- বইয়ের নামঃ ভীষণ অরণ্য ২
- লেখকের নামঃ রকিব হাসান
- সিরিজঃ তিন গোয়েন্দা সিরিজ
- প্রকাশনাঃ সেবা প্রকাশনী
- বিভাগসমূহঃ রহস্যময় গল্প, গোয়েন্দা কাহিনী, অ্যাডভেঞ্চার, কল্পকাহিনী
ভীষণ অরণ্য ২
০১.
এমন সুযোগ হাতছাড়া করতে চাইল না মুসা।
লম্বা নাকে ফাঁস লাগিয়েই ধরা যায়। কুমিরটাকে। এত বড় দানব সচরাচর চোখে পড়ে না।
কুমিরের চাহিদা কেমন, জানা নেই তার। আশা করল, অনেক দামে বিক্রি হবে। ধরতে পারলে নেবে কিভাবে, ভাবল না একবারও।
কুমিরের নাক অনেক লম্বা, অ্যালিগেটরের মত ভৌতা নয়।
নিঃশব্দে ক্যানূর দড়ির এক মাথা গাছ থেকে খুলে নিয়ে ফাঁস বানাল মুসা। পা টিপে টিপে এগোল ঘুমন্ত সরীসৃপের দিকে।
আস্তে করে ফাঁস গলিয়ে দিল চোখা নাকটায়, তারপর হ্যাঁচকা টান। লাফিয়ে। সরে গেল।
রাগে হিসিয়ে উঠল কুমির। মুসাকে ধরার জন্যে লাফ দিতেই দড়িতে লাগল টান। দ্বিধায় পড়ে গেল। লেজের ঝাপটায় পানি তোলপাড় করে ঘুরে গিয়ে পড়ল। খালের মাঝখানে। টানটান হয়ে গেল ক্যানূতে বাধা দড়ি।
ঝাঁকুনির চোটে ঘুম ভেঙে গেল আরোহীদের। চেঁচাতে শুরু করল গলা ফাটিয়ে।
দড়ি ছাড়ানোর জন্যে একবার এদিকে ঘুরে টান মারছে কুমির, একবার ওদিক। ঝটকা দিয়ে বার বার ঘুরে যাচ্ছে ক্যানূর নাক। টালমাটাল অবস্থা।
কিছুতেই দড়ি ছাড়াতে না পেরে খালের মাঝখান দিয়ে সোজা ছুটতে শুরু করল কুমির। টেনে নিয়ে চলল ক্যানূটাকে।
খানিক দূর গিয়ে বোধহয় মনে করল, ক্যানূটাই তাকে তাড়া করছে, যত শয়তানী ওটারই। ঘুরে এসে তাই আক্রমণ করে বসল ওটাকে। বিশাল হাঁ করে কামড় লাগাল একপাশে। মড়মড় করে উঠল কাঠ। হ্যাঁচকা টানে সরিয়ে না নিলে আরেকটু হলে জিবার হাতটাই গিয়েছিল।
শক্ত কাঠে কামড় দিয়ে বিশেষ সুবিধে করতে না পেরে আক্রমণের ধারা। পাল্টাল কুমির। লেজের বাড়ি মারতে শুরু করল। থরথর করে কেপে উঠল ক্যানূ।
দিশেহারা হয়ে গেছে মুসা।
চেঁচামেচিতে অন্যদেরও ঘুম ভেঙেছে। লাফিয়ে গিয়ে মনট্যারিয়াতে উঠেছে সবাই। মুসাও উঠল। ক্যানূর দিকে ছুটল নৌকা।
কিছুতেই দড়ি খসাতে না পেরে আবার সোজা ছুটেছে কুমির। ধরা যাবে না ওই দানবকে। দড়িটা কাটতে পারলে এখন বাঁচা যায়। ছুরি বের করল জিবা।
কিন্তু দড়ি কাটার আগেই ডুব দিল কুমির। পানি ওখানে গভীর। টানের চোটে ক্যানূর গলুই গেল ডুবে। খাড়া হয়ে গেল আরেক গলুই। ঝুপঝাপ করে পানিতে পড়ল মানুষেরা, হাত-পা ছুড়ছে অসহায় ভঙ্গিতে। আতঙ্কে চিৎকার করছে। তাদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চেঁচিয়ে উঠল পাশের বনের বানর আর পাখির দল।
সর্বনাশ! পানিতে খেপা কুমিরের সঙ্গে চারজন মানুষ। রাইফেল তুলল মুসা।
না না! চেঁচিয়ে উঠল কিশোর। কার গায়ে লাগে ঠিক নেই।
কি করব তাহলে?
দড়ি কাটতে হবে। ছাড়া পেলে হয়তো পালাবে। আর কোন উপায় নেই।
দ্রুত মনস্থির করে নিল মুসা। অঘটন সে ঘটিয়েছে, তাকেই করতে হবে যা করার। রাইফেল রেখে একটানে কোমর থেকে ছুরি খুলে নিয়ে ডাইভ দিয়ে পড়ল পানিতে।
ভয়ে চেঁচিয়ে উঠল রবিন।
পানিতে রক্ত। জিবা আর তার দুই সঙ্গীর মাথা দেখা যাচ্ছে পানির ওপরে, আরেকজন নেই। কুমিরে টেনে নিল?
দড়িতে ঢিল পড়েছে। কাত হয়ে ভেসে উঠল ক্যানূ। দড়িতে পোঁচ মারল মুসা।
হঠাৎ ক্যানূর খানিক দূরে পাগলা ঘোড়ার মত লাফিয়ে উঠল কুমির, ভারি কাঠের মত এক গড়ান দিয়ে আবার ডুবে গেল। তার কাছেই ভাসল তৃতীয় ইনডিয়ান লোকটার মাথা। হাতে শিকারের বিশাল ছুরি, তাতে পানি মেশানো হালকা রক্তের ধারা। তাকে কুমিরে ধরেনি, মরিয়া হয়ে সে-ই কুমিরকে ছুরি মারছে।
তাড়াহুড়ো করে ক্যানূ সোজা করে তাতে চড়ে বসল চারজনে। মুসাকে টেনে তোলা হলো মনট্যারিয়ায়। পানিতে নতুন বিপদ। রক্তের গন্ধে এসে হাজির হয়েছে।
ডুবে গিয়েছিল, আবার ভেসে উঠল কুমির। দাপাদাপি করছে, অস্থির, পাগল হয়ে গেছে যেন।
পিরানহা! আমাজন নদীর আতঙ্ক।
রক্তের গন্ধে হাঙর যেমন পাগল হয়ে ছুটে আসে, পিরানহাও তেমনি আসে। ঝাঁপিয়ে পড়ে শিকারের ওপর। বড় জোর ফুটখানেক লম্বা এই মাছ। মুখ বন্ধ রাখলে নিরীহ দেখায়। কিন্তু হাঁ করলে বেরিয়ে পড়ে দুই সারি ক্ষুরধার দাঁত।
নদীর পানিতে এমন কোন প্রাণী নেই, যে পিরানহাকে ভয় পায় না, এমনকি কুমিরও এড়িয়ে চলে। ঝাকে ঝাকে থাকে ওরা, শয়ে শয়ে, হাজারে হাজারে। মোটাতাজা একটা তাপিরকে শেষ করতে কয়েক মিনিটের বেশি লাগে না, পড়ে থাকে শুধু জানোয়ারটার ঝকঝকে সাদা কঙ্কাল।
কুমিরটার চারপাশে পানি যেন টগবগ করে ফুটছে। রক্তে লাল।
ইনডিয়ানরা উত্তেজিত। নৌকা থেকে মাছ ধরার বল্লম নিয়ে ক্যানূ চালিয়ে চলে গেল কাছাকাছি। দেখতে দেখতে ধরে ফেলল গোটা বিশেক মাছ। ক্যানূর তলায়। তুপ করে রাখল। ডাঙায়ও নিরাপদ নয়, ওগুলোর কাছ থেকে দূরে রইল ওরা।
খালের মাঝখানে ছোট এক চিলতে বালির চরা, শুকনো। গাছপালা নেই। তাতে মাছগুলো ছড়িয়ে ফেলল ইনডিয়ানরা, ছুরি দিয়ে কুপিয়ে মাথা আলাদা করল।
ভালমত দেখার জন্যে একটা হাঁ হয়ে থাকা মাথা তুলল রবিন। সঙ্গে সঙ্গে খটাস করে বন্ধ হয়ে গেল চোয়াল, যেন স্প্রিং লাগানো রয়েছে। চমকে ওটা হাত থেকে ফেলে দিল সে।