটির মধ্যে তুমি যে কি এমন দেখলে আমি তো বুঝতে পারছি না।
মলি শান্তস্বরে বলল–ওই লোকটার জন্য আমার কষ্ট হয়।
জিল বিদ্রূপ সুরে বলল–একটা খুনে পাগলার জন্য সমবেদনা? মলি এবার অদ্ভুতভাবে তাকিয়ে রইল জিলের দিকে।
তারপর বলল–হ্যাঁ, একটা খুনে পাগলার জন্য আমার মনে সমবেদনা জাগতে পারে!
শুনলাম তুমি ওকে ক্রিস্টোফার বলেই ডাকছিলে। এতটা ঘনিষ্ঠতা কি করে হলো?
মলি রেগে গিয়ে বলল–জিল, বোকার মত কথা বলো না, আজকাল সবাই সবার নাম ধরে ডাকে, সেটা তুমি ভালোভাবেই জানো!
হ্যাঁ, জানি, তবে তার জন্য সময় লাগে দু-চারদিন। এক্ষেত্রে যেন একটু তাড়াতাড়ি মনে হচ্ছে। সম্ভবতঃ তুমি ক্রিস্টোফার রেনকে আগে থেকেই চিনতে। ভদ্রলোক যে মিথ্যে পরিচয়ে এখানে আসবেন তা আগে থেকে ঠিক করা ছিল। আসলে তাকে তুমিই হয়ত ডেকেছিলে। এটা নিশ্চয় তোমাদের দুজনের কারসাজি।
মলি অবাক চোখে জিলের দিকে তাকিয়ে বলল–জিল তোমার কি বুদ্ধি কি লোপ পেতে শুরু করেছে? তোমার কথার মানে কি?
জিল বলল–আমার কথার মধ্যে এমন কোনো জটিলতা নেই। আমি বলতে চাই ক্রিস্টোফার রেনের সঙ্গে তোমার অনেকদিনের পুরনো পরিচয়। এবং কোনো কারণে তোমাদের এই পরিচয়টা আমার কাছে গোপন করতে চাও।
মলি বলে নিশ্চয় তোমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে।
জিল বলে–এই পুরোন পরিচয়ের কথা যে তুমি আমার কাছে গোপন করবে তা আমি জানি। তবে একটা নির্জন হোটেলে রেনের হঠাৎ আবির্ভাবটাও কেমন আশ্চর্যজনক যোগাযোগ বলে মনে হয়।
মেজর মেটকাফ…
কিংবা মিসেস বয়েলের চেয়েও বেশি আশ্চর্যের?
অবশ্যই! আমি অন্তত সেই রকমই মনে করি। তাছাড়া বইয়ে যা পড়েছি–এই সমস্ত উন্মাদ প্রকৃতির খুনিদের নারীর প্রতি একটা তীব্র মোহ থাকে।
এখানেও প্রমাণ পাওয়া গেছে।…
আচ্ছা তোমাদের কি ভাবে পরিচয় হলো? এর ইতিহাসই বা কতদিনের?
তোমার কথাবার্তা ক্রমেই পাগলের প্রলাপে গিয়ে পৌঁছেছে, জিল।
এখানে আসবার আগে ক্রিস্টোফার রেনের সঙ্গে আমার কোনো পরিচয়ই ছিলো না।
তুমি কি দুদিন আগে ভদ্রলোকের সঙ্গে দেখা করবার জন্যে লণ্ডনে গিয়েছিলে? অপরিচিত অতিথি হিসাবে এই হোটেলে এসে আশ্রয় নেবার ব্যাপারেও নিশ্চয় তখন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিলো?
তুমি নিশ্চয় জান ভালোভাবে, আগের কয়েক সপ্তার মধ্যে আমি লণ্ডনে যাইনি।
তাই বুঝি? খুবই আশ্চর্যের কথা! জিল পকেটে হাত ঢুকিয়ে একটা পশমের দস্তানা বের করল। তারপর বলল–গত পরশু এই দস্তানাটাই তো ছিল তোমার হাতে–আমি যেদিন তারের জাল কিনতে সেলহ্যামে গেলাম?
তীব্র অনুসন্ধানী দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে বিড়বিড় করলো মলি, সেদিন বাইরে বেরোবার সময় আমি ওই দস্তানাটাই পরেছিলাম।
তুমি আমাকে জানালে, জরুরী প্রয়োজনে তোমাকে গ্রামের দিকে যেতে হয়েছিল। কিন্তু তুমি গ্রামের গেলে তো এটা এলো কোথা থেকে? ক্ষুব্ধ চিত্তে গোলাপী মাথা নেড়ে মলির দিকে বাড়িয়ে ধরলো জিল।
ক্ষনেকের মধ্যে বোবা হয়ে গেল মলি, তুমি লণ্ডন গিয়েছিলে, তাই না? প্রশ্ন করলো জিল।
হা, গিয়েছিলাম। আড়ষ্ট ভঙ্গিতে মাথা নাড়ালো মলি। তার দু গালে রক্তিম আভা।
আমি এখান থেকে লণ্ডনেই চলে যাব।
ক্রিস্টোফার রেনের সঙ্গে দেখা করেছে?
না না, ওসব কোনো ব্যাপারই নয়।
তবে কি জন্যে?
মলি দৃঢ় কণ্ঠে ঘোষণা করল,–এই মুহূর্তে তোমায় আমি তার উত্তর দিতে রাজি নই।
তার অর্থ একটা বিশ্বাস যোগ্য গল্প বানাবার সময় চাইছো।
এই তো? তুমি… তুমি এত নিচ জিল!
উত্তেজনায় মলি গলা কাঁপিয়ে বলল, আমি তোমাকে ঘৃণা করি।
আমি অবশ্য করি না, কিন্তু করতে পারলেই যেন স্বস্তি পেতাম।
এখন মনে হচ্ছে…, তুমি আমার কাছে সম্পূর্ণ অজ্ঞাত, অপরিচিত… তোমার সম্বন্ধে প্রায় কিছুই আমি জানি না।
আমার বক্তব্যও ঠিক তাই।
তুমি আমার জীবনে একজন বিদেশী আগন্তুক ছাড়া আর কিছুই নয়। আমার কাছে নির্দ্বিধায় মিথ্যে বলতেও তোমার বাধে না…।
আমি কখন তোমাকে মিথ্যে বলেছি?
মলির ঠোঁটের ফাঁকে রুগ্ন হাসি ফুটে উঠলো।
তুমি কি ভাবছো আমি তোমার এই তারের জাল কিনতে আসার আষাঢ়ে গল্প সত্যি বলে বিশ্বাস করি?
ওই একই দিনে তুমিও লণ্ডনে গিয়েছিলে।
তুমি নিশ্চয় আমাকে কোথাও দেখেছিলে? ক্লান্তকণ্ঠে জিল বললো, এবং আমার ওপর এইটুকু বিশ্বাসও তোমার নেই যে…।
তোমাকে বিশ্বাস!
আমি আর কোনোদিনই কাউকে বিশ্বাস করবো না… কখনও না।
ইতিমধ্যে কিচেনের ভেজানো দরজাটা যে নিঃশব্দে ঈষৎ ফাঁকা হয়েছিলো, দুজনের কারোরই সেটা নজরে পড়েনি।
মৃদু শব্দে কেশে উঠলেন প্যারাভিসিনি।
পরিবেশটা সত্যিই বেশ অস্বস্তিকর! বিব্রত কণ্ঠে মন্তব্য করলেন তিনি।
আমি আশা করি, তোমাদের এই মনোমালিন্যটাও তেমন গভীর নয়।
যুবক যুবতীদের দাম্পত্য কলহে এমন অনেক অবাঞ্ছিত প্রসঙ্গেরই অবতারণা ঘটে থাকে, যাকে হালকা ভাবে গ্রহণ করা উচিত।
জিল তীব্র স্বরে বলে উঠল–দাম্পত্যকলহ? খুব ভালো বলেছেন কথাটা।
প্যারাভিসিনি মাথা নেড়ে বললেন–হ্যাঁ নিশ্চয়, তোমাদের তরুণ মনের ভেতরে যে আলোড়ন চলছে তা আমি বুঝতে পারছি। কারণ একসময় তোমাদের এই বয়সটা আমি পার হয়ে এসেছি। এবং আমার স্ত্রীও খুব মুখরা ছিল। কিন্তু আমি যা এখন বলতে এসেছি তা হল এই যে, ইনসপেক্টর ট্রেটার আমাদের সকলকে ড্রইংরুমে যেতে বলছেন। কথাবার্তা শুনে মনে হল ভদ্রলোকের মাথায় নতুন কোনো পরিকল্পনা এসেছে। একটু থেমে আবার বলতে শুরু করলেন–পুলিস কোনো সূত্র পেয়েছে তা প্রায়ই শুনতে পাচ্ছি। কিন্তু পুলিসের মাথায় কোনো পরিকল্পনা এসেছে একথা কেউ শুনেছে বলে তো আমার বিশ্বাস হয় না। আমাদের এই পুলিস অফিসার সার্জেন্ট ট্রেটার খুবই জেদী এবং পরিশ্রমী এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। তবে তেমন একটা তার বুদ্ধি আছে বলে তো মনে হয় না।
মলি বলল–জিল, তুমিই হয় যাও আমার এখনও রান্না বাকি আছে। সম্ভবতঃ সার্জেন্ট ট্রেটার তার কাজ চালিয়ে যেতে পারবেন।
প্যারাভিসিনি বলল,–রান্নার কথাই যখন উঠলো আপনি কি কখনও রুটির টুকরোর উপর মুরগীর মেটে ছড়িয়ে তার ওপর যকৃতের তেল দিয়ে ভাজা শুয়োরের মাংস আর রহিসরষের মোটা প্রলেপ দিয়ে কখনও টোস্ট তৈরি করেছেন? ওঃ, সে কি অপূর্ব খেতে।
জিল রুক্ষুকণ্ঠে জবাব দিল-যকৃতের তেল এই বাজারে খুব একটা পাওয়া যায় না। আসুন মিঃ প্যারাভিসিন।
আমি কি এখান থেকে আপনাকে সাহায্য করবো কোনোভাবে ম্যাডাম?
জিলের কণ্ঠে বাজল অন্য সুর– তার কোনো প্রয়োজন হবে না। আপনি আমার সঙ্গে ড্রয়িংরুমেই চলুন। প্যারাভিসিনি মুচকি হাসলেন। বললেন– আপনার স্বামী ভয় পাচ্ছেন আমাকে। যদিও এটাই স্বাভাবিক। তিনি আমাকে আপনার সঙ্গে একা রাখতে চান না। সম্ভবতঃ আমার এই অদ্ভুত চেহারাটাই দায়ী এজন্য। তবে তিনি যে অসম্মান করছেন আমায়, তা কিন্তু নয়। এবং তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে আমি যেতে চাই না। ভদ্রলোক কথাটা বলে আড়ম্বর সহকারে বিদায় নিল।
মলি অপ্রস্তুত কণ্ঠে বলে উঠল–মিঃ প্যারাভিসিনি নিশ্চয় আপনি….
প্যারাভিসিনি ডান ও বাঁদিকে মাথা ঘুরিয়ে জিলকে উদ্দেশ্য করে বললে– সত্যিই আপনার মাথায় বেশ বুদ্ধি ধরেন মিঃ ডেভিস। কোনোরকম সুযোগ নেওয়ার পক্ষপাতি আমি নই। আমি কি আপনার ও ট্রেটারের কাছে নির্দোষিতার প্রমাণ দাখিল করব। আমি যে একজন খুনে উন্মাদ নই, আপনারা কি সেকথা বিশ্বাস করবেন? কিন্তু তা সম্ভব হবে কিভাবে? নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করা খুবই কষ্টসাধ্য…।
ভদ্রলোক কথা থামিয়ে আস্তে আস্তে শিস্ দিতে শুরু করল।
মলি অস্বস্তি সুরে বলল, দোহাই আপনার। দয়া করে আর ওই সুরটা বাজাবেন না।
তিনটে ইঁদুর অন্ধ–ছড়ার এইগুলো কথাই তো তাই না? এখন আমি এর মানেটা বুঝতে পারি। খুবই ঘৃণ্য নিষ্ঠুর লেখা। নার্সারির পদ্য হিসাবেও এর কোনো সাহিত্যিকগত মূল্য নেই। গ্রাম্য কবির নিষ্ঠুর মানসিকতাই প্রতিটি লাইনে ফুটে উঠেছে। কিন্তু বাচ্চারা অনেক সময় এই নিষ্ঠুরতা পছন্দ করে। সেইজন্য তারা মনে রাখে ছড়াটা। তিনটে অসহায় ইঁদুরের শোচনীয় এই অবস্থাই তাদের মনে আনন্দের খোরাক জোগায়। সেই শেষ দৃশ্যটার দৃশ্য খুবই করুণ, চাষীর বউ একটা ধারালো কঁচি দিয়ে ইঁদুরের লেজগুলো কেটে দিচ্ছে। অসহ্য যন্ত্রণায় তিনটে অন্ধ ইঁদুর ছটফট করছে। ব্যাপারটা দেখতে খুব একটা ভালো লাগে না। কিন্তু বাচ্চারা এতেই আনন্দ পায়।
মলি ক্ষোভ ও হতাশার সুরে বলে উঠল–মিঃ প্যারাভিসিনি আমার একান্ত অনুরোধ, এ ধরনের আলোচনা আপাততঃ এখন আপনি বন্ধ করুন। আপনার কথা শুনে মনে হচ্ছে আপনি খুবই নিষ্ঠুর আর পৈশাচিক। মলির মুখটা আস্তে আস্তে রাগে রাঙ্গা হয়ে উঠল। তাকে একজন রুগী ছাড়া কিছুই মনে হচ্ছে না। গলার সুরটা যেন আজ অন্য সুরে বাজছে। সে আবার বলতে শুরু করল–আপনি তো সারাক্ষণ শুধু হেসেই বেড়াচ্ছেন। আপনাকে মনে হচ্ছে দেখে আপনি যেন একটা বেড়ালসর্বদা আমাদের মত ইঁদুরের সঙ্গে আপনি খেলা করছেন।
কথা থামিয়ে জোরে জোরে হাসতে থাকে মলি।
জিল বলল–মলি শান্ত হও। চলো আমরা না হয় ড্রয়িংরুমে একসঙ্গে যাই। নিশ্চয় ট্রেটার খুব বিরক্ত হয়ে উঠেছেন। রান্নাবান্না পরে করলেও চলবে। খুনের ব্যাপারটা নিয়ে কথা বলাই এখন জরুরী।
প্যারাভিসিনি যেতে যেতে মন্তব্য করলেন–আমি আপনাদের সাথে যেতে না পারার জন্য দুঃখিত। ফাঁসির আসামীরা তাদের প্রাতঃরাশটা খাওয়ার সময় উপভোগ করে!
রেনের সঙ্গে দেখা হল বড় হল ঘরটায়। জিল কটাক্ষ দৃষ্টিতে একবার তাকে দেখল। কিন্তু মলি তার দিকে একবারের জন্যও তাকালো না। দৃষ্টি সামনে রেখে সে সোজা এগিয়ে গেল। দলটা যেন মৌন শবযাত্রার লাইনের মত হেঁটে চলল।
সার্জেন্ট ট্রেটার ও মেজর মেটকাফ ড্রয়িংরুমের দরজার সামনে দাঁড়িয়েছিলেন। মেটকাফের মুখে একটা চাপা রাগের ছাপ ফুটে উঠেছে। ট্রেটার কিন্তু বেশ প্রাণচঞ্চল।
ট্রেটার সমবেত দলকে আহবান জানালেন–আসুন আসুন…, আমি সকলকেই একসঙ্গে দেখতে চাই। এই হত্যাকাণ্ডের ব্যাপারে একটা ছোটখাটো পরীক্ষা করতে চাই–আর সেইজন্য সকলেরই সাহায্য আমার দরকার।
মলি ট্রেটারকে প্রশ্ন করল–এরজন্য খুব বেশি সময় লাগবে? আমার কিন্তু এখনও রান্না বাকি আছে। লাঞ্চের ব্যবস্থাটাতো ঠিকমতো সারতে হবে।
ট্রেটার মাথা দুলিয়ে বললহা তা তো ঠিক, আমি আপনার কথা মানছি। কিন্তু মিসেস ডেভিস বর্তমান পরিস্থিতিতে একবেলা খাওয়ার দিকে মন না দিয়ে এই হত্যারহস্যের উপর দৃষ্টি দেওয়া আমাদের সকলের উচিত। মিসেস বয়েলের কথাটা একবার ভাবুন তো! তার কিন্তু আর কোনো খাবারের প্রয়োজন হয়নি।
মেটকাফ রেগে গিয়ে বললেন সার্জেন্ট, আপনার কথাবার্তাগুলো কিন্তু শুনতে খুব একটা ভালো লাগে না। কোনো ভদ্রমহিলার সামনে এভাবে কথা বলা উচিত নয়।
ট্রেটার বললেন মেজর মেটকাফ, এরজন্য আমি খুবই দুঃখিত। তবে এই ব্যাপারে আমি সবার কাছ থেকেই সহযোগিতা আশা করছি।
মলি প্রশ্ন করল–আপনার স্কী দুটো খুঁজে পেয়েছেন?
সার্জেন্টের চোখে যেন দপ করে আগুন জ্বলে উঠল– বলল–না এখনও পাইনি, তবে কে এটা চুরি করছে, এবং তার চুরি করার কারণটাই বা কি সে ব্যাপারে আমি বুঝতে পারছি। অবশ্য এ ব্যাপারে আমি এখন কিছু বলব না।
প্যারাভিসিনি অনুরোধের সুরে বললেন-দোহাই আপনাকে বলতে হবে না, এই সব কথা শেষের পরিচ্ছদে বেশ মানায়। উত্তেজনাটা তাহলে বেশ উপভোগ করা যায় ভালোভাবে।
এটা কোনো নাটক নভেলের গল্প নয়, আমরা কেউই এখানে খেলা করতে আসিনি।
সত্যিই কি তাই? আমার মনে হয় কোথাও আপনি ভুল করছেন, আসলে এটা তো একটা রঙ্গমঞ্চই অন্ততঃ একজনের কাছে তো বটেই।
মলি বিড়বিড় করে নিজের মনে বলল–বর্তমান হত্যাকারী এই পরিবেশটা বেশ ভালোভাবেই উপভোগ করছে।
প্রত্যেকের দিকে মলি একবার তাকালেন। তার মুখটা আবার লাল হয়ে উঠল। সে বলল- এটা আমার কথা নয় কথাটা বলেছিলেন সার্জেন্ট ট্রেটার। তিনি আমাকে এই কথাটা বলেছিলেন।
কথাটা যে ট্রেটারের খুব একটা ভালো লাগল তার মুখ দেখে তা মনে হল না। সে বলল — আপনার কথাবার্তা শুনে বেশ ভালো লাগে মিঃ প্যারাভিসিনি, ঠিক যেন কোনো রহস্য নাটকের দৃশ্য। কিন্তু একটা কথা মনে রাখবেন এর প্রতি মুহূর্তেই লুকিয়ে আছে বাস্তব। সমস্ত কিছুই বর্তমানে ঘটে যাচ্ছে।
রেন মৃদু হেসে বললেন–তবে যতক্ষণ না ব্যাপারটা আমার ঘাড়ের উপর টের পাচ্ছি—
ট্রেটার এবার গলা ঝাড়া দিলেন। তার চালচলনের মধ্যে আনলেন একটা পুলিসোচিত দৃঢ়তা।
কিছুক্ষণ আগে আমি আপনাদের কাছ থেকে একটা কথা শুনেছি। মিসেস বয়েল যখন মারা যান তখন সে সময় আপনারা কে কোথায় ছিলেন–ওই কথা থেকে জানা যায়–মিঃ রেন ও মিঃ ডেভিস তাদের নিজের নিজের শোবার ঘরে ছিলেন, মিসেস ডেভিস ছিলেন রান্নাঘরে। মেজর মেটকাফ তখন মাটির নিচে গুপ্ত ঘরের সন্ধান পান। এবং মিঃ প্যারাভিসিনি বসে বসে পিয়ানো বাজাচ্ছিলেন।
ট্রেটার একটু চুপ করে সকলের দিকে একবার তাকালেন। তারপর আবার বলতে শুরু করলেন, আপনা নিজেরাই আমাকে এই কথাগুলো বলেছেন। তবে এগুলোর সত্যতা যাচাই করার সুযোগ আমার কাছে নেই। আপনাদের এই কথা সত্যিও হতে পারে আবার মিথ্যেও হতে পারে। স্পষ্ট ভাষায় বলতে গেলে এটাই বলতে হয় এই কথাগুলোর মধ্যে চারটে কথা সত্যি কিন্তু একটা মিথ্যে– কিন্তু প্রশ্ন কোন্ কথাটা মিথ্যে?
তরুণ সার্জেন্ট সকলের মুখের ওপর তার কুটিল দৃষ্টি ছুঁড়ে দিলে। তবে কেউ কোনো উত্তর করল না।
আপনাদের মধ্যে সত্যি কথা বলেছেন চারজন আর একজন ব্যতিক্রম। এই ব্যতিক্রমটাকে আবিষ্কার করার জন্য আমি এই সুন্দর পরিকল্পনা করেছি তার ফলে সত্যিকারের হত্যাকারীর সন্ধান পাওয়া যাবে।
জিল তীক্ষ্ণকণ্ঠে প্রশ্ন করল–মিথ্যেবাদীকেই যে হত্যাকারী হতে হবে তেমন কোনো কথা নেই। অন্য কোনো বিশেষ কারণে কেউ মিথ্যে কথা বলতে পারে!
এক্ষেত্রে তেমন কোনো সম্ভাবনা নেই মিঃ ডেভিস।
কিন্তু আপনার পরিকল্পনাটাই বা কি সার্জেন্ট? একটু আগেই বললেন যে কথাগুলোর সত্য মিথ্যে যাচাই করার মত আপনার কোনো সুযোগ নেই!
ট্রেটার মাথা দুলিয়ে বলল–তা নেই ঠিকই তবে আপনারা প্রত্যেকেই যদি অতীতের এই ভূমিকাটা আরেকবার অভিনয় করে দেখান…
মেজর মেটকাফ বিদ্রুপের সুরে বললেন, বাঃ অপরাধের পুনর্বিন্যাস! পদ্ধতিটাও যদিও সম্পূর্ণভাবে বিদেশী!
ট্রেটার বলল–মেজর আপনি ভুল করছেন, এটা ঠিক অপরাধের পুনর্বিন্যাস নয়। কিছু নিরাপরাধ ব্যক্তির সুনির্দিষ্ট ভূমিকাটুকু আবার অভিনয় করা।
কিন্তু এর থেকে আপনি কি জানতে পারবেন বলে মনে হয়?
কিছু মনে করবেন না, এ ব্যাপারে এখন আমি কিছু বলতে পারব না।
মলির কণ্ঠে তীব্র বিস্ময়ের সুর শোনা গেল–আপনি কি আমাদের ওই সময়ের ঘটনাটুকু অভিনয় করে দেখাতে বলছেন।
ট্রেটার বললেন– হ্যাঁ, অনেকটা সেইরকমই?
ঘরের মধ্যে একটা নিস্তব্ধতা নেমে এল, সবাই যেন অস্বস্তিকর পীড়ায় ভুগছে।
মনে মনে মলি ভাবল–এটা একটা ফঁদ। সত্যিই পরিকল্পনা মাফিক ফাঁদ। কিন্তু কিভাবে এই ফাঁদটা কার্যকরী হবে…
ড্রয়িংরুমের এইরকম পরিস্থিতি দেখে মনে হয় যেন পাঁচজনই অপরাধী। প্রত্যেকেই যেন খুশিমনে তরুণ সার্জেন্টের দিকে অস্বস্তিভরা চাউনিতে বারবার তাকাতে লাগল। যে তাকানোর মধ্যেও ছিল একটা গোপন উত্তেজনার চাঞ্চল্য। সবার আগে ক্রিস্টোফারই চেঁচিয়ে উঠল, বলল কিন্তু আমি বুঝতে পারছি না…এর সাহায্যে আপনি কি করতে চান অথবা যদি আগের ঘটনাটা অভিনয় করে দেখাই তাহলে সমাধানটাই বা কি হবে? এ সমস্ত অবাস্তব ধ্যান ধারণা!
মিঃ রেন সত্যিই কি তাই?
জিল আস্তে আস্তে মাথা দুলিয়ে বলল–হ্যাঁ, নিশ্চয়, আপনার বক্তব্যের মধ্যে যথেষ্ট যুক্তি আছে বলে আমি মনে করি সার্জেন্ট। আমরা এব্যাপারে সকলেই আপনাকে যতটা পারি সাহায্য করব। আমরা ওই সময় কে কি কাজ করছিলাম আমাদের সেই কাজই করতে হবে, তাই তো?
ট্রেটার বলল–হ্যাঁ আপনি ঠিক বলেছেন। আমি আরেকবার দেখতে চাই।
ট্রেটারের দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল মেজর মেটকাফ। ট্রেটার সেদিকে গ্রাহ্যই করল না। প্যারাভিসিনিকে লক্ষ্য করে বললেন, মিঃ প্যারাভিসিনি আপনি তো পিয়ানোতে একটা গানের সুর তুলছিলেন তাই তো? আপনি তখন ঠিক কি করছিলেন দয়া করে একবার দেখাবেন?
প্যারাভিসিনি দৃঢ় পায়ে এগিয়ে গিয়ে পিয়ানোর সামনে টুলের ওপর বসলেন। তিনি মুচকি হেসে সকলের দিকে একবার তাকিয়ে বললেন- এই প্রাণহীন পিয়ানোর ভেতর থেকে এখুনি মৃত্যুর সুর ভেসে আসবে। সকলে মন দিয়ে শুনুন। সেই বিখ্যাত সুর তিনটে ইঁদুর অন্ধ।
যথারীতি পিয়ানোর সাদা কালো রীডের ওপর হাত দিলেন তিনি।
ভদ্রলোক বেশ উপভোগ করছেন ব্যাপারটা মলির তাই মনে হল। সত্যিই তিনি বেশ সয়ে সয়ে উপভোগ করছেন ব্যাপারটা।
বড় ড্রয়িংরুমের মধ্যে এই সুরটা যেন একটা মাদকতা নিয়ে এল সকলের বুকের ওপর দিয়ে যেন একটা শিহরণ লেগে যাচ্ছে।
সার্জেন ট্রেটার তাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন– ধন্যবাদ, মিঃ প্যারাভিসিনি, ঠিক এটাই জানতে চাইছিলাম। আগের বারেও আপনি এই একইভাবে বাজাচ্ছিলেন?
সে উত্তর দিল, হ্যাঁ সার্জেন্ট। একেবারে এইরকম। এবং মাত্র তিনবার আমি এই লাইনটা করেছিলাম।
মলির দিকে তাকালেন ট্রেটার, বললেন মিসেস ডেভিস আপনি পিয়ানো বাজাতে পারেন?
মুখে কিছু না বলে শুধু সম্মতিসূচক মাথা নাড়ল মলি, মিঃ প্যারাভিসিনি যেভাবে দেখালেন, সেভাবে নিশ্চয় সুরটা ফোঁটাতে পারবেন?
মলি বলল–খুব ভালোভাবেই পারব?
ট্রেটার বললেন, তাহলে আপনি এই টুলের ওপর গিয়ে বসুন এবং আমার বলামাত্র আপনি বাজানোর জন্য প্রস্তুত থাকবেন।
মলির মুখের পর যেন একটা বিভ্রান্তির ছায়া ফুটে উঠল। তারপর পায়ে পায়ে বিপরীত দিকে পিয়ানোর দিকে এগিয়ে গেল।
প্যারাভিসিনি একটি বিরক্তি ভঙ্গিতে টুল ছেড়ে দাঁড়ালেন। তার গলায় শোনা গেল মৃদু প্রতিবাদের সুর– কিন্তু সার্জেন্ট আমার ধারণা ছিল– আমরা সবাই যে যার নিজের ভূমিকাটাই দুবার পালন করব। আমি তো সেইসময় পিয়ানোই বাজাচ্ছিলাম।
ট্রেটার বলল হ্যাঁ আগের কাজ একই থাকবে তার কোথাও কোনো বিচ্যুতি হবে না। তবে একই ব্যক্তির দ্বারা যে তা পালিত হবে তার কোনো বাধ্যবাধকতা নেই।
জিল আবার বিড়বিড় করে বলল এর পেছনে যে কি উদ্দেশ্য আছে তা তো কিছুই বোঝা যাচ্ছে না।
এর পেছনে সুনির্দিষ্ট একটা কারণ ঠিক আছে মিঃ ডেভিস। প্রত্যেকেরই কথাটুকু যাচাই করার জন্য এই একটাই পথ আমি বলতে চাই। তাহলে আমি আপনাদের ভূমিকাটুকু জানিয়ে দিচ্ছি। মিসেস ডেভিস এখানে এই পিয়ানোর কাছে আপনি অপেক্ষা করুন। মিঃ রেন, আপনি রান্নাঘরের দিকে যান দয়া করে, মিসেস ডেভিসের রান্নাবান্নার দিকে একটু নজর রাখবেন। আপনাকে মিঃ রেনের শোবার ঘরে যেতে হবে, মিঃ প্যারাভিসিনি। সেখান থেকে আপনি ঐরকম শিস্ দিতে থাকুন। ওই সুরটাই ফুটিয়ে তুলবেন। সুরটা তো খুব প্রিয় আপনার। মেজর মেটকাফ, আপনি মিঃ ডেভিসের শোবার ঘরে টেলিফোনের লাইনটার দিকে লক্ষ্য রাখবেন আর মিঃ ডেভিস সিঁড়ির দিকে কাঠের আলমারির পাশ দিয়ে অন্ধকার গুপ্তকক্ষের দিকে এগিয়ে যান।
কিছুক্ষণ কেউ কোনো কথা বললেন না, তারপর চারজনই কোন কথা না বলে দরজার দিকে এগিয়ে গেলেন। ট্রেটারও তাদের পেছন পেছন গেল।
ট্রেটার বলল–মিসেস ডেভিস আপনি এক থেকে পঞ্চাশ গুনুন। গোনা শেষ হলেই পিয়ানোয় হাত দেবেন।
ট্রেটার ফের সকলের পেছন পেছন চলল। দরজাটা জোরে বন্ধ হবার আগে প্যারাভিসিনির হতচকিত কণ্ঠস্বর মলির কানে ভেসে এলো।
পুলিস যে কখনও আবার এই ধরনের ছেলেখেলায় মেতে ওঠে, সে কথা জন্মে কোনোদিন শুনিনি।
আটচল্লিশ…উনপঞ্চাশ…পঞ্চাশ… গোনা শেষ করে এক মুহূর্ত অপেক্ষা করলো মলি।
তারপর বাধিত ভঙ্গিতেই সাদা কালো রীডগুলোর ওপর ঝুঁকে পড়লো।
তার নরম আঙুলের মৃদুস্পর্শে যেন প্রাণ ফিরে পেলো পিয়ানোটা।
প্রশস্ত ড্রয়িংরুমের মধ্যে এমন একটা ক্রুর নিষ্ঠুর ছন্দই শুধু বুকে হেঁটে ঘুরে বেড়াচ্ছে।
চার দেওয়ালে ধাক্কা খেয়ে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে সুরটা।
তিনটে ইঁদুর অন্ধ।
জানলা কপাট বন্ধ…
মলির মনে হলো তার হৃৎস্পন্দনও বুঝি দ্রুত থেকে দ্রুততর হচ্ছে ক্রমশ শিরায় শিরায় অস্তির এক উত্তেজনা। শরীরের সমস্ত রক্তকণিকাও যেন নাচতে শুরু করেছে তালে তালে। দেখা যাচ্ছে প্যারাভিসিনি যা বলেছিলেন।
মিথ্যা নয়।
বরঞ্চ তা অক্ষরে অক্ষরে সত্যি। এই ছড়াটার মধ্যে এক ধরনের ক্রুর নিষ্ঠুরতা আছে। এবং মনের ওপরও এর প্রভাব খুবই দূর প্রসারী।
শিশুবেলায় এই ছড়া শুনে কি অবোধ নিষ্ঠুরতায় মেতে উঠতো মনটা! পরিপূর্ণভাবে সাবালক হবার পরেও তার প্রভাবটুকু যেন কাটিয়ে ওঠা যায় না।
দোতলায় কোনো শোবার ঘর থেকে এই একই সুরে শিস্ দিচ্ছে কেউ। তবে শব্দটা খুবই মৃদু এবং অস্পষ্ট।
কান খাড়া করে না শুনলে সবটা ঠিক উপলব্ধি করা যায় না।
প্যারাভিসিনিই তাহলে রেনের ঘর থেকে শিস্ দিতে শুরু করেছেন। যুবক ক্রিস্টোফারের ভূমিকাটুকু বেশ ভালোই ফুটিয়ে তুলেছেন তিনি। আচমকা পাশের ঘর থেকে বেতার ঘোষিকার সুরেলা কণ্ঠস্বর ভেসে এলো। সার্জেন্ট ট্রেটারই নিশ্চয় রেডিওটা চালিয়ে দিয়েছেন।
ভদ্রলোক কি তাহলে মিসেস বয়েলের ভূমিকাই গ্রহণ করলেন।
কিন্তু কেন?
এই পরিকল্পনার পশ্চাতে আসল উদ্দেশ্যই বা কি?
গোপন ফাঁদটাই বা কোথায়।
ফাঁদ যে একটা পাতা আছে সে বিষয়ে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই।
মলি অন্তত মনে মনে নিশ্চিত।
একঝলক ঠান্ডা হাওয়া হঠাৎ তার পিঠে এসে লাগলো।
কেউ যেন নিঃশব্দে পেছনে দাঁড়িয়ে তুহিন শীতল হাত রাখলো ঘাড়ের ওপর। ভীষণ ভাবে চমকে উঠে ফিরে তাকালো মলি।
কেউ কোথাও নেই।
দরজাটা আগের মতোই বন্ধ। নিশ্চয় দরজাটা কেউ খুলে ছিলো। তা নাহলে ঠান্ডা হাওয়ার স্পর্শ পাবে কেন?
মনে মনে মলি ভীষণ সন্ত্রস্ত হয়ে উঠলো। যদি সত্যিই কেউ সকলের অলক্ষ্যে ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়ে।
ব্যক্তিটি প্যারাভিসিনি হওয়াও বিচিত্র নয়।
তিনিই হয়তো এখন সহজাত সাবলীলভঙ্গিতে পেছন থেকে মলির ওপর ঝুঁকে পড়ে দশটা বাঁকানো শক্ত আঙুল দিয়ে…আপনি তাহলে সত্যিই ম্যাডাম আপনার মৃত্যুর সুর বাজিয়ে চলেছেন?
বাঃ…দৃশ্যটা বেশ মনোহর! … দূর, কি যে সব আবোল-তাবোল চিন্তা হচ্ছে মাথার মধ্যে।
সমস্তই অলীক অর্থহীন কল্পনা। বাস্তবের সঙ্গে তার কোনো যোগযোগ নেই।
তাছাড়া ভদ্রলোক তো এখনো আগের মতোই মৃদু সুরে শিস্ দিচ্ছেন। দোতলায় রেনের শোবার ঘর থেকেই ভেসে আসছে শব্দটা।
হঠাৎ একটা কথা মনে আসতেই মলি পিয়ানোর ওপর থেকে হাত গুটিয়ে নিলো। প্যারাভিসিনির বাজনা কিন্তু কেউ শুনতে পায়নি।
আসল রহস্যটা কি সেইখানে?
হয়তো আদপেই ভদ্রলোক তখন পিয়ানো বাজাচ্ছিলেন না।
তার পরিবর্তে লাইব্রেরি ঘরে মিসেস বয়েলকে গলা টিপে হত্যা করবার কাজে ব্যস্ত ছিলেন।
ট্রেটার যখন মলিকে প্যারাভিসিনির ভূমিকা নিতে বললেন, তখন ভদ্রলোক খুব বিরক্ত বোধ করছিলেন।
তার চোখেমুখে একটা বিমূঢ় বিভ্রান্ত ভাব ফুটে উঠেছিলো।
এবং তিনি যে খুবই মৃদু সুরে পিয়ানো বাজাচ্ছিলেন সে কথাটাও দৃষ্টান্ত সহযোগে বুঝিয়ে দিলেন মলিকে।
হয়তো এই বক্তব্যের মূল উদ্দেশ্য যে তাঁর সঙ্গীতের সুরটা এতই নিম্ন গ্রামে বাঁধা ছিলো যে বাইরে থেকে সেটা শুনতে পাওয়া যায় না।
কিন্তু এখন এই নাটকের পুনরাভিনয়ের সময় যদি সুরটা কারো কানে যায় তবে প্রকৃত পক্ষে ট্রেটারের উদ্দেশ্যই সফল হবে।
আসল অপরাধীও ধরা পড়বে হাতে নাতে। ড্রয়িংরুমের ভেজানো দরজা আস্তে আস্তে খুলে গেল। মলি ভেবেছিল যে আগন্তুক বোধহয় প্যারাভিসিনি, সেই ভেবে ভয় পেয়ে চিৎকার করতে যাচ্ছিল কিন্তু ট্রেটারকে দেখে সে মনোবল ফিরে পেল। কোনরকমে বেরিয়ে আসা আর্তনাদটাকে সে চেপে রইল। তার বাজনাও সবেমাত্র শেষ হয়েছে।
ট্রেটার উচ্ছ্বাসের সুরে বলল–অসংখ্য ধন্যবাদ মিসেস ডেভিস। তার চোখে মুখে একটা চঞ্চলতার কুটিল ছায়া খেলে গেল। তার গতিভঙ্গিতে দেখা গেল এক বলিষ্ঠের ছাপ।
মলি এবার পরিপূর্ণ দৃষ্টিতে সার্জেন্টের দিকে তাকিয়ে বলল–আপনার উদ্দেশ্য সফল হয়েছে কি? আপনি যাকে চাইছিলেন তাকে খুঁজে পেয়েছেন?
আনন্দের সঙ্গে ট্রেটার মাথা দুলিয়ে বলল–হ্যাঁ নিশ্চয় যাকে চেয়েছিলাম তাকেই পেয়েছি। মলি প্রশ্ন করে, তাহলে প্রকৃত অপরাধী কে? তার নাম কি।
ট্রেটার বলল–মিসেস ডেভিস, আপনি কি সিত্যই জানেন না? কিন্তু ব্যাপারটা কিন্তু তেমন কিছু নয়। আপনি খুব বোকা বলেই সে লোকটিকে আপনি খুঁজে পাননি। শুধু আপনি কেন –আপনারা সকলেই বোকা। আর আপনাদের এই বোকামি আমাকে তৃতীয় শিকারের মুখোমুখি দাঁড়াবার সুযোগ করে দিয়েছে। সত্যিই ম্যাডাম, আপনার এখন সাংঘাতিক বিপদ।
মলি বলল–আমি?… আপনি কি বলছেন আমি তা কিছু বুঝতে পারছি না।
ট্রেটার বলল–আমার বক্তব্য খুব একটা জটিল নয় মিসেস ডেভিস, মিসেস বয়েলের মত আপনিও সত্যটাকে লুকিয়েছেন। সবকিছু স্বীকার করেননি।
মলি বলল–তার মানে? আপনি কি বলতে চাইছেন?
হা আপনিই।… আমি যখন লঙরিজ ফার্মের মামলাটার কথা বললাম, তখন এই সমস্ত ঘটনা আপনি জানতেন। এই মামলা সংক্রান্ত প্রতিটি ঘটনাই আপনার জানা। তাই আমার কাছ থেকে ঘটনাটা শোনা মাত্র আপনি অস্থির হয়ে উঠলেন। মিসেস বয়েল যে ওই সময় পুনর্বাসন দপ্তরের একজন অফিসার ছিলেন তা প্রথম আপনিই বললেন, আপনারা দুজনেই এ অঞ্চলের অধিবাসী। সেই জন্য যখন আমি মনে মনে হিসেব করে দেখলাম তৃতীয় শিকার হওয়ার সম্ভাবনা কার সব থেকে বেশি, তখন সবার আগে আপনার মুখটাই আমার মনে আসে। লক্ষ্য করে দেখলাম ওই মামলার ব্যাপারে আপনি অনেক কিছুই জানেন। সাধারণ দৃষ্টিতে পুলিশের যতই নিরীহ প্রকৃতির মনে হোক না কেন, তাদের চোখ কান সবসময় ভোলা থাকে।
মলি অবাক চোখে ট্রেটারের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল তারপর ক্লান্তস্বরে বলল– আমার মানসিক অবস্থাটা আপনি ঠিক বুঝতে পারছেন না। ওই দুঃস্বপ্নের স্মৃতিটা আমি আমার মন থেকে মুছে ফেলতে চাই।
ট্রেটার ঠান্ডা গলায় বলল–হ্যাঁ সেটা আমি বুঝতে পারছি। আপনার কুমারী জীবনের পদবীতো ওয়েনরাইন? ঠিক তো?
মলি ঘাড় নেড়ে বলল।
ট্রেটার বলল, আর আপনাকে দেখে যতটা কমবয়সী মনে হয় আসলে কিন্তু ততটা ছেলেমানুষ আপনি নন।
১৯৪০ সালের ওই দুর্ঘটনার সময় আপনি স্থানীয় এ্যাবিভ্যালের স্কুলের শিক্ষিকা ছিলেন।
মলি বলল না আমি নই।
ট্রেটার উত্তেজিত হয়ে বলল, সত্যকে অস্বীকার করবেন না মিসেস ডেভিস।
মলি বলল–আমি সত্যি কথা বলছি। আপনি বিশ্বাস করুন।
লঙরিজ ফার্মের শিশুটা যে মারা গিয়েছিলো অত্যাচারের ফলে সে মারা যাবার আগে আপনার কাছে একটা চিঠি পাঠায়। কোনোরকমে চুরি করে সে ঠিকানাটা জোগাড় করে চিঠির মধ্যেই সাহায্য চেয়েছিল সে আপনার। কোনো ছাত্র ঠিক সময় মত স্কুলে হাজির হচ্ছে কিনা তার দায়িত্ব শিক্ষিকার। কিন্তু সে দায়িত্ব আপনি পালন করেননি। হতভাগ্য ছাত্রের অনুরোধটা আপনার পাষাণ হৃদয়ে এতটুকু নাড়া দেয়নি। এমন কি সেই চিঠিটারও কোনো গুরুত্ব দেননি।
মলি বাধা দিয়ে বলল-দাঁড়ান…দাঁড়ান, আপনি যার কথা বলছেন সে আমি নয়–সে আমার দিদি। আমার দিদি আমার থেকে সাত বছরের বড়। সে একজন শিক্ষিকা ছিলো। কিন্তু চিঠিটা সে অবজ্ঞা করেছে সে ধারণাটা সম্পূর্ণ ভুল। আমার দিদি ওই সময় নিউমোনিয়ায় ভুগছিল। চিঠিটা তার হাতে এসে পৌঁছয়নি। এবং এই ব্যাপারটা সে বিন্দু বিসর্গও জানতো না। যখন খামটা সত্যিই তার হাতে পৌঁছল তখন আর করার কিছু ছিল না। সে ছেলেটা মারা গেল। আমার দিদি খুবই অনুভূতিপ্রবণ মানুষ। তার ওপর ওরকম একটা ঘটনা ঘটে যাওয়ায় দিদি খুব ভেঙে পড়েছিল। মনে রাখবেন এই ঘটনার পেছনে তার কোনো হাত ছিল না। তবুও সে নিজেকে অপরাধী মনে করত। বিবেকের দংশন থেকে সে একটুও মুক্তি পায়নি। আমরা পুরো ঘটনাটা জানতাম বলে ঘটনাটাকে এড়িয়ে যাবার চেষ্টা করতাম। ভুলেও কখনও এ বিষয়ে কোনো কথা দিদির সামনে উল্লেখ করিনি। ব্যাপারটা আমাদের কাছে দুঃস্বপ্নের মত মনে হত।
মলি নিজের অজান্তেই দুহাত দিয়ে মুখ ঢেকে ফেলল, তার শরীরটা তখনও কাঁপছে। শেষে নিজেকে সংযত করে যখন আবার মুখ তুলে তাকাল তখন দেখল ট্রেটারের একজোড়া চোখ তার মুখের উপর পড়েছে।
ট্রেটার ধীরে ধীরে বলল–তা হলে আপনি নন আপনার বোন? যদিও তাতে কিছু এসে যায় না। তাই না। আপনার বোন… আপনার ভাই… তার ঠোঁটের কোণে দেখা গেল কুটিল হাসি। কথা বলতে বলতেই পকেটে হাত ঢুকিয়ে কি যেন বের করলেন।
মলিও অবাক চোখে তাকিয়ে রয়েছে ট্রেটারের হাতের জিনিষটার দিকে।
তারপর বলল–কিন্তু … কিন্তু পুলিসরা তো সবসময় রিভলবার নিয়ে চলাফেরা করে, আমার তাই ধারণা।
ট্রেটার বললেন– তবে আমি পুলিস নই মিসেস ডেভিস। তাই আপনি আমার হাতে রিভলবার দেখতে পাচ্ছেন, আমার নাম জিম। আমি হতভাগ্য জর্জের ভাই। আপনি আমায় পুলিস বলে মনে করেছিলেন আর এই মঙ্কসওয়েলে পা দেওয়ার আগে টেলিফোনের তারটা কেটে দিই। তার ফলে নতুন করে পুলিসের সঙ্গে যোগাযোগ করার কোনো উপায় রইল না।
মলি কোনো কথা বলল না। তার দু চোখের মধ্যে আছে এক বিস্ময়। কোনো যাদুকর বুঝি তাকে যাদু করেছে। রিভলবারের নলটাও তার দিকেই তাক করা আছে।
ট্রেটার বলল–এক পা নড়বেন না মিসেস ডেভিস। চেঁচিয়ে লোক জড়ো করেও কোনো লাভ নেই। আপনার ফুসফুস দুটো তাহলে এই রিভলবারের গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে যাবে।
ট্রেটারের মুখে সেই কুটিল হাসি। মলির হাবভাবে দেখা গেল একধরনের শিশুসুলভ ভাব। ট্রেটারের গলার স্বরও খুব বদলে গেছে। মনে হচ্ছে যেন কোনো কিশোর কথা বলছে।
ট্রেটার দু বার মাথা ঝাঁকিয়ে বলল–হ্যাঁ আমিই সেই হতভাগ্য জর্জের বড় ভাই। লঙরিজ ফার্মেই যে জর্জ মারা গিয়েছিল। ওই নোংরা নিষ্ঠুর মেয়েটাই আমাদের ওখানে পাঠিয়েছিল। ওই ফার্মের কর্মচারী মিসেস গ্রেগ খুবই আমাদের সাথে বাজে ব্যবহার করেছে। আপনিও আমাদের কোনো সাহায্য করেননি। তিনটে অন্ধ ইঁদুরের মত আমরা ওই ফার্মে বন্দী ভাবে জীবন যাপন করতাম। তখনই মনে মনে ভাবতাম বড় হলে আমি আপনাদের প্রত্যেককেই মেরে ফেলব। এই প্রতিজ্ঞার কথা আমি ভুলিনি এবং কিভাবে আমার এই প্রতিজ্ঞাকে সার্থক করব তা সবসময় ভাবতাম।
ট্রেটার একটু চুপ করে আবার বলতে শুরু করল, সেনাবাহিনীর ডাক্তাররা সবসময় আমাকে বিরক্ত করত। নানারকম অদ্ভুত প্রশ্ন করত। সেইজন্য আমি পালাবার পথ খুঁজছিলাম। কারণ আমার সন্দেহ হয়েছিল ওরা হয়ত আমাকে আটকে রাখতে চায়। কিন্তু এখন আমি সাবালক আমার স্বাধীন ভাবে কাজ করার অধিকার এখন হয়েছে।
মলি যেন তার বুদ্ধিটা কিছু ফিরে পেয়েছে। আলাপচারিতার মধ্যে এই খুনে জায়গাটাকে এখন ভুলিয়ে রাখতে হবে। মলি মনে মনে চিন্তা করল। এছাড়া কোনো উপায় নেই। তাহলে অন্ততঃ আত্মরক্ষার কাজটা হতে পারে।
মলি কাতর কণ্ঠে বলল– কিন্তু জিম শোন, আমাকে মেরে তুমি মুক্তি পাবে না। এখান থেকে যেতে পারবে না।
প্রশ্নটা শুনে জিমের মুখ কালো হয়ে গেল। বলল, হ্যাঁ আমার স্কী দুটোও কে লুকিয়ে রেখেছে অনেক খুঁজেও পাইনি।
জিম একটু থেমে আবার বলল– তবে এই মুহূর্তে আমার কোনো ভয় পাচ্ছে না। কেননা রিভলবারটা আপনার স্বামীর। আমি ড্রয়ার থেকে এটা চুরি করেছি। সকলে ভাববে আপনাকে তিনিই খুন করেছেন। তবে আমার তাতে কিছু এসে যায় না, সমস্ত ব্যাপারটাই বেশ মজার। এই ধরনের লুকোচুরি খেলতে আমার বেশ ভালোই লাগে।
লণ্ডনের ওই মেয়েটা মারা যাবার আগে তখন আমাকে চিনতেই পারল না। তখন তার মুখেও দেখা দিল ভয়ের ছাপ। বোকা বুড়ি মিসেস বয়েলের খুন হওয়াটা কম মজার নয়।
আনন্দ সহকারে ট্রেটার মাথা দোলান। তারপর শিস দিতে লাগল–তিনটে ইঁদুর অন্ধ…
ট্রেটার যেন কিছুটা হকচকিয়ে গেল। তার হাতের মুঠোর রিভলবারটা কিছুটা কেঁপে উঠল। ঠিক সেই মুহূর্তে কেউ যেন বলে উঠল-মিসেস ডেভিস, আপনি শুয়ে পড়ুন।
মলি কিছু না বলেই নরম কার্পেটের মধ্যে শুয়ে পড়ল, ইতিমধ্যে মেজর মেটকাফ ট্রেটারের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। ট্রেটারের রিভলবারটা দূরে ছিটকে পড়ল। আচমকা একটা গুলি গিয়ে লাগল দেওয়ালে টাঙানো একটা অয়েল পেন্টিংয়ের বুকে।
সমস্ত ড্রইংরুমে এখন বিশৃঙ্খলা পরিবেশ। জিল রিভলবারের আওয়াজ শুনতে পেয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে এসে হাজির হল। তার পেছনে মিঃ রেন ও মিঃ প্যারাভিসিনি। প্রত্যেকের চোখেমুখে একটা উৎকণ্ঠা ও ভয়।
মেজর মেটকাফ ছদ্মবেশী ট্রেটারের দুটো হাত ধরে পরিবেশটা সকলকে বুঝিয়ে দিলেন।
মিসেস ডেভিস, যখন পিয়ানো বাজানোয় মগ্ন ছিলেন, তখন আমি চুপি চুপি ভেতরে ঢুকে সোফার আড়ালে লুকিয়ে থাকি, প্রথম থেকেই আমি ওকে চোখে চোখে রেখেছিলাম। কেননা আমি জানতাম ও পুলিস অফিসার নয় আমিই পুলিস অফিসার ইনসপেক্টর ট্রানার মেটকাফের ছদ্মবেশে আমি এখানে এসেছি। কারণ স্কটল্যাণ্ড ইয়ার্ড এখানে কোনো দায়িত্বজ্ঞান পুলিস অফিসারের উপস্থিতি যুক্তিযুক্ত মনে করে।
ভদ্রলোক একবার ট্রেটারের দিকে তাকালেন। তারপর আবার বললেন–তাহলে ট্রেটার এখানে আর কোনো গণ্ডগোল করার চেষ্টা করো না। ঠান্ডা হয়ে আমার সঙ্গে চলো, আমি কথা দিলাম, এখানে কেউ তোমার গায়ে হাত তুলবে না।… আমার কথাটা মাথায় ঢুকেছে তো?
ট্রেটারের মধ্যে দেখা গেল এক আমূল পরিবর্তন। কিছু আগের উগ্রতা ভাবটা তার মধ্যে এখন আর দেখা গেল না। শান্ত ছেলের মত এখন বাধ্য ও বিনয়ী, এই মুহূর্তে তার গলাটাও যেন মনে হল অল্পবয়সী ছেলের মত। বলল, জর্জ আমার ওপর রাগ করবে না তো?
মেটকাফ তাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলল–না, না জর্জ কিছুতেই রাগ করবে না। তোমার চিন্তার কোনো কারণ নেই। জিলের পাশ দিয়ে যাবার সময় সে আস্তে বলল–একেবারে উন্মাদ। বদ্ধউন্মাদ।…সত্যিই হতভাগ্য মূক।
ট্রেটারকে সঙ্গে নিয়ে মেটকাফ বাইরে চলে গেল। মিঃ প্যারাভিসিনি দু পা এগিয়ে ক্রিস্টোফারের হাত ধরে বলল–চলুন– আমরাও চলে যাই।
বড় ড্রয়িংরুমের মধ্যে মলি ও জলি দুজনে মুখ চাওয়া চাওয়ি করতে লাগল। পরে জিলের দুই বাহুর মধ্যে ধরা দিল মলি। তখন সে ভয়ে কাঁপছে।
জিলের গলায় একরাশ উৎকণ্ঠার সুরে বলল–তুমি কোনো আঘাত পাওনি তো মলি।
মলি বলল–না, না আমি ভালো আছি। কিন্তু আমার মধ্যে এমন কতগুলো উদ্ভব ধারণা আমার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে…প্রথমে তো আমি ভেবেছিলাম… তুমি… নিশ্চয় ঐদিনে লণ্ডন গিয়েছিলে…।
জিল বলল–হ্যাঁ গিয়েছিলাম। আগামীকাল ছিল আমাদের বিবাহবার্ষিকী, তোমার জন্য একটা উপহার আনতে যাওয়াই ছিল আমার উদ্দেশ্য। ভেবেছিলাম তোমাকে একটা চমক লাগিয়ে দেবো। তাই গোড়ায় কিছু বলিনি।
মলি অবাক সুরে চেঁচিয়ে বলল–কি আশ্চর্য! সেদিন তো আমিও লণ্ডনে গিয়েছিলাম।
জিল অনুতাপের সুরে বলে–আমি তোমার উপর খুব বাজে ব্যবহার করেছি। কেন জানি না ওই আধপাগলা যুবকটিকে প্রথম দেখামাত্র একটা হিংসার ভাব জেগে উঠেছিল। অথচ তার কোনো যুক্তিসঙ্গত কারণ নেই। হয়ত আমার তখন বিচারবুদ্ধি লোপ পেয়েছিল। আমায় তুমি ক্ষমা করো মলি।
বন্ধ করা দরজাটা একটু ফাঁক করে প্যারাভিসিনি উঁকি দিলেন। তার হাবভাবে বেশ একটা খুশির আমেজ, সে বলল–এই পুনর্মিলনে বাধা দিতে বাধ্য হলাম বলে আমি দুঃখিত। সত্যি বলতে কি এমন দৃশ্যের তুলনা হয় না। কিন্তু হায়। আমার যাবার সময় এসে গেছে। আমি এখন আপনাদের কাছে বিদায় নিতে এসেছি। পুলিসের একটা জিপ এই বরফের পাহাড় ভেদ করে কোনোরকমে আমি এখানে এসে পৌঁছেছি। অনেক কষ্টে তাদের রাজী করিয়েছি আমাকে সঙ্গে নিয়ে যাবার জন্য।
প্যারাভিসিনি মলির কাছে এসে কানে কানে বলল–তবে ম্যাডাম, অদূর ভবিষ্যতে আপনার নামে যে বাক্সটা পাঠাবো তার মধ্যে বিশেষ টোস্ট তৈরির মশলা সমস্ত মজুত থাকবে। তার সঙ্গে দু-চার জোড়া মোজা থাকবে। আশা করি অনুগত ভক্তের এই সামান্য উপহারটুকু গ্রহণ করতে আপনি অরাজী হবেন না।… আর হ্যাঁ আমার চেকটা হলঘরের পেপারওয়েটের নিচে চাপা দেওয়া আছে।
প্যারাভিসিনি মলির হাতের তালুতে মৃদু চুম্বন করে দ্রুত পায়ে দরজার কাছে এগিয়ে গেলেন।
মলি বিড় বিড় করে বলল–নাইলন। যকৃতের তেল,… মিঃ প্যারাভিসিনি কি তাহলে আসলে খ্রীস্টমাস বুড়ো সান্তাক্লজ নাকি?
কথাবার্তার ধরনধারণ দেখে মনে হয় কালোবাজারীদের কোনো বড় চাই–জিল পরিহাসছলে কথাটা বলল।
জিলের কথা শেষ হতে না হতেই ক্রিস্টোফার রেন আবার এল। তার চালচলনে একটা ব্যস্ততার ছাপ। সে বলল–আপনাদের কথায় মাথা গলাতে বাধ্য হচ্ছি। বেশ কিছুক্ষণ ধরে রান্নাঘরের দিক থেকে একটা পোড়া পোড়া গন্ধ ভেসে আসছে। মনে হয় এবিষয়ে আপনার একবার নজর দেওয়া উচিত।
মলির গলা দিয়ে একটা আর্তনাদের সুর বেরিয়ে এল, বলল–হ্যায় হায়…। এতকষ্ট করে মাংসের কোপ্তাগুলো করলাম মনে হয় সব পুড়ে ছাই হয়ে গেল এতক্ষণে।
ভয় পাওয়া হরিণীর মতই মলি দুজনের মাঝখান দিয়ে বেরিয়ে গেল।