- বইয়ের নামঃ ড্রাগন
- লেখকের নামঃ রকিব হাসান
- সিরিজঃ তিন গোয়েন্দা সিরিজ
- প্রকাশনাঃ সেবা প্রকাশনী
- বিভাগসমূহঃ রহস্যময় গল্প, গোয়েন্দা কাহিনী, অ্যাডভেঞ্চার, কল্পকাহিনী
ড্রাগন
এক
এমন চমকে উঠল তার দুই সহকারী যে, রবিনের হাত থেকে কার্ডের বাণ্ডিল পড়ে খুলে ছড়িয়ে গেল, বেকায়দা ভঙ্গিতে ঝাঁকুনি দিয়ে ওপরে উঠে গেল মুসার হাতে ধরা স্কু-ড্রাইভারটা। এতদিন পুরানো ছাপার মেশিনটা মুসা একাই রকিব হাসান ব্যবহার করেছে, কিন্তু কিশোরের নির্দেশে রবিন এখন শিখে নিচ্ছে কাজটা। মুসাকে শিখে নিতে বলা হয়েছে ইলেকট্রনিকের কাজ, এতদিন এই কাজটা কিশোর করত। তার মতে, সব কাজ মোটামুটি জানা থাকলে গোয়েন্দাগিরিতে অনেক সুবিধে।
কি বললে? স্ক্রু-ড্রাইভারের খোঁচা লেগে রেডিওর বাক্সের পেছনে হার্ডবোর্ডের কভারে বিশ্রী একটা আঁচড় পড়েছে, সেটা মোছার চেষ্টা করল মুসা।
বলছিলাম কি, আবার বলল কিশোর, এই অঞ্চলে আগে কখনও হয়নি, এমন একটা ডাকাতি করলে কেমন হয়? ধরা যাক, অনেক বড় অপরাধী আমরা, মাস্টার ক্রিমিন্যাল…
তাহলে আগে ভাবো, ধরা পড়লে কি হবে? শুনেছি, অপরাধ করে শেষ পর্যন্ত কোন অপরাধীই পার পায় না।
কার্ডগুলো কুড়িয়ে নিচ্ছে রবিন। মাস্টার ক্রিমিন্যাল হয়ে সুবিধে করতে পারব না। প্রেসে কার্ড ছাপাটাই শিখতে পারলাম না ঠিকমত, এত সহজ একটা কাজ।
কথার কথা বললাম আর কি, কিশোর বলল। আমরা গোয়েন্দা তো, মনে হলো বড় ডাকাতি কিভাবে কিভাবে হতে পারে, সেটা আগেই যদি ভেবে রাখি, অপরাধীদের চেয়ে এগিয়ে থাকতে পারব। মাস্টার মাইণ্ড ক্রিমিনালদের অপরাধী মনে কি কি ভাবনা চলে, বুঝতে পারব। অনেক সময় দুর্বোধ্য করে কথা বলা কিংবা কঠিন শব্দ ব্যবহার করা কিশোরের স্বভাব।
মাথা ঝাঁকাল মুসা, তা ঠিক। এই যেমন, তোমার ফর্মুলায় ফেললে, রেডিওর মালিকদের কুৎসিত মনে কি কি ভাবনা চলে সেটা জানা থাকলেও আমার জন্যে অনেক সুবিধে হবে। দেখেছ, রেডিওটার কি অবস্থা করেছে? কতখানি বাজে লোক হলে এমন সুন্দর একটা জিনিসকে এভাবে নষ্ট করতে পারে? খারাপ করে আবার নিজে নিজেই কারিগরি ফলাতে গেছে। একটা তারও জায়গামত নেই…দাঁড়াও, আগে ঠিক করে নিই। তারপর ডাকাতির আলোচনায় যোগ দেব।
কাজ শেষ, শুধু একটা স্কু লাগানো বাকি। শক্ত করে লাগাল সেটা মুসা। তারপর হাসিমুখে রেডিওটা তুলে কিশোরকে দেখিয়ে বলল, এটা বেচতে পারলে কম করেও তিন ডলার লাভ হবে তোমার চাচার। বাতিল জিনিস ছিল, একেবারে নতুন করে দিলাম।
হাসল কিশোর। দেখতে তো ভালই লাগছে। দেখো, কাজ করে কিনা।
ছোট্ট একটা নব টিপে দিয়ে ডায়াল ঘোরাতে শুরু করল মুসা। করছে!…এই যে লাইট জ্বলে।
খরুখর আওয়াজ বেরোল স্পীকার থেকে, ফিসফাস, ঝনঝন আর নানারকম বিচিত্র শব্দ করল কয়েক মুহূর্ত, তারপর শোনা গেল কথা।
স্পষ্ট ভারি গলায় খবর হচ্ছে: …সী-সাইডের অদ্ভুত ঘটনার কোন সমাধান করতে পারছে না কর্তৃপক্ষ। গত এক হপ্তায় পাঁচটা কুকুর নিখোঁজ হওয়ার খবর এসেছে। কুকুরের মালিকেরা উদ্বিগ্ন।…কুকুর মালিক সমিতির সভাপতি মিস্টার ক্যাঙরুনিয়ান আজ
দূর, দাও বন্ধ করে, হাত নাড়ল কিশোর।
হাহ, শেষমেশ কুত্তা চোর, নব ঘুরিয়ে রেডিও অফ করে দিল। মুসা। পাঁচটা কুকুর নিয়ে গেছে। করবে কি?
মাস্টার ক্রিমিন্যাল কিশোর পাশাকে সমাধান দিতে অনুরোধ করছি, হেসে নাটকীয় ভঙ্গিতে বলল রবিন। তবে সেই সঙ্গে আমার অনুমানটাও বলে দিই। কুকুর চুরি করে লুকিয়ে রাখবে চোর। এ এলাকার সব কুকুর যখন শেষ হয়ে যাবে, বাজারে কুকুরের চাহিদা বাড়তে বাড়তে অসম্ভব দাম হয়ে যাবে, তখন একদিন ঝপাৎ করে এনে অনেক কুকুর বাজারে ফেলবে। বিক্রি করে রাতারাতি বড়লোক হয়ে যাবে।
নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটছে কিশোর, তারমানে গভীর ভাবনা চলছে তার মনে। অদ্ভুত! আনমনে বিড়বিড় করল।
কি অদ্ভুত? জানতে চাইল রবিন। পাঁচটা কুকুর? পাঁচ আমার কাছেও অদ্ভুত লাগে…
মাথা নাড়ল কিশোর। পাঁচ সংখ্যাটা অদ্ভুত লাগছে না, লাগছে পাঁচটা কুকুর। এক হপ্তায় পাঁচটা হারাল, বেশি হয়ে গেল না?
ওই যা বলছিলাম, কুত্তা চোরের কাজ, কুকুরের বাজার দর ওঠাতে চাইছে। কিংবা মাংসের কারখানার মালিকের সঙ্গে শত্রুতা হয়েছে চোরের। কুকুর না থাকলে কুকুরের জন্যে মাংস কিনবে না কেউ, ফলে মার খাবে কোম্পানি। বিচিত্র প্রতিশোধ বলতে পারো।
আলতো হাসি ফুটল কিশোরের ঠোঁটে। অনেক ঘুরিয়ে ভাবছ। এভাবে ভাবলে হবে না। আমি জানতে চাই, এক হপ্তায় পাঁচটা কেন? আর এই রহস্যের সমাধান করার জন্যে এখনও ডাকা হলো না কেন আমাদের?
হয়তো রহস্যটা তেমন জটিল মনে করছে না, মুসা বলল। মাঝেমধ্যেই বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায় কুকুর, কদিন পর আবার ফিরেও আসে। এটা কোন ব্যাপারই না।
আমারও তাই মনে হয়, মাথা দোলাল রবিন। খবরে কিন্তু বলেনি কুকুরগুলো দামী। শুধু বলেছে, নিখোঁজ।
হয়তো তোমাদের অনুমানই ঠিক, মেনে নিতে পারছে না। কিশোর। ভাবছি, কেউ তো এখনও ডাকল না, রহস্যটায় নাক গলাই কিভাবে? যেচে খোঁজ নিতে গেলে যদি মালিকেরা বিরক্ত হয়, কিংবা আমাদেরকেই চোর ভেবে বসে?
যাচ্ছে কে? বলল মুসা।
বা-রে, এমন একটা জটিল রহস্য…
জটিল রহস্য? রবিনের দিকে একবার তাকিয়ে আবার কিশোরের দিকে ফিরল মুসা, কুকুর হারানোটা একটা অতি সাধারণ ঘটনা, দু চারটা সব সময়ই হারায়। এর মধ্যে রহস্য দেখলে কোথায়?
কর্তৃপক্ষ যখন সমাধান করতে পারছে না, নিশ্চয় রহস্য। আচ্ছা, নাক গলানো বলছি কেন? নিজেকেই যেন বোঝাল কিশোর। আমরা গোয়েন্দা, যে কোন রহস্যের সমাধান করার জন্যে এগিয়ে যেতে পারি। সী-সাইড এখান থেকে বেশি দূরে না, ইচ্ছে করলেই চলে যেতে পারি। যাচ্ছি না কেন?
কার্ড ছাপানো শেষ, মেশিন বন্ধ করে দিল রবিন। ঘটারং-ঘট, ঘট ঘটু-ঘটাং করে অন্তিম আর্তনাদ তুলে চুপ হয়ে গেল আদিম যন্ত্রটা। একটা কার্ড হাতে নিয়ে ছাপাটা দেখে নিজেই নিজের প্রশংসা করল সে, চমৎকার ছেপেছি।
হুঁ, ভালই, দেখে বলল কিশোর। চলো, হেডকোয়ার্টারে গিয়ে আলোচনা করি। জবাবের অপেক্ষা না করেই উঠে পড়ল সে।
পরস্পরের দিকে তাকাল অন্য দু-জন। তারপর গোয়েন্দাপ্রধানকে। অনুসরণ করল। বলে কোন লাভ হবে না যে জানে, তবু হেসে বলল মুসা, গণতান্ত্রিক দেশে বাস করছি আমরা, কিশোর, আমাদের তিনজনের মধ্যেও গণতান্ত্রিক চেতনা থাকা উচিত। যে কোন সিদ্ধান্ত নিতে ভোটাভুটি আবার চালু করলে কেমন হয়?
কিন্তু কিশোর শুনল বলে মনে হলো না। ছাপার মেশিনটার খানিক দূরে মোটা একটা পাইপের মুখ থেকে একটা লোহার পাত সরাচ্ছে। হামাগুড়ি দিয়ে পাইপের ভেতর ঢুকে গেল সে। কি আর করবে, মুসাও ঢুকল তার পেছনে। সব শেষে ঢুকল রবিন, ভেতরে থেকেই হাত বাড়িয়ে পাতটা আবার দাঁড় করিয়ে দিল পাইপের মুখে, ঢেকে দিল। কৃত্রিম সুড়ঙ্গমুখ। হেডকোয়ার্টারে ঢোকার এটা একটা গোপন পথ, ওরা নাম রেখেছে দুই সুড়ঙ্গ। ১৪ পাইপের মেঝেতে নরম কার্পেট বিছানো রয়েছে, কাজেই হামাগুড়ি দিয়ে এগোতে কোন কষ্ট হচ্ছে না। প্রায় চল্লিশ ফুট মত জঞ্জালের ভেতর দিয়ে এগিয়ে একটা ট্রেলারের তলায় এসে শেষ হয়েছে পাইপ। মাথায় আলগা ঢাকনা, ওপর দিকে খোলে। ঠেলে তুলে ট্রেলারের ভেতরে ঢুকল কিশোর।
এক সময় এটা একটা মোবাইল হোম ছিল, দুর্ঘটনায় পড়ে না কিভাবে যেন ভেঙে নষ্ট হয়ে গিয়েছিল, বাতিল অবস্থায় কিনে এনেছিলেন রাশেদ পাশা। কোনভাবেই আর বিক্রি করতে না পেরে দিয়ে দিয়েছেন ছেলেদের। জঞ্জালের তলায় এখন পুরোপুরি চাপা পড়েছে ট্রেলারটা, বাইরে থেকে দেখা যায় না।
ওটাকেই সারিয়ে নিয়ে ভেতরে হেডকোয়ার্টার করেছে তিন। গোয়েন্দা। সাজানো-গোছানো ছোট্ট অফিস, খুদে ল্যাবরেটরি, ছবি প্রসেস করার ডার্ক-রুম, টেলিফোন, টাইপরাইটার, আর নানারকম আধুনিক প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি আছে তাতে।
ডেস্কের ওপাশে নিজের চেয়ারে গিয়ে বসল কিশোর। পুরানো নষ্ট রিভলভিং চেয়ারটা অল্প পয়সায় কিনে এনে সারিয়ে নিয়েছে সে নিজেই। ডেস্কটাও পুরানো। কিন্তু ঘষেমেজে বার্নিশ করে চকচকে করে তোলা হয়েছে, নতুনই মনে হয় এখন। রবিন আর মুসা বসল তাদের চেয়ারে।
ঠিক এই সময় বাজল টেলিফোন।।
তিনজনেই তাকাল একে অন্যের দিকে। কোন রহস্যের তদন্তের সময় না হলে সাধারণত ফোন করে না কেউ তাদেরকে।
দ্বিতীয়বার রিঙ হতেই রিসিভার তুলে নিল কিশোর। কানে ঠেকানোর আগে একটা সুইচ টিপল। স্পীকারের সঙ্গে যোগাযোগ অন হয়ে গেল, সবাই একসঙ্গে শুনতে পাবে এখন ওপাশের কথা।
কিশোর পাশা? মহিলা কণ্ঠ, মিস্টার ক্রিস্টোফার কথা বলবেন।
নতুন কেস! প্রায় চেঁচিয়ে উঠল রবিন। হলিউডের বিখ্যাত। চিত্রপরিচালক ডেভিস ক্রিস্টোফার ফোন করলে বুঝতে হবে, নতুন একটা জটিল কেস পাওয়ার সম্ভাবনা খুব বেশি।
হাল্লো, কিশোর পাশা, স্পীকারে গমগম করে উঠল পরিচালকের কণ্ঠ। হাতে কোন কাজ আছে তোমাদের? আই মীন, কোন কেস?
না, স্যার। তবে মনে হচ্ছে একটা কিছু পাব এবার?
কি করে বুঝলে?
আপনি ফোন করেছেন।
মৃদু হাসি শোনা গেল। ঠিকই আন্দাজ করেছ। আমার এক পুরানো বন্ধু, এক্স ফিল্ম ডিরেক্টর একটা সমস্যায় পড়েছে।
কি সমস্যা, স্যার? সঙ্গে সঙ্গে প্রশ্ন করল কিশোর।
দ্বিধা করছেন পরিচালক। অল্প কথায় কিভাবে পরিবেশন করবেন কথাটা, ভাবছেন বোধহয়, সাজিয়ে নিচ্ছেন মনে মনে। অবশেষে বললেন, কুকুর। এই খানিক আগে ফোন করে বলল, তার কুকুরটা খুঁজে পাচ্ছে না।
উজ্জ্বল হলো কিশোরের চোখ। আপনার বন্ধু কি সী-সাইডে থাকেন?
দীর্ঘ এক মুহূর্ত নীরবতার পর যখন কথা বললেন পরিচালক, বোঝা গেল তাজ্জব করে দিয়েছে তাঁকে কিশোর। হ্যাঁ। তুমি জানলে কি করে?
জানাটা কঠিন কিছু নয়। সাধারণ কয়েকটা ছিন্ন সুতো জোড়া দিয়েছি কেবল, জটিল করে কথা বলার সুযোগ পেলে সেটা ছাড়ে না কিশোর, যার সঙ্গেই বলুক।
হুঁ, চুপ করে গেলেন পরিচালক।
শুধু কুকুর নয়, স্যার, মনে হচ্ছে আরও ব্যাপার আছে। বলুন না?
আসলে, আমিই বিশ্বাস করছি না তো, তাই..ধরো, একটা জলজ্যান্ত ড্রাগন যদি চোখে পড়ে যায় হঠাৎ, মনের অবস্থাটা কেমন দাঁড়াবে?
গলা পরিষ্কার করে নিল কিশোর। ড্রাগন?
হ্যাঁ। আমার বন্ধুর বাড়ি সাগরের তীরে, পাহাড়ের ওপর। নিচে গুহা আছে। একটা বিশাল ড্রাগনকে সাগর থেকে উঠে এসে সেই গুহায় ঢুকতে দেখেছে সে।
স্তব্ধ হয়ে রইল তিন গোয়েন্দা।
এখন কি বলবে, বলো? আবার বললেন পরিচালক।
আমিই বিশ্বাস করতে পারছি না, তোমাদের কি করে করতে বলি? তা গিয়ে একবার দেখবে নাকি?
এত উত্তেজিত হয়েছে কিশোর, তোতলাতে শুরু করল, আ আপনার ব-বন্ধুর ঠিকানা বলুন, স্যার। দারুণ জমবে মনে হয় কেসটা, তিন গোয়েন্দার সবচেয়ে রোমাঞ্চকর কেস।
কাগজ-কলম নিয়ে তৈরিই আছে রবিন, তিন গোয়েন্দার সমস্ত কেসের রেকর্ড রাখা আর প্রয়োজনীয় লেখাপড়ার দায়িত্ব তার ওপর। লিখে নিল ঠিকানা।
ড্রাগন
ছেলেদের গুড লাক জানিয়ে লাইন কেটে দিলেন পরিচালক। দুই সহকারীর দিকে তাকাল কিশোর। এই আধুনিক যুগে জ্যান্ত ড্রাগন দেখাটা সৌভাগ্য বলতে হবে, তাই না?
মাথা ঝাঁকাল রবিন।
কিন্তু মুসা মুখটাকে এমন করে ফেলল যেন নিমের তেতো গিলেছে।
কি ব্যাপার, সেকেণ্ড, খুশি হওনি মনে হচ্ছে? জিজ্ঞেস করল কিশোর।
রোমাঞ্চকর শব্দটার সঙ্গে আরও তিনটে শব্দ যোগ করা উচিত ছিল, মুখ গোমড়া করে বলল মুসা, মিস্টার ক্রিস্টোফারকে বলনি সে কথা।
ভুরু নাচাল শুধু কিশোর; অর্থাৎ, কী?
রোমাঞ্চকর এবং শেষ কেস, বলল মুসা। জ্যান্ত ড্রাগনের সামনে গেলে বেঁচে আর ফিরব না কোনদিন!
দুই
রকি বীচ থেকে প্যাসিফিক কোস্ট হাইওয়ে ধরে মাইল বিশেক গেলেই সী-সাইড, প্রশান্ত মহাসাগরের কূলের ছোট্ট একটা শহর। ঠিক হলো, লাঞ্চের পর ওখানে যাবে তিন গোয়েন্দা। নিয়ে যাবে বোরিস, ইয়ার্ডের কর্মচারী, বিশালদেহী দুই ব্যাভারিয়ান ভাইয়ের একজন। ইয়ার্ডের ছোট পুরানো ট্রাকটাতে করে কিছু মাল ডেলিভারি দিতে সে যাবে সী-সাইডের ওদিকে, তিন গোয়েন্দাকে সঙ্গে নিতে কোন অসুবিধে নেই।
মেরিচাচীর রান্না ভরপেট খেয়ে ট্রাকে এসে উঠল তিন কিশোর, বোরিসের পাশে গাদাগাদি করে বসল। ইয়ার্ড থেকে বেরিয়ে এল ট্রাক, উপকূলের ধারের মহাসড়ক ধরে ছুটে চলল দক্ষিণে।
রবিন, রেফারেন্স বই দেখেছিলে? এতক্ষণে জিজ্ঞেস করার সুযোগ পেল কিশোর, ড্রাগনের কথা কি কি জেনেছ?
ড্রাগন হলো পৌরাণিক দানব। ডানাওয়ালা বিশাল সরীসৃপ, উড়তে পারে; বড় বড় বাঁকা নখ আছে, নিঃশ্বাসের সঙ্গে আগুন বেরোয়।
আমি রেফারেন্স বই দেখিনি, মুসা বলে উঠল। কিন্তু বাজি রেখে বলতে পারি, মোটেই শান্ত স্বভাবের নয় ড্রাগন। সাংঘাতিক পাজী জানোয়ার।
তা ঠিক, সায় দিল রবিন। পৌরাণিক জীব, তারমানে বাস্তবে নেই। আর নেই যখন পাজী হলেই কি, ভাল হলেই বা কি?
ঠিক, কিশোর বলল। রূপকথার গল্পে আছে ড্রাগনের কথা। যখনকার গল্প তখন যদি সত্যি সত্যি এই জীব থেকেও থাকে, তাহলেও এতদিন পর এখনকার পৃথিবীতে থাকার কথা নয়, ইভালুশনের থিওরি তাই বলে। বিশালদেহী ডাইনোসররা যেমন আর বেঁচে নেই আজ।
না থাকলেই ভাল, মুসা বলল। কিন্তু ইভালুশনের থিওরি যদি সব প্রাগৈতিহাসিক দৈত্য-দানবকে হাওয়া করে দিয়েই থাকে, এই ড্রাগনটা এল কোত্থেকে?
মুসার কথায় কান না দিয়ে কিশোর বলল, গত হপ্তায় সী-সাইড থেকে পাঁচটা কুকুর হারিয়েছে, তার মধ্যে মিস্টার ক্রিস্টোফারের বন্ধুরটাও থাকতে পারে। বাড়ির কাছে ড্রাগনও দেখেছেন তিনি। কিছু বোঝা যায়?
নিশ্চয় যায়, বলল মুসা, ওসব কুকুরকে ধরে ধরে খেয়ে ফেলে। ড্রাগনটা। মানুষের মাংসেও নিশ্চয় তার অরুচি হবে না। ড্রাগন ধরতে যাওয়াটা মোটেও উচিত হবে না আমাদের।
ধরতে পারলে তো কাজই হত। রাতারাতি বিখ্যাত হয়ে যেতাম। আমরা।
বিখ্যাত হয়ে লাভটা কি হবে?
সে সব তুমি বুঝবে না।
সী-সাইডে ঢুকল ট্রাক। ঠিকানা বলল কিশোর।
গতি কমিয়ে রাস্তাটা খুঁজতে শুরু করল বোরিস। আরও মাইলখানেক এগিয়ে গাড়ি থামাল। মনে হয় এটাই।
পাতাবাহারের উঁচু বেড়া, তারপরে সারি সারি পাম গাছ, বাড়িটা থাকলে লুকিয়ে আছে তার ওপারে।
গাড়ি থেকে নামল ছেলেরা।
বোরিস, কিশোর বলল, দুই ঘণ্টার বেশি লাগবে না। ফেরার পথে নিয়ে যাবেন।
বলল ও-কে, কিন্তু উচ্চারণের কারণে শব্দটা শোনাল হো-কে। কর্কশ ভারি কণ্ঠস্বর তার। ট্রাকের মুখ ঘুরিয়ে সরু পথটা ধরে চলে গেল। আবার শহরের দিকে।
চলো, আগে আশপাশটায় একবার চোখ বুলিয়ে নিই, পরামর্শ দিল কিশোর। সুবিধে হবে।
পাহাড়ী এলাকা, উঁচু ঢালের ওপর বাড়ি। পুরো অঞ্চলটাই কেমন নিঃসঙ্গ, নির্জন। চিত্রপরিচালকের বাড়ির সামান্য দূরে ছোট একটা খোলা জায়গায় এসে দাঁড়াল ছেলেরা, নিচে তাকাল। পাহাড়টা এখানে। খাড়া নেমে গেছে অনেক নিচের সৈকতে। তীরে এসে ঢেউ ভাঙছে।
সেদিক তাকিয়ে রবিন বলল, খুব সুন্দর। কি শান্তি।
বলল, খুব সুন্দরে এসে ঢেউটা এখানে
শান্তি না ছাই, গজগজ করল মুসা, ঢেউ দেখেছ একেকটা!
তেমন আর বড় কই? কিশোর বলল। ফুট তিনেকের বেশি না। তবে রাতে জোয়ারের সময় নিশ্চয় আরও ফুলে ওঠে। ড্রাগন আসার উপযুক্ত সময় তখন। ঢেউয়ের তলায় লুকিয়ে লুকিয়ে চলে আসতে পারবে। বকের মত গলা বাড়িয়ে নিচে তাকাল সে। গুহাটা দেখা যায় না। এখান থেকে দেখা যাবে না। আগে কথা বলে আসি মিস্টার জোনসের সঙ্গে, তারপর নেমে দেখব।
সৈকতের দিক থেকে চোখ ফেরাল না রবিন। নামবে কি করে?
পুরানো কয়েকটা তক্তা দেখাল মুসা, ধাপে ধাপে নেমে গেছে। এককালে বোধহয় সাদা ছিল ওগুলো, কিন্তু এখন আর রঙ চেনা যায় না। রোদ, বৃষ্টি এবং সাগরের নোনা হাওয়ায় করেছে এই অবস্থা। সিঁড়ির কি ছিরি, বলল সে, নামতে গেলেই খসে পড়ে কোমর ভাঙবে।
খাড়া পাড়ের কিনারটা দেখিয়ে কিশোর বলল, আরও সিঁড়ি নিশ্চয় আছে। এখান থেকে দেখছি না বটে, খুঁজলেই পাওয়া যাবে। চলো এবার, বাড়িটাতে ঢুকি।
আগে আগে চলল কিশোর। পাতাবাহারের বেড়ার চাপে জড়সড় হয়ে আছে যেন কাঠের গেটটা। ঠেলা দিতেই পাল্লা খুলে গেল। পামের জঙ্গলের ভেতর দিয়ে ঘুরে ঘুরে চলে গেছে পথ। নারকেলের ঝাড়, ঘন ঝোঁপ আর বুনো ফুলের আড়াল থেকে উঁকি দিচ্ছে বিবর্ণ হলদে ইটের একটা বাড়ি। অযত্নে হয়েছে এই অবস্থা, বোঝাই যায়। সাগর থেকে হু-হুঁ বাতাস এসে সরসরানি তুলছে নারকেল শাখায়, বুনো ফুল আর লতাকে নড়িয়ে দিয়ে যাচ্ছে। বাড়িটা সাগরের একেবারে কিনারে।
সদর দরজায় এসে ঘণ্টা বাজাল কিশোর।
দরজা খুলে দিলেন মিস্টার জোনস। বেঁটে, মোটাসোটা মানুষ। বিষণ্ণ বড় বড় বাদামী চোখ, ঘন ভুরু, সাদা চুল, মুখের রোদে পোড়া চামড়ায় বয়েসের ভাজ।
এসো এসো, হাত বাড়িয়ে দিলেন তিনি। ডেভিস পাঠিয়েছে তো? তিন গোয়েন্দা?
হ্যাঁ, স্যার, পকেট থেকে কার্ড বের করে দিল কিশোর। আমি কিশোর পাশা..ও মুসা আমান, আর ও রবিন মিলফোর্ড।
সন্তুষ্ট হয়ে মাথা ঝাঁকালেন জোনস, কার্ডটা পকেটে রাখলেন। এসো। স্টাড়িতে গিয়ে কথা বলি।
রোদ ঝলমলে মস্ত এক খোলামেলা ঘরে ওদের নিয়ে এলেন। তিনি।
হাঁ হয়ে গেল ছেলেরা। বিরাট ঘরের দেয়ালে মেঝে থেকে ছাত পর্যন্ত খালি ছবি আর ছবি, এক তিল জায়গা নেই। নানা রকম বিখ্যাত চিত্রকর্ম, বড় বড় অভিনেতা-অভিনেত্রীর সই করা ফ্রেমে বাঁধানো ছবি, আর সিনেমা জগতের কিছু বিশেষ অনুষ্ঠানের দৃশ্য।
পড়ার টেবিলটায় টেবিল-টেনিস খেলা যাবে, এত বড়; কাগজ, বই আর কাঠের ছোটবড় খোদাইকর্মে বোঝাই। শেলফ ও শো কেসগুলোতেও ঠাই নেই, অদ্ভুত সব মূর্তি, পুতুল, খেলনায় ভর্তি। দুটো জিনিস কিশোরের দৃষ্টি আকর্ষণ করল: দুটোই মূর্তি-একটা ডাইনীর, মধ্যযুগে তৈরি হয়েছিল; আরেকটা আফ্রিকান, এক কালো দেবতার, কুৎসিত, নিষ্ঠুর চেহারা।
ছেলেদের চেয়ার দেখিয়ে বসতে বললেন বৃদ্ধ। ঘুরে গিয়ে বসলেন। ডেস্কের ওপাশে সিংহাসনের মত এক চেয়ারে। আমি কি কাজ করতাম নিশ্চয় বলেছে ডেভিস?
হ্যাঁ, কিশোর জানাল। চিত্রপরিচালক।
ছিলাম, হেসে বললেন জোনস। অনেক বছর আগেই রিটায়ার করেছি। ডেভিস তখন নতুন পরিচালক হয়েছে। ও তো এখন বিখ্যাত লোক, আমার সময়ে আমিও ছিলাম। আমাদের দুজনের কাজের ধারা প্রায় এক। দু-জনেই রহস্য-রোমাঞ্চের ভক্ত, তবে মানসিকতার দিক থেকে কিছুটা আলাদা। ও বাস্তব জিনিস পছন্দ করে, আমি অবাস্তব।
বুঝলাম না, স্যার।
বাস্তবে যা ঘটে, ঘটতে পারে, সে-সব কাহিনী নিয়ে ছবি তৈরি করে ডেভিস। আমি করতাম অতিকল্পিত কাহিনী নিয়ে, ফ্যান্টাসি। ড্রাগনের কথা পুলিশের কাছে বলতে পারলাম না তো এ জন্যেই। উদ্ভট, অবাস্তব কাহিনী নিয়ে ছবি করেছি সারা জীবন, ভয়াবহ দুঃস্বপ্নেও যা কল্পনা করা যায় না। আমার ছবিতে থাকত ভয়ানক সব দৈত্য-দানব, মায়ানেকড়ে, ভূতপ্রেত, ডাইনী…সোজা কথা, আমার স্পেশালিটি ছিল হরর ফিল্ম।
মাথা ঝাঁকাল কিশোর। হ্যাঁ, স্যার, আপনার নাম শুনেছি। এবার চলচ্চিত্র উৎসবে আপনার একটা ফিল্মও দেখেছি। রোম খাড়া হয়ে গিয়েছিল।
থ্যাংক ইউ, বললেন বৃদ্ধ। তাহলে বুঝতেই পারছ, কেন পুলিশের কাছে যাইনি। দীর্ঘ দিন কোন ছবি বানাই না, নতুন দর্শকেরা অনেকেই আমার নাম জানে না, পুরানোরা ভুলে গেছে। কিছু বোকা লোক ভাববে, ড্রাগনের গল্প ফেঁদে নতুন করে পাবলিসিটি করতে চাইছি আমি, আবার সিনেমায় ঢোকার জন্যে।
কিন্তু আমি জানি, আমার কাজ শেষ, দিন শেষ। এখন কিছু বানালে চলবে না, ফ্লপ করবে, নেবে না আধুনিক দর্শক। এই বয়েসে নতুন কিছু যে বানাব, তা-ও সম্ভব না। সেই পুরানোই হয়ে যাবে। তার চেয়ে নতুনদের জন্যে পথ ছেড়ে দিয়ে সরে এসেছি। অনেক কাজ করেছি জীবনে, আর না, বুড়ো বয়েসটা একটু শান্তিতে কাটাতে চাই। টাকার অসুবিধে নেই আমার। শান্তিতেই কাটাচ্ছিলাম এখানে, নিরিবিলি…
ড্রাগনটা এসে সব পণ্ড করল, না? জোনসের বাক্যটা শেষ করল কিশোর।
নাক কুঁচকালেন পরিচালক, হ্যাঁ। এক এক করে তাকালেন ছেলেদের মুখের দিকে, তার কথা বিশ্বাস করছে কিনা বোঝার চেষ্টা করলেন। সাগর থেকে উঠেছে। একটা কথা ডেভিসকে বলতেও বেধেছে, বলিনি, যদি হেসে ফেলে। ড্রাগনটা শুধু যে দেখেছি তাই নয়, তার গর্জনও শুনেছি।
হঠাৎ যেন বড় বেশি নীরব হয়ে গেল ঘরটা।
শুনেছেন, শান্ত রয়েছে কিশোর। শব্দটা ঠিক কেমন? তখন কোথায় ছিলেন আপনি?
ছোট তোয়ালের সমান একটা রঙিন রুমাল বের করে ঘন ভুরুর ঘাম মুছলেন জোনস। একটা টিলার ওপর। এই তো, কাছেই। ওখান থেকে পরিষ্কার দেখা যায় সাগর।…চোখের ভুলও হতে পারে, কি। জানি!
তা পারে। কিন্তু শোনাটা? শব্দ তো আর চোখের ভুল নয়?
তা নয়। তবে কানেও তো ভুল শুনতে পারি? বুড়ো হলে চোখ কান সবই খারাপ হয়ে যায়। আবার কপালে রুমাল বুলালেন তিনি। তবে, এ-ক্ষেত্রে ভুল হয়েছে এটা বিশ্বাস করতে পারছি না, দেখেছি যে সেটাও মেনে নিতে পারছি না। বাস্তবে ড্রাগন নেই, সেই রূপকথার যুগেও ছিল না, আর এখন তো থাকার প্রশ্নই ওঠে না। ড্রাগন নিয়ে ছবি বানিয়েছি আমি, সবই যান্ত্রিক দানব, খেলনা। ভারি ইঞ্জিনের গর্জনের সঙ্গে তীক্ষ্ণ হুইসেল মিলিয়ে, সেটাকে বিশেষ কায়দায় ভোতা করে চালিয়ে দিয়েছি ড্রাগনের গর্জন বলে। সেই সঙ্গে পর্দায় বিশেষ আবহ সৃষ্টির ব্যবস্থা করে ভয় পাইয়েছি হলের দর্শকদের। অন্ধকারে ভীতিকর। শোনায় ওই গর্জন।
কিন্তু গতরাতে যা শুনেছি, আমার সৃষ্টি করা শব্দের সঙ্গে তার কোন মিল নেই। উঁচু পর্দার তীক্ষ্ণ একধরনের খসখসে শব্দ, যেন শ্বাস নিতে খুব কষ্ট হচ্ছে জানোয়ারটার, সেই সঙ্গে কাশি। আসলে, বলে। ঠিক বোঝানো যাবে না শব্দটা কেমন।
শুনলাম, আপনার বাড়ির নিচে একটা গুহা আছে? জিজ্ঞেস করল কিশোর। ছোট, না বড়? ড্রাগনের মত কোন জানোয়ারের জায়গা হবে?
তা হবে। একটা না, অনেক গুহা আছে এখানে, মাটির তলায় সুড়ঙ্গের জাল রয়েছে বলা যেতে পারে। উত্তর-দক্ষিণে অনেক দূর পর্যন্ত ছড়িয়ে গেছে। এককালে জলদস্যু, চোরাচালানি আর ডাকাতের আড্ডা ছিল ওসব জায়গায়। বছর কয়েক আগে ভূমিকম্পে একটা পাহাড়ের চূড়া ভেঙে গিয়ে ভূমিধস নামে, বেশ কিছু সুড়ঙ্গ আর গুহা বুজে যায়, হ্যাঁগিটিজ পয়েন্টের কাছে। তবে এখনও অনেক গুহা আর সুড়ঙ্গ আগের মতই আছে।
হুম্। আনমনে মাথা দোলাল কিশোর। অনেক বছর ধরেই তো আছেন এখানে, কিন্তু এই প্রথম ড্রাগন দেখলেন। তাই না?
মাথা ঝাঁকালেন বৃদ্ধ, হাসলেন। একবারই যথেষ্ট, আর দেখতে চাই না। কুকুরটা না হারালে এটাকেও দেখতাম না। পাইরেটকে খুঁজতে গিয়েই তো চোখে পড়ল।
কুকুরটার কথা কিছু বলুন। রবিন, নোটবই অর পেন্সিল নাও, কিশোর বলল।
ছেলেদের খাঁটি পেশাদারী ভাবভঙ্গি দেখে মুচকি হাসলেন পরিচালক। বললেন, গত দু-মাস ছিলাম না এখানে। ছবি বানাই না বটে, কিন্তু সিনেমা-জগৎ থেকে পুরোপুরি বিদায়ও নিতে পারিনি। প্রতি বছর বড় বড় যত চলচ্চিত্র উৎসব হয়, সবগুলোতে যোগ দিই; ইউরোপে যাই, দুনিয়ার বড় বড় অনেক শহরে যাই। এবারও গিয়েছিলাম। রোম, ভেনিস, প্যারিস, লণ্ডন আর বুদাপেস্ট সফর করেছি, উৎসবে যোগ দিয়েছি, পুরানো বন্ধুদের সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ করেছি।
আমি বাইরে গেলে পাইরেটকে একটা কুকুরের খোঁয়াড়ে রেখে যাই, কাছেই খোয়াড়টা। গত হপ্তায় ফিরে এসে ওখান থেকে নিয়ে এসেছিলাম ওকে। খুব সুন্দর কুকুর, আইরিশ সেটার। দিনে বেঁধে রাখি, রাতে ছেড়ে দিই। মাঝে মাঝেই বাড়ির সীমানার বাইরে চলে যেত পাইরেট, খানিকক্ষণ পরেই ফিরে আসত। কাল রাতে বেরিয়ে আর ফিরল না। তিন বছর ধরে আছে, কোনদিন এ রকম হয়নি। ফোন করলাম খোয়াড়ে। ভাবলাম, দু-মাসের অভ্যাস, বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করতে গেছে। কিন্তু ওখানে যায়নি কুকুরটা। নিজেই খুঁজতে বেরোলাম তখন। ড্রাগনটাকে দেখলাম।
সৈকতে যাননি নিশ্চয়? জিজ্ঞেস করল কিশোর।
মাথা নাড়লেন বৃদ্ধ। না। কি যে খারাপ লেগেছে না। সারাজীবন লোর্ককে ভয় দেখিয়েছি, আতঙ্কিত করেছি, তাদের ভয় দেখে হেসেছি, মজা পেয়েছি। নিজে ভয় পাওয়ার পর বুঝলাম, ওদের কেমন লেগেছে…ভয়ানক ড্রাগনটা পাইরেটকে ছিঁড়ে ছিঁড়ে খেয়েছে ভাবলেই মনটা খারাপ হয়ে যায়…ওটাকে দেখে ভাবলাম, আমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে…কি, বিশ্বাস হচ্ছে?
প্রশ্নটা এড়িয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করল কিশোর, সকালে আপনার বন্ধুকে ফোন করলেন, তাই না?
আবার ভুরু আর কপাল মুছলেন বৃদ্ধ। ডেভিস আমার খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু। রহস্যের জগতে অনেক উদ্ভট ঘটনা ঘটে, জানা আছে তার। তাই প্রথমেই তার কথা মনে পড়ল। ভাবলাম, কোন সাহায্য করলে সে-ই। করতে পারবে। ভুল করিনি। বিশ্বাস না করলে তোমাদের পাঠাত না। তোমাদের ওপর ভরসা করে সে, বুঝতে পারছি।
আপনি করছেন?
করছি। ডেভিস আমার চেয়ে অনেক বেশি খুঁতখুঁতে। সে যাদের ওপর আস্থা রাখতে পারে, তাদের ওপর আমিও রাখতে পারি চোখ
থ্যাংক ইউ, মিস্টার জোনস, খুশি হলো কিশোর। এই শহরে আরও কুকুর হারিয়েছে, জানেন? গত এক হপ্তায় পাঁচটা, আপনারটা ছাড়াই।
আবার মাথা ঝাঁকালেন বৃদ্ধ। শুনেছি, তবে পাইরেট নিখোঁজ হওয়ার পর। আগে জানলে ওকে ছেড়ে রাখতাম না।
যাদের হারিয়েছে, তাদের কারও সঙ্গে কথা বলেছেন?
না। ভয়েই যাইনি। মুখ ফসকে যদি ড্রাগনের কথাটা বেরিয়ে যায়!
এখানে সবারই কুকুর আছে?
হাসলেন জোনস। সবার নেই। রাস্তার ওপারে মিস্টার হেরিঙের নেই। আমার বাড়ির ডানে আরেক প্রতিবেশী আছে, রোভার মারটিন, তারও নেই। আর তেমন কাউকে চিনি না। নিরিবিলি একা থাকা পছন্দ আমার। বই, ছবি, আর পাইরেটকে নিয়ে কাটাই। এখানে কারও সঙ্গে বিশেষ আলাপ নেই। দেখা হলে, কেমন আছেন, ভাল, ব্যস।
উঠল কিশোর। যাই এখন। কিছু জানতে পারলে জানাব। আপনাকে।
তিন গোয়েন্দার সঙ্গে আবার হাত মেলালেন জোনস। গেটের কাছে, এগিয়ে দিয়ে গেলেন ওদেরকে। বাইরে বেরিয়ে পাল্লাটা বন্ধ করে দিল। কিশোর। ওপরের হুক লাগিয়ে দিল।
হেসে বলল মুসা, ভয় পাচ্ছ? ড্রাগন বেরোবে ভাবছ বাড়ির ভেতর থেকে?
যা গেট, ড্রাগনের বাচ্চাকেও ঠেকাতে পারবে কিনা সন্দেহ, বলল কিশোর। এমনি তুলে দিলাম। ভদ্রতা।
নির্জন পথের দিকে তাকাল মুসা। ঘড়ি দেখল। বোরিস আসছে না কেন? এই এলাকা ছাড়তে পারলে যেন বাঁচে।
এত তাড়াতাড়ি আসার কথা না। আরও দেরি হবে।
রাস্তা পেরোতে শুরু করল কিশোর।
যাচ্ছ কোথায়? জিজ্ঞেস করল রবিন।
মিস্টার হেরিঙের সঙ্গে দেখা করব। তারপর যাব মারটিনের ওখানে। এমন একটা জায়গায় থাকে অথচ কুত্তা পালে না, তারা কেমন লোক, দেখার আগ্রহ নেই তোমাদের?
না, নেই, দু-হাত নাড়ল মুসা। এখানে সব পাগলদের বাস। একজন দেখেছে ড্রাগন, আরেকজন হয়তো বলবে আরব্য উপন্যাসের চেরাগওয়ালা দৈত্য দেখেছে। আমার গিয়ে কাজ নেই।
কিন্তু দেখা গেল, কিশোরের পেছনে মুসাই গেল আগে, তারপর রবিন।
সরু পথ পেরিয়ে গেট খুলে ঢুকল মিস্টার হেরিঙের সীমানায়। জোনসের বাড়িতে যেমন অযত্ন, এখানে তেমনি অতিযত্ব। সব কিছু ছিমছাম, পরিচ্ছন্ন। পাতাবাহারের একটা পাতাও এদিক-ওদিক হয়ে নেই, সমান করে ছাঁটা, সমান উঁচু প্রতিটি গাছ, ঝকঝকে সবুজ লন, নিয়মিত ঘাস ছাঁটা হয়, একটা মরা ডাল নেই বাগানের কোন গাছে। ফুলের বিছানাগুলো দেখার মত। বাড়ির মালিক পরিষ্কার থাকতে পছন্দ করেন।
বেল টিপল কিশোর।
প্রায় সঙ্গে সঙ্গে খুলে গেল দরজা। মাঝারি উচ্চতার বলিষ্ঠ একজন লোক কড়া চোখে তাকালেন ওদের দিকে। কি চাই? বাজখাই কণ্ঠ।
মাপ করবেন, স্যার, বিনয়ে বিগলিত গোয়েন্দাপ্রধান। রাস্তার ওপারে আপনার পড়শীর সঙ্গে দেখা করে এলাম, মিস্টার জোনসের কথা বলছি। তার কুকুরটা হারিয়ে গেছে। আপনি কিছু জানেন কিনা। জিজ্ঞেস করতে এলাম।
চোখের পাতা কাছাকাছি হলো ভদ্রলোকের, ঘন ভুরুজোড়া কাছাকাছি হয়ে আবার সরে গেল। ঠোঁটে ঠোঁট চেপে বসল।
কুত্তাটা তাহলে হারিয়েছে? খুব ভাল। আর না পাওয়া গেলেই খুশি। যত্তসব পাগল-ছাগল, কুত্তা পালে, হুহ্!
জ্বলে উঠল তার চোখ, মুঠো হলো আঙুল।
বাপরে, ঘুসি মারতে আসবে নাকি! ভয় পেয়ে গেল মুসা।
জোর করে চেহারাটা স্বাভাবিক রাখল কিশোর। বুকের মধ্যে। কাঁপুনি শুরু হয়ে গেছে তারও। আপনি যে কুকুর দেখতে পারেন না, নিশ্চয় যথেষ্ট কারণ আছে। কি করেছে ওরা যদি বলেন…
কি করেছে, না; কি করেছে! বলি, কি করেনি? সব সময় যা করে তাই করেছে। সারা রাত হউ হউ করে চেঁচায়, চিল্কারের জ্বালায় ঘুমাগো যায় না। আমার ফুলের বেড় মাড়িয়ে শেষ করে, লন নষ্ট করে, ডাস্টবিন উল্টে ফেলে ময়লা-আবর্জনা সব পথের ওপর ছড়িয়ে দেয়। আরও শুনবে?
তাই নাকি? বলল কিশোের। মালিকদের আরও সাবধান হওয়া উচিত। আমরা, স্যার, এই এলাকায় এই প্রথম এসেছি, মিস্টার জোনস কুকুরটা খুঁজে দিতে ডেকেছেন। তাঁকে বলব আপনার অসুবিধের কথা। তার কুকুর আপনার জিনিস নষ্ট করে থাকলে ক্ষতিপূরণ দিতে তিনি বাধ্য। কুকুরের জন্যে সব কিছুই তিনি করতে রাজি…
বাধা দিলেন হেরিঙ, রাজি, না; রাজি! কুকুরের জন্যে সব কিছুই করবেন! একটু দাঁড়াও, দেখাচ্ছি, ভেতরে চলে গেলেন তিনি।
দাঁড়িয়ে আছে তিন গোয়েন্দা, ভদ্রলোকের ব্যবহারে অবাক।
ঝটকা দিয়ে খুলে গেল আবার দরজা। ফিরে এসেছেন হেরিঙ। হাতে শটগান।
ওরা কেউ কিছু করবে না। যা করার এরপর থেকে আমাকেই করতে হবে। জানো কি করব? ফেটে পড়ল বাজখাই কণ্ঠ। কুত্তাটা আবার এলে দুটো নলই খালি করব হারামীটার পাছায়। কুত্তার ছায়া আমার বাড়িতে দেখলেই গুলি করব! অনেক সহ্য করেছি, আর না!
বন্দুকের বাঁট কাঁধে ঠেকালেন তিনি। নিশানা করলেন তিন গোয়েন্দাকে, এমন ভঙ্গি, যেন ওরাই কুত্তার ছায়া।
তিন
ট্রিগারে আঙুলের চাপ বাড়ছে। কর্কশ কণ্ঠে ধমকে উঠলেন হেরিঙ, নিশানা খুব ভাল আমার, মিস করি না। আর কিছু বলার আছে। তোমাদের?
দুরুদুরু করছে মুসার বুক। তার মনে হলো নলের কালো ফুটো দুটো তার দিকেই চেয়ে আছে।
অস্বস্তিতে মাথা নাড়ল কিশোর। না, স্যার, আর কিছু জানার নেই। ডিসটার্ব করেছি, সরি। চলি।
শক্ত হলো হেরিঙের ঠোঁট। হ্যাঁ, যাও, জোনসকে বলে দিও, মিষ্টি কথায় কোন কাজ হবে না। আর যেন খাতির করার জন্যে কাউকে না পাঠায় আমার কাছে।
তিনি, স্যার, পাঠাননি। আমরাই…
খোঁচা মারার ভঙ্গিতে সামনের দিকে বন্দুকের নলটা ঠেলে দিলেন। হেরিঙ। গুহ করে থুতু ফেললেন মাটিতে।
ধীরে ধীরে পিছাতে শুরু করল ছেলেরা।
আহ্, দেখে হাঁটো! কানা নাকি! ধমকে উঠলেন হেরিঙ। লন মাড়িয়ে দিচ্ছ তো!
আড়চোখে দুই বন্ধুর দিকে তাকাল কিশোর। ভয় পাচ্ছে ওরা। পাগলের পাল্লায় পড়েছে ভাবছে। ঘুরতেও যেন ভয় পাচ্ছে, যদি গুলি। করে বসেন।
ফিসফিস করে মুসাকে বলল রবিন, আস্তে ঘোরো। তাড়াহুড়ো কোরো না।
মাথা সামান্য একটু কাত করে সায় জানাল মুসা। সাবধানে ঘুরল। দু-জনে। ছোটার জন্যে অস্থির হয়ে উঠেছে, কিন্তু ছুটছে না।
বোম ফাটল যেন পেছনে।
ভীষণ চমকে গেল মুসা। ধড়াস করে উঠল বুক। পরমুহূর্তে বুঝল না, বন্দুকের গুলি নয়, দরজার পাল্লা লাগানোর শব্দ।
জোরে নিঃশ্বাস ফেলে ঘুরে তাকাল কিশোর। হেরিঙকে দেখা যাচ্ছে না।
অর্ধেক পথ এসে আরেকবার ফিরল। এখনও দরজা বন্ধ।
দ্রুত গেটের বাইরে বেরিয়ে এল ওরা।
উফ্ফ্! হাঁপাতে হাঁপাতে বলল রবিন, বড় বাঁচা বেঁচেছি!
ঠিকই বলেছ, মুসা বলল, আমরা একটু এদিক-ওদিক করলেই দিত গুলি মেরে!
না, মারত না, মাথা নাড়ল কিশোর। বোল্ট লক করা ছিল, সেফ পজিশন।
বোকা হয়ে গেল দুই সহকারী গোয়েন্দা।
অ, এ জন্যেই, মাথা দোলাল মুসা, এ জন্যেই ভয় পাওনি তুমি! তাই তো বলি…
আমাদের গুলি করার জন্যে বন্দুক আনেননি, কিশোর বলল।
রাগ দেখাতে, ভয় দেখাতে এনেছিলেন। কুকুরের কথা বলেই ভুল করেছি।
গেছি কুকুরের কথা জিজ্ঞেস করতে, বলল মুসা, আর কি করতাম?
আনমনে ঠোঁট কামড়াল কিশোর। আবার গেলে সাবধানে কথা বলতে হবে মিস্টার হেরিঙের সঙ্গে।
আবার? মাথা নাড়ল মুসা। না, ভাই, আমি এর মধ্যে নেই। যেতে হলে তুমি যাও। আমি আর যাচ্ছি না ওখানে।
আমিও না, মানা করে দিল রবিন।
সহকারীদের কথায় বিশেষ কান দিল না কিশোর। এমনও হতে পারে, রাগ দেখানোটা একটা অভিনয়। কুকুরগুলোর খবর হয়তো তাঁর জানা।
কথাটা কিন্তু মন্দ বলনি! একমত হলো রবিন।
এভাবে আর হুট করে কোথাও ঢুকব না। বুঝে-শুনে, তারপর।
কি বলছে ও? কিশোরকে দেখিয়ে রবিনকে জিজ্ঞেস করল মুসা।
জবাবটা কিশোরই দিল। হাত তুলে আরেকটা বাড়ি দেখিয়ে বলল, মিস্টার জোনসের আরেক প্রতিবেশী। একজনের সঙ্গে তো মোলাকাত করলাম, বাকি আরেকজন। তাঁর মেজাজটা জানাই বা বাকি রাখি কেন? মিস্টার রোভার মারটিনকেও কয়েকটা প্রশ্ন করব।
বুক সমান উঁচু ধাতব একটা গেট পথরোধ করল ওদের। তার ওপর দিয়ে বিরাট বাড়িটার দিকে তাকাল ওরা।
ভালই তো মনে হচ্ছে, রবিন বলল। কামান-টামান নেই।
শটগান আছে কিনা দেখো! খুব সাবধানে কয়েক ইঞ্চি পাশে সরল মুসা। ওপর আর নিচতলার সবগুলো জানালায় নজর বোলাল।
কই, কাউকে দেখা যাচ্ছে না। মিস্টার মারটিন বাড়ি নেই নাকি?
আগে বাড়ল কিশোর। গেলেই দেখা যাবে… থেমে গেল সে, হাঁ করে চেয়ে আছে গেটের পাল্লার দিকে। নিঃশব্দে খুলে যাচ্ছে।
খাইছে! ককিয়ে উঠল মুসা, জাদুকরের বাড়ি…
আরে, না, বাতাসে খুলেছে, রবিন বলল।
মাথা নাড়ল কিশোর। ডানার মত করে দু-পাশে দু-হাত ছড়িয়ে দিয়ে রবিন আর মুসাকে আটকাল, পিছিয়ে যেতে বলে নিজেও পিছিয়ে এল। আপনা-আপনি বন্ধ হয়ে গেল গেট।
আবার সামনে এগোল কিশোর। খুলে গেল গেট।
ইলেকট্রনিকের জাদু, বলল সে। এয়ারপোর্ট, সুপারমার্কেট, অফিস-পাড়ার বড় বড় বিল্ডিংগুলোতে দেখনি?
তা দেখেছি, মুসা বলল। কিন্তু কারও বাড়িতে এই প্রথম…
এতেই প্রমাণ হচ্ছে কুসংস্কার কিংবা ভূতপ্রেতে বিশ্বাস করেন না। মিস্টার মারটিন। ড্রাগনের ব্যাপারটা হেসেই উড়িয়ে দেবেন।
তাহলে আর গিয়ে লাভ কি?
এসেছি যখন দেখেই যাই না, ভেতরে ইলেকট্রনিকের আরও জাদু থাকতে পারে।
গেটের ভেতরে পা রাখল ওরা। পথের ধারে লন, ঠিক মাঝখানে বড় একটা সূর্যঘড়ি, চমৎকার তার অলঙ্করণ। সামনে মাথার ওপরে।
একটা ফুলের জাফরি, তাতে অনেকগুলো ফুলগাছ, ফুল ফুটে রয়েছে।
সামনে এগোল ওরা। পেছনে নিঃশব্দে বন্ধ হয়ে গেল গেট। জাফরির তলা দিয়ে পথ। ওটার নিচ দিয়ে এগোতেই হঠাৎ যেন ভেঙে খসে পড়ল জাফরি। এক সঙ্গে পিছিয়ে আসতে গিয়ে একে অন্যের গায়ে ধাক্কা লাগাল ওরা। পড়ে যাচ্ছিল রবিন, খপ করে তার হাত চেপে ধরল মুসা।
আসলে পুরো জাফরিটা খসে পড়েনি। মস্ত এক মাচার চারধারে ধাতব রেলিঙ দিয়ে ঘেরা, চারপাশের ওই রেলিঙগুলো খসে পড়েছে চারদিক থেকে, মাচাটা আর তাতে লাগানো ফুলগাছগুলো রয়ে গেছে তেমনি। শিকের একটা খাঁচায় বন্দি হলো যেন ছেলেরা, মাথার ওপরে ফুলের কেয়ারি।
আজব রসিকতা। শুকনো ঠোঁট চাটল কিশোর। পোর্টকালিস দেখে আইডিয়াটা পেয়েছে বোধহয়।
সেটা আবার কি জিনিস? জানতে চাইল মুসা।
ভারি লোহার শিকের কপাট। পুরানো দুর্গের দরজার ওপরে শেকল দিয়ে ঝোলানো থাকত। শেকল ছেড়ে দিলেই ওপর থেকে ঝমঝম করে নেমে এসে পথ বন্ধ করে দিত।
বইয়ে ছবি দেখেছি, রবিন বলল। বেশির ভাগ পুরানো দুর্গেরই সদর দরজায় লাগানো থাকত ওই জিনিস। পাল্লাও থাকত দরজায়। শত্রুরা পাল্লা ভেঙে ফেললে তাদেরকে ঠেকানোর শেষ চেষ্টা হিসেবে ছেড়ে দেয়া হত পোর্টকালিস, পাল্লার চেয়ে অনেক শক্ত।
আমরা কি দুর্গে ঢুকছি নাকি? হাত ওল্টাল মুসা।
অদ্ভুত একটা হিসহিস শব্দ তুলে আবার উঠে যেতে শুরু করল রেলিঙগুলো। মাচার চারধারে জায়গামত গিয়ে বসে গেল আবার।
পরস্পরের দিকে তাকাল ছেলেরা।
রসিকতা, বিড়বিড় করল কিশোর! চলো।
কিশোরের হাত চেপে ধরল মুসা। যাওয়াটা কি ঠিক হচ্ছে? এই দুর্গে আমাদেরকে ঢুকতে দিতে চায় না বোধহয়।
হাসল কিশোর। ভয় পেলে? পাওয়ারই কথা অবশ্য। অটোমেটিক গেট, জাফরির ইলেকট্রনিক কনট্রোলড রেলিঙ। বিজ্ঞানের জাদুকর মিস্টার মারটিন। দেখা না করে যাচ্ছি না আমি।
এগোল কিশোর। পেছনে ভয়ে ভয়ে পা ফেলতে ফেলতে চলল তার দুই সহকারী।
সদর দরজার কাছে দাঁড়িয়ে সঙ্গীদের দিকে চেয়ে হাসল গোয়েন্দাপ্রধান। তারমানে, দেখলে তো, আর কিছু হলো না। বেল বাজানোর সুইচে আঙুল রাখল।
আঁউ! করে চিৎকার দিয়ে ছিটকে সরে এল কিশোর। হাত ঝাড়ছে। সুইচেও কারিগরি করে রেখেছে। কারেন্ট!
আগেই বলেছি তোমাকে, মুখ গোমড়া করে বলল মুসা। আমাদের ঢুকতে দিতে চায় না। তা-ও জোরাজুরি করছ। যথেষ্ট হয়েছে, চলো এবার। মিস্টার মারটিনের সঙ্গে দেখা করা আর লাগবে না।
আসলে আমাদের পরীক্ষা করছে। ফেরার কোন ইচ্ছেই নেই কিশোরের। ভয় দেখিয়ে তাড়াতে চাইছে। শেষ পর্যন্ত যদি থাকতে পারি, দেখা করবে এসে।
কিশোরের কথার জবাবেই যেন মৃদু ক্লিক করে উঠে নিঃশব্দে খুলে যেতে শুরু করল দরজা।
দারুণ! রবিন বলল। পুরো বাড়িটাকে ইলেকট্রনিকসের জালে ঘিরে রেখেছে।
সাবধানে ভেতরে পা রাখল ওরা। আবছা অন্ধকার, বড় বেশি নীরব।
কাউকে দেখা গেল না। কেশে গলা পরিষ্কার করে অদৃশ্য কারও উদ্দেশ্যে জোরে জোরে বলল কিশোর, গুড ডে, মিস্টার মারটিন। আমরা তিন গোয়েন্দা। আপনার প্রতিবেশী মিস্টার জোনসের হয়ে কথা বলতে এসেছি। আসব, স্যার?
জবাব নেই।
তারপর, অতি মৃদু একটা খসখস শোনা গেল মাথার ওপরে। ডানা ঝাঁপটানোর আওয়াজ। নেমে আসছে।
ঝট করে চোখ তুলে তাকাল তিনজনে।
ছাত দেখা যাচ্ছে না, অনেক উঁচু আর অন্ধকার। সেই অন্ধকার থেকে নেমে আসছে পাখিটা। বিশাল এক কালো বাজ পাখি। ছো মারার জন্যে নামছে, গতি বাড়ছে দ্রুত। তীক্ষ্ণ চিৎকার করে উঠল, বাঁকা ভীষণ ঠোঁট ফাঁক, ভেতরে চোখা লাল জিভ, চোখে তীব্র ঘৃণা। ধারাল নখ বাড়িয়ে ওদেরকে ছিঁড়তে আসছে।
চার
খাইছে! চেঁচিয়ে উঠল মুসা। ঝাঁপ দিয়ে পড়ল মেঝেতে।
তার দেখাদেখি রবিন আর কিশোরও শুয়ে পড়ল।
থামল না পাখিটা। ভীষণ গতিতে নেমে এল। থেমে গেল ওদের মাথার এক ফুট ওপরে এসে। তিন গোয়েন্দাকে অবাক করে দিয়ে ঝুলে রইল ওখানেই। চিৎকারও থেমে গেছে।
আস্তে মাথা কাত করে ওপর দিকে তাকাল কিশোর। উঠে বসল। ভয় দূর হয়ে গেল চেহারা থেকে, সে-জায়গা দখল করল হাসি।
ওঠো, ডাকল সে। জ্যান্ত পাখি না ওটা।
কী? ভয়ে ভয়ে মাথা তুলল মুসা। চোখে অবিশ্বাস।
রবিনের অবস্থাও তারই মত।
সরু তামার তারে ঝুলছে পাখিটা।
খেলনা, ছুঁয়ে দেখে বলল কিশোর। বেশির ভাগই প্ল্যাস্টিক।
আল্লারে, কোন্ পাগলের পাল্লায় পড়লাম! মুখ বিকৃত করে ফেলল মুসা।
বিশাল ঘরের অন্ধকার থেকে ভেসে এল খসখসে অট্টহাসি। মাথার ওপর দপ করে জ্বলে উঠল একাধিক উজ্জ্বল আলো।
লম্বা, রোগাটে একজন মানুষ চেয়ে আছেন ওদের দিকে, পরনে কালো ঢোলা আলখেল্লার মত ওভারকোট। খাট করে ছাঁটা চুল, তামাটে লাল।
রহস্যের দুর্গে স্বাগতম, ভারি খনখনে গলায় বললেন তিনি, মুসার মনে হলো কবর থেকে উঠে এসেছে জিন্দালাশ।
সামনের দিকে বাঁকা হয়ে গেল তার শরীর, প্রবল হাসিতে দুলছে। হাসতে হাসতে কেশে ফেললেন, তারপরও কাশি চলল কিছুক্ষণ, দমকে দমকে।
রসিকতা-বোধ না ছাই! নিচু কণ্ঠে বিড়বিড় করল মুসা। বদ্ধ উন্মাদ!
হাসি আর কাশির জন্যে মুসার কথা কানে গেল না বোধহয় তাঁর। ধীরে ধীরে সোজা হলেন, চোখের কোণে পানি জমেছে। রোভার মারটিন বলছি। পাখিটাকে সরিয়ে দিচ্ছি, নইলে যদি ঠোকর মারে।
উঠে দাঁড়াল তিন গোয়েন্দা।
হাসিমুখে তাদের কাছে এগিয়ে এলেন মারটিন। হুক থেকে খুলে নিলেন পাখিটা।
ছাতের দিকে চেয়ে কিশোরও হাসল। সঙ্গীদের বলল, সরু লাইন। বানিয়ে তার ওপর দিয়ে চালায়। ইলেকট্রিক খেলনা ট্রেনের মত।
ওপর দিকে চেয়ে মুসা আর রবিনও দেখল বিশেষ কায়দায় তৈরি লাইন। সামান্য ঢালু। ওটার ওপর দিয়ে পাখিটা পিছলে নামে বলে গতি বাড়ে। লাইন শেষ হলে ছিটকে নেমে আসে, আবছা অন্ধকারে মনে হয় ছোঁ মারতে আসছে।
ট্রেন অনেক ভাল, মুসা বলল। মানুষকে ভয় দেখায় না।
হাসছেন মারটিন। খুব বোকা বানিয়েছি, না? সরি। বিচিত্র খেলনা বানানো আমার হবি। হাত তুলে দেখালেন, ওই যে আমার কারখানা।
ঘরের এক ধারে ওঅর্কশপ, নানারকম যন্ত্রপাতি, কাঠ, তারের জাল, প্ল্যাস্টিকের টুকরো, তারের বাণ্ডিল ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে।
পাখিটা একটা টেবিলে রাখলেন মারটিন। তারপর, কি মনে করে? কণ্ঠস্বর পাল্টে গেছে, একেবারে স্বাভাবিক, তারমানে ইচ্ছে। করেই তখন স্বর বিকৃত করে কথা বলছিলেন।
একটা কার্ড বের করে দিল কিশোর। এটা দেখলেই বুঝবেন।
তিন গোয়েন্দার কার্ডটা পড়লেন তিনি, তারপর হাসিমুখে ফিরিয়ে দিলেন। হারানো কুকুরের খোঁজ নিতে এসেছ তো?
হ্যাঁ, বলল কিশোর। মিস্টার জোনসের আইরিশ সেটারটা পাওয়া যাচ্ছে না। ভাবছি, সী-সাইডের অন্যান্য কুকুর নিখোঁজের সঙ্গে এর সম্পর্ক আছে।
থাকতে পারে, বললেন মারটিন। রেডিওর খবরে শুনেছি। জোনস তো মাঝে মাঝেই থাকে না, শুনেছি, গত দু-তিন মাসও নাকি ছিল না। গত হপ্তায় ফিরেছে। কুত্তাটা হারিয়েছে তাহলে। খুঁজে বের করতে পারবে তো?
চেষ্টা করব। ভাবলাম, মিস্টার, জোনসের প্রতিবেশীদের সঙ্গে আলাপ করলে জরুরী তথ্য পাওয়া যাবে, তাই এসেছি। মিস্টার হেরিঙের ওখানেও গিয়েছিলাম। চেনেন নিশ্চয়?
হাসলেন মারটিন। এখানে কে তাকে না চেনে? যা বদমেজাজ। বন্দুক দেখিয়েছে?
দেখিয়েছেন। তবে সেফটি ক্যাচ অন করা ছিল। শাসিয়েছেন, আবার যদি তার বাড়িতে কুকুর ঢোকে, গুলি করে মারবেন। কুকুর দু চোখে দেখতে পারেন না ভদ্রলোক।
শুধু কুকুর কেন, কোন কিছুই দেখতে পারে না। মানুষও না।
আপনি পারেন বলেও তো মনে হয় না, ফস করে বলে বসল মুসা, অযথা ভয় পেয়েছে বলে রাগ লাগছে এখন। মানুষকে এভাবে ভয় দেখানোর কোন মানে হয়?
ভুল করলে। মানুষকে আমি খুবই পছন্দ করি। কিন্তু যখন তখন অবাঞ্ছিত লোক ঢুকে পড়ে তো, শান্তিতে কাজ করতে দেয় না, তাই এই বিশেষ ব্যবস্থা। ফেরিওলা আর কোম্পানির এজেন্টরা হচ্ছে সবচেয়ে বিরক্তিকর। তোমরা ভয় পেয়েছ, না?
দুর্বল হার্ট হলে এতক্ষণে তিনটে কফিনের অর্ডার দিতে হত আপনাকে।
হেসে উঠলেন মারটিন। খুব মজার মজার কথা বলল যা হোক। হ্যাঁ, আমি জাতে ইঞ্জিনিয়ার। ছোটখাটো আবিষ্কারও করেছি। আগেই বলেছি, খেলনা বানানো আমার হবি, তবে ওগুলো ক্ষতিকর। নয়।
কুকুরের কথা কিছু বলুন, আগের কথার খেই ধরল কিশোর। কিছু জানেন-টানেন?
মাথা নাড়লেন মারটিন। সরি। রেডিওতেই যা শুনেছি। মালিকদের সঙ্গে গিয়ে আলাপ করে দেখতে পারো।
মিস্টার জোনসের সঙ্গে অবশ্য করেছি। কিন্তু তিনি যে কথা বললেন, বিশ্বাস করাই শক্ত।
কি কথা?
ঠোঁট কামড়াল কিশোর। বলা কি উচিত হবে?
কেন হবে না?
হয়তো ব্যাপারটা ভালভাবে নেবেন না মিস্টার জোনস। সরি, মিস্টার মারটিন।
একেবারে উকিলের মত কথা বলছ। মক্কেলের গোপন কথা ফাঁস হয়ে যাবে যেন।
মাথা ঝাঁকাল কিলোর। অনেকটা সে রকমই, মিস্টার মারটিন। আপনি তো তাঁর প্রতিবেশী। সাংঘাতিক কোন রহস্যময় ঘটনা এখানে ঘটলে, আর সেটা তিনি জানলে, আপনারও জানার কথা।
হাসলেন মারটিন। বাহ, বেশ গুছিয়ে কথা বলতে পারো তো। তা খুলেই বলল না কি হয়েছে?
কিশোরের এই ইনিয়ে-বিনিয়ে বলা সহ্য হলো না মুসার, এমনিতেই কিছুক্ষণ যাবৎ স্নায়ুর ওপর অসম্ভব চাপ গেছে। অধৈর্য হয়ে বলেই ফেলল, ড্রাগন দেখেছেন মিস্টার জোনস। গতরাতে সাগর থেকে উঠেছিল ওটা।
ড্রাগন! তাই নাকি? দেখেছে? ভুরু কোঁচকালেন মারটিন।
দ্বিধা করছে কিশোর। এভাবে ফস করে মুসার বলে ফেলাটা পছন্দ হয়নি তার। কিন্তু আর গোপন রেখে লাভ নেই, যা বলার বলেই ফেলেছে। দেখেছেন, বলল সে। লোক জানাজানি হোক, এটা চান না। মিস্টার জোনস, হাসির পাত্র হতে চান না।
অসম্ভব!
শুধু দেখেননি, রবিন বলল, ওটার গর্জনও শুনেছেন। তাঁর বাড়ির নিচে গুহায় নাকি গিয়ে ঢুকেছে।
মিস্টার জোনস যখন দেখেছেন, কিশোর বলল, আপনিও দেখে থাকতে পারেন, একই এলাকায় থাকেন তো। তাই জিজ্ঞেস করতে এলাম।
না, আমি দেখিনি। সৈকতের ধারেকাছে যাই না আমি। সাঁতারও পছন্দ নয়। আর গুহার কাছে যাওয়া বাদ দিয়েছি অনেক দিন আগে। সাংঘাতিক খারাপ জায়গা।
কেন? জিজ্ঞেস করল রবিন।
কেন? যখন তখন ভূমিধস নেমে মুখ বন্ধ হয়ে যায় বলে। ভেতরে আটকা পড়লে জ্যান্ত কবর হয়ে যাবে।
শুনেছি চোর-ছ্যাচড়েরও নাকি আড্ডা? কিশোর বলল।
আগে ছিল, অনেক আগে। ধসের ভয়ে ওরাও ঢোকে না এখন। কাছে গিয়ে একবার দেখে এসো না, তাহলেই বুঝবে। অনেক সময় পাড় ধসে বাড়িসুদ্ধ পড়ে যায়। ক্ষণিকের জন্যে আলো ঝিলিক দিল মারটিনের চোখে। আহা, তোমাদের বয়েস যদি এখন হত আমার। ড্রাগন দেখার জন্যে গুহায় ঢুকতামই। তোমরাও ঢুকবে বুঝতে পারছি, কিন্তু সাবধান। খুব খারাপ জায়গা। মোরো না যেন।
থ্যাংকস, বলল কিশোর। তাহলে ড্রাগনের কথা বিশ্বাস করছেন না?
হাসলেন মারটিন, তুমি করছ?
দ্বিধায় পড়ে গেল কিশোর। ইয়ে…
আরও জোরে হেসে উঠলেন মারটিন।
আপনার সঙ্গে আলাপ করে ভাল লাগল, মিস্টার মারটিন, বলল কিশোর। মিস্টার জোনস আসলে কি দেখেছেন, খোঁজ নিয়ে জানার চেষ্টা করব।
হ্যাঁ, দেখো। জানি, অনেক হরর ফিল্ম বানিয়েছে জোনস। মাথায় সারাক্ষণ নানা রকম উদ্ভট চিন্তাভাবনা খেলে। ড্রাগন দেখাটা তার কল্পনা হতে পারে। কিংবা এমনও হতে পারে, তার সঙ্গে রসিকতা করেছে তার কোন পুরানো বন্ধু।
তা হতে পারে, স্বীকার করল কিশোর।
হ্যাঁ, মাথা ঝাঁকালেন মারটিন, কত রকমের পাগল আছে এই দুনিয়ায়।
তুমিও তো এক পাগল! বলতে ইচ্ছে করল মুসার, কিন্তু বলল না।
সরি, আবার বলল মারটিন। তোমাদের কোন সাহায্য করতে পারলাম না। চলো, এগিয়ে দিয়ে আসি।
দরজা খুলে বেরিয়ে এল ছেলেরা। ..
দরজার ওপাশ থেকে হাত বাড়িয়ে দিলেন ইঞ্জিনিয়ার। গুড লাক, সন।
বাড়ানো হাতটা শক্ত করে চেপে ধরল কিশোর। থ্যাংক ইউ, স্যার, বলে আলতো ঝাঁকি দিল।
নিঃশব্দে বন্ধ হয়ে গেল দরজা। হাতটা ধরাই আছে কিশোরের হাতে। হা হয়ে গেল সে। শিরশির করে মেরুদণ্ড বেয়ে নেমে গেল। ভয়ের ঠাণ্ডা স্রোত।
শরীর থেকে আলাদা হয়ে গেছে ইঞ্জিনিয়ারের ডান হাতটা।
পাঁচ
আতঙ্কিত দৃষ্টিতে ছেঁড়া হাতটার দিকে তাকিয়ে রইল কিশোর। মনে হচ্ছে একেবারে আসল, রক্ত-মাংসের তৈরি। আচমকা অস্ফুট একটা শব্দ করে উঠে ছেড়ে দিল হাতটা।
ফিরে তাকাল অন্য দুই গোয়েন্দা।
কি হয়েছে? জিজ্ঞেস করল মুসা।
দেখে চমকে গেল রবিনও, আরি! এ কি! একটা ছেঁড়া হাত!
খাইছে! আঁতকে গেল মুসা।
বিড়বিড় করে বলল কিশোর, এটা…এটা মিস্টার মারটিনের হাত, হ্যান্ডশেক করার সময় ছিঁড়ে এসেছে!
বাড়ির ভেতর থেকে জোর হাসি শোনা গেল। শেষ হলো চাপা কাশির মত শব্দ দিয়ে, আচমকা গলা টিপে ধরা হয়েছে যেন।
কিশোরের মুখে রক্ত জমল। গাধা বানিয়েছেন আমাকে মারটিন। রসিক লোক, ভুলেই গিয়েছিলাম।
হাতটা তুলে দুই সহকারীর দিকে বাড়িয়ে ধরল সে।
মাথা নাড়ল মুসা।
রবিন নিল হাতটা। এক্কেবারে আসল মনে হয়। ডান হাত নেই আরকি মিস্টার মারটিনের। আরটিফিশিয়াল হাত লাগানো ছিল। জোরে ঝাঁকুনি দিয়েছ, খুলে চলে এসেছে।
মাথা নাড়ল কিশোর। মনে হয় না। হাসলেন, শুনলে না। এটাও রসিকতা। মানুষকে ভয় দেখানোর জন্যে উদ্ভট সব কাণ্ডকারখানা করে রেখেছেন।
হ্যাঁ, মুখ বাঁকাল মুসা। নেই কাজ তো খই ভাজ, আর কি করবে? চলো, আরও কিছু করে বসার আগেই পালাই।
হাতটা ছুঁড়ে ফেলে দিল রবিন।
জোরে জোরে হাঁটতে শুরু করল তিনজনে।
ফুলের জাফরিটার ভেতর দিয়ে না গিয়ে পাশ কাটিয়ে এল। থেমে গেল ধাতব গেটটার সামনে এসে।
নিঃশব্দে খুলে গেল পাল্লা।
পথে বেরিয়ে এল তিন গোয়েন্দা।
বাঁচলাম! স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল রবিন, মানুষকে কামড়ানোর জন্যে যে গেটে কোন ব্যবস্থা রাখেনি, এতেই আমি খুশি।
থেমো না, হাঁটো, হুঁশিয়ার করল মুসা। এখনও বিপদ-মুক্ত নই আমরা।
বেশ খানিকটা দূরে এসে থামল ওরা, হাঁপাচ্ছে।
এবার কি? রবিনের প্রশ্ন। বোরিসের জনে দাঁড়িয়ে থাকব?
তারচেয়ে চল রকি বীচের দিকে হাঁটতে থাকি, প্রস্তাব দিল মুসা।
এখানে যে কাণ্ডকারখানা, তাতে বিশ মাইল হাঁটাও কিছু না। কষ্ট হয়তো হবে, কিন্তু নিরাপদ জায়গায় তো গিয়ে পৌঁছব।
নিচের ঠোঁটে টান দিয়ে ছেড়ে দিল কিশোর। ঘড়ি দেখল। সময় আছে এখনও। নিচে গিয়ে গুহাটা একবার দেখলে কেমন হয়? কি বলো?
একটা পাহাড়ের চূড়ার দিকে তাকাল মুসা, ওই ড্রাগনের গুহায়? আমি বলি কি, কিশোর, এই একটা রহস্য তুমি ভুলে যাও। বাদ দাও কেসটা।
রবিনের দিকে ফিরল কিশোর, তোমার কি বক্তব্য?
মুসার সঙ্গে আমি একমত। মারটিন কি বললেন, মনে নেই? খুব বিপজ্জনক জায়গা। ড্রাগনের কথা না হয় বাদই দিলাম, ভূমিধসও কম খারাপ না। মেরে ফেলার জন্যে যথেষ্ট।
পাড়ের কাছে এসে দাঁড়াল কিশোর। উঁকি দিয়ে নিচে তাকাল একবার! পুরানো কাঠের সিঁড়ির রেলিঙে হাত রেখে বলল, না দেখে ফিরে যাওয়াটা কি ঠিক হবে? দেখে গেলে, বাড়ি গিয়ে ভাবনাচিন্তা করার একটা বিষয় পাব। না দেখে গেলে কি বুঝব?
কাঠের সিঁড়ি বেয়ে নামতে শুরু করল সে।
রবিনের দিকে তাকাল মুসা। নিচু স্বরে কিশোর যাতে শুনতে না পায় এমন করে বলল, আমাদের মতামতের কোন দামই দিল না। তার কথা কেন শুনতে যাব?
ফোঁস করে দীর্ঘশ্বাস ফেলল রবিন। জানোই তো, ও গোঁয়ার। যা বলে, করে ছাড়ে। ধরে নাও না, আমরা ওর চেয়ে অনেক বেশি ভদ্রলোক, হাসল সে।
মুসাও হাসল। হ্যাঁ, ঠিকই বলেছ। আমরা ভদ্রলোকই। চলো। এখানে দাঁড়িয়ে থাকা মোটেও নিরাপদ নয়। কে জানে, মারটিন না আবার কোন উড়ুক্কু ঝামেলা ছুঁড়ে মারে। হেরিঙকেও বিশ্বাস নেই। মানুষের ওপর টার্গেট প্র্যাকটিসের শখ চাপলে মরেছি।
রেলিঙ ধরে নামতে শুরু করল রবিন।
তারপর মুসা।
খুবই পুরানো সিঁড়ি, সরু ধাপগুলো বেশি কাছাকাছি, নড়বড়ে। কাঁচম্যাচ করে উঠছে। খাড়াও যথেষ্ট।
ভয়ে ভয়ে নামছে দু-জনে। নিচের দিকে তাকাচ্ছে না।
ওপরে তাকাল কিশোর। দুই সহকারী নামতে দেখে মুচকি হাসল। কিন্তু হাসি মুছে গেল শিগগিরই। পনেরো ফুট ওপরে রয়েছে তখনও, এই সময় ঘটল অঘটন।
কোন রকম জানান না দিয়ে মুসার ভারে ভেঙে গেল একটা তক্তা। পিছলে গেল পা। রেলিঙ চেপে ধরে পতন রোধ করার অনেক চেষ্টা করল সে, পারল না। জোরাজুরিতে রেলিঙের জোড়াও গেল ছুটে। নিচে পড়তে শুরু করল সে।
মুসার চিৎকারে চমকে ওপরে তাকাল রবিন। তাড়াতাড়ি নামার চেষ্টা করল। কিন্তু কয় ধাপ আর নামবে? তার গায়ের ওপর এসে পড়ল মুসা।
রবিনের হাতও ছুটে গেল। সে-ও পড়তে লাগল।
ময়দার বস্তার মত এসে কিশোরকে আঘাত করল যেন দুটো শরীর। ঠেকানোর প্রশ্নই ওঠে না। রেলিঙ ভাঙল, পায়ের নিচের তক্তা ভাঙল, ভেঙে সবসুদ্ধ নিচে পড়তে শুরু করল কিশোরের শরীর।
ধুপ ধুপ করে নিচে পড়ল তিনটে দেহ।
কিশোরের ওপর কে পড়ল দেখার সময় পেল না সে, তার আগেই মাথা ঠুকে গেল পাথরে।
আঁধার হয়ে গেল সবকিছু।
ছয়
কিশোর, তুমি ঠিক আছ?
মিটমিট করে চোখ মেলল কিশোর। মুসা আর রবিনের চেহারা। আবছা দেখতে পেল, কেমন যেন হিজিবিজি দেখাচ্ছে দুটো মুখই, চেয়ে রয়েছে তার দিকে।
চোখ বন্ধ করে মাথা ঝাড়া দিয়ে আবার মেলল সে। উঠে বসল। চোখের পাতায় লেগে থাকা বালি সরাল, মুখের বালি পরিষ্কার করল, তারপর বলল, হ্যাঁ, ঠিকই আছি। আমার ওপর কে পড়েছিল?
নাকমুখ ভোতা করে ফেলেছ। বালিতে দেবে গিয়েছিল তাই রক্ষা।
ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াল কিশোর। আশপাশে ভাঙা তক্তা পড়ে আছে, তার একটা তুলে নিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখল। না, এটাতে নেই। ফেলে দিয়ে আরেকটা তুলল। চতুর্থ তক্তাটা এক নজর দেখেই মাথা ঝাঁকাল সে। মুসা, তোমার দোষ নয়। তোমার ভারে ভেঙেছে বটে, তবে কারসাজি করে না রাখলে ভাঙত না। এমনভাবে করে রেখেছে, যাতে পায়ের চাপে ভেঙে যায়।
দুই সহকারীর দিকে কাঠটা বাড়িয়ে দিল সে। ভাল করে দেখলেই বুঝতে পারবে। নিচের দিকে কেটেছে, যাতে দেখা না যায়।
হাতে নিয়ে রবিন আর মুসাও দেখল।
রবিন বলল, ঠিক বোঝা যায় না। ধরলাম, তোমার কথাই ঠিক। কিন্তু আমরা নামব, এটা কে জানে?
ঠিক, রবিনের কথায় সায় দিয়ে বলল মুসা। কিশোর, এটা তোমার অনুমান। দেখে তো বোঝা যায় না, কাটা হয়েছে। আমরা যে আসব, কে কে জানে, বলো? নিশ্চয় মিস্টার জোনস, মারটিন কিংবা হেরিঙ কাটেননি?
মাথার যেখানটায় বাড়ি খেয়েছে কিশোর, ফুলে উঠেছে সুপারির মত। সেখানে হাত বোলাচ্ছে, দৃষ্টি দূরের আরেক সিঁড়ির দিকে। কি জানি, কণ্ঠে অনিশ্চয়তা। ভুলও হতে পারে আমার। তবে করাতে কাটা বলেই মনে হলো।
পরস্পরের দিকে তাকাল মুসা আর রবিন। সাধারণত কোন ব্যাপারে ভুল করে না কিশোর পাশা, ভুল যে করেনি জোরগলায় বলেও সেটা; সে জন্যেই এত সহজে ভুল স্বীকার করাটা বিস্মিত করেছে দু জনকে।
ঠোঁট কামড়াল কিশোর। যা হবার তো হয়েছে, চলো, যাই।
কোথায়? জানতে চাইল মুসা। ওই সিঁড়িটা দিয়ে উঠে চলে যাব? দূরের সিঁড়িটা দেখাল সে।
না। অঘটন যা ঘটার তো ঘটেই গেছে। এখন আর ফিরে যাব কেন? যে কাজে এসেছি, সে কাজ সারব। সৈকতে, গুহায় ড্রাগনটার চিহ্ন খুঁজব।
মনে মনে খুশি হলো কিশোর, তবে সেটা প্রকাশ করল না।
সাগরের দিকে হাঁটতে শুরু করল। বলল, পানির ধার থেকে শুরু করব। কারণ, সাগর থেকে উঠে ড্রাগনটাকে গুহায় ঢুকতে দেখা গেছে।
মাটিতে বসল একটা পাখি। সেটা দেখিয়ে মুসা বলল, চলো না, ওকে জিজ্ঞেস করি, ড্রাগন দেখেছে কিনা? অনেক কষ্ট বাঁচবে তাহলে আমাদের।
ভাল বলেছ, মুসার রসিকতায় হাসল রবিন। ও না বললে ওই টাগবোটের মাঝিদেরকে জিজ্ঞেস করব।
মাইলখানেক দূরে একটা বার্জকে টেনে নিয়ে চলেছে একটা টাগবোট, স্যালভিজ রিগ-জাহাজ কোন দুর্ঘটনায় পড়লে উদ্ধার করা ওগুলোর কাজ।
তাড়াহুড়ো আছে বলে তো মনে হচ্ছে না, মুসা বলল। দেখছ না কি রকম ধীরে ধীরে চলছে। ড্রাগন শিকারে বেরিয়েছে কিনা কে জানে। হাহ্ হাহ্।
টিটকারিতে কান দিল না কিশোর। গুহা আর পানির সঙ্গে একটা কল্পিত সরলরেখা বরাবর দৃষ্টি, একবার এপাশে তাকাচ্ছে, একবার ওপাশে। কি যেন বোঝার চেষ্টা করছে। অবশেষে বলল, এই এলাকায়ই কোথাও ড্রাগনের পায়ের ছাপ মিলবে। একসঙ্গে না থেকে ছড়িয়ে পড়ো।
আলাদা আলাদা হয়ে তিনদিকে ছড়িয়ে হাঁটতে লাগল ওরা। নিচে বালির দিকে চোখ। ড্রাগনের চিহ্ন খুঁজছে।
কি আর দেখব? একসময় বলল রবিন। খালি আগাছা।
আমিও তাই বলি, মুসা বলল। তবে কিছু শামুক আর ভেসে আসা কাঠ আছে। ড্রাগনের এ সব পছন্দ কিনা বুঝতে পারছি না।
খানিকক্ষণ পর পর মাথা নাড়ল রবিন। কিছু নেই। কিশোর, জোয়ারের পানিতে মুছে যায়নি তো?
নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটছে কিশোর। আনমনে বলল, হয়তো এখানে, পানির ধারে…না না, ওখানে…শুকনো বালি..গুহামুখ পর্যন্ত রয়েছে। থাকলে ওখানে থাকবে।
ধরো, মুসা বলল, ড্রাগনটা গুহায় বসে আছে। কি করব আমরা তাহলে? লড়াই করব ওর সঙ্গে? খালি হাতে? আদ্যিকালের রাজকুমারদের কাছে তো তবু জাদুর তলোয়ার থাকত…
কারও সঙ্গে লড়াই করতে আসিনি আমরা, মুসা, গম্ভীর হয়ে বলল কিশোর। সাবধানে গুহার মুখের কাছে এগিয়ে যাব। ভেতরে বিপদ নেই এটা বুঝলেই কেবল গুহায় ঢুকব।
কুটি করল মুসা। নিচু হয়ে একটা কাঠ তুলে নিয়ে বলল, যত যা-ই বলল, খালি হাতে ঢুকতে আমি রাজি না। মরি আর বাঁচি, একখান বাড়ি তো মারতে পারব।
হেসে ফেলল কিশোর।
রবিন আরেকটা কাঠ তুলে নিল। নৌকার একটা দাঁড়, আধখানা ভেঙে গেছে। ঠিকই বলেছে মুসা। সেইন্ট জর্জ অ্যাণ্ড দ্য ড্রাগন ছবিটা দেখেছি। তলোয়ার দিয়ে কিভাবে ড্রাগনকে খোঁচা মেরেছে মনে আছে। আমরা অবশ্য খোঁচা মারতে পারব না, তবে দু-জনে মিলে পেটালে ভড়কে গিয়ে পালিয়েও যেতে পারে। পুরানো আমলের জন্তু তো, নতুন আমলের মানুষকে ভয় না পেয়েই যায় না।
কিশোরের দিকে তাকাল সে। তুমি কিছু নিলে না? ভাঙা রেলিঙটা এনে দেব? বড় বড় পেরেক বসানো আছে মাথায়, দেখেছি, চোখা কাঁটা বেরিয়ে আছে। ড্রাগনকে আঁচড়ে দিতে পারবে।
হেসে বলল কিশোর, তা মন্দ বলোনি। হাতে করে একটা লাঠিটাটি নিয়েই নাহয় গেলাম। রেলিঙের দরকার নেই। লম্বা ভেজা একটা তক্তা তুলে নিয়ে কাঁধে ফেলল সে, যেন তলোয়ার নিয়ে চলেছে। গর্বিত রাজকুমার। তারপর হাঁটতে শুরু করল বন্ধুদের পাশে পাশে।
গুহামুখের দিকে এগিয়ে চলেছে তিন ড্রাগন-শিকারী। মুখে যতই বড় বড় কথা বলুক, গুহাটার কাছাকাছি এসে কিশোরের বুকের ধুকপুকানিও বাড়ল।
হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ল সে। শুকনো বালির দিকে আঙুল তুলে বলল, দেখো দেখো!
মুসা আর রবিনও দেখল। নরম বালি বসে গেছে এক জায়গায়, গভীর দাগ।
নতুন প্রজাতির ড্রাগন নাকিরে বাবা? নিচু কণ্ঠে বলল রবিন। পায়ের ছাপ তো নয়, যেন ঘোড়া গাড়ির চাকা।
মাথা ঝাঁকাল কিশোর। তারপর তাকাল পানির দিকে, দু-দিকের সৈকতও দেখল। কোন গাড়ি-টাড়ি তো দেখছি না। তবে চাকার দাগ যে, তাতে কোন সন্দেহ নেই। বীচ-বাগি হতে পারে, লাইফ-গার্ডদের। পেট্রলে এসেছিল এদিকে।
হয়তো, মেনে নিতে পারছে না রবিন। কিন্তু তাই যদি হবে, তাহলে তো চাকার দাগ পড়বে উত্তর-দক্ষিণে, সৈকতের একদিক থেকে আরেক দিকে। অথচ এটা গেছে গুহার দিকে।
কারেক্ট, আঙুলে চুটকি বাজাল কিলোর। বুদ্ধি খুলছে। হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল দাগ পরীক্ষা করার জন্যে।
পানির দিকে ফিরল রবিন। পানির কাছে গিয়ে দেখে এলে কেমন হয়?
ওখানে বোধহয় পাবে না, কিশোর বলল। ঢেউয়ের জোর বেশি, জোয়ারের পানিতে মুছে গিয়ে থাকতে পারে।
মুসা বলল, মিস্টার জোনসের বুড়ো চোখের ওপর ভরসা করা যাচ্ছে না আর। কি দেখতে কি দেখেছেন, কে জানে। জীপের সার্চলাইটকেই হয়তো ড্রাগনের চোখ ভেবেছেন, ইঞ্জিনের শব্দকে ড্রাগনের গর্জন।
তা-ও হতে পারে। তবে আগে থেকেই এত অনুমান করে লাভ নেই। গুহায় ঢুকে ভালমত দেখা দরকার।
গুহামুখের গজ দশেক দূরে হঠাৎ করে শেষ হয়ে গেল দাগ। সামান্যতম চিহ্নও নেই আর।
একে অন্যের দিকে তাকাল ছেলেরা।
আশ্চর্য! বিড়বিড় করল মুসা।
গুহামুখে পৌঁছে ভেতরে উঁকি দিল ওরা। শূন্য মনে হচ্ছে।
ড্রাগন তো ড্রাগন, আস্ত বাস ঢুকে যেতে পারবে এই মুখ দিয়ে, ওপর দিকে চেয়ে বলল রবিন। দেখি ভেতরে ঢুকে, কত বড় সুড়ঙ্গ?
যাও, কিশোর বলল। তবে কাছাকাছি থেকো, ডাকলে যাতে শুনতে পাও। আমি আর মুসা আশপাশটা ভালমত দেখে আসছি।
দাড়টা বল্লমের মত বাগিয়ে ধরে ভেতরে ঢুকে গেল রবিন।
হঠাৎ এত সাহসী হয়ে উঠল কিভাবে? মুসা বলল।
ওই যে, হেসে বলল কিশোর, মানুষের তৈরি চাকা দেখলাম। তাতেই অনেকখানি দূর হয়ে গেছে ড্রাগনের ভয়।
কান খাড়া করল সে। দেখি তো ডেকে, রবিনের সাড়া আসে কিনা। ওর কথার প্রতিধ্বনি শুনলেই আন্দাজ করতে পারব, গুহাটা কত বড়। চেঁচিয়ে ডাকল, রবিন? কি দেখছ?
মুসাও কান খাড়া করে ফেলেছে।
শব্দটা শুনতে পেল দু-জনেই। বিচিত্র একটা শব্দ, কিসের বোঝা গেল না।
পরক্ষণেই ভেসে এল রবিনের চিৎকার, তীক্ষ্ণ, আতঙ্কিত। তারপর একটি মাত্র শব্দ: বাঁচাও!
সাত
চোখ বড় বড় করে আবছা অন্ধকার গুহার ভেতরে তাকিয়ে রয়েছে কিশোর আর মুসা, কি করবে বুঝতে পারছে না। এই সময় আবার শোনা গেল রবিনের চিৎকার।
বাঁচাও! আমাকে বাঁচাও!
বিপদে পড়েছে! চেঁচিয়ে উঠল মুসা। এসো। ছুটে সুড়ঙ্গের ভেতরে ঢুকে গেল সে।
তাকে অনুসরণ করতে কষ্ট হচ্ছে কিশোরের। হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, আরেকটু আস্তে, মুসা। ও বেশি দূরে নয়, হুঁশিয়ার থাকা দরকার…
কথা শেষ করতে পারল না কিশোর, মুসার গায়ে এসে পড়ল। বাড়ি খেয়ে হুক করে সমস্ত বাতাস বেরিয়ে গেল তার ফুসফুস থেকে। পড়তে পড়তে কোনমতে সামলে নিল।
কানে এল মুসার গলা, সরো, কিশোর, সরে যাও! ও এখানেই!
কোথায়? কই, আমি তো কিছুই দেখছি না।
চোখ মিটমিট করল কিশোর। চোখে সয়ে এল আবছা আলো। তার সামনেই চার হাত-পায়ে ভর রেখে উপুড় হয়ে রয়েছে মুসা।
আরেকটু হলেই গেছিলাম গর্তে পড়ে, বলল সে। রবিন ওতেই পড়েছে।
কই? মুসার কাঁধের ওপর দিয়ে দেখার চেষ্টা করল কিশোর। রবিন, কোথায় তুমি?
এত কাছে থেকে শোনা গেল রবিনের কণ্ঠ, চমকে উঠল কিশোর। এই যে, এখানে! চটচটে কিছু! খালি নিচে টানছে!
ইয়াল্লা! চিৎকার করে বলল মুসা। চোরাকাদা!
অসম্ভব! এই জরুরী মুহূর্তেও যুক্তির বাইরে গেল না গোয়েন্দাপ্রধান। সাধারণত গ্রীষ্মমণ্ডলীয় অঞ্চল ছাড়া চোরাকাদা দেখা, যায় না। মুসার পাশ দিয়ে ঘুরে এসে কিনারে বসল, সাবধানে হাত নামিয়ে দিল নিচে। কই, দেখছি তো না। রবিন, আমাদের দেখছ?
হ্যাঁ! এই তো, তোমাদের নিচেই।
নিচু হয়ে হাত আরেকটু নামাল কিশোর। আমি দেখছি না। রবিন, ধরো, আমার হাতটা ধরো। আমি আর মুসা টেনে তুলব।
নিচে আঠাল তরলে নড়াচড়ার ফলে চপচপ শব্দ হলো। পারছি না।…নড়লেই ডুবে যাচ্ছি আরও। নাগাল পাচ্ছি না।
হাতের ডাণ্ডাটা আছে তোমার? মুসা জিজ্ঞেস করল। ওই দাঁড়ভাঙাটা। থাকলে…
নেই! প্রায় ককিয়ে উঠল রবিন। পড়ে গেছে!
নিজের হাতের কাঠটায় মুঠোর চাপ শক্ত হলো মুসার। আমারটাও এত শক্ত না। ভার সইবে না, ভেঙে যাবে। গোঙানির মত একটা শব্দ করল সে।
শুঁয়োপোকার মত কিলবিল করে গর্তের ধারে হামাগুড়ি দিতে শুরু করল কিশোর। রবিন, চুপ করে থাকো, নোড়ো না। গর্তটা কত বড়, বুঝে নিই।
জলদি করো। কেঁদেই ফেলবে যেন রবিন। তোলো আমাকে। গর্ত মাপার সময় নয় এটা।
খুব ধীরে ধীরে এগোচ্ছে কিশোর। মাপতেই হবে। এ ছাড়া তোমাকে তুলে আনার আর কোন উপায় দেখছি না।
অন্ধকারে খুব সাবধানে গর্তটার চারধারে ঘুরল কিশোর, হুশিয়ার থাকা সত্ত্বেও কিনারের মাটি ভেঙে ঝুরঝুর করে পড়ল ভেতরে। আরে, করছ কি! নিচ থেকে চেঁচিয়ে উঠল রবিন। ভূমিধস নামাবে নাকি?
সরি। কিনারে আলগা মাটি, হাত লাগলেই পড়ে যাচ্ছে।
মুসার গায়ে হাত পড়তেই বুঝল কিশোর, গর্ত ঘোরা শেষ হয়েছে। থামল। মুসা, মনে হয় পারব। রবিন, তোমার পা কি তলায় ঠেকেছে? বুঝতে পারছ কিছু?
আরেকবার চপচপ করে উঠল আঠাল তরল। না, তিক্ত শোনাল রবিনের কণ্ঠ। একটু নড়াচড়ায়ই আরও অনেকখানি তলিয়ে গেছি। দোহাই তোমাদের, কিছু একটা করো! তোলো আমাকে! তোমার হিসেবনিকেশটা পরে কোরো, কিশোর!
মুসা বলল, কিশোর, আমার পা শক্ত করে ধরতে পারবে? আমি গর্তের ভেতর পেট পর্যন্ত ঢোকাতে পারলেই ওকে তুলে আনতে পারব।
মাথা নাড়ল কিশোর, অন্ধকারে মুসা সেটা দেখতে পেল না।
আমার কাঠটা ব্যবহার করতে পারি, কিশোর বলল।
টেনে তোলা যাবে না। গর্তের কিনারে আলগা নরম বালি, ভার রাখতে পারবে না, চাপাচাপি করলে দেবে যাবে। তবে, কাঠটা আড়াআড়ি গর্তের ওপর রাখা যায়, দু-মাথা গর্তের কিনারে মোটামুটি ভালই আটকাবে।
তাতে লাভটা কি? রবিন তো নাগাল পাবে না।
মনে হয় পাবে, যদি কোনাকুনি ঢুকিয়ে দিই। কি করব, বুঝতে পারছ তো? একমাথা গর্তের ভেতরে কোনাকুনি ঢুকিয়ে ঠেসে ঢোকাব দেয়ালে। নরম মাটিতে ঢুকে যাবে সহজেই। আরেক মাথা থাকবে ওপরে, কিনারে শক্ত করে চেপে ধরব। সিঁড়ি তৈরি হয়ে যাবে…
ঠিক বলেছ! জলদি করো, জলদি…
বেশি আশা করতে পারল না কিশোর, পাতলা কাঠ। ভার সইতে পারলে হয়। তবু, দেখা যাক চেষ্টা করে।…রবিন, তোমার মাথার কাছে। দেয়ালে ঢোকানোর চেষ্টা করছি। খুব সাবধানে উঠবে। পিছলালে কিন্তু মরবে। কাঠটা ভেঙে গেলেও…খুব সাবধান।
জলদি করো! আরও ডুবেছি! গলা কাঁপছে রবিনের।
দ্রুত গর্তের অন্য ধারে চলে এল কিশোর, মুসা যেখানে রয়েছে তার উল্টো দিকে। লম্বা হয়ে শুয়ে কাঠটা ঠেলে দিল গর্তের ভেতরে। আস্তে আস্তে, এক ফুট এক ফুট করে।
হঠাৎ নিচ থেকে রবিনের চিৎকার শোনা গেল, আরেকটু, আরেকটু ঠেলে দাও, ধরতে পারছি না।
আরও কয়েক ইঞ্চি ঠেলে দিল কিশোর।
আরও একটু, নিচে থেকে বলল রবিন। এই আর কয়েক ইঞ্চি।
কাঠটা আরেকটু আসার অপেক্ষা করছে রবিন। এল না। তার বদলে শুনল ওপরে কিশোরের চাপা গলা, অস্ফুট একটা শব্দ। কি হলো, কিশোর?
কাঠের ভারে পিছলে যাচ্ছি, ব্যালান্স রাখতে পারছি না। কাঠ না ছাড়লে আমিও পড়ব গর্তে। সাংঘাতিক নরম বালি…
আর কিছু শোনার অপেক্ষা করল না মুসা। লাফিয়ে উঠে বিপজ্জনক কিনার ধরে প্রায় ছুটে চলে এল কিশোরের কাছে। ঝাঁপিয়ে পড়ল তার ওপর। উপুড় হয়ে শুয়ে কিশোরের পা ধরে টেনে সরিয়ে আনল খানিকটা। হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, এবার পারবে?
থ্যাংক ইউ, কিশোরের কণ্ঠও কাঁপছে। পা ছেড়ো না। কাঠটা আবার ঢোকাচ্ছি আমি। বড় বাঁচা বেঁচেছি। আরেকটু হলেই আমিও গিয়েছিলাম… কাঠটা আবার ঠেলে দিল সে। গর্তের দেয়ালে ঠেকতেই হ্যাঁচকা ঠেলা দিয়ে ঢুকিয়ে দিল কয়েক ইঞ্চি। জোরে জোরে শ্বাস নিল কয়েকবার।
মুসা জিজ্ঞেস করল, কি হলো, পারছ না?
হ্যাঁ, দেয়ালে ঠেকেছে।
আমি ধরে আছি, ছাড়ব না। তুমি ঠেলো।
জোরে জোরে কয়েকটা হ্যাঁচকা ঠেলা দিয়ে কাঠের মাথা অনেকখানি গর্তের দেয়ালে ঢুকিয়ে দিল কিশোর। ডেকে বলল, রবিন, দেখো এবার। ঝুলে ঝুলে আসবে, আস্তে আস্তে হাত সরাবে, একটুও তাড়াহুড়ো করবে না। কাঠ ভাঙলে সর্বনাশ!
কাঠের মৃদু কড়মড় প্রতিবাদ শুনেই বোঝা গেল উঠে আসছে রবিন। কতক্ষণ সইতে পারবে কে জানে।
আসছে, না? জানতে চাইল মুসা।
হ্যাঁ, বলল কিশোর। পা ছেড়ো না আমার। কখন কি হয় বোঝা যাচ্ছে না। গর্তের ভেতরে হাত আর মাথা ঢুকিয়ে দিল সে, বিপজ্জনক ভঙ্গিতে ঝুলে পড়ল, রবিন নাগালের মধ্যে এলেই যাতে টেনে তুলতে পারে।
গুঙিয়ে উঠল রবিন। কিশোর, আর পারছি না! ইস, এত পিছলা! খালি হাত পিছলে যায়!
আমার হাত দেখতে পাচ্ছ? জিজ্ঞেস করল কিশোর।
পাচ্ছি। আর তিন-চার ফুট উঠতে পারলেই ধরতে পারব। কিন্তু পারছি না তো।
চুপ! তাড়াহুড়ো কোরো না। জোরে জোরে হাঁপাচ্ছে কিশোর। আনমনে বলল, ইস, একটা দড়ি যদি পেতাম।
দড়ি পাবে কোথায়? পেছন থেকে বলল মুসা।
কিশোর, আর পারছি না! নিচে থেকে ককিয়ে উঠল রবিন। হাত ছিঁড়ে যাচ্ছে!
আরেকটু ধরে থাকো। মুসা, আরও শক্ত করে ধরো।
অনেক কায়দা কসরত করে কোমর থেকে বেল্টটা খুলে ফেলল কিশোর। বাকসের ভেতর চামড়ার ফালিটা ঢুকিয়ে ছোট একটা ফাঁস বানাল। তারপর মাথা ধরে ঝুলিয়ে দিল নিচে। রবিন, দেখতে পাচ্ছ?
হ্যাঁ হ্যাঁ, পাচ্ছি।
ফাঁসের মধ্যে হাত ঢোকাও।
আস্তে করে কাঠ থেকে একটা হাত সরিয়ে ফাঁসের মধ্যে ঢোকাল রবিন। আরেক হাতে অনেক কষ্টে ঝুলে রইল। পিছলে সরে যাচ্ছে। ধীরে ধীরে।
টান দিয়ে তার হাতে ফাঁসটা আটকে দিল কিশোর। মুসা, টানো। টেনে টেনে পেছনে সরাও আমাকে।
ব্যথা পাবে তো।
আরে, রাখো তোমার ব্যথা। টাননা।
টানতে শুরু করল মুসা। দু-হাতে বেল্টের একমাথা ধরে রেখেছে। কিশোর। ঘামে ভিজে পিছল হয়ে গেছে হাতের তালু, বেল্টটা না ছুটলেই হয় এখন।
অবশেষে গর্তের বাইরে বেরিয়ে এল রবিনের হাত। মাথা বেরোল। উঠে এল সে।
থামল না মুসা। টেনে আরও সরিয়ে আনল কিশোরকে, সেই সঙ্গে রবিনকে। যখন বুঝল আর ভয় নেই, কিশোরের পা ছেড়ে দিয়ে ধপ করে বসে পড়ল। আরিব্বাপরে, কি একখান টাগ অভ ওয়ার গেল!
হাঁপাচ্ছে কিশোর আর রবিন, ঘড়ঘড় শব্দ বেরোচ্ছে গলা থেকে।
রবিনের গায়ে হাত রাখল কিশোর, ইস, এত পিছলা। কাদায় গড়িয়ে ওঠা শুয়োরও তো এত পিচ্ছিল না।
তিনজনেই হাসল।
আট
বন্ধুদেরকে বার বার ধন্যবাদ জানাল রবিন। মুখের কাদা মুছে বলল, কিশোর, ঠিকই বলো তুমি, বিপদে মাথা গরম করতে নেই। তোমার ঠাণ্ডা মাথাই আজ আমার প্রাণ বাঁচিয়েছে।
সব ভাল যার শেষ ভাল, মুসা বলল। তো, এখন কি করব?
বাড়ি ফিরব, সঙ্গে সঙ্গে বলল কিশোর। গোসল করে কাপড় বদলানো দরকার, বিশেষ করে রবিনের। নিশ্চয় খুব অসুবিধে হচ্ছে ওর। সব দোষ আমার। টর্চ না নিয়ে অন্ধকারে গুহা দেখতে এসেছি, গর্দভের মত কাজ করেছি।
আমারই দোষ, রবিন বলল। তুমি তো হুঁশিয়ার থাকতে বলেইছিলে। আমি গাধার মত ছুটে গিয়ে পড়েছি গুহায়। এত তাড়াহুড়ো না করলেই তো পড়তাম না।
উঠে দাঁড়াল কিশোর। চিন্তিত কণ্ঠে বলল, গুহামুখের অত কাছে এমন একটা গর্ত, কৌতূহলী লোককে ঠেকানোর ভালই ব্যবস্থা! দূরে সরিয়ে রাখবে!
খাইছে! হঠাৎ কি মনে পড়ে যাওয়ায় বলে উঠল মুসা, হয়তো কুত্তাগুলো সব গিয়ে পড়েছে ওই গর্তে, চোরাকাদায় ডুবে মরেছে।
কিশোর বলল, হতে পারে। কিন্তু ঢোকার আগেই ভালমত দেখেছি আমি। কুকুরের পায়ের ছাপ তো চোখে পড়ল না।
হুঁ! যাকগে, ওসব পরে ভাবা যাবে। চলো, বেরোই। জায়গাটা মোটেও পছন্দ হচ্ছে না আমার। ভয় ভয় করছে।
তিনজনেই একমত হলো এ-ব্যাপারে।
গর্তের কাছ থেকে সরে এল ওরা।
তখন উত্তেজনা আর তাড়াহুড়োয় খেয়াল করেনি কিশোর, এখন দেখল, গুহামুখের উল্টো দিকে বড় বড় পাথরের চাই। আরেকটা সুড়ঙ্গমুখ দেখা যাচ্ছে। কদ্দূর গেছে কে জানে, আপনমনে বিড়বিড় করল সে। চোর-ডাকাত আর চোরাচালানীর আখড়া ছিল তো শুনলাম।
সে তো ছিলই, জোর দিয়ে বলল মুসা। কিন্তু তাতে কি?
দেখে কিন্তু সেরকম মনে হয় না। এতবেশি খোলামে, ঢোকা আর বেরোনো খুব সহজ, একটু সাবধানে চললেই বিপদ এড়ানো সম্ভব।
আরও সুড়ঙ্গ-টুড়ঙ্গ আছে হয়তো, রবিন বলল। নরম মাটিকে ক্ষয় করে ফেলে পানির স্রোত, ধুয়ে নিয়ে যায়, অনেক সুড়ঙ্গ তৈরি হয়। তবে তাতে সময় লাগে, অনেক ক্ষেত্রে লাখ লাখ বছর। মনে হচ্ছে, অনেক আগে এই জায়গাটাও পানির তলায় ছিল। যদি তাই হয়, আরও অনেক সুড়ঙ্গ আছে এখানে।
হয়তো, স্বীকার করল কিশোর। তবে সেগুলো খুঁজতে পারব না এখন। বাড়ি যাওয়া দরকার।
হ্যাঁ, সেই ভাল, মুসা বলল।
গুহামুখের কাছে চলে এসেছে, সাগরের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে গেল কিশোর। তার গায়ের ওপর এসে পড়ল অন্য দু-জন।
কি হলো? মুসার প্রশ্ন।
নীরবে হাত তুলে দেখাল কিশোর।
তার পাশে দাঁড়িয়ে অন্য দু-জনও তাকাল। চোখ মিটমিট করল।
হাত দিয়ে চোখ ডলে আবার তাকলি মুসা। বিশ্বাস করতে পারছে না।
ইয়াল্লা!বিড়বিড় করল সে।
কালো, চকচকে কিছু একটা মাথা তুলছে পানির ওপরে।
কি ওটা! ফিসফিস করল রবিন।
কম্পিত কণ্ঠে মুসা বলল, ড্রাগনের মাথার মতই তো লাগছে!
গড়িয়ে এল মস্ত এক ঢেউ, ঢেকে দিল কালো জিনিসটা।
চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে ছেলেরা। চোখ সরাচ্ছে না।
প্রচণ্ড শব্দে সৈকতে আছড়ে পড়ে ভাঙল বড় ঢেউটা। তার পেছনে এল আরেকটা ছোট ঢেউ, ওটাও ভাঙল, সাদা ফেনার নাচানাচি চলল কয়েক মুহূর্ত, তারপর সরতে শুরু করল পানি।
ঢেউ সরে যেতেই আবার দেখা গেল কালো জীবটা। নড়ছে। সাগর থেকে উঠে এল টলোমলো পায়ে।
স্কিন ডাইভার, স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল মুসা। ফেস মাস্ক…ফ্লিপার…অথচ কি ভয়ই না পেলাম। চলো, আমাদের পথে আমরা যাই।
ঘুরতে গিয়েও দাঁড়িয়ে গেল কিশোর। ফিসফিসিয়ে বলল, সাবধান! ওর হাতে স্পীয়ারগান!
হেসে উঠল সহকারী গোয়েন্দা। তাতে কি? মাছ মারতে নেমেছিল হয়তো সাগরে।
মাথা নাড়ল কিশোর। এদিকে আসছে দেখছ না?
হঠাৎ হাঁটু গেড়ে বসল ডুবুরি। স্পীয়ারগান তুলল।
আরে! চেঁচিয়ে উঠল রবিন। আমাদেরকেই তাক করছে!
অ্যাঁ! চমকে গেল মুসা। কেন… দ্রুত চোখ বোলাল আশপাশে।
কিশোর, রবিন ঠিকই বলেছে! আর কেউ নেই, আমাদেরকেই নিশানা করছে!
একশো গজ দূরে রয়েছে লোকটা।
দৌড় দাও! চেঁচিয়ে বলল কিশোর। একেকজন একেকদিকে।
কিন্তু দেখা গেল, একদিকেই দৌড় দিয়েছে তিনজন, ওপরে ওঠার কাঠের সিঁড়ির দিকে। কাছে যাওয়ার আগে মনেই পড়ল না, ওটা ভাঙা। ওরাই ভেঙেছে খানিক আগে। পেছনে পাহাড়ের খাড়া পাড়, বেয়ে ওঠা প্রায় অসম্ভব।
আরেকটা সিঁড়ি যেটা আছে, ওটার দিকে তাকাল কিশোর। অনেক দূরে। নরম বালির ওপর দিয়ে তাড়াতাড়ি দৌড়াতে পারবে না, সিঁড়ির কাছে যাওয়ার আগেই স্পীয়ারগান থেকে ছোঁড়া বর্শা বিধবে শরীরে। খোলা সৈকতে খুব সহজ টার্গেট হয়ে যাবে ওরা।
দ্রুত সিদ্ধান্ত নিল কিশোর। একটাই উপায় আছে। আবার গুহায় ঢুকতে হবে। কুইক!
ঘুরে আবার গুহামুখের দিকে দৌড় দিল ওরা। ফিরে তাকানোর সাহস নেই। ভাবছে, এই বুঝি এসে পিঠে বিধল চোখা ইস্পাত।
আলগা নরম বালি, জুতোর ঘায়ে ছিটকে যাচ্ছে।
ডাইভ দাও! হাঁপাতে হাঁপাতে বলল কিশোর।
গুহামুখের ভেতরে ঝাঁপ দিয়ে পড়ল তিনজনে। হামাগুড়ি দিয়ে সরে গেল একটা বড় পাথরের আড়ালে।
ওফ, মুখ দিয়ে বাতাস ছাড়ল মুসা। বাঁচলাম!…এবার?
লুকাতে হবে, জোরে জোরে নিঃশ্বাস ফেলছে কিশোর। বাঁচিনি
এখনও। খানিকটা সময় পেয়েছি মাত্র।
কোথায় লুকাব? রবিন বলল। ভেতরে আরও সুড়ঙ্গ নাকি আছে? চলো, খুঁজে বের করি। ওগুলোর কোনটাতেই ঢুকব।
মাথা ঝাঁকাল কিশোর। তাই বোধহয় করতে হবে। তবে এখুনি নড়ছি না। লোকটা আসুক আগে। তেমন বুঝলে পাহাড়ের একেবারে ভেতরে ঢুকে যাব।
কিশোরের কাঁধের ওপর দিয়ে তাকিয়ে রয়েছে মুসা। এখুনি সরতে হবে। আসছে।
যাব কোন দিক দিয়ে? রবিন বলল। আবার গিয়ে ওই গর্তে পড়তে চাই না, কাদার মধ্যে।
গুহার দেয়ালের কাছে পিছিয়ে গেল কিশোর। হঠাৎ ডাকল, এই, দেখে যাও।
মেঝে থেকে ছাতের কাছে খাড়া উঠে গেছে কয়েকটা তক্তা।
খাইছে, মুসা বলল। তখন দেখলাম না কেন?
ধুলোবালিতে কেমন ঢেকে আছে দেখছ না? সহজে চোখে পড়ে না। তক্তায় থাবা দিল কিশোর, ফাঁপা শব্দ হলো। গোপন পথ-টথ আছে। মনে হয় খোলা যাবে। মুসা, চট করে দেখে এসো তো ও আসছে কিনা?
গিয়েই সঙ্গে সঙ্গে ফিরে এল মুসা। উত্তেজিত কণ্ঠে বলল, ভাল বিপদে পড়েছি! একজন না, দু-জন আসছে!
দু-জন? জলদি এসো, হাত লাগাও।
তক্তার ফাঁকে আঙুল ঢুকিয়ে ধরে জোরে জোরে টানতে শুরু করল ওরা।
এভাবে হবে না, রবিন বলল। ওপরে-নিচে শক্ত করে গেঁথে দিয়েছে।
মাথা নাড়ল কিশোর। নিশ্চয় হবে। পায়ের কাছে মাটিতে জুতোর ডগা দিয়ে খোঁচা দিয়ে দেখল মাটি আলগা। বসে পড়ে দু-হাতে খুঁড়তে শুরু করল তক্তার গোড়ার কাছে।
অন্য দু-জনও হাত লাগাল।
কিছুটা খুঁড়ে টান দিতেই নড়ে উঠল তক্তা।
এই তো হয়েছে, বলল কিশোর। এটাই তো সবচেয়ে চওড়া, নাকি?…হ্যাঁ, সরালে ভেতরে ঢোকা যাবে… মাথা ঢুকিয়ে দিল সে, কিন্তু কাধ ঢোকাতে পারল না, চাড় দিয়েও কাজ হলো না।
আরও খানিকটা মাটি সরাল মুসা আর রবিন। টান দিয়ে আরও ফাঁক করল তক্তা, হ্যাঁ, এবার ঢোকা যায়।
ঢুকে গেল কিশোর। পেছনে দুই সহকারী। তারপর আবার টেনে আগের জায়গায় লাগিয়ে দিল তক্তা।
অন্ধকার গুহায় বসে কান পেতে রয়েছে ওরা।
ওপাশে কথা শোনা গেল। তক্তার ফাঁক দিয়ে টর্চের আলো দেখল।
নিক, বলল একজুন, ওরা এখানেই ঢুকেছে, আমি শিওর। তুমি পড়ে গেলে, আমিও চোখ সরালাম। নইলে ঠিকই দেখতে পেতাম। ঢুকেছে এখানেই। বাতাসে তো আর মিলিয়ে যেতে পারে না।
এখানে থাকলে যাবে কোথায়? বলল অন্যজন। বের করে ফেলব। আর না থাকলে তো নেই-ই। আমাদের কাজ শুরু করব।
নিঃশ্বাস বন্ধ করে রইল তিন গোয়েন্দা।
গুহার ভেতরে আলো ফেলে ফেলে দেখছে লোকটা।
তক্তার ফাঁকে চোখ রেখে দেখছে কিশোর। তার ওপর ঝুঁকে রয়েছে রবিন আর মুসা, ওরাও দেখছে।
দু-জনের পরনেই কালো ওয়েট স্যুট, পানির নিচ থেকে উঠে এসেছে। আলো ফেলে গুহার চারপাশটা একবার দেখে অন্য দিকে চলে গেল। ফ্লিপার পরা পায়ের শব্দ মিলিয়ে গেল, হারিয়ে গেল আলো।
দ্বিতীয় লোকটা, অর্থাৎ নিকের খসখসে গলা শোনা গেল গর্তটার ধার থেকে, যেটাতে পড়েছিল রবিন, কই, জো? কোথায় ওরা? ভুল করেছ তুমি। এখানে ঢোকেনি।
আরেকটা সিঁড়ি যে আছে ওদিকে, ওটা বেয়ে উঠে গেল না তো? অনিশ্চিত শোনাল জো-র কণ্ঠ।
তা-ই গেছে হয়তো।
টুলুপ টুলুপ করে মৃদু শব্দ হলো, তারপর নীরবতা। কিছুই আর কানে এল না কিশোরের, কিছু দেখছে না। ফাঁক থেকে চোখ সরিয়ে আনল সে। চোখের কোণে, নাকের ভেতরে কিচকিচ করছে বালি। সুড়সুড় করছে নাক। হাঁচি এলে এখন সর্বনাশ। তার সঙ্গীদেরও কি একই অবস্থা নাকি?
মুসাকে বিশ্বাস নেই। অসময়ে হাঁচি দেয়ার জুড়ি নেই তার। বিপদ, দেখলে কিংবা বেশি উত্তেজিত হলেই যেন সুড়সুড় করতে থাকে তার নাকটা। হুশিয়ার করল কিশোর, দেখো, হাঁচি দিও না। নাক ধরো।
শুধু মুসাই নয়, রবিনও নাক টিপে ধরল। চুপ করে বসে আছে। অন্ধকার গুহায়, অস্বস্তিতে ভুগছে।
কিছুক্ষণ পর উঠে দাঁড়াল কিশোর। নেই মনে হচ্ছে। চলো, সময় থাকতে কেটে পড়ি।
তক্তা সরিয়ে বেরোল ওরা। জায়গামত আবার তক্তাগুলো দাঁড় করিয়ে গোড়া বালি দিয়ে ঢেকে সমান করে দিল আগের মত।
কিশোর, তুমি আগে বেরোও, ফিসফিস করে বলল মুসা। আমি আর রবিন পেছনে নজর রাখছি।
নিঃশব্দে গুহামুখের কাছে চলে এল ওরা। খুব সাবধানে বাইরে। উঁকি দিল কিশোর। নির্জন সৈকত। কাউকে দেখা যাচ্ছে না। পিছিয়ে এসে বন্ধুদের বলল, কেউ নেই। এসো।
নয়
তারপর, কি বুঝলে? প্রশ্ন করল কিশোর।
হেডকোয়ার্টারে বসেছে সে আর মুসা। ঘণ্টাখানেক হলো ফিরে এসেছে রকি বীচে। রবিন বাড়ি গেছে। তার শরীর আর কাপড়চোপড়ের যা অবস্থা হয়েছে কাদায়, শুধু হাতমুখ ধুলে হবে না, গোসল দরকার।
ঠোঁট ওল্টাল মুসা। কিছুই বুঝতে পারছি না। ডুবুরীরা কারা, তা-ও জানি না; শুধু নাম জানি-নিক আর জো। স্পীয়ারগান তুলে আমাদের নিশানা করেছিল কেন, জানি না। জানি না কেন আমাদের পিছু নিয়ে এসে ঢুকেছিল গুহায়। তারপর কিভাবে কোথায় গায়েব হয়ে গেল, জানি না। এমনকি এ-ও জানি না, কি করে বেঁচে ফিরে এলাম আমরা।
নিচের ঠোঁটে চিমটি কেটে মাথা ঝাঁকাল কিশোর। হ্যাঁ, আরও অনেক কিছুই জানি না। সিঁড়ি কে কেটে রাখল? কুকুর কিভাবে গায়েব হলো? কেউ কি চুরি করল ওগুলোকে? তাহলে কেন করল? এই কেসের–কিনারা করতে হলে এ-ধরনের অনেক কেনর জবাব জানতে হবে আমাদের।
এক কাজ করলে আর দরকার হবে না, পরামর্শ দিল মুসা।
উ! রিভলভিং চেয়ার ঘুরিয়ে মুসার দিকে ফিরল কিশোর। চোখে জ্বলজ্বলে আগ্রহ। কি?
ফোনটা দেখাল মুসা। ওটা তুলে ফোন করো মিস্টার জোনসকে। বলো, হারানো কুত্তা নিয়ে আর মাথা ঘামাচ্ছি না আমরা। আরেকটু হলে আমরাই হারিয়ে যাচ্ছিলাম। বলে দাও, ড্রাগনের কথাও ভুলে যেতে রাজি আছি আমরা।
নিরাশ হলো কিশোর। দপ করে নিভে গেল চোখের আলো। দুঃখিত। তোমার পরামর্শ মানতে পারছি না। এখন আমাদের প্রথম সমস্যা, এক আঙুল তুলল সে, ডুবুরীরা কে, এবং গুহায় কি করছিল সেটা জানা?
ওদের নিয়ে এত মাথা ঘামানোর কি হলো? আমরাও তো গিয়েছিলাম গুহায়। কেন? সেটাই কি জানি?
মিস্টার জোনসের ড্রাগন দেখার সপক্ষে সূত্র খুঁজছিলাম, মাঝে মাঝে কঠিন শব্দ ব্যবহার, কিংবা লম্বা বাক্য, কিংবা দুর্বোধ্য করে কথা বলা কিশোরের স্বভাব। এবং তার আইরিশ সেটার কুকুর পাইরেটের সন্ধানে গিয়েছিলাম, রাতারাতি হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে যেটা।
এবং তাহাতে আমরা মোটেও কৃতকার্য হই নাই, কিশোরের সুরে সুর মেলাল মুসা। অবশ্য কুয়া আবিষ্কারের ব্যাপারটা বাদ দিতে রাজি আমি, যদি ওটা কোন সূত্র হয়। এবং সেজন্যে রবিনের কাছে মহাকৃতজ্ঞ আমরা, নাকি?
মুসার টিটকারি গায়েই মাখল না কিশোর। কিছু পাইনি, তাই বা বলি কিভাবে? তক্তার ওপাশে আরেকটা সুড়ঙ্গ পেয়েছি, হয়তো কোন গোপন গুহায় যাওয়ার পথ ওটা। হয়তো পুরানো আমলে দস্যু-তস্কররা হেডকোয়ার্টার হিসেবে ব্যবহার করত ওটাকে।
তাতে আমাদের কি? কুত্তা লুকিয়ে রাখার জায়গা নিশ্চয় নয় ওটা?
ভ্রূকুটি করল কিশোর। একটা কথা ভুলে যাচ্ছ, মুসা আমান, আমরা গোয়েন্দা। সামান্যতম সূত্রকেও অবহেলা করলে চলবে না আমাদের। ওই গুহা আর সুড়ঙ্গগুলো আরও ভালমত দেখা দরকার, কি বলো?
তা তো নিশ্চয়, ভোতা গলায় বলল মুসা। তবে খামোখা যাবে। ওখানে কুত্তা পাওয়ার আশা নেই। লুকিয়ে রাখা হয়নি। আবোল তাবোল ভাবনা হচ্ছে, অথচ অবাক হওয়ার মত যেটা ব্যাপার, সেটা নিয়েই ভাবছি না?
কী? আবার আগ্রহে সামনে ঝুঁকল কিশোর।
রবিন যে কুয়াটায় পড়েছিল, দুই ডুবুরী ওটাতে পড়ল না কেন? তারমানে এই নয় কি, ওরা গুহার ভেতরে কোথায় কি আছে জানে?
দ্বিতীয়বার নিরাশ হতে হলো কিশোরকে। ভাবার কি দরকার? ওদের হাতে টর্চ ছিল, রবিনের কাছে ছিল না। আর ওরা কোথায় কিভাবে গায়েব হলো, টর্চ নিয়ে আমরা যখন যাব…
ফোন বেজে উঠল।
যন্ত্রটার দিকে তাকিয়ে রইল দু-জনে।
আবার রিঙ হলো।
মুসা জিজ্ঞেস করল, তুলব?
আমি তুলছি, রিসিভার তুলল কিশোর। স্পীকারের সঙ্গে যোগাযোগের সুইচ অন করে দিয়ে বলল, হ্যালো।
জবাব নেই।
আবার বলল, হ্যালো?
জবাব নেই।
রঙ নাম্বার-টাম্বার হবে, মন্তব্য করল মুসা।
আমার মনে হয় না। জবাব তো দেবে-..
অদ্ভুত একটা শব্দ শোনা গেল স্পীকারে, ঘড়ঘড়ে, গলা টিপে ধরে ঠিকমত শ্বাস নিতে দেয়া হচ্ছে না যেন, অনেক কষ্টে দম টানছে
বেচারা। তা ধীরে ধীরে বদলে গেল ঘড়ঘড়ানি, কথা ফুটল। কোনমতে উচ্চারণ করল একটা মাত্র শব্দ, দূরে…!
তারপর আবার শুরু হলো ঘড়ঘড়ানি। অনেক কষ্টে যেন গলা থেকে আঙুলের চাপ সামান্য শিথিল করে আবার বলল, দূরে দূরে থাকবে…! জোরে জোরে শ্বাস টানল।
কি করে থাকব? গলা চড়িয়ে জিজ্ঞেস করল কিশোর।
আমার…গুহা…! আবার ঘড়ঘড়ানি, আগের চেয়ে বেড়েছে। শ্বাসকষ্ট, মৃত্যুযন্ত্রণা শুরু হয়েছে বুঝি।
কে বলছেন? উত্তেজনায় রিসিভার-ধরা হাত কাঁপছে কিশোরের।
স্পীকারে ভেসে এল কাঁপা কাঁপা কণ্ঠস্বর, যেন বহু দূর থেকে, মরা…মানুষ…! অনেক দিন আগে মরে যাওয়া একজন…গুহায় আটকে রেখে খুন করা হয়েছিল আমাকে…?
কাঁপা দীর্ঘ ঘড়ঘড়ানি, ফিসফাস হলো কিছুক্ষণ, তারপর নীরব হয়ে গেল।
আস্তে করে রিসিভার নামিয়ে রাখল কিশোর। দু-জনেই চেয়ে রইল যন্ত্রটার দিকে।
হঠাৎ উঠে দাঁড়াল মুসা। আমি যাই। মা বলে দিয়েছে সকাল সকাল বাড়ি ফিরতে, জরুরী কাজ আছে। ভুলেই গেছিলাম।
যাবে? নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটছে কিশোর।
হ্যাঁ, যাই, দুই সুড়ঙ্গের ঢাকনার দিকে এগোল মুসা। কিশোরকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে নেমে পড়ল সুড়ঙ্গে।
ভূতের ভয়ে পালাচ্ছে মুসা, বুঝল কিশোর। সে ভয় পায়নি, কিন্তু অবাক হয়েছে খুব। বিড়বিড় করল, দূরে থাকবে…আমার গুহা…
মিস্টার জোনস বলেছিলেন, ড্রাগন দেখেছেন। সাগর থেকে উঠে দানবটাকে গুহায় ঢুকতে দেখেছেন। কিন্তু কই, কোন ভূতের কথা তো বলেননি?
একা একা বসে থাকতে ভাল লাগল না তার। ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে উঠে দাঁড়াল সে-ও।
দশ
গোসল সেরে, কাপড় বদলে, হালকা খাবার খেয়ে অনেকটা ভাল বোধ। হলো রবিনের। রকি বীচ পাবলিক লাইব্রেরিতে চলল, পার্ট টাইম চাকরিতে।
রবিনকে ঢুকতে দেখে মুখ তুলে তাকালেন লাইব্রেরিয়ান, হাসলেন। এই যে, রবিন, এসেছ। খুব ভাল হয়েছে। সাংঘাতিক ভিড় আজ, কুলিয়ে উঠতে পারছি না। অনেক বই ফেরত এসেছে, রীডারও বেশি। ওই দেখো, কত বই নিচে জমে আছে। তাকে তুলে দেবে, প্লীজ?
এখুনি দিচ্ছি, বলে বইয়ের স্তূপের দিকে এগোল রবিন।
ফেরত আসা বইগুলো এক এক করে তাকে সাজিয়ে রাখতে লাগল সে। সেগুলো ভোলা শেষ করে চোখ ফেরাল রীডিং রুমের দিকে। টেবিলে অনেক বই জমে আছে। তুলতে শুরু করল। হঠাৎ একটা বইয়ের মলাটে দৃষ্টি আটকে গেল তার। নামটা নজর কেড়েছে:
লিজেন্ডস অভ ক্যালিফোর্নিয়া আনমনে বইটা হাতে নিয়ে পাতা ওল্টাতে লাগল। দৃষ্টি আটকে গেল আবার বইয়ের একটা অধ্যায়ে:
সী-সাইড: ড্রীম অভ আ সিটি দ্যাট ডাইড
হুমম, আপন মনে মাথা দোলাল রবিন, ইনটারেসটিং!
বইটা একপাশে সরিয়ে রাখল সে। বেশ ভাল একটা লেখা পেয়ে গেছে। পড়ার জন্যে আকুল হয়ে উঠল মন, কিন্তু আগে কাজ শেষ করতে হবে। তাড়াহুড়ো করে বই তুলতে লাগল।
বই তোলা শেষ হলে তাকে ডাকলেন লাইব্রেরিয়ান। কয়েকটা বইয়ের মলাট, পাতা ছিঁড়ে গেছে, আঠা দিয়ে ওগুলো জোড়া দিতে বললেন।
পেছনের একটা ঘরে সমস্ত সরঞ্জাম রয়েছে। বইগুলো তুলে নিয়ে সেখানে চলে এল রবিন। খুব দ্রুত হাত চালাল। কিন্তু কাজটা সহজ নয়, সময় লাগলই।
মেরামত সেরে সেগুলো নিয়ে আবার লাইব্রেরিয়ানের কাছে ফিরে এল সে। হয়ে গেছে। আর কিছু?
হাসলেন লাইব্রেরিয়ান। খুব তাড়া আছে মনে হচ্ছে?
হ্যাঁ, একটা বই পেয়েছি, হেসে বলল রবিন।
আর থাকতে পারছ না, না? হাসলেন লাইব্রেরিয়ান। নাহ, আপাতত আর কিছু নেই। যাও, পড়োগে। দরকার হলে ডাকব।
তাঁকে ধন্যবাদ জানিয়ে পড়ার টেবিলে চলে এল রবিন।
অধ্যায়টা চিহ্ন দিয়েই রেখেছিল। খুলে পড়তে শুরু করল:
দুর্ভাগ্যের শিকারে পরিণত হয়, এমন অনেক শহর আছে। শহরের সঙ্গে সঙ্গে সেগুলোর বাসিন্দাদের ভাগ্যেও নেমে আসে অমঙ্গল। সী সাইডের অবস্থাও হয়েছে তাই। কী রিসোর্ট কমিউনিটি হওয়ার কথা ছিল ওটার, কিন্তু সে-স্বপ্ন নস্যাৎ হয়ে গেছে পঞ্চাশ বছর আগে।
ঝলমলে যে কর্মব্যস্ত শহরের কল্পনা করেছিল এর পরিকল্পনাকারীরা, তাদের সর্বস্ব বাজি ধরেছিল এর পেছনে, কার্যকর হয়নি। তারা কল্পনা করেছিল, ভেনিস নগরীর মত এটাতেও জালের মত বিছিয়ে থাকবে খাল আর প্রণালী। কিন্তু তাদের আশাকে দুমড়ে-মুচড়ে দিয়ে গড়ে উঠল অসংখ্য কারখানা। একদা রমরমা হোটেলগুলোর কিছু পরিবর্তিত হয়ে গেল বোর্ডিং হাউসে, বাকিগুলো সব প্রাণ দিল বুলডোজারের কঠিন চোয়ালে-উত্তর-দক্ষিণে চলে যাওয়া সুবিশাল মহাসড়ককে জায়গা ছেড়ে দেয়ার জন্যে।
সী-সাইডের সবচেয়ে তিক্ত ঘটনা সম্ভবত এর ভূগর্ভ রেলওয়ে তৈরির ব্যর্থতা। পশ্চিম উপকূলে পাতালরেল ওটাই প্রথম তৈরি হওয়ার কথা ছিল। ব্যর্থতার একটা মূল কারণ, সাধারণ মানুষের কাছ থেকে বিশেষ সাড়া মেলেনি। ফলে শুরুতেই থেমে গেল কর্মব্যস্ততা, কয়েক মাইল সুড়ঙ্গ তৈরি হলো বটে, কিন্তু ওই পর্যন্তই। পরিত্যক্ত হতে সময় লাগল না। ভূতুড়ে সুড়ঙ্গ এখন ওটা।
এই অবস্থা! অবাক হলো রবিন। বইটা লেখা হয়েছে অনেক আগে, প্রায় পঞ্চাশ বছর। তারমানে সী-সাইড মারা গেছে তারও আগে, অর্থাৎ পঞ্চাশ বছরের বেশি। ভাগ্যিস পেয়ে গিয়েছিল টেবিলের ওপর, নইলে শহরটার এই করুণ ইতিহাস হয়তো জানা হতো না কোন দিনই।
কিছু কিছু পয়েন্ট নোটবুকে টুকে নিয়ে বইটা তাকে তুলে রাখল সে। তারপর বসে বসে ভাবতে লাগল। কিশোরকে বলার মত অনেক কিছু জেনেছে, কিন্তু সেগুলো উগরানোর জন্যে অপেক্ষা করতে হবে। ছুটি হতে দেরি আছে।
সময় হলো। লাইব্রেরিয়ানকে গুডবাই জানিয়ে বেরিয়ে এল রবিন। সাইকেল চালিয়ে বাড়ি ফিরল। মা রাতের খাবার সাজাচ্ছেন। বাবা খবরের কাগজ পড়ছেন, মুখে পাইপ। রবিনের সাড়া পেয়ে মুখ তুলে হাসলেন। এই যে, রবিন, কি হয়েছিল তোমার? এত কাদা লাগল কোত্থেকে? ওয়াশিং মেশিনটা তো বাপ বাপ ডাক ছাড়ল ধুতে গিয়ে।
গর্তে পড়েছিলাম, বাবা। প্রথমে ভেবেছিলাম চোরাকাদা। পরে বুঝলাম, সাধারণ কাদা। তবে সাংঘাতিক আঠা।
কোথায় সেটা?
সী-সাইডে গিয়েছিলাম কেসের তদন্ত করতে। একটা গুহায় ঢুকলাম। অন্ধকারে কিছু দেখা যায় না। ঢুকেই পড়লাম গর্তের মধ্যে। চোরাকাদা ভেবে তো জানই উড়ে গিয়েছিল।
মাথা ঝাঁকিয়ে কাগজটা নামিয়ে রাখলেন মিস্টার মিলফোর্ড। হু, জায়গাটা খারাপই। সব ছিল চোর-ডাকাতের আড্ডা। লোকে তো ঢোকারই সাহস পেত না। শুনেছি অনেকেই নাকি ঢুকে আর বেরোতে পারেনি।
আমিও শুনেছি। লাইব্রেরিতে একটা বই পেয়ে গেলাম আজ হঠাৎ করে। জন্মেই নাকি মারা গেছে সী-সাইড, বেড়ে ওঠার আর সুযোগ পায়নি। তুমি কিছু জানো?
খবরের কাগজের লোক মিস্টার মিলফোর্ড, প্রচুর পড়াশোনা। রবিনের তো ধারণা, তার বাবা চলমান জ্ঞানকোষ।
আবার মাথা ঝাঁকালেন তিনি। হ্যাঁ। কত লোকের সর্বনাশ যে করেছে শহরটা। ওটার পেছনে টাকা খরচ করে ফকির হয়ে গিয়েছিল কত কোটিপতি, শেষে রুটি কেনার পয়সা পর্যন্ত জোটেনি। কপালই খারাপ ওদের, নইলে অ্যামিউজমেন্ট পার্কে আগুন লাগবে কেন? ওই হলো ধ্বংসের সূত্রপাত।
আমার কাছে কিন্তু এত খারাপ লাগল না শহরটা। বেশ বড়, প্রায় রকি বীচের সমান।
হাসলেন মিস্টার মিলফোর্ড। পঞ্চাশ-ষাট বছর আগে হলে এ কথা বলতে পারতে না। শহর ধ্বংস হয়ে যাওয়ার পর যারা তখনও টিকে রইল, তারা আবার ওটাকে গড়তে শুরু করল তিল তিল করে। অনেক পরিশ্রম আর আত্মত্যাগের পর আজ ওই অবস্থায় এসেছে। এখন আর পোড়া শহর বলে না কেউ, তবে স্বপ্ননগরীও আর হবে না কোনদিন। এখন ওটা কারখানা-শহর, টাকা কামানোর জায়গা।
যা দেখলাম-টেখলাম, কামানো বোধহয় খুব কঠিন। আচ্ছা, একটা আণ্ডারগ্রাউণ্ড রেলওয়ে তৈরি হওয়ার কথা নাকি ছিল ওখানে?
ছিল। সামনে ঝুঁকলেন মিস্টার মিলফোর্ড, স্বপ্ননগরী তৈরির সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন একজন কোটিপতি। আর এই ভুলের জন্যে, শেষমেশ প্রাণ দিতে হয়েছিল তাকে। কাজটা শুরু করেই বোকা বনে গিয়েছিলেন ভদ্রলোক। বিশাল পরিকল্পনা। একচুমুকে যেন কোটি কোটি টাকা গিলে শেষ করে ফেলল পরিকল্পনার বিশাল দৈত্যটা। চোখের পলকে ফুরিয়ে গেল সব টাকা। এমনটা যে ঘটবে কল্পনাই করতে পারেননি তিনি। আশা করেছিলেন, শুরু করলে অনেকেই এগিয়ে আসবে সাহায্য করতে, কিন্তু এল না। পথের ফকির হয়ে শেষে আত্মহত্যা করতে হলো তাকে।
ঘনঘন বারকয়েক পাইপে টান দিয়ে ধোয়া ছাড়লেন তিনি। নামটা এখন মনে করতে পারছি না। শেষ মুহূর্তে যদি কিছু লোক বিশ্বাসঘাতকতা না করত, সী-সাইড সত্যি একটা দেখার মত শহর হত এখন…
বেরসিকের মত বাধা দিলেন মিসেস মিলফোর্ড, খাবার তৈরি।
আরও অনেক কিছু জানার ইচ্ছে ছিল রবিনের, কিন্তু হলো না। দেরি করলে মা রেগে যাবেন। উঠে বাবার পিছু পিছু খাবার টেবিলের দিকে এগোতে হলো তাকে।
এগারো
ডিনারের পর আবার হেডকোয়ার্টারে এসে ঢুকল তিন গোয়েন্দা।
আমি বলছিলাম কি, দৃঢ়কণ্ঠে বলল মুসা, মিস্টার জোনসের কুত্তা খোঁজার কাজটা আমাদের বাদ দেয়া উচিত। কি কাণ্ড! ভয়াবহ এক মানুষখেকো ড্রাগন, দু-জন শয়তান ডুবুরী-সঙ্গে আবার স্পীয়ারগান থাকে, লোকের গায়ে বর্শা গাঁথার জন্যে হাত নিশপিশ করে ওদের। মানুষ পেলেই গিলতে চায় যে কাদা-ভরা গর্তটা, ওটার কথা নাহয় বাদই দিলাম। আর পুরানো কাঠের সিঁড়ি, যেটা থেকে পড়ে কোমর ভাঙার জোগাড় হয়, ওটাও নাহয় ধরলাম না। বাড়িতে ফিরেও যন্ত্রণার কমতি নেই। ভূতুড়ে টেলিফোন আসে, গুহার কাছ থেকে দূরে থাকতে বলে। উপদেশটা খুব পছন্দ হয়েছে আমার।
ভূতুড়ে টেলিফোন? চোখ বড় বড় হয়ে গেল রবিনের।
তুমি যাওয়ার পর, কিশোর বলল, একটা ফোন এসেছিল। কি কি বলেছে, জানাল রবিনকে।
আমার কাছে ভোগলামী মনে হচ্ছে, শুকনো গলায় বলল রবিন।
কারও শয়তানী। সে চায় না, আমার গুহাটার কাছে যাই। না যাওয়াই বোধহয় ভাল।
যাব না মানে? গম্ভীর হয়ে গেল কিশোর, এখনও ড্রাগনটাকেই দেখিনি। ভাবছি, আজ রাতেই দেখতে যাব।
ভোটাভুটি হয়ে যাক তাহলে, প্রস্তাব দিল মুসা। আমি, না। কারও হ্যাঁ বলার থাকলে বলতে পারো।
হা! হা! হা! মাথার ওপরে ঝোলানো খাঁচা থেকে তীক্ষ্ণ কণ্ঠে চেঁচিয়ে উঠল ব্ল্যাকবিয়ার্ড, লঙ জন সিলভারের সেই ময়নাটা, রেখে দিয়েছে তিন গোয়েন্দা।
চুপ, ব্যাটা! কড়া ধমক লাগাল মুসা। তোকে কথা বলতে কে বলেছে? তুই কি তিন গোয়েন্দার কেউ? হারামীপনার আর জায়গা পাওনি, ব্যাটা। ভোট নিয়ে মস্করা করতে এসেছ। বেশি জ্বালাতন করলে খাঁচাসুদ্ধ নিয়ে গিয়ে ফেলে দিয়ে আসব গুহায়।
গ্রাহ্যই করল না ব্ল্যাকবিয়ার্ড। টেনে টেনে বলল, মরা মানুষ…মরা মানুষ। অ্যায়াম ব্ল্যাকবিয়ার্ড দ্য পাইরেট। হেহ হেহ হেহ্! তারপর মুখ খারাপ করে গাল দিল কয়েকটা, কান গরম করে দিল মুসার।
যা শোনে তাই মনে রাখে ব্যাটা, বলল রবিন। ওই যে শুনেছে, মরা মানুষ, ব্যস, আর ভুলবে না। চান্স পেলেই বলবে।
একদিন ওটার ঘাড় না মটকে দিয়েছি তো আমার নাম মুসা আমান নয়, ফোঁস ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলল মুসা। কিন্তু রবিন আর কিশোর জানে, তা সে কোনদিনই করবে না। তার অনুরোধেই পাখিটা রেখে দিয়েছে কিশোর, নইলে অন্যগুলোর সঙ্গে ওটাকেও দিয়ে আসত মিস কারমাইকেলের পাখির আশ্রমে। তবে বেশি জ্বালাতন করলে কিশোরের কথাও আর শুনবে না, ঠিকই চালান করে দিয়ে আসবে।
যাকগে। তো, এখন কি ঠিক হলো? আগের কথার খেই ধরল। কিশোর।
আমি যাচ্ছি না, মুসার সাফ জবাব।
কেন?
ভয় পাচ্ছি।
ভণিতা করছ তুমি, মুসা, হাসল কিলোর। এই সামান্য ব্যাপারে ভয় পাওয়ার ছেলে তুমি নও। মাঝে মাঝে তোমার সাহস দেখে আমারই তাক লেগে যায়। সেই আমাজনের জঙ্গলে…
ব্যস ব্যস, হয়েছে, আর ফোলাতে হবে না, হাত তুলল মুসা, যাব, যাও। মরলে তারপর দেখাব মজা…
মরলে তো মরেই গেলে, কিশোরের হাসি রবিনের মাঝেও সংক্রমিত হয়েছে। আর দেখাবে কি করে?
মরে গেলাম মানে? তোমরা মরবে না, যখনই মরো? আমি নরকে গেলে তোমরাও ওখানে যাবে। আগে মরলে বরং কিছু সুবিধে, শয়তানের সঙ্গে ভাব হয়ে যাবে আমার। তোমরা যখন যাবে তখন আমি অনেক পুরানো দোজখী, চোটপাট অনেক বেশি…
হয়েছে, হয়েছে, বাধা দিল কিশোর। তোমার চোটপাট বেশি হলেই আমাদের সুবিধে। নরকে সুযোগ-সুবিধা বেশি পাব। রিসিভারের দিকে হাত বাড়াল সে।
কাকে করবে? জিজ্ঞেস করল মুসা।
হ্যানসনকে। গাড়িটা দরকার। তোমার সম্মানার্থে আজ রোলস রয়েসে করেই যাব।
.
ঘণ্টাখানেক পর, গাড়ির জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে রয়েছে মুসা।
রাজকীয় রোলস রয়েস। চকচকে কালো শরীরের ওপর সোনালী অলঙ্করণ, শত গুণ বাড়িয়ে দিয়েছে গাড়িটার রূপ। শক্তিশালী বিশাল ইঞ্জিনের শব্দ প্রায় নেই বললেই চলে। উড়ে চলেছে যেন উপকূলের মহাসড়ক ধরে। দক্ষ, ভদ্র, খাঁটি ইংরেজ শোফারের হাতে পড়ে জীবন্ত হয়ে উঠেছে গাড়ি, তার প্রতিটি নির্দেশের সাড়া দিচ্ছে চোখের পলকে, বিন্দুমাত্র প্রতিবাদ না করে।
বাজিটা সেদিন তুমি না জিততে পারলেই বোধহয় ভাল হত, কিশোর, মুসা বলল। এই গাড়িটাই যত নষ্টের মূল। তিন গোয়েন্দা সৃষ্টিতে ওর মস্তবড় অবদান রয়েছে, অবশ্যই খারাপ অর্থে। কত বিপদে যে পড়লাম।
দোষটা কিশোরের চেয়ে অগাস্টের বেশি, মুসা, হেসে মনে করিয়ে দিল রবিন। বাজি জিতে তো মাত্র তিরিশ দিনের জন্যে পাওয়া গিয়েছিল গাড়িটা। কিন্তু অগাস্টই তো চিরকালের জন্যে বহাল করে দিল।
এবং সর্বনাশ করল আমাদের, ঘোঁৎ-ঘোৎ করল মুসা। নরম গদিতে আরাম করে হেলান দিয়ে হাসল। তবে এরকম গাড়িতে চড়ার আলাদা আনন্দ। আরামের কথা বাদই দিলাম, নিজেকে খুব হোমরা চোমরা মনে হয়। আহ, কোটিপতি ব্যাটারা কি মজায় না আছে।
সী-সাইডে পৌঁছল রোলস রয়েস। হ্যাঁনসনকে পথ বাতলে দিল কিশোর।
সাগরপাড়ে পৌঁছল গাড়ি।
আপনি এখানেই থাকুন, হ্যাঁ, শোফারকে বলল কিশোর। আমরা আসছি।
ভেরি গুড, মাস্টার পাশা, বিনয়ের চূড়ান্ত করে ছাড়ে হ্যাঁনসন, এত বেশি, একেক সময় কিশোরের লজ্জাই লাগে।
বড় বড় হেডলাইট দুটো জ্বেলে রেখেছে হ্যাঁনসন, তিন গোয়েন্দার হাঁটার সুবিধের জন্যে। হেডলাইট তো নয়, যেন সার্চলাইট, পথের ওপর ছড়িয়ে দিয়েছে তীব্র আলো।
নামল ছেলেরা। গাড়ির পেছনে গিয়ে বুট খুলল কিশোর।
টর্চ.ক্যামেরা:-টেপরেকর্ডার, নিতে নিতে বিড়বিড় করছে সে, নিজেকে বোঝাচ্ছে, জরুরী অবস্থার জন্যে তৈরি এখন আমরা। ডকুমেন্ট রাখতে পারব।
রেকর্ডারটা রবিনের হাতে দিল। ড্রাগন, কিংবা ভূতের যে শব্দই শোনো, রেকর্ড করবে। কিছুই বাদ দেবে না।
মুসার হাতে খুব শক্তিশালী একটা টর্চ দিল সে। আরেকটা দিল রবিনকে। নিজে রাখল একটা। এক বাণ্ডিল দড়ির ভেতরে হাত ঢুকিয়ে। দিয়ে কাঁধে ঝুলিয়ে নিল সেটা।
দড়ি কেন? জিজ্ঞেস করল মুসা।
কোটা যে কখন কাজে লাগবে কে জানে। তৈরি থাকা ভাল। একশো ফুট নাইলনের দড়ি আছে এখানে, হালকা, কিন্তু খুব শক্ত। একটা সিঁড়ি তো ভেঙেছে, আরেকটার কি অবস্থা কি জানি। যদি ওটাকেও ভেঙে পড়ার অবস্থা করে রাখে? দড়ি লাগবে না তখন? উঠে আসব কি বেয়ে?
আর কিছু বলল না মুসা।
গাড়ির আলোর সীমানা শেষ হলো। তারপর অন্ধকার পথটুকু চুপচাপ হাঁটল তিন গোয়েন্দা। দ্বিতীয় সিঁড়িটার কাছে এসে দাঁড়াল। প্রথমটা, ওই যেটা সকালে ভেঙে ছিল, সেটার কাছ থেকে কয়েকশো গজ দূরে দ্বিতীয়টা।
সবাই ঝুঁকে তাকাল নিচে। নির্জন সৈকত। হালকা মেঘের ফাঁকে লুকোচুরি খেলছে উঠতি চাঁদ। ঘোলাটে আলো ছড়িয়ে পড়েছে। বেলাভূমিতে। বালিয়াড়িকে একনাগাড়ে চুমু খাচ্ছে ছোট ছোট ঢেউ, তার মোলায়েম মৃদু হিসহিস শব্দ কানে আসছে। নিয়মিত সময় পর পর ছোট ঢেউয়ের মাথায় ভর করে যেন ছুটে আসছে পাহাড়-প্রমাণ বিশাল ঢেউ, আছড়ে পড়ে ভাঙছে তীরে, বিকট শব্দে ঢাকা পড়ে যাচ্ছে হিসহিসানি, সামান্য বিরতি দিয়ে আবার শুরু হচ্ছে।
অস্বস্তি বোধ করছে মুসা। শুকনো ঠোঁটে জিভ বোলাল। পুরানো কাঠের সিঁড়ির রেলিঙ আঁকড়ে ধরে রেখেছে, ধীরে ধীরে বাড়ছে আঙুলের চাপ। কান খাড়া করে শুনছে।
রবিন আর কিশোরও কান খাড়া রেখেছে।
বড় ঢেউয়ের ভোঁতা গর্জন, আর ছোট ঢেউয়ের মোলায়েম হাসি ছাড়া আর কিছুই কানে আসছে না। না না, আসছে, যার যার বুকের ঢিপঢিপানি।
চলো, নামি, অবশেষে বলল মুসা। আল্লাহগো, তুমিই জানো।
কয়েক ধাপ নেমেই থেমে গেল কিশোর। পেছনে অন্য দু-জন।
কি হলো? ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করল মুসা।
সাগরের গর্জন একটু বেড়েছে না? বলল কিশোর।
কান পেতে ভালমত শুনল মুসা।
তার শ্রবণশক্তি অন্য দু-জনের চেয়ে জোরাল। কি জানি। সেরকমই তো লাগছে। হয়তো আমাদেরকে হুশিয়ার করছে ঢেউ।
সিঁড়ির ধাপগুলো অস্পষ্ট। মুখে কামড় মারছে যেন রাতের নোনা হাওয়া। ঠেলে বেরিয়ে রয়েছে পাহাড়ের চূড়া, চাঁদের আলোয় বিষণ্ণ ছায়া ফেলেছে বালিতে।
ওদের ভারে ভেঙে পড়ল না সিঁড়ির তক্তা। ভয় কাটল, পরের কয়েকটা ধাপ পেরোল দ্রুত। লাফিয়ে বালিতে নেমে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল।
ওপরে তাকাল কিশোর। পাড়ের দু-একটা বাড়িতে এক-আধটা আলো জ্বলছে।
গুহামুখের কাছে এসে দাঁড়াল ওরা। কান পাতল শোনার জন্যে, ভালমত দেখল আশপাশটা। শব্দও নেই, কিছু চোখেও পড়ল না। গুহার ভেতরে নড়ছে না কিছু।
আবার ওপরে তাকাল কিশোর। ঠেলে বেরোনো চূড়ার জন্যে। পাড়ের ওপরের বাড়িঘর কিছু চোখে পড়ছে না। ভ্রুকুটি করল সে। এই যে না দেখা যাওয়ার ব্যাপারটা, এটাকে একটা পয়েন্ট বলে মনে হলো তার, কিন্তু কেন সেটা বুঝতে পারল না।
অবশেষে মাথা ঝাঁকাল সে, অল ক্লিয়ার।
নিঃশব্দে ভেতরে ঢুকে পড়ল ওরা। কান পাতল আবার কিশোর।
মুসার অবাক লাগছে। গেরিলা যোদ্ধার মত আচরণ করছে। গোয়েন্দাপ্রধান, যেন যে-কোন মুহূর্তে আক্রমণের ভয় করছে।
ব্যাপার কি? ফিসফিস করল মুসা। বিপদ আশা করছ?
সাবধানের মার নেই, ঘুরিয়ে জবাব দিল কিশোর। টর্চ জ্বালল মুসা। ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে আলো ফেলে গুহাটা দেখতে শুরু করল। মাটিতে চোখ পড়তেই অস্ফুট শব্দ করে উঠল। বলল, আরি! ওখানেই শেষ হয়ে গেল গুহাটা, ওই যে, ওই গর্তের ওপারে। ডাইভার দু-জন তাহলে গেল কই?
আলো জ্বেলে কিশোরও দেখছে। গুহাটা এত ছোট হবে ভাবিনি। মুসা, ঠিকই বলেছ, ওরা গেল কই? কোন পথে?
গুহার দেয়াল পরীক্ষা করতে লাগল তিনজনে।
নিরেট, মাথা নাড়ল মুসা। নাহ্, মাথামুণ্ড কিছুই বোঝা যাচ্ছে না।
কি বোঝা যাচ্ছে না? জিজ্ঞেস করল রবিন।
দেখছ না, কি ছোট গুহা? গর্তটাও ছোট। ড্রাগনের জায়গা হবে না।
বিস্ময় ফুটল কিশোরের চোখে। অথচ মিস্টার জোনস বললেন, চূড়ার নিচে এদিকেই কোথাও ড্রাগন ঢুকতে দেখেছেন। গর্তের পাড়ে দাঁড়িয়ে নিচে তাকাল সে। আর, ডাইভার দু-জনও বাতাসে মিলিয়ে যেতে পারে না। হয় ধারেকাছেই আরও গুহা আছে, কিংবা এই গুহারই আরও মুখ আছে। সুড়ঙ্গ আছে।
কিশোর! বলে উঠল রবিন। একটা কথা মনে পড়েছে।
দ্রুত জানাল সে, বইয়ে কি পড়েছে, আর বাবার মুখে কি কি শুনেছে।
চিন্তিত দেখাল কিশোরকে। সুড়ঙ্গ?
উত্তেজিত ভঙ্গিতে মাথা ঝাঁকাল রবিন। পাতাল রেলের জন্যে খোঁড়া হয়েছিল। কাজ শেষ হয়নি। এখনও আছে, ভূতুড়ে রেলপথ বলা যায়।
হুঁ! মাথা দোলাল কিশোর। কিন্তু কোথায় সেটা কে জানে। কয়েক মাইল দূরেও হতে পারে। এমনও হতে পারে, এখানেই এসে শেষ হয়েছে সুড়ঙ্গের মাথা, কিংবা এখান থেকেই শুরু হয়েছে।
কিশোর পাশাকে চমকে দেবে ভেবেছিল, কিন্তু হতাশ হতে হলো রবিনকে। হতে পারে।
খুঁজে বের করব রেলপথটা, কিশোর বলল। ম্যাপ পেলে ভাল হত। সী-সাইড সিটি প্ল্যানিং বোর্ড অফিসে গেলে হয়তো পাওয়া যাবে।
পঞ্চাশ-ষাট বছর পর? হেসে উঠল মুসা। যে এঁকেছিল, এতদিনে নিশ্চয় মরে ভূত হয়ে গেছে। আর ম্যাপটা থাকলেও চাপা পড়েছে পুরানো কাগজ আর বালির তলায়। খুঁজে পাওয়া যাবে না।
মাথা ঝাঁকাল কিশোর। হয়তো। এসো, এখন ম্যাপ ছাড়াই খুঁজে দেখি পাওয়া যায় কিনা।
এক কাজ করলে কেমন হয়? আজ সকালে তক্তার আড়ালে যে গুহাটা দেখেছি, ওটা থেকে শুরু করলে?
মন্দ বলনি, কিশোর বলল।
রবিনও একমত হলো।
গুহাটার কাছে চলে এল তিন গোয়েন্দা।
বালি সরাতেই বেরিয়ে পড়ল একটা বড় তক্তা। উত্তেজনায় জ্বলে, উঠল কিশোরের চোখ।
লক্ষ করল রবিন। গলা বাড়িয়ে দিল, কী?
ভুরু কুঁচকে গেছে কিশোরের। বুঝতে পারছি না এখনও। মনে হচ্ছে এটা প্লাইউড।
প্লাইউড? হলেই বা কি বুঝতে পারছে না রবিন।
আমার তাই বিশ্বাস। তক্তায় হাত বুলাচ্ছে কিশোর। এই রহস্যের সঙ্গে এর কি সম্পর্ক?…থাক, পরে ভাবব। আপাতত বালি সরাই, তক্তাগুলো যাতে সরানো যায়।
বালি সরিয়ে তক্তার গোড়া আলগা করে ফেলল ওরা। তক্তা সরিয়ে পথ করে সাবধানে ঢুকল সরু জায়গাটায়। আবার আগের জায়গায় লাগিয়ে রাখল তক্তা। টর্চ জ্বালল।
ছোট্ট একটা গুহা। নিচু ছাত। আর সামান্য নিচু হলেই সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারত না মুসা, মাথায় লাগত। ভেজা ভেজা। খানিক দূর এগিয়ে হঠাৎ ঢালু হয়ে মিশেছে উল্টোদিকের একটা পাথুরে তাকের সঙ্গে।
পথ নেই, বিড়বিড় করল মুসা।
চোর-ডাকাতের জন্যে চমৎকার লুকানোর জায়গা, বলল কিশোর। অতীতে নিশ্চয় খুব ব্যবহার হত। তক্তা যেভাবে লাগিয়েছে, বোঝাই যায়, গোপন কুঠুরী বানিয়েছিল এটাকে।
মেঝেতে আলো ফেলল রবিন। ডাকাত হলে কিছু মোহর কি আর ফেলে যায়নি?
মোহরের কথায় রবিনের সঙ্গে মুসাও খুঁজতে লেগে গেল। বসে পড়ে বালির স্তর সরিয়ে দেখতে লাগল কোথায় লুকিয়ে আছে গুপ্তধন।
আগে হাল ছাড়ল মুসা। দূর, কিছু নেই।
রবিন খুঁজতে খুঁজতে চলে গেল শেষ মাথার কাছে। কোণের দিকেই মোহর স্তূপ করে রাখে ডাকাতরা। আঁউ!
তক্তাগুলোর ওপর আলো ফেলে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে কি দেখছিল কিশোর, ঝট করে ঘুরল। কি হলো, রবিন?
ঘড়ঘড় একটা শব্দ। রবিন গায়েব।
রবিন! চেঁচিয়ে উঠে দৌড় দিল কিশোর। দাঁড়িয়ে গেল যেন। হোঁচট খেয়ে, হাঁ হয়ে গেছে।
কি হয়েছে? উঠে দাঁড়িয়েছে মুসা।
হাত তুলে দেখাল কিশোর। মুহূর্ত আগেও ওখানে ছিল। দেখনি? তারপর দেয়ালটা যেন গিলে ফেলেছে ওকে!
কী? কিশোরের পাশ দিয়ে দেয়ালের দিকে ছুটল মুসা। কাছে গিয়ে আলো ফেলে ভালমত দেখল। কই, কিছু তো নেই। গর্ত-টর্তও নেই।
খানিক আগে রবিন মোহর খুঁজছিল যে জায়গাটায় সেখানে মাটিতে বসে হাত বুলিয়ে দেখল মুসা। আবার হলো ঘড়ঘড় শব্দ। চমকে সরে এল সে। চোখ বন্ধ করে ফেলল ভয়ে।
ও-কে, হাসিহাসি কণ্ঠ কিশোরের, আবার উদয় হচ্ছে রবিন।
চোখ মেলল মুসা। ছোট্ট একটা অংশ সরে গেছে, দেয়ালের ওখানে কালো ফোকর যেন মুখব্যাদান করল। হামাগুড়ি দিয়ে ওপথে বেরিয়ে এল রবিন। আবার বন্ধ হয়ে গেল ফোকর।
কি বুঝলে? মিটিমিটি হাসছে রবিন। পাথরের গোপন দরজা। ঠেস দিয়ে বসেছিলাম ওটায়। ব্যস, গেল সরে।
ওপাশে কি আছে? জিজ্ঞেস করল কিশোর।
ঝুলে পড়ল রবিনের চোয়াল। দেখারই সময় পাইনি। এত তাড়াতাড়ি ঘটে গেল সব কিছু…দেখি তো আবার খোলা যায় কিনা।
দেয়ালে আবার হেলান দিয়ে বসল সে। চাপ দিল। কিছুই ঘটল। না। সামান্য সরে কাঁধ দিয়ে আবার ঠেলা দিল। ক্লিক করে মৃদু একটা শব্দ হলো, তারপরই শুরু হলো ঘড়ঘড়। পাথর সরে যেতেই পেছনে হেলে পড়ল তার শরীর। আবার ঢুকছি! জলদি এসো, বন্ধ হয়ে যাবে।
লাফ দিয়ে এগিয়ে এল কিশোর আর মুসা। ঢুকে গেল রবিনের পিছু পিছু।
বাব্বারেহ্! গাল ফুলিয়ে ফুস করে মুখ দিয়ে বাতাস ছাড়ল মুসা। আরব্য রজনীর জিন নাকি? চিচিং ফাঁব বলতেই, দুই হাত দুই দিকে ছড়াল সে, হাঁ!
এটা অনেক বড় গুহা, ছড়ানো। ছাতও অনেক উঁচু।
ফোকরের কাছ থেকে সরে এল ওরা, গুহাটা ঘুরেফিরে দেখার জন্যে।
ক্লিক করে শব্দ, পরক্ষণেই ঘড়ঘড়। ঘুরল ওরা, কিন্তু দেরি হয়ে গেছে। বন্ধ হয়ে গেছে ফোকর।
খাইছে! আঁতকে উঠল মুসা। বেরোব কি করে?
রবিন যেভাবে বেরিয়েছে, শান্তকণ্ঠে বলল কিশোর।
ও কিছু না। সহজ কোন লিভারেজ সিসটেম। চলো আগে গুহাটা দেখি, পরে এসে লিভার খুঁজে বের করব। ভয় পেয়ো না, খোলা যাবে ঠিকই।
ছাতের দিকে তাকাল রবিন। কিশোর, আমার মনে হয় এটাই। এটার কথাই পড়েছি রেফারেন্স বইয়ে। সাইজ দেখেছ?
হতে পারে, কিশোর বলল। কিন্তু, রবিন, লক্ষ করেছ আর সব প্রাকৃতিক গুহার মত এটার দেয়ালও রুক্ষ, খসখসে। ছাতে খোঁচা খোঁচা পাথর বেরিয়ে আছে। মানুষের তৈরি হলে সমান হত, মসৃণ। পাতাল রেলের সুড়ঙ্গ সিমেন্ট দিয়ে তৈরি হয়, সমান হতেই হবে।
আলো ফেলে ফেলে দেয়াল, ছাত আবার দেখল সে, মাথা নাড়ল। নাহ, প্রাকৃতিক গুহাই মনে হচ্ছে। সাগরের দিক থেকে ঢোকার সরাসরি কোন পথ দেখছি না। নিরেট পাথরের দেয়াল। চলো, এগিয়ে। দেখি। যে সুড়ঙ্গটা খুঁজছি, হয়তো সামনেই আছে সেটা।
যাক, বাঁচা গেল। হাত নাড়ল মুসা। সাগরের দিকে পথ নেই। তারমানে ড্রাগন ঢুকতে পারবে না এখানে।
তা তো হলো, হেসে বলল কিশোর। কিন্তু ভুলে যাচ্ছ, গুহাটা বিরাট। জায়গা হয়ে যাবে, চমৎকার বাসা হবে ড্রাগনের।
মনে করিয়ে দেয়ার জন্যে ধন্যবাদ, অস্বস্তি ফিরে এল আবার মুসার কণ্ঠে। একটা সেকেণ্ডের জন্যে নিশ্চিত হওয়ার জো নেই, এমনই কাণ্ড!
মেঝে বেশ সমান, মসৃণ বলা না গেলেও আর সব গুহার মত খসখসে নয়।
শেষ মাথায় এসে থমকে দাঁড়াল ওরা। ছাত থেকে খাড়া নেমেছে। পাথরের দেয়াল.। পথ নেই।
নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটছে কিশোর।
কি ভাবছ? জিজ্ঞেস করল রবিন।
ওই দেয়ালটা, সামনে হাত তুলে দেখাল কিশোর, ঠিক দেয়ালের মত লাগছে না।
আমার কাছে তো দেয়ালই লাগছে।…ভেবেছিলাম পথটথ পাব, সুড়ঙ্গে… থেমে গেল সে। কিশোরের মনোযোগ তার দিকে নেই।
চোখ আধবোজা হয়ে গেছে গোয়েন্দাপ্রধানের, এগিয়ে গিয়ে দাঁড়াল দেয়ালের কাছে। থাবা দিল, কিল মারল, টোকা দিল। কান খাড়া করে আওয়াজ শুনছে। আরেকটা জায়গায় আঘাত করে শুনল, হাত রেখে অনুভব করল কি, যেন।
তফাৎ আছে, অবশেষে বলল সে। বোঝাতে পারব না কেমন, তবে…
তাতে কি এমন মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে গেল? অধৈর্য হয়ে পড়েছে। মুসা। চলো। শীত করছে আমার।
উজ্জ্বল হলো কিশোরের মুখ। পেয়েছি! চুটকি বাজাল দুই আঙুলে। ঠাণ্ডা…
সে কথাই তো বলছি…
আমি শীতের কথা বলছি না। বলছি, দেয়ালটা ঠাণ্ডা নয়। কিন্তু এই গুহারই অন্য সব দেয়াল ঠাণ্ডা। বিশ্বাস নাহলে গিয়ে হাত রেখে দেখতে পারো।
দেখল দুই গোয়েন্দা।
ঠিকই তো, মাথা দোলাল মুসা। তত ঠাণ্ডা নয়। কিন্তু তাতে কি? ছাতের ওপর বাড়িঘর আছে, ওগুলো থেকেই কোনভাবে নেমে এসেছে। উত্তাপ। দেয়াল গরম করেছে।
তাপ ওপর দিকে ওঠে, নিচে নামে না।
ওপাশে আরও গুহাটুহা আছে হয়তো, অনুমান করল রবিন। হয়তো ওই পাশটা গরম।
মাথা নাড়ল কিশোর। যুক্তিটা মানতে পারছে না। পকেট থেকে ছুরি বের করল।
হেসে উঠল মুসা। পাগল! ছুরি দিয়ে পাথর কাটবে? ফলা ভাঙবে খামাকা। ডিনামাইট দরকার।
মুসার কথায় কান না দিয়ে আঁচড় কাটল কিশোর। ছুরির আগা দিয়ে খোঁচা দিল। ধূসর আঠা আঠা পদার্থ লেগে গেল ছুরির ফলায়।
সঙ্গীদের দিকে ফিরল গোয়েন্দাপ্রধান। মুখে জয়ের হাসি, যেন সাংঘাতিক কিছু আবিষ্কার করে ফেলেছে। দুই গোয়েন্দার কাঁধের ওপর দিয়ে চোখ পড়তেই হাসি মুছে গেল মুখ থেকে। আ-আরে খুলে যাচ্ছে …
চরকির মত পাক খেয়ে ঘুরল দুই সহকারী গোয়েন্দা। বিশ্বাস করতে পারছে না। এ-কি কাণ্ড? সরে যাচ্ছে দেয়াল।
খুলছে খুলছে-ফিকে হচ্ছে অন্ধকার। বাতাস এসে লাগল ওদের মুখে।
স্থির দৃষ্টিতে চেয়ে আছে ওরা। দুরুদুরু করছে বুক। দেয়ালের খোলা জায়গা দিয়ে আবছামত চোখে পড়ল সৈকতের বালি, তার পেছনে সাগরের সীমারেখা।
আগে সামলে নিল কিশোর। জলদি! ছোট গুহাটায় ঢোকো…
ছুটে এসে প্রায় দেয়ালে ঝাঁপ দিয়ে পড়ল তিন গোয়েন্দা, এখান দিয়েই বেরিয়েছিল।
পাগলের মত লিভার খুঁজতে শুরু করল রবিন। পেল না। কাঁধ দিয়ে জোরে ধাক্কা দিল দেয়ালে। খুলল না। সঙ্গীদের দিকে ফিরে বলল, খুঁজে পাচ্ছি না..! গলা কাঁপছে।
পেতেই হবে, জোর দিয়ে বলল কিশোর।
তিনজনে তিন জায়গায় খুঁজতে লাগল। কোন ধরনের হাতল বা এমন কিছু রয়েছে, যাতে চাপ লাগলে খুলে যায় দরজা।
হঠাৎ আলোর বন্যায় ভেসে গেল গুহার ভেতর। জমে গেল যেন তিন কিশোর। দেয়াল আরও ফাঁক হয়েছে। কি যেন আসছে, এদিকেই। বিশাল একটা ছায়ামত, সাগর থেকে উঠেছে।
কিশোরের কাঁধ খামচে ধরল মুসা। সত্যিই দেখছি তো. কথা আটকে গেল।
কিশোরও স্তম্ভিত। মাথা নেড়ে সায় দিল। গলা শুকিয়ে কাঠ, চোখের পাতা ফেলছে ঘনঘন। ড্রাগন!
এগিয়ে আসছে দানবীয় সরীসৃপ। ভেজা চকচকে চামড়া, পানির কণা লেগে আছে। শরীরের তুলনায় ছোট মাথা, ত্রিকোণ। এদিক ওদিক দুলছে লম্বা সাপের মত গলা। হলুদ দুই চোখ থেকে আলো আসছে গুহার ভেতরে, যেন দুটো বিশাল, হেডলাইট। একটানা শব্দ করছে, অদ্ভুত একধরনের গুঞ্জন।
দেয়ালের খোলা অংশ জুড়ে দাঁড়াল ওটা। প্রাগৈতিহাসিক ডাইনোসর যেন মাথা নোয়াল। হাঁয়ের ফাঁকে লকলকে জিভটা ঢুকছে বেরোচ্ছে। ভোস ভেঁাস করে শ্বাস ফেলছে, যেন দীর্ঘশ্বাস।
হাতল খোঁজায় বিরতি দিল না ওরা। বার বার দেয়ালে ধাক্কা দিয়ে দেখছে, খোলে কিনা।
গুহায় ঢুকছে ড্রাগন। শ্বাস টানছে জোরে জোরে, হাঁপানী রোগীর মত।
দেয়ালের গা ঘেঁষে দাঁড়াল ওরা, কুঁকড়ে বাঁকা করে রেখেছে। শরীর। আত্মরক্ষার ভঙ্গিতে হাত উঠে গেছে মাথার ওপর।
লম্বা গলাটা বাড়িয়ে দিল ড্রাগন।
ভেজা চোয়াল ঝুলে পড়ল নিচে, বেরোল একসারি ঝকঝকে সাদা ধারাল দাঁত। আবার জোরে জোরে শ্বাস টানল কয়েকবার, ছোট্ট একটা কাশি দিয়ে থেমে দাঁড়াল।
আমাজনের জঙ্গলের জাগুয়ারের কথা মনে পড়ল কিশোরের। শিকার ধরার আগে এরকম করেই কাশে ওই ভয়ানক বাঘ। তারমানে ড্রাগনও এখন শিকার ধরবে।
কালচে মাথাটার দিকে স্থির হয়ে আছে কিশোরের চোখ, নড়াতে পারছে না, যেন সম্মোহিত করে ফেলেছে তাকে দানটা। ঝটকা দিয়ে মাথা সামনে বাড়াল, কিশোরকে ধরার জন্যেই বোধহয়।
পিছু হটার জায়গা নেই, বন্ধুদের কাছে সরে এল কিশোর। আঙুলগুলো মরিয়া হয়ে খুঁজল পেছনের দেয়াল। ইস্, কোথায় হাতলটা?
এগিয়ে আসছে ড্রাগনের হাঁ করা চোয়াল। গায়ে এসে লাগছে বাষ্পের মত ভেজা উত্তপ্ত নিঃশ্বাস।
বারো
পেছনের দেয়ালে কিট করে একটা শব্দ হলো। ঘড়ঘড় করে সরে গেল পাথর। ফোকর দিয়ে ভেতরে উল্টে পড়ল রবিন। তাকে ঠেলে সরিয়ে হামাগুড়ি দিয়ে ঢুকল মুসা। তার পর-পরই ঝাঁপ দিয়ে পড়ল কিশোর।
বন্ধ হয়ে গেল আবার পাথরের দরজা।
হাঁপ ছাড়ল ছেলেরা। কিন্তু সেটা ক্ষণিকের জন্যে।
ড্রাগনের চাপা, গর্জন শোনা যাচ্ছে ওপাশ থেকে। কেঁপে উঠল দেয়াল। থাবা মারছে যেন দানবটা, ধাক্কা দিচ্ছে।
ভাঙতে চাইছে। চেঁচিয়ে উঠল মুসা।
গর্জন বাড়ছে ওপাশে। ধাক্কায় থরথর করে কাঁপছে গুহার দেয়াল। ছাত থেকে ঝরতে শুরু করল বালি আর ছোট ছোট পাথর।
বাতাসে বালি উড়ছে, নাক দিয়ে ঢুকছে বালির কণা। দাঁতে কিচকিচ করছে বালি। কেশে উঠল মুসা, থুথু করে থুতু ফেলল।
ভূমিধস!
পড়েছি ফাঁদে আটকা! রবিনও কাশতে শুরু করল। দম বন্ধ হয়ে মরব এবার!
মনে পড়ল কিশোরের, বলা হয়েছে এখানে যখন তখন ভূমিধস নামে, জ্যান্ত কবর হয়ে যায় লোকের। কত লোক যে মরেছে এভাবে তার হিসেব নেই। বোঝা যাচ্ছে বানিয়ে বলেননি মিস্টার জোনস।
আরও পাথর পড়ল। ওপাশে যেন পাগল হয়ে গেছে ড্রাগনটা। গর্জনে কান ঝালাপালা।
ধীরে ধীরে মাথা নাড়ল কিশোর, আতঙ্কে বুদ্ধি ঘোলা হয়ে গেছে। নইলে এই গুহা থেকেও যে বেরিয়ে যাওয়া উচিত সে কথা মনে পড়ত। তক্তার ওপর চোখ পড়তেই চেঁচিয়ে উঠল, তক্তা! বেরিয়ে যেতে হবে!
লাফ দিয়ে এগিয়ে গেল তিনজনে। পাগলের মত মাটি সরাতে লাগল দুই হাতে। যখন মনে হলো, আর কোনদিনই সরাতে পারবে না, ঠিক এই সময় নড়ে উঠল তক্তাটা।
ছোট ফাঁক দিয়ে হুড়োহুড়ি করে বেরিয়ে এল ওরা। তক্তাটা আবার জায়গামত বসিয়ে লাথি দিয়ে দিয়ে বালি ঠাসতে লাগল ওটার গোড়ায়। হাঁপাচ্ছে জোরে জোরে।
ভাগো, বলেই দৌড় দিল কিশোর।
এক ছুটে গুহা থেকে বেরিয়ে দৌড়ে চলল সৈন্ত ধরে। পাশে ছুটছে মুসা। রবিন পেছনে।
ওদের হাতের টর্চ নাচছে ছোটার তালে তালে, আলোর বিচিত্র রেখা তৈরি করছে বালিতে বার বার। ভাঙা সিঁড়িটা পেরিয়ে এল। এসে পৌঁছল ভাল সিঁড়িটার গোড়ায়। থামল না। পুরানো কাঠ ভেঙে পড়ার পরোয়া করল না, উঠে চলল একজনের পেছনে একজন। পাড়ের ওপরে নিরাপদ জায়গায় উঠে যেতে চায় যত তাড়াতাড়ি সম্ভব। ওখানে রয়েছে হ্যাঁনসন আর রাজকীয় রোলস রয়েস, একবার পৌঁছতে পারলে ছুটিয়ে নিয়ে যাবে ড্রাগনের কাছ থেকে দূরে। কিন্তু পারবে তো? পেছনে শোনা যাচ্ছে দানবের ভয়াবহ গর্জন।
অর্ধেক সিঁড়ি উঠে যাওয়ার পরেও ড্রাগনটাকে দেখা গেল না, তাদেরকে কামড়াতে এল না ভয়াবহ চোয়াল। শুধু শব্দ শোনা যাচ্ছে।
ওপরে উঠে এল ওরা। হাপরের মত ওঠানামা করছে বুক।
সামনে, দূরে লস অ্যাঞ্জেলেস শহরের আলো মিটমিট করছে। পথের মোড়ে দাঁড়িয়ে আছে রোলস রয়েস।
গাড়ির কাছে এসে হাঁপাতে হাঁপাতে বলল কিশোর, হ্যানসন, বাড়ি চলুন!
নিশ্চয়। উঠুন।
প্রাণ পেল বিশাল ইঞ্জিন। শাঁ করে মোড় নিয়ে প্যাসিফিক কোস্ট হাইওয়ে ধরে তীব্র গতিতে ছুটে চলল গাড়ি।
একটু সুস্থির হয়ে নিয়ে মুসা বলল, এত জোরে দৌড়তে পারো তুমি, কিশোর, জানতাম না।
আমিও না, গাল ফুলিয়ে মুখ দিয়ে বাতাস বের করে দিল কিশোর। দৌড়েছি কি আর সাধে?…জীবনে আর কখনও ড্রাগনের সামনে পড়েছি, বলো?
চামড়ামোড়া নরম গদিতে হেলান দিল রবিন। উফ্, বড় বাঁচা বেঁচেছি আজ। আরেকটু হলেই…
…গেছিলাম, কথাটা শেষ করে দিল মুসা। কিশোর, ড্রাগনের সামনে যে পড়ব কি করে জানলে তুমি? শুরু থেকেই হুঁশিয়ার ছিলে দেখেছি।
এমনি, না জেনেই হুঁশিয়ার। ড্রাগন দেখা গেছে শুনেছি তো।
আরিব্বাপরে, কি চেহারা ওটার। জীবনে ভুলব না।
আমি এখনও বিশ্বাস করতে পারছি না, রবিন মাথা নাড়ল। যত বই পড়েছি, কোনটাতেই লেখা নেই যে ড্রাগন, আজও বেঁচে আছে। কোনদিন ছিল, সে কথাও বিশ্বাস করেন না বিজ্ঞানীরা। ছিল শুধু রূপকথাতেই।
মাথা দোলাল কিশোর। চিমটি কাটতে শুরু করল নিচের ঠোঁটে। কোনদিন ছিল কিনা জানি না, কিন্তু এখন নেই। আর বাস্তবে যদি না-ই থাকে, তাহলে ড্রাগন দেখিনি।
কি বলছ? মুসা বলল। তিনজোড়া চোখ ভুল দেখতে পারে না। গুহায় ওটা কি দেখলাম? গরম নিঃশ্বাস এখনও গায়ে লাগছে মনে হচ্ছে।
আমারও লাগছে, রবিন বলল।
এক্সকিউজ মী, জেন্টলমেন, আর চুপ থাকতে পারল না হ্যাঁনসন। ড্রাগন দেখেছেন? জ্যান্ত?
হ্যাঁ, মুসা জবাব দিল। সাগর থেকে উঠে সোজা এসে ঢুকল গুহায়, আমরা যেটাতে ছিলাম সেটাতেই। আচ্ছা, হ্যাঁনসন, আপনার কি মনে হয়, ড্রাগন আছে?
মাথা নাড়ল শোফার। আমার মনে হয় না। তবে, স্কটল্যাণ্ডে শুনেছি ড্রাগনের মত একটা জীব আছে, অনেকে নাকি দেখেছে। বিশাল এক লেকে থাকে দানবটা।
লক নেস মনস্টারের কথা বলছেন? আগ্রহ দেখাল কিশোর।
হ্যাঁ। লোকে আদর করে ডাকে নেসি। একশো ফুট লম্বা।
আপনি কখনও দেখেছেন?
না। ছেলেবেলায় অনেকবার গেছি ওই হ্রদের ধারে, শুধু নেসিকে দেখতে। কিন্তু একবারও চোখে পড়েনি।
হুম। ড্রাগন তো তাহলে নিশ্চয় দেখেননি।
দেখেছি, পথের দিকে মুখ ফিরিয়ে রেখেছে, হ্যাঁনসনের হাসিটা। দেখতে পেল না ছেলেরা।
দেখেছেন! এই না বললেন, দেখেননি?
দেখেছি, ফুটবল মাঠে, খেলার আগে।
ফুটবল মাঠে? বুঝতে পারছে না রবিন।
মাথা ঝাঁকাল হ্যাঁনসন। নতুন বছরের খেলার সময় প্যাসাডেনার লোকেরা বেলুনে বেঁধে ড্রাগন ছেড়ে দেয় আকাশে।
হ্যাঁনসন দেখেছে শুনে উত্তেজনায় সামনে ঝুঁকে বসেছিল মুসা, চেপে রাখা নিঃশ্বাসটা ফোঁস করে ছেড়ে বলল, ওগুলো তো ফুল দিয়ে বানানো, তাই না, কিশোর?
হ্যাঁ। আমি জিজ্ঞেস করছি, আসল ড্রাগন দেখেছেন কিনা।
আমাদের মত, যোগ করল মুসা।
না।
আবার নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটা শুরু করল কিশোর। চুপচাপ চেয়ে আছে জানালা দিয়ে পথের দিকে।
স্যালভিজ ইয়ার্ডে পৌঁছল রোলস রয়েস। হ্যাঁনসনকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলল কিশোর, দরকার পড়লেই আবার ডাকবে।
ভেরি গুড, মাস্টার পাশা, হ্যাঁনসন বলল। আপনাদের সঙ্গে সময়টা খুব ভাল কাটে। ধনী বিধবাদের কাজ করতে বিরক্ত লাগে। তাই আপনারা যখন ডাকেন, খুশিই হই। কিছু মনে না করলে, একটা প্রশ্নের জবাব দেবেন?
নিশ্চয়। কি?
রক্ত-মাংসের জ্যান্ত ড্রাগন দেখেছেন আজ আপনারা? খুব কাছে থেকে?
কাছে মানে? বলে উঠল মুসা। হাত বাড়ালেই ছুঁতে পারতাম। গায়ের ওপর এসে উঠেছিল।
আপনাদের নিশ্চয় জানা আছে, নিঃশ্বাসের সঙ্গে ড্রাগনের নাকমুখ দিয়ে আগুন বেরোয়। ওটার কি বেরিয়েছিল?
আস্তে মাথা নাড়ল কিশোর। না, আগুন দেখিনি। তবে ধোয়া-হা, ধোঁয়া বেরিয়েছে বলা যায়।
তাহলে ড্রাগনের আসল ভয়ঙ্কর রূপই দেখেননি…
যা দেখেছি তা-ই যথেষ্ট, বাধা দিয়ে বলল মুসা। অনেক দিন ঘুমাতে পারব না। ভাবলেই রোম খাড়া হয়ে যায়।
আর কিছু না বলে গাড়ি নিয়ে চলে গেল হ্যাঁনসন।
জাঙ্কইয়ার্ডে ঢুকল তিন গোয়েন্দা। চাচা-চাচীর বেডরুমে আলো নেই, ঘুমিয়ে পড়েছেন। শুধু কিশোরের ঘরে স্লান একটা আলো জ্বলছে।
বন্ধুদের দিকে ফিরল কিশোর। আমাদের বোধহয় আরেকবার গুহায় যেতে হবে।
কী? চমকে উঠল মুসা। আবার। একবার যে বেঁচে ফিরেছি, যথেষ্ট নয়?
হত, যদি বোকামিটা না করতাম।
একবার যাওয়াটাই তো বোকামি হয়েছে। আরেকবার গেলে আরও বড় বোকামি হবে, কারণ এবার ড্রাগন আছে জেনেশুনে যাচ্ছি।
কিন্তু যেতেই হবে, উপায় নেই। ক্যামেরা, রেকর্ডার সব কিছু ফেলে রেখে ভয়ে দিয়েছি দৌড়। ওগুলো আনতে হবে।
ইচ্ছে করে ফেলে রেখে আসোনি তো? আবার ফিরে যাওয়ার
ছুতো?চ্ছে করে কেহ দৌড়। ওই ক্যামেরা
ছুতো? নাহ, আরেক দিকে তাকিয়ে মাথা চুলকাল কিশোর।
কিছু বলবে মনে হয় তুমি? কিশোরের উসখুস ভাবটা ধরে ফেলল রবিন।
বোম ফাটাল কিশোর, আমার ধারণা, ড্রাগনটা আসল নয়।
বোকা হয়ে গেল অন্য দু-জন। বলে কি?
আসল না? বিড়বিড় করল মুসা। আমাদের খেয়ে ফেলতে চাইল, আর তুমি বলছ ওটা আসল না?
মাথা নাড়ল কিশোর, না।
তাহলে কামড়াতে চাইল কেন? রবিনের প্রশ্ন।
চায়নি, হয়তো ভঙ্গি করেছে।
তাই বা কি করে করল?
আসলে, ভঙ্গিও করেছে কিনা, সে ব্যাপারেও শিওর নই। জ্যান্ত জানোয়ারের মত আচরণ করেনি ওটা, ওটুক বলতে পারি। আরেক বার গুহায় গিয়ে দেখলেই পুরো শিওর হতে পারব। তবে প্রাণী যে নয় ওটা, বাজি ধরে বলতে পারি।
কখন মরতে চাও? জিজ্ঞেস করল মুসা।
এমন ভঙ্গিতে প্রশ্নটা করল সে, কিশোরও বুঝতে পারল না।
মরতে চাই মানে?
বুঝলে না। আরেকবার গুহায় দেখলে তো আর ছাড়বে না, গিলে খাবে আমাদের। তাই জিজ্ঞেস করছি, ড্রাগনের নাস্তা হতে চাও কখন?
ও, এই কথা, হাসল কিশোর। এখন আর সময় নেই। কালকে সকালের আগে হবে না। এতক্ষণ না খেয়েই থাকতে হবে ড্রাগনটাকে।
তেরো
সে-রাতে ভাল ঘুম হলো না রবিনের।
ভীষণ ক্লান্ত হয়ে শুয়েছে, সঙ্গে সঙ্গে ঘুমিয়ে পড়ার কথা। পড়লও তাই, কিন্তু চোখ বোজার সঙ্গে সঙ্গে দেখা দিল দুঃস্বপ্ন, গুহা থেকে গুহায় তাকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াতে লাগল ভয়ঙ্কর এক ড্রাগন, আগুনের হলকা আর বাষ্পের মত গরম নিঃশ্বাস দিয়ে পুড়িয়ে দিল চামড়া।
দুঃস্বপ্ন কখন গেল, বলতে পারবে না রবিন, ঘুম ভাঙল মায়ের ডাকে। নাস্তা রেডি।
খাবার টেবিলে এসে দেখল, তার বাবার খাওয়া প্রায় শেষ। মাথা সামান্য ঝাঁকিয়ে ইশারায় গুড মর্নিং জানিয়ে ঘড়ি দেখলেন মিলফোর্ড।
গুড মর্নিং, বাবা।
মুখের খাবারটুকু গিলে নিয়ে বাবা জিজ্ঞেস করলেন, কাল রাতে বন্ধুদের সঙ্গে কেমন কাটালে?
ভাল, আরেক দিকে তাকিয়ে জবাব দিল রবিন।
গুড! ন্যাপকিনে মুখ মুছে দলেমুচড়ে ওটা টেবিলে ফেলে উঠে দাঁড়ালেন মিলফোর্ড। ও হ্যাঁ, ভাল কথা, কাল সী-সাইডের কথা বলছিলে না, তুমি যাওয়ার পর নামটা মনে পড়ল! স্বপ্নের শহর বানাতে গিয়ে আত্মহত্যা করেছিলেন যে মানুষটা…
তাই? কি নাম?
ডন হেরিঙ।
হেরিঙ? জন হেরিঙের কথা মনে পড়ল রবিনের। বদমেজাজী, হাতে শটগান।
হ্যাঁ। ভাল স্বাস্থ্য ছিল। কিন্তু সী-সাইড টাউন কাউন্সিল যখন তার স্বপ্ন ভেঙে চুরমার করে দিল, স্বাস্থ্যও ভাঙতে লাগল তার। টাকা, স্বাস্থ্য, সুনাম হারালে আর কি থাকে একজন মানুষের? বেঁচে থাকার আর কোন যুক্তি দেখলেন না তিনি।
হ্যাঁ, শুনলে খারাপই লাগে। তার পরিবারের আর কেউ নেই?
আছে। হেরিঙ মারা যাওয়ার কিছুদিন পরেই তার স্ত্রীও মারা গেলেন। থাকল শুধু একমাত্র ছেলে জনহেরিঙ।…এখনও বেঁচে আছে। কিনা জানি না। অনেক কাল আগের কথা তো।
বেরিয়ে গেলেন মিলফোর্ড, অফিসে যাবেন।
তথ্যগুলো নোট করে রাখল রবিন। খেতে খেতে ভাবল, এসব শুনলে কি করবে কিশোর? এমন একজন মানুষকে পাওয়া গেছে, যিনি সুড়ঙ্গগুলো চেনেন। বাবার মৃত্যুর কারণ হয়েছিল বলে টাউন কাউন্সিলের ওপর যার রাগ আছে।
তাড়াহুড়া করে নাস্তা সেরে বেরিয়ে গেল রবিন।
.
খাইছে, বলে উঠল মুসা, কিশোর, আজব কথা শোনাল তো রবিন!
হেডকোয়ার্টারে জড় হয়েছে তিন গোয়েন্দা। আগে হেরিঙের খবর জানাল রবিন। তারপর বলল, বাড়ি থেকে সোজা লাইব্রেরিতে গিয়েছিলাম। ড্রাগনের ওপর যত বই পেয়েছি, ঘেঁটে দেখে এসেছি।
রবিনের নোট বইয়ের গিজিগিজি লেখার দিকে তাকাল কিশোর এক পলক। কি জানলে? জ্যান্ত ড্রাগন আছে?
মাথা নাড়ল রবিন। না। নো ড্রাগন। একটা বইতেও লেখেনি। এমন কি ড্রাগন আছে, এ ব্যাপারে বিন্দুমাত্র সন্দেহও প্রকাশ করেনি কেউ।
গাধা! ফেটে পড়ল মুসা, ব্যাটারা আস্ত গাধা। বই যারা লিখেছে, কিছুদিন এসে সী-সাইডের গুহায় বাস করা উচিত তাদের। তাহলেই বুঝবে আছে কি নেই। ধরে ধরে যখন গিলবে…
হাত তুলল কিশোর। আহ, আগে রবিনের কথা শুনি। হ্যাঁ, তারপর, নথি?
আবার নোটের দিকে তাকাল রবিন। একটি মাত্র ড্রাগনের নাম লেখা আছে, একমাত্র প্রজাতি, কমোডো ড্রাগন। বিশাল গিরগিটি, দশ বারো ফুট লম্বা হয়। আমরা যেটাকে দেখেছি ওটার চেয়ে অনেক ছোট।
মানুষের মধ্যে দানব আছে না, ফস করে বলল মুসা, ওটাও হয়তো তেমনি। একটা কমোডো ড্রাগনের গায়ে ভিটামিন বেশি জমেছে আর কি।
হুঁ, বলেছে তোমাকে, অধৈর্য হয়ে হাত নাড়ল কিশোর। রবিন, বলো।
কিন্তু কমোডো ড্রাগনের নিঃশ্বাসের সঙ্গে আগুন বা ধোয়া কিছুই বেরোয় না, রবিন বলল। ওয়েস্ট ইনডিজের ছোট্ট একটা দ্বীপ কমোডোতে ছাড়া দুনিয়ার আর কোথাও পাওয়াও যায় না। গুহায়। যেটাকে দেখেছি, চেহারায়ও ওটার সঙ্গে কোন মিল নেই। জোর দিয়ে বলা যায়, ড্রাগন নেই পৃথিবীতে। ওই ধরনের কোন জীব কাউকে আক্রমণ করেছে বলেও শোনা যায়নি। অথচ… মুখ তুলল রবিন। আরও পড়ব?
হ্যাঁ হ্যাঁ, পড়ো, বলল কিশোর।
অনেক জানোয়ার আছে, মানুষকে আক্রমণ করে, মেরে খেয়েও ফেলে অনেকে। এর একটা হিসেবও টুকে এনেছি। এই যে, রোগজীবাণুবাহী পোকামাকড়ের কারণে প্রতি বছর সারা পৃথিবীতে দশ লাখ মানুষ মারা যায়। চল্লিশ হাজার মরে সাপের কামড়ে, দুই হাজার বাঘে মারে, এক হাজার যায় কুমিরের পেটে, আরও এক হাজার। হাঙরের শিকার হয়। মুখ তুলল সে।
মুসা, শুনলে তো, কিশোর বলল। ড্রাগনের কথা কিন্তু এখানেও বলা হয়নি।…হা, রবিন, পড়ো।
অন্যান্য জন্তু-জানোয়ারের আক্রমণেও মরে মানুষ। হাতি, গণ্ডার, জলহস্তী, নেকড়ে, সিংহ, চিতা, হায়েনা-সুযোগ পেলে কিংবা কোণঠাসা হলে এদের কেউই মানুষ মারতে ছাড়ে না। এগুলোর মাঝে আবার মানুষখেকোও আছে কিছু।
ম্যান ইজ দ্য প্রে বইতে জন ক্লার্ক লিখেছে: মেরুভালুক, পুমা, অ্যালিগেটর, এমন কি কিছু কিছু ঈগলও মানুষকে আক্রমণ করে মেরে ফেলে। তবে সেটা খুব রেয়ার। টারানটুলা মাকড়সার কামড়েও মানুষ মরে, গ্রিজলি ভালুক আর গরিলাও মাঝেসাঝে মারে। সবচেয়ে বিপজ্জনক জায়গা হলো, আফ্রিকা আর ভারতের জঙ্গল। সবচেয়ে নিরাপদ জায়গা আয়ারল্যাণ্ড। নোট বই বন্ধ করল রবিন।
কিছুক্ষণ চুপ করে রইল সবাই।
মুসার দিকে ফিরল কিশোর। কোন মন্তব্য?
মাথা নাড়ল মুসা। ক্লার্ক মিয়া সী-সাইডে আসেনি, এলে অন্য কথা বলত। ওসব বইটইয়ের কথা কমই বিশ্বাস করি। নিজের চোখে ড্রাগন দেখে এলাম। ওরা বললেই হবে নাকি? বিশ্বাস করতে পারি, যদি তুমি দেখিয়ে দাও ওটা আসল নয়।
বেশ… টেলিফোনের শব্দ বাধা দিল কিশোরকে। রিসিভারে হাত রাখল, তুলতে দ্বিধা করছে।
তোলো, মাথা ঝাঁকিয়ে বলল মুসা। গুহার ভূতটাই হয়তো করেছে আবার।
মৃদু হেসে রিসিভার তুলে কানে ঠেকাল কিশোর।
হ্যালো? অন করল স্পীকারের কানেকশন।
হ্যালো, পরিচিত কণ্ঠস্বর। ডেভি ক্রিস্টোফার। কিশোর?
ও, স্যার, আপনি। নিশ্চয় কুকুরের খোঁজ নিতে করেছেন?
হ্যাঁ, স্পীকারে গমগম করছে ভারি কণ্ঠ। জোনসকে বড় মুখ করে বলেছি এ-রহস্যের সমাধান তোমরা করতে পারবেই। কুকুরের খোঁজ পেয়েছ?
এখনও পাইনি। তবে ড্রাগনটা দেখে এসেছি।
সত্যি আছে! তাহলে তো ড্রাগন বিশেষজ্ঞের সঙ্গেই তোমাদের আবার কথা বলা উচিত।
কে, স্যার?
কেন, আমার বন্ধু জোনস। বলেনি? সারাজীবন দৈত্য-দানব আর ড্রাগন নিয়েই ছিল তার কারবার।
হ্যাঁ, বলেছেন। সিনেমার জন্যে নাকি খেলনা ড্রাগন বানাতেন। ঠিক আছে, এখুনি ফোন করছি তাকে।
দরকার নেই। আমি লাইন দিচ্ছি। সে লাইনেই আছে। ফোন করে কুকুরের খবর জানতে চাইছিল।
সেক্রেটারীকে নির্দেশ দিলেন মিস্টার ক্রিস্টোফার।
কয়েক সেকেণ্ড খুটখাটের পর স্পীকারে ভেসে এল বৃদ্ধ পরিচালকের কণ্ঠ। হাল্লো, কিশোর?
হ্যাঁ, মিস্টার জোনস। আপনার কুকুরের খোঁজ এখনও পাইনি, তবে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।
ভেরি গুড। এত তাড়াতাড়ি পাবে আশাও করিনি, তবু মন মানছিল না…
আপনার পড়শীদের কুকুরগুলো পাওয়া গেছে?
না। প্রায় একই সময়ে সবগুলো হারাল, এটাই অবাক লাগে।
হ্যাঁ।
আমার পড়শীদের সঙ্গে দেখা করেছিলে?
করেছিলাম দু-জনের সঙ্গে, যাঁদের কুকুর নেই। মিস্টার হেরিঙ আর মিস্টার মারটিন।
বলেছে কিছু?
আজব লোক দু-জনেই। মিস্টার হেরিঙ শটগান নিয়ে এসে গুলি করার হুমকি দিলেন। কুকুর দু-চোখে দেখতে পারেন না। তার বাগান টাগান নাকি সব নষ্ট করে ফেলে।
হাসি শোনা গেল। ও এমনি ভয় দেখিয়েছে। মানুষ তো দূরের কথা, একটা ইঁদুর মারার ক্ষমতা নেই তার। মারটিন কি বলল?
ভয় তিনিও দেখিয়েছেন, তবে অন্যভাবে।
আবার হাসলেন বৃদ্ধ চিত্রপরিচালক। ওর বাড়ির আজব খেলনাগুলোর কথা বলছ তো? আসলে খুব রসিক লোক। এই রসিকতার জন্যে মস্ত ক্ষতি হয়ে গেছে তার। ভাল একটা চাকরি হারিয়েছে।
মুসা ও রবিনের সঙ্গে দৃষ্টি বিনিময় করল কিশোর।
কি হয়েছিল?
সেটা বেশ কয়েক বছর আগের ঘটনা। সিটি প্ল্যানিং ব্যুরোতে ইঞ্জিনিয়ার ছিল সে। তার এক জন্মদিনে কি জানি কি করে সারা শহরের কারেন্ট ফেল করিয়ে দিল। তার বক্তব্য, শহরে আলোই যদি থাকল, কেকের ওপর মোম জ্বেলে কি লাভ?
তারপর? আগ্রহী হয়ে উঠেছে কিশোর।
কয়েক ঘণ্টা কারেন্ট বন্ধ থাকায় অনেকের অনেক রকম ক্ষতি হলো। বড় বড় কয়েকজন কর্তাব্যক্তি গেল খেপে। চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হলো মারটিনকে। শুধু তাই নয়, শহরে আর কোথাও যেন চাকরি না পায় সে ব্যবস্থা করে ছাড়ল।
তারপর আর চাকরি পাননি? চলেন কিভাবে?
ভাল ইঞ্জিনিয়ার, কাজ জানে। এটা-ওটা টুকটাক প্রাইভেট কাজ করে। সবই আজব ধরনের। তবে তাতে বিশেষ আয় হয় বলে মনে হয় না।
হুঁ। দেখে কিন্তু মনে হয় না অসুবিধেয় আছেন। খেলনা বানিয়ে মানুষকে ভয় দেখান, সুখেই তো আছেন।
ভয় দেখানোর রসিকতা সব সময় পছন্দ করে না লোকে। আচ্ছা, রাখি?
আরেকটা প্রশ্ন, স্যার। যে ড্রাগনটা দেখেছেন আপনি, সেটা কি গোঙায়?
নিশ্চয়ই। কি রকম যেন গোঁ গোঁ করে।
পাড়ে দাঁড়িয়ে নিচে গুহায় ঢুকতে দেখেছেন, না?
হা। রাতে দেখেছি তো, মনে হলো গুহায়ই ঢুকেছে। তবে ড্রাগন দেখেছি তাতে কোন সন্দেহ নেই।
থ্যাংক ইউ, স্যার। শিগগিরই যোগাযোগ করব আপনার সঙ্গে। লাইন কেটে গেল।
মারটিন তাহলে ভাল লোক নন, বলে উঠল মুসা। মানুষকে অহেতুক ভয় দেখানোটা আমারও ভাল লাগে না। বাজপাখিটার কথাই ধরো, ড্রাগনের চেয়ে কম কিসে… তার কথায় কিশোরের কান নেই দেখে থেমে গেল।
বিড়বিড় করল কিশোর, মিস্টার জোনসের কথায় নড়চড় আছে।
অ্যাঁ! ভুরু কুঁচকে গেল সহকারী গোয়েন্দার।
মিথ্যুক বলতে চাও? রবিনও অবাক।
মাথা ঝাঁকাল কিশোর। বলেছেন পাড়ে দাঁড়িয়ে ড্রাগনটাকে গুহায় ঢুকতে দেখেছেন।
ভুরু আরও কুঁচকে গেল মুসার। তাতে দোষটা হয়েছে কোথায়? তাছাড়া শিওর হয়েছেন এ কথা তো বলেননি, বলেছেন মনে হলো।
মাথা চুলকাল মুসা। কি জানি। বুঝতে পারছি না। শিওর হওয়া যায় কিভাবে?
আজ বিকেলে আবার যাব গুহায়। আশা করি আজই ড্রাগন রহস্যের সমাধান করে ফেলতে পারব।
চুপ করে রইল দুই সহকারী গোয়েন্দা।
মিস্টার জোনসকেও সন্দেহের বাইরে রাখতে পারছি না আর, বলে চলল কিশোর। আমাদের ভেবে দেখতে হবে, এই শহরের লোকের ওপর কার ব্যক্তিগত আক্রোশ রয়েছে। এবং কারা কারা গুহা আর সুড়ঙ্গগুলো চেনে। মিস্টার জোনস চেনেন। শহরবাসীর ওপরও আক্রোশ থাকতে পারে। হেরিঙ আর মারটিনের তো আছেই। এর সঙ্গে ড্রাগনটাকে যদি কোনোভাবে যোগ করতে পারি, খোলাসা হয়ে যাবে স। দেখি আজ রাতে গুহায় গিয়ে।
আবার, মিনমিন করল মুসা, জানে প্রতিবাদ করে লাভ নেই। কিশোর যখন সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে, যাবেই।
জবাব না দিয়ে সামনে রাখা প্যাডে খসখস করে কিছু লিখল গোয়েন্দাপ্রধান। হাত বাড়াল ফোনের দিকে। ইস্, আরও আগেই মনে পড়া উচিত ছিল।
চোদ্দ
প্লীজ, মিস্টার ডেভিস ক্রিস্টোফারকে দিন, ফোনে বলল কিশোর। বলুন কিশোর পাশা বলছি।
শূন্য দৃষ্টিতে একে অন্যের দিকে তাকাল মুসা আর রবিন।
ভেসে এল চিত্রপরিচালকের ভারি কণ্ঠ, কি ব্যাপার, কিশোর?
স্যার, আপনার বন্ধু মিস্টার জোনস তো হরর ফিল্ম বানাতেন।
হ্যাঁ, বাদুড়, মায়ানেকড়ে, ভ্যাম্পায়ার, ভূত-প্রেত, ড্রাগন…মানে যা যা মানুষকে ভয় দেখাতে পারে, সব।
আচ্ছা, তাঁর দানবগুলোকে কি ছবিতে আসল মনে হয়?
নিশ্চয়। না হলে লোকে সেসব দেখবে কেন?
দানবগুলো কে বানাত?
স্টুডিওতে ওই পেশার অনেক লোক আছে, তারাই।
কাজ হয়ে গেলে ওগুলো কি করে? ফেলে দেয়?
কিছু কিছু রেখে দেয়, পরে আবার কাজে লাগায়। কিছু নিলামে কিনে নিয়ে যায় লোকে, সংগ্রহে রাখে। বাকি সব নষ্ট করে ফেলা হয়।
স্যার, মিস্টার জোনসের কোন ছবি সংগ্রহে আছে আপনার? এমন কিছু, যাতে ড্রাগন আছে?
আছে একটা, অবাক মনে হলো পরিচালকের কণ্ঠ। দেখতে চাও?
তাহলে খুব ভাল হয়, স্যার। ফিল্ম, না ক্যাসেট?
ফিল্ম।
তাহলে তো আপনার ওখানে গিয়েই দেখতে হয়। কখন সময় হবে, স্যার।
চলে এসো, এখুনি। চার নম্বর প্রোজেকশন রুমে থাকব আমি। লাইন কেটে দিলেন পরিচালক।
আস্তে করে ক্রেডলে রিসিভার নামিয়ে রাখল কিশোর। দুই সহকারীর দিকে তাকাল। খুব ভালমত লক্ষ করবে, ছবির ড্রাগন কি করে না করে, আচার-আচরণ, স্বভাব। হয়তো পরে কাজে লাগতে পারে। কে জানে, প্রাণও বাঁচতে পারে।
মানে? একই সঙ্গে প্রশ্ন করল রবিন আর মুসা।
মানে? আবার রিসিভারের দিকে হাত বাড়াল কিশোর। আমার ধারণা, সী-সাইডের দানবটা মানুষের বানানো।
.
সময় মতই রোলস রয়েস নিয়ে পৌঁছল হ্যাঁনসন। তিন গোয়েন্দাকে নিয়ে চলল হলিউডে।
চার নম্বর প্রোজেকশন রুমে অপেক্ষা করছেন মিস্টার ক্রিস্টোফার। মেশিনপত্র, ফিল্ম সব রেডি। ইশারায় তিন গোয়েন্দাকে চেয়ার দেখিয়ে বসতে বললেন। তারপর ইশারা করলেন মেশিনম্যানকে।
শুরু হলো ছবি। কয়েক মিনিটেই ভুলে গেল ছেলেরা, কোথায় রয়েছে। সত্যি ছবি বানাতেন বটে মিস্টার জোনস। দর্শককে এভাবে সম্মোহিত করে ফেলার ক্ষমতা সব পরিচালকের থাকে না।
পর্দায় চলছে একটা গুহার দৃশ্য। ঝাঁকুনি দিয়ে বেরোল একটা মুখ, গুহামুখ জুড়ে দাঁড়াল। বিশাল দানব। এতই আচমকা ঘটল ঘটনাটা, চমকে উঠল তিন গোয়েন্দা। তাদের মনে হলো, যেন সত্যি সত্যি একটা ড্রাগন তাদের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে।
কানফাটানো গর্জন করে উঠল দানবটা। হাঁ করতেই দেখা গেল বড় বড় বাঁকা ধারাল দাঁত।
খাইছে! চেয়ারের পেছনে পিঠ চেপে ধরল মুসা। আসল ড্রাগন।
ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে ড্রাগন। চেয়ারের হাতল খামচে ধরল রবিন।
কিশোর শান্ত। গভীর মনোযোগে দেখছে ড্রাগনের প্রতিটি নড়াচড়া। ছবির গল্পের দিকে তার কোন খেয়াল নেই।
স্তব্ধ হয়ে ছবিটা শেষ পর্যন্ত দেখল ওরা। ছবি শেষে উজ্জ্বল আলো জ্বলার পরও বিমূঢ় হয়ে রইল কিছুক্ষণ, যেন ঘোরের মধ্যে রয়েছে।
মিস্টার ক্রিস্টোফার নেই। কোন এক ফাঁকে চলে গেছেন তার অফিসে।
সেদিকে চলল তিন গোয়েন্দা। পায়ে জোর নেই যেন, কাঁপছে।
সব্বোনাশ, কিশোর! প্রথম কথা বলল মুসা। গতরাতে যেটা দেখেছি ঠিক ওই রকম। যেন জ্যান্তটাই এনে ছবিতে বসিয়ে দিয়েছে।
মাথা ঝাঁকাল কিলোর। গুণী লোকের কাজই এমন। একটা ছবি দেখেই বোঝা গেল কতখানি দক্ষ পরিচালক ছিলেন মিস্টার জোনস। আরিব্বাপরে, কি ছবি! ভয় পাবে না এমন মানুষ কম আছে।
ফাইলে ডুবে ছিলেন মিস্টার ক্রিস্টোফার, ছেলেদের সাড়া পেয়ে। মুখ তুললেন। কেমন দেখলে?
মাথা কাত করল কিশোর। সাংঘাতিক।
অনেক প্রশ্নের ভিড় জমেছে মনে, এক এক করে করার ইচ্ছে ছিল তার, কিন্তু পরিচালককে ব্যস্ত দেখে আর করা হলো না। এমনিতেই তার অনেক সময় নষ্ট করেছে ওরা। ধন্যবাদ জানিয়ে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে এল অফিস থেকে।
রোলস রয়েসে উঠে রকি বীচে ফিরে যেতে বলল কিশোর। স্টুডিও থেকে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে এল হ্যাঁনসন।
ভালমত লক্ষ করতে বলেছিলে, রবিন বলল, করেছি। মুসা ঠিকই বলেছে, গতকাল যেটাকে গুহায় দেখেছি তার সঙ্গে কোন পার্থক্য নেই।
কিছুই না? কিশোরের প্রশ্ন।
না, কেবল ওই গর্জনটা বাদে, মুসা জবাব দিল। ছবিরটা বেশি গর্জাচ্ছিল, আর গুহারটা গোঙাচ্ছিল, আর মাঝে মাঝে ছোট ছোট কাশি।
একদম ঠিক। তুড়ি বাজাল কিশোর।
গুহার ওটার ঠাণ্ডা লেগেছে বোধহয়।
ড্রাগনের ঠাণ্ডা লাগে কি করে? ব্যাঙের সর্দির মত হয়ে গেল না। ব্যাপারটা? ড্রাগনটা থাকে পানিতে আর ভেজা গুহায়। ঠাণ্ডা লাগে কি করে?
জবাব দিতে পারল না দুই সহকারী গোয়েন্দা।
আশা করি, আর কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই ভেদ করে ফেলব কাশির রহস্য, বলল কিশোর। আর সেটা পারলেই পরিষ্কার হয়ে যাবে অনেক কিছু।
যদি ততক্ষণ জীবিত থাকি, জোরে একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল মুসা। ড্রাগনের পেটে চলে যাই।
বলা যায় না, রহস্যময় কণ্ঠে বলল কিশোর, শেষ পর্যন্ত ড্রাগনের পেটেও ঢুকতে হতে পারে আমাদের!
পনেরো
ড্রাগনের পেটে! আঁতকে উঠল মুসা। কি বলতে চাও তুমি, কিশোর? কিছু একটা ভাবছ, বুঝতে পারছি। এরকম অন্ধকারের মধ্যে না রেখে খুলে বলো না। হাজার হোক, আমরা তোমার সহকারী। তুমি যেমন মরতে যাচ্ছ, আমরাও যাচ্ছি। জানার অধিকার আমাদের আছে। কি বলো, রবিন?
হাসল গবেষক। তা তো নিশ্চয়। বলল, কিশোর। আগে থেকে জানা থাকলে হুঁশিয়ার থাকতে পারব। আমরা মরে গেলে এত ভাল সহকারী আর কোথায় পাবে?
রবিনের শেষ কথাটায় কিশোরও হাসল। আসলে আমি নিজেই শিওর না। ঝুঁকি একটা নিতে যাচ্ছি আর কি।
জোরে মাথা নাড়ল মুসা। না জেনে কোন ঝুঁকি নিতে রাজি না আমি। বলতে ভুলে গেছি, গতরাতে একটা ছবি দেখেছি বাসায়। একটা সাইন্স ফিকশন। বোকার মত না বুঝে ঝুঁকি নিয়েছেন এক বিজ্ঞানী, প্রাণটা খোয়াতে হয়েছে তাঁকে।
ভ্রুকুটি করল কিশোর। কি ছবি?
দাঁত বের করে হাসল মুসা। পোকামাকড়।
পোকামাকড়?
পিঁপড়ে আর সামান্য বিষাক্ত পোকা দুনিয়া দখল করতে চায়। যে ছবিটা এইমাত্র দেখে এলাম তার চেয়ে কম ভয়ঙ্কর নয়। একশো ফুট লম্বা একেকটা পিঁপড়ে, পঞ্চাশ ফুট উঁচু। বড় বিল্ডিঙের সমান।
করে কিভাবে এটা? আনমনে বলল কিশোর।
আসল পিঁপড়ে দিয়ে।
আসল পিপঁড়ে? রবিন বিশ্বাস করতে পারছে না। কিভাবে, জানো?
বাবাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, মুসা বলল।
বলেছেন? জানতে চাইল কিশোর।
বলেছে। আতস কাঁচের ভেতর দিয়ে প্রথমে পিঁপড়ের ছবি তোলে। তারপর বড় করে ছবিকে, সুপার ইমপোজ করে, সেগুলোকে। আবার বিল্ডিঙের ছবির পটভূমিকায় রেখে ছবি তোলে। পর্দায় দেখে মনে হয় জ্যান্ত পিঁপড়েগুলো একেকটা বিল্ডিঙের সমান। যে ছবিটা দেখেছি, তার গল্পটা হলো মহাকাশের কোন এক গ্রহ থেকে এসে হাজির হয়েছে একদল পোকামাকড়…
মাঝপথে থেমে গেল মুসা।
শুনছে না কিশোর। নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটা শুরু হয়েছে, তারমানে গভীর চিন্তায় ডুবে গেছে। হঠাৎ যেন ডুব দিয়ে উঠে এল ভাবনার জগৎ থেকে। ছবিটা দেখেছ?
বললামই তো, হাত নাড়ল মুসা।
ফিল্ম, না ক্যাসেট?
ফিল্ম। দেখতে চাও? চলো আজ রাতে।
মাথা নাড়ল কিশোর। রাতের আগেই দরকার হতে পারে ওটা। ঘড়ির দিকে তাকাল। তোমাদের প্রোজেকটরে দেখেছ, না?
কিশোরের কথা বুঝতে পারছে না মুসা। তো আর কারটা দিয়ে দেখব?
আনমনে বিড়বিড় করল কিশোর, জিনিসটা হয়তো আমাদের প্রাণ বাঁচাতে সাহায্য করবে। হয়তো রহস্যের সমাধান করতে পারব। মুসা, আজ রাতের জন্যে প্রোজেকটরটা আনতে পারবে?
চোখ মিটমিট করল মুসা। কেন, আমাদের বাড়ি গিয়ে দেখতে অসুবিধে কি?
হ্যাঁ। ছবিটা কাউকে দেখাতে চাই। ওই ছবিই এখন আমার দরকার।
মাঝেমাঝে রহস্য করে কথা বলা কিশোরের স্বভাব। রবিন আর মুসাও বুঝতে পারে না তখন তার কথার অর্থ।
নাক ডলল মুসা। আনা যাবে। মাকে বললেই দিয়ে দেবে। তবু বাবাকে একবার জিজ্ঞেস করে নিলে ভাল, তার জিনিস তো।
ঠিকই বলেছ, বলল কিশোর। আংকেলকে ফোন করে অনুমতি নিয়ে নাও।
ধরে নাও, প্রোজেকটর পেয়ে গেছ, মুসা বলল। তবে তার আগে জানতে হবে, আজ রাতে কি করতে যাচ্ছি আমরা। অন্ধকারে থাকতে রাজি না আমি।
রবিনও মুসার সঙ্গে একমত হলো।
দু-জনেই তাকাল কিশোরের দিকে।
দ্বিধা করল কিশোর। ধড়াস করে দুই হাত ফেলল টেবিলে।
আমার নিজের কাছেই স্পষ্ট নয় এখনও ব্যাপারটা। পুরো রহস্যটাই কেমন যেন অদ্ভুত, ঘোরাল। শুরু করেছি কুকুর হারানো দিয়ে, জড়িয়ে পড়েছি ড্রাগন শিকারে। ২ বার বার একটা কথাই বোঝাতে চাইছ, ড্রাগনটা নকল, রবিন বলল। কেন এই সন্দেহ?
অনেক কারণে। গুহাটা আসল নয়। পুরানো সুড়ঙ্গটা আসল নয়। গুহামুখ আসল নয়। ড্রাগনটাও আসল হওয়ার কোন কারণ নেই।
এসব তো খেয়াল করিনি! বিস্ময় ঢাকতে পারল না রবিন।
প্রথমে গুহার কথাই ধরো। তা সরিয়ে একটা ছোট গুহায় ঢুকলাম।
হ্যাঁ, অদ্ভুত চোখে তখন তাকিয়েছিলে আমার দিকে। আসল নয় বুঝলে কি করে?
গুহাটা পুরানো সন্দেহ নেই। চোর-ডাকাতের আড্ডা ছিল। কিছু কিছু তক্তাও পুরানো।
কিছু কিছু? কথাটা ধরল মুসা। সব নয় কেন?
সবগুলো পুরানো নয়, সেজন্যে। যে তক্তা আমরা সরিয়েছি ওগুলো পুরানো। কিন্তু পাশেই আরও কিছু রয়েছে, যেগুলো অনেক পরে লাগানো হয়েছে। প্লাইউড। মাত্র এই সেদিন আবিষ্কার হয়েছে। ওগুলো প্রাচীন চোর-ডাকাতেরা লাগায়নি। পায়ইনি, লাগাবে কোত্থেকে?
প্লাইউড? ভুরু কাছাকাছি হলো মুসার। তা নাহয় হলো। কিন্তু তাতেই কি প্রমাণ হয় সব কিছু নকল?
না হলে আরও প্রমাণ আছে। তারপরের গুহাটার কথা ধরো। বড় গুহাটা, রবিন যেটা আবিষ্কার করেছে, সেটার দরজাটা কি প্রাকৃতিক? মোটেও না, মানুষের তৈরি। বড় গুহাটার শেষ মাথায় কি দেখলাম? দেয়াল। অন্য পাশে যাওয়ার পথ নেই। অথচ আমরা আশা করেছিলাম। ওই গুহা ধরে এগিয়ে গেলে একটা সুড়ঙ্গ-টুড়ঙ্গ পাব। কি মনে হয়?
একমত হলো দুই সহকারী।
ছুরি দিয়ে খোঁচাচ্ছিলে, মনে পড়ছে, মুসা বলল। পাথরে ঘষে নষ্ট করেছিলে ছুরিটা?
পকেট থেকে ছোট ছুরিটা বের করল কিশোর। নিজেই দেখো।
কি লেগে আছে ফলায়?
শুঁকে দেখো।
আরি! রঙ! চেঁচিয়ে উঠল গোয়েন্দা-সহকারী।
রবিনও শুঁকে একমত হলো।
ভাঁজ করে আবার ছুরিটা পকেটে রেখে দিল কিশোর। পুরানো গুহার দেয়ালে বাড়িঘরের মত রঙ করা হয়, শুনেছ কখনও? ছুরির আঁচড়ের দাগ বসেছে দেয়ালে। আমার অনুমান, ওটা পাথরের দেয়াল নয়, প্ল্যাসটারবোর্ড। তার ওপর ধূসর রঙ করা হয়েছে। এবং তার ওপর বালি আর পাথরের কণা এমনভাবে লাগিয়েছে, দেখে মনে হয় আসল দেয়াল।
মানে? রবিন বলল। অন্য পাশের কোন মূল্যবান আবিষ্কার লুকিয়ে রাখতে চাইছে কেউ?
হতে পারে।
ঠিক, আঙুল তুলল মুসা। পুরানো সুড়ঙ্গটা হয়তো কেউ আবিষ্কার করে ফেলেছে। জানাজানি হলে লোকে ভিড় করে নষ্ট করে ফেলবে, তাই লুকিয়ে রাখতে চাইছে।
নাকি আগেব চোর-ডাকাতেরাই কোন কারণে ওই দেয়াল লাগিয়েছিল? রবিনের প্রশ্ন।
না। মাথা নাড়ল কিশোর। প্ল্যাসটারবোর্ড ছিল না তখন।
চুপ হয়ে গেল রবিন।
আরেকটা ব্যাপার, কিশোর বলল, আমরা ঢুকেছি চিচিং ফাঁক দিয়ে। কিন্তু ড্রাগনটা?
ঢোক গিলল মুসা। নিশ্চয় পাহাড়ের আরেকটা চিচিং ফাঁক দিয়ে ঢুকেছে। আমাদের চোখে পড়েনি ওটা।
তাহলে ওই দরজা কে বানাল? কি সিসটেমে খোলে ওটা?
নিশ্চয় ড্রাগনটা জানে, মুখ ফসকে বলে ফেলল রবিন।
অনেকটা সে রকমই। বলেছি তো, সব নকল। ওই ড্রাগনটাও। গিয়ে দেখোগে, মানুষে চালায় ওটা।
চোখ মিটমিট করল মুসা। রবিনের দিকে তাকিয়ে নিল একবার চট করে। আবার কিশোরের দিকে ফিরল, কি বলছ?
যা বলা উচিত, তাই।
তোমার ধারণা, উত্তেজনায় লাল হয়ে গেছে রবিনের মুখ, আমাদের কেশো ড্রাগনটা একটা রোবট?
এখনও শিওর না। হতে পারে। আর তা হয়ে থাকলে, পাহাড়ের যে দরজা দিয়ে ওটা ঢোকে, সেটা মানুষের তৈরি। সিনেমায় যেমন করে বানানো হয়।
রোলস রয়েসের জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল মুসা। আজ রাতে দরজাটা খুঁজে বের করার চেষ্টা করব। কিশোরের দিকে ফিরে জিজ্ঞেস করল, আচ্ছা, ড্রাগনটা আসল নয় কিভাবে বুঝলে?
সীটে হেলান দিল কিশোর, কোলের ওপর রাখল দুই হাত। ড্রাগনটা যখন সামনে এল, কি দেখলাম, কি শুনলাম, মনে করার চেষ্টা করো।
চুপ করে ভাবতে লাগল রবিন আর মুসা।
গুঞ্জন, অবশেষে বলল রবিন। আর গোঙানি। মাঝে মাঝে কাশি।
উজ্জ্বল আলো দেখেছি, মুসা যোগ করল। সার্চ লাইটের মত।
হ্যাঁ। আর চলে কিভাবে খেয়াল করেছ?
খুব দ্রুত।
রবিনের দিকে ফিরল কিশোর, কিভাবে চলে?
হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে কপালের বিন্দু বিন্দু ঘাম মুছল রবিন। মুসা ঠিকই বলেছে, খুব দ্রুত ছোটে। যেন উড়ে যায়।
সিনেমায় যে ড্রাগনটা দেখলাম, ওটা কি ওভাবে চলে?
মাথা নাড়ল রবিন। না, ওটা হাঁটে। আমাদেরটা ওড়ে।
দেখে ওরকমই লাগে বটে, আসলে ওড়ে না। ওটার চেহারাটাই শুধু ড্রাগনের মত, কাজেকর্মে অন্যরকম। মানুষকে ভয় দেখানোর জন্যে কিংবা দূরে সরিয়ে রাখার জন্যেই ওরকম চেহারা তৈরি করা হয়েছে। আর ওড়ে মনে হয় কেন বলো তো? চাকায় ভর করে চলে বলে। সৈকতের বালিতে চাকার দাগ দেখেছিলাম মনে আছে?
হাঁ করে কিশোরের দিকে তাকিয়ে রইল দুই সহকারী।
ড্রাগনের আবার চাকা! বিড়বিড় করল মুসা।
তার সঙ্গে যোগ করল রবিন, আরও একটা ব্যাপার, মিস্টার জোনসের সিনেমার ড্রাগন গর্জন করে, আর আমাদেরটা গোঙায়, কাশে।
হ্যাঁ, মুচকি হাসল কিশোর। মানুষের তৈরি বলেই এই কাণ্ড করে। কাশিটা ড্রাগনের না হয়ে মানুষেরও হতে পারে।
মানে? বুঝতে পারছে না মুসা।
হাসি বিস্তৃত হলো কিশোরের। ওই ড্রাগনের ভেতরে বসা কোন একজন মানুষের হয়তো ঠাণ্ডা লেগেছে, খুকুর খুকুর সে-ই করে…
বেরসিকের মত বাধা দিল হ্যাঁনসনের কণ্ঠ, ইয়ার্ডে পৌঁছে গেছি।
নামতে গেল কিশোর।
জিজ্ঞেস করল শোফার, আমি থাকব?
হ্যাঁ, থাকুন। কয়েকটা জিনিস নিতে হবে আমাদের। আজ রাতে আবার সী-সাইডে যাব।
ষোলো
ছবিটার কিছু অংশ আগেই দেখে নেয়ার ইচ্ছে কিশোরের।
প্রোজেকটর চালাচ্ছে মুসা। ফিতে গুটিয়ে নিয়ে সুইচ টিপল সে। পর্দায় ফুটল ছবি। বাড়িয়ে বলেনি ও। রবিন আর কিশোরও দেখল; ঠিকই, বিশাল সব পিঁপড়ে ভয়ানক ভঙ্গিতে চলাফেরা করছে পর্দায়।
মিনিটখানেক পরই থেমে গেল প্রোজেকটর। অন্ধকারে মুসার গলা শোনা গেল, রবিন, লাইটটা জ্বালবে, প্লীজ?
কি হয়েছে? জিজ্ঞেস করল কিশোর।
ভুল ফিল্ম লাগিয়েছি, জবাব দিল মুসা। এটা ছয় নম্বর। অনেক পরের সিরিয়াল।
সিনেমা দেখতে বসিনি, মুসা, বাধা দিয়ে বলল কিশোর।
এটাতেই চলবে। চালাও।
প্রথমটা দেখো। ওটাতেও অনেক ভয়ঙ্কর ব্যাপার-স্যাপার আছে। পিঁপড়েরা কি করে শহর আক্রমণ করে…
দরকার নেই। যেটা দেখছি এটাই ভাল। মনে হবে গুহা আক্রমণ করতে আসছে পিঁপড়েরা।
অবাক হলো দুই সহকারী।
মনে হবে? বুঝতে পারল না মুসা।
হ্যাঁ, হবে।
হবে মানে… হঠাৎ বুঝে ফেলল মুসা, ড্রাগনের গুহায় ছবি দেখাতে যাচ্ছি নাকি আমরা?
হ্যাঁ। প্রোজেকটরটা ভাল, আমাদের কাজের উপযুক্ত। বিল্ট-ইন, স্পীকার রয়েছে, শব্দ সৃষ্টি করতে কোন অসুবিধে হবে না। চলেও ব্যাটারিতে। গুহায় গিয়ে চমৎকার চালাতে পারব।
বাবার কাজের জিনিস তো, পোর্টেবল, এখানে-ওখানে নিয়ে যায়। দেখে-শুনেই কিনেছে।
হয়েছে, কথা থামিয়ে ছবিটা দেখি, এসো, বলে উঠল রবিন। চালাও।
আবার চলল প্রোজেকটর। তাজ্জব হয়ে পিঁপড়েদের কাণ্ডকারখানা দেখল রবিন আর কিশোর।
শেষ হলো রীলটা। প্রোজেকটর বন্ধ করে মুসা জিজ্ঞেস করল, আরেকটা চালাব?
অন্ধকারে হেসে বলল কিশোর, না, এটাতেই চলবে।
আলো জ্বালল রবিন।
ফিল্ম গুটিয়ে নিতে নিতে মুসা বলল, কি করতে চাইছ তুমি, বলো তো? পিঁপড়ের ছবি দেখিয়ে গুহার ভূত তাড়াবে?
ধরো, অনেকটা ওই রকমই। তবে রসিকতার জবাব রসিকতা দিয়ে দিলে কি ঘটে আমার দেখার খুব ইচ্ছে।
রসিকতা? রবিন জানতে চাইল, আমাদের চেনা কাউকে সন্দেহ করছ?
মিস্টার হেরিঙ? মুসার প্রশ্ন।
না, শান্তকণ্ঠে বলল কিশোর। ড্রাগনটা তিনি বানাননি। শটগান হাতে যে হুমকি দিচ্ছিলেন, সেটাও রসিকতা মনে হয়নি।
এত শিওর হচ্ছ কি করে? মুসা চোখ নাচাল।
কথা বলার সময় প্রচুর চেঁচামেচি করেছেন মিস্টার হেরিঙ, কিন্তু কাশেননি। ঠাণ্ডা লাগেনি তার। কিন্তু মারটিনের লেগেছিল। কথা বলার সময় কাশছিলেন।
ড্রাগনটা তাঁরই কীর্তি বলতে চাইছ?
বানালে অসুবিধে কি? হাত নাড়ল কিশোর। এসব কাজে তো তিনি ওস্তাদ।
কিন্তু স্বার্থটা কি? নিজের বাড়িতে নানা রকম খেলনা বানিয়েছেন, সেটা আলাদা কথা। অনুমতি না নিয়ে কেউ ঢুকে পড়লে তাকে তাড়াতে কাজে লাগে। গুহায় ড্রাগন ঢোকাতে যাবেন কেন? গুহাটা তার সম্পত্তি নয়। ওখান থেকে তোক তাড়ানোরও কোন প্রয়োজন নেই।
আছে কিনা সেটাই দেখতে যাব আজ। তবে মিস্টার জোনসের কাজও হতে পারে। ড্রাগন বানানোর অভিজ্ঞতা তারও আছে। হাতঘড়ির দিকে তাকাল কিশোর। তৈরি হওয়া দরকার।
এক মিনিট, হাত তুলল মুসা। তোমার ধারণা, জোনস কিংবা মারটিন দু-জনের একজন বানিয়েছেন ড্রাগনটা। বেশ। কিন্তু সেদিন যে দু-জন ডুবুরীকে গুহায় ঢুকতে দেখলাম, তারা কারা?
হ্যাঁ, তারা কারা? রবিনেরও জিজ্ঞাসা।
প্রোজেকটর বাক্সে ভরে ফেলেছে মুসা। তালা আটকে দিয়ে মুখ তুলে তাকাল কিশোরের দিকে। বলল, কারা?
সেটাও আজ রাতেই জানতে পারব। হেসে বলল কিশোর, বেশ ভাল একখান সিনেমা দেখতে পাবে ওরা।
আর ড্রাগনটাও যদি আসে?
তাহলে তো আরও ভাল, আরেকটা পরীক্ষা হয়ে যাবে, রহস্যময় কণ্ঠে বলল কিশোর। ভয় দেখিয়ে ইঁদুর যে হাতি তাড়িয়েছে সেই গল্পটা শোনোনি? ইঁদুর যদি হাতি তাড়াতে পারে, পিঁপড়ে কেন ড্রাগন তাড়াতে পারবে না?
সৈকতের পাশে পাড়ের ওপরে অন্ধকার। শান্ত পথের মোড়ে গাড়ি রাখল হ্যাঁনসন।
সবার আগে নামল রবিন। নির্জন পথের এদিক-ওদিক তাকিয়ে দেখল কেউ আছে কিনা। এত দূরে রাখতে বললে কেন? নিচু গলায় জিজ্ঞেস করল সে। সিঁড়ি তো অনেক দূরে।
ভারি বোঝা নিয়ে কোনমতে বেরোল মুসা, প্রোজেকটরের ভারে নুয়ে পড়েছে। আল্লারে, কি ভার, হাত না লম্বা হয়ে যায়!
ভালই তো, হেসে বলল রবিন। গরিলা হয়ে যাবে। তোমাকে দেখলে ভয়ে পালাবে তখন ড্রাগন।
জবাবে গোঁ গোঁ করে কি বলল গোয়েন্দা-সহকারী, স্পষ্ট হলো না। বোঝাটা কাঁধে তুলে নিল।
দেখি, হাত বাড়াল কিশোর, আমাকেও কিছু দাও।
মাথা নাড়ল মুসা। নো, থ্যাঙ্কস, আমিই পারব। কষ্টটা যদি কাজে লাগে তাহলেই খুশি।
তোমার খুশি হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি, হাসল কিশোর।
হ্যানসনকে গাড়িতে বসিয়ে রেখে নির্জন পথ ধরে দ্রুত হেঁটে চলল তিনজনে। মেঘে ঢাকা পড়েছে চাঁদ। সৈকতে আছড়ে পড়া ঢেউয়ের গর্জন ছাড়া আর কোন শব্দ নেই।
সিঁড়ি থেকে বিশ কদম দূরে থাকতে কানে এল পদশব্দ।
জলদি লুকাও! বলতে বলতেই ভারি বোঝা নিয়ে মাটিতে শুয়ে পড়ল মুসা। হামাগুড়ি দিয়ে এগোল ছোট্ট একটা হালকা ঝোঁপের দিকে।
তাকে অনুসরণ করল অন্য দুই গোয়েন্দা।
কাছে আসছে পায়ের আওয়াজ। আরও কাছে এসে কমে গেল গতি, কেমন যেন অনিশ্চিত। কিছু সন্দেহ করেছে? গায়ে গা ঘেঁষাঘেঁষি করে এল ছেলেরা।
অন্ধকার থেকে বেরিয়ে এল আবছা ছায়াটা…কাছে, আরও কাছে…দুই কদম পাশে সরলেই এসে পড়বে একেবারে গায়ের ওপর
দুরুদুরু করছে গোয়েন্দাদের বুক। মোটা ওই মানুষটাকে আগেও দেখেছে। চোখ চলে গেল তার হাতের দিকে। আছে সেই ভয়ঙ্কর চেহারার ডাবল-ব্যারেল শটগানটা। মিস্টার জন হেরিঙ; যিনি কুকুর দেখতে পারেন না, বাচ্চাদের ভালবাসেন না, পছন্দ করেন না দুনিয়ার কোন কিছুই।
মাথা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখছেন তিনি, বোঝা যায় কিছু সন্দেহ করেছেন। অবাক কাণ্ড! আপনমনেই বিড়বিড় করলেন। নড়তে যে দেখেছি তাতে কোন ভুল নেই…
আরেকবার মাথা নেড়ে, ভাবনা ঝেড়ে ফেলে হাঁটতে শুরু করলেন।
পায়ের শব্দ দূরে মিলিয়ে যাওয়ার পরও খানিকক্ষণ নড়ল না ওরা।
অবশেষে মাথা তুলল রবিন। হউফ! করে মুখ দিয়ে বাতাস ছেড়ে বলল, বাচা গেল! আমি তো ভাবলাম, দেখেই ফেলেছেন।
আমিও, মুসা বলল। কিন্তু বন্দুক নিয়ে কি করতে বেরিয়েছেন? খুঁজছেন কাউকে?
এসো, নিচু কণ্ঠে ডাকল কিশোর। যাই। মিস্টার হেরিঙ অনেক দূরে চলে গেছেন। এ-ই সুযোগ, সিঁড়ি দিয়ে নেমে পড়া দরকার। মাথা নামিয়ে রাখো।
সিঁড়ির কাছে প্রায় ছুটে চলে এল ওরা।
ভালমত দেখে বলল মুসা, কেউ নেই।
নিঃশব্দে সিঁড়ি বেয়ে নামল তিনজনে। হাঁপ ছাড়ল। ঢেউয়ের গর্জন এখন তাদের পায়ের শব্দ ঢেকে দেবে, কারও কানে পৌঁছবে না।
চলো, জলদি চলল, তাড়া দিল মুসা। গুহায় ঢুকি। দেখি গিয়ে সিনেমা কেমন পছন্দ ড্রাগনের।
যদি সে বাড়িতে থেকে থাকে, কিশোর যোগ করল।
না থাকলেই আমি খুশি, রবিন বলল। আমার আকর্ষণ ওই সুড়ঙ্গ।
গুহার কাছে এসে গতি কমাল দুই সহকারী গোয়েন্দা। কিন্তু তাদেরকে অবাক করে দিয়ে এগিয়েই চলল কিশোর।
এই, কিশোর, এটাই তো, রবিন বলল।
নীরবে ঘাড় নেড়ে সায় দিল কিশোর। ইঙ্গিতে দেখাল ঠেলে বেরিয়ে থাকা চূড়াটা। ওপাশে রয়েছে বড় গুহাটার মুখ। চলো, দেখি, খুঁজে বের করতে পারি কিনা।
চূড়ার নিচে এসে থামল ওরা। মাথার ওপরে তিনটে বিশাল পাথরের চাঙড় চূড়ার গায়ে গা ঘেঁষাঘেঁষি করে রয়েছে।
বোধহয় ওগুলো নকল, আনমনে বলল কিশোর। মুসা, নাগাল পাবে তুমি। চাপড় দিয়ে দেখো তো। মনে হয় এর নিচেই দরজা, লুকিয়ে রাখা হয়েছে।
এগিয়ে গিয়ে একটা পাথরে চাপড় দিল মুসা। ভোতা, ফাপা শব্দ। মুচকে হেসে বলল, ঠিকই বলেছ। পাথর নয়, নকল। সিনেমার স্টুডিওতে যেমন তৈরি করে, হালকা কাঠ, প্লাস্টার আর তার দিয়ে।
মাথা নেড়ে সায় জানিয়ে ঘুরে দাঁড়াল কিশোর। চলো, তোমাকে গুহায় রেখে আসি। তারপর আমি আর রবিন ঘুরতে বেরোব।
কী? চমকে উঠল মুসা। আমাকে একা…
আমাদের চেয়ে অনেক নিরাপদে থাকবে তুমি, ভরসা দিল কিশোর। এগোল প্রথম গুহামুখের দিকে। আমাদের কাজ অনেক বেশি বিপজ্জনক। গঁাট হয়ে বসে থাকবে চুপচাপ, সিনেমা দেখানোর জন্যে তৈরি হয়ে।
বিস্ময় গেল না মুসার। আশপাশে তাকাল। দেখাব কাকে? বাদুড় টাদুড় কোন কিছু…
জবাব না দিয়ে গুহায় ঢুকে পড়ল কিশোর। পেছনে রবিন। মুসাকেও ঢুকতে হলো।
ছোট গুহাটার সামনের তক্তা সরিয়ে ফেলল কিশোর। সাবধানে ঢুকল ভেতরে। অনুসরণ করল সহকারীরা। তক্তাটা আবার আগের জায়গায় লাগিয়ে রাখল সে।
নরম শিস দিয়ে উঠল কিশোর। এই যে, আমাদের জিনিসপত্র, যেগুলো ফেলে গিয়েছিলাম। থাক, যাওয়ার সময় নেব। রবিন, দেখো তো পাথরটা আবার খুলতে পারো কিনা।
এগিয়ে গিয়ে ঝুঁকে বসল রবিন। সামান্য চেষ্টার পরেই আনন্দে চেঁচিয়ে উঠল, পেরেছি।
ঘড়ঘড় করে ঘুরে গেল পাথরের দরজা, ওপাশে ঢোকার পথ মুক্ত।
মুসা, কিশোর বলল, এখানেই থাকো। এই ফাঁক দিয়ে প্রোজেকটরের মুখ বের করে গুহার দেয়ালে ছবি ফেলবে। ফাঁকে পাথর আটকে দিচ্ছি, পুরোপুরি আর বন্ধ হবে না, দরজাটা। আমি সঙ্কেত দিলেই ছবি শুরু করবে।
পা ছড়িয়ে আরাম করে বসে প্রোজেকটর খুলতে শুরু করল মুসা। টর্চের আলোয় ফিল্মের ক্যানটা দেখল, সিধে করে নিয়ে মেশিনে ফিতে পরাতে পরাতে বলল, ঠিক আছে। সঙ্কেতটা কি?
ভেবে নিয়ে বলল কিশোর, বাঁচাও! বাঁচাও!
সতেরো
মুসাকে রেখে বিশাল গুহায় বেরিয়ে এল কিশোের আর রবিন। এগিয়ে চলল। বাতাস ভেজা ভেজা, ঠাণ্ডা, গায়ে কাঁটা দিল ওদের।
খানিকটা এগিয়ে বলে উঠল রবিন, আরি!
কি?
খোলা। আলো ফেলল সামনে। ধূসর ছড়ানো দেয়ালের মাঝে একটা ফোকর। কিংবা বলা যায় মস্ত এক ফাঁক, মেঝে থেকে ছাত পর্যন্ত।
রবিন, মনে হয় হারানো সুড়ঙ্গটা পাওয়া গেল।
খুব সাবধানে ফাঁক দিয়ে অন্যপাশে বেরিয়ে এল ওরা।
সুড়ঙ্গ এখানে আরও বেশি চওড়া, উচ্চতা বেশি। লম্বা হয়ে চলে গেছে সামনে। যতদূর দৃষ্টি চলে, কিছু নেই, তারপরে অন্ধকার।
আরও কিছুদূর এগিয়ে থমকে দাঁড়াল দু-জনে। ধড়াস করে উঠল বুকের মধ্যে। খাড়া হয়ে গেল ঘাড়ের রোম।
সুড়ঙ্গের আবছা অন্ধকারে হুমড়ি খেয়ে আছে বিরাট এক ছায়া, শান্ত, নিথর।
প্রায় ঝাঁপ দিয়ে মেঝেতে পড়ল ওরা। উপুড় হয়ে শুয়ে হাঁপাতে লাগল। জোরে নিঃশ্বাস ফেলতেও ভয় পাচ্ছে।
চুপ করে আছে তো আছেই। কিছুই ঘটল না।
ড্রাগনটা যেমনি ছিল তেমনি রয়েছে। লম্বা গলার ডগায় বসানো মাথাটা লুটিয়ে আছে মাটিতে।
ঘু-ঘুমোচ্ছে, ফিসফিস করে বলল রবিন।
মাথা নাড়ল কিশোর। কণ্ঠস্বর স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করছে। ভুলে যাও কেন, আসল না-ও হতে পারে।
সেটা তোমার ধারণা। হতেও পারে।
আরও কিছুক্ষণ চুপ করে রইল ওরা। তারপর টর্চ জ্বালল কিশোর। ধীরে ধীরে আলোকরশি এগিয়ে নিয়ে গেল ড্রাগনের দিকে। হঠাৎ হাসি ফুটল মুখে। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। ড্রাগনের নিচের দিকে দেখো, পায়ের জায়গায়, পুরোপুরি স্বাভাবিক হয়ে গেছে কণ্ঠস্বর।
চোখ মিটমিট করল রবিন। বিশ্বাস করতে পারছে না। লাইন! রেললাইনের মত!
উঠে বসল কিশোর। যা আন্দাজ করেছিলাম, ওটা বানানো ড্রাগন। এই লাইনই তৈরি করেছিল ডন কারটার। তবে একটা কথা ভুল। বলেছ, রবিন। বলেছ, ওটা কখনও ব্যবহার হয়নি।
ভুল কই বললাম?
ভুলই তো বলেছ। ড্রাগনটা ওই লাইন ব্যবহার করছে না?
করছে!
হ্যাঁ, করছে। এখনই বুঝতে পারবে। চলো, গিয়ে দেখি। তাড়াতাড়ি করতে হবে, ওরা চলে আসতে পারে।
কারা? জিজ্ঞেস করল রবিন।
জবাব দিল না কিশোর। হাঁটতে শুরু করেছে।
সুড়ঙ্গ জুড়ে পড়ে থাকা বিশাল আকৃতিটার কাছে এসে দাঁড়াল ওরা।
কুটি করল কিশোর, নাক দিয়ে বিচিত্র শব্দ করল।
কি হয়েছে? জানতে চাইল রবিন।
ঠিক বুঝতে পারছি না। বাইরের দিকে, মানে সৈকতের দিকে মুখ করে পড়ে আছে এটা। ধূসর দেয়ালটা খোলা, কিন্তু বাইরের পথ এখনও বন্ধ। কি মানে হয়?
ঠোঁট ওল্টাল রবিন। মাথা নাড়ল, একই সঙ্গে হাতও নাড়ল। সে-ও বুঝতে পারছে না।
মনে হয়, জবাবটা কিশোরই দিল, এটার ভেতরে যে বা যারা ছিল তারা বেরিয়ে চলে গেছে। ড্রাগনটাকে এমনভাবে ফেলে রেখে গেছে, যাতে কেউ ঢুকলেই দেখে ভয়ে পালায়।
চুপ করে রইল রবিন।
ড্রাগনের মুখে টর্চের আলো ফেলল কিশোর। চোখ নয়, খুদে হেডলাইট, মুভেবল।
আবার ড্রাগনের পাশে চলে এল দু-জনে। আঁশ আঁশ কালচে চামড়ায় কি একটা চোখে পড়ল কিশোরের, হাত বাড়িয়ে চেপে ধরল। দরজার হাতল। কিন্তু দরজাটা কই?
কিশোরের কাঁধের ওপর দিয়ে তাকাল রবিন। ওই যে আরেকটা হাতল, তার ওপরে আরেকটা।
ফিক করে হাসল কিশোর। আবার বোকা বানাল। দরজার হাতল নয় ওগুলো। পা-দানী। পা রেখে উঠে যাওয়ার জন্যে।
হাতলের সিঁড়ি বেয়ে উঠে যেতে শুরু করল সে। কিছুটা উঠে ফিরে তাকিয়ে রবিনকে ওঠার জন্যে ডাকল। পিঠের ওপরে উঠে রাস্তার ম্যানহোলের মত ঢাকনাটা দেখতে পেল।
আরি, একেবারে সাবমেরিনের হ্যাঁচ, অবাক কণ্ঠে বলল কিশোর। রবিন, থাকো এখানে, পাহারা দাও। আমি নিচে যাচ্ছি।
ঢোক গিলল রবিন, কিছু বলল না, মাথা কাত করল শুধু।
উবু হয়ে হ্যাঁচের হাতল ধরে জোরে টান দিল কিশোর। উঠে গেল ঢাকনা। সিঁড়ি বেয়ে ভেতরে নামল কিশোর।
অপেক্ষা করে আছে রবিন। খানিক পরেই সাড়া এল ভেতর থেকে। থাবা দেয়া হচ্ছে খোলসে। তারমানে ড্রাগনের পেটে ঢুকে গেছে গোয়েন্দাপ্রধান।
ভয় পাচ্ছে রবিন, অস্বস্তিতে বার বার তাকাচ্ছে এদিক-ওদিক। অন্ধকারে লম্বা সুড়ঙ্গে বেশিদূর এগোচ্ছে না টর্চের আলো। সুড়ঙ্গের দেয়াল কংক্রিটে তৈরি, ছাতে ইস্পাতের কড়িবরগা।
এতই অন্যমনস্ক ছিল রবিন, হ্যাঁচ খোলার শব্দে চমকে উঠল। চেয়ে দেখল, মাথা বের করেছে কিশোর। ডাকল, এসো, দেখে যাও।
সিঁড়ি বেয়ে ভেতরে নামল রবিন।
টর্চ জ্বেলে আলো ফেলল। চমৎকার, তাই না? বাইরে থেকে মনে হয় জ্যান্ত ড্রাগন। চলে রেলের ওপর দিয়ে। এই যে দেখো, পেরিস্কোপ। আর এটা, পোর্টহোল। আসলে, রবিন, এটা একটা সাবমেরিন। অদ্ভুত সাবমেরিন।
ভেতরের দিকে বাঁকা, মসৃণ দেয়ালে হাত বোলাল রবিন। কি দিয়ে বানিয়েছে?
সাধারণত লোহা আর ইস্পাত দিয়েই সাবমেরিন বানানো হয়। তবে এটা অন্য কিছু দিয়ে তৈরি। দেখি তো, ইঞ্জিনরুমটা কেমন?
সরু গলিপথ ধরে মাথার দিকে এগোেল দু-জনে।
এক জায়গায় এসে চেঁচিয়ে উঠল রবিন, গীয়ারশিফট, ড্যাশবোর্ড, ব্রেক, প্যাডাল! কি ধরনের সাবমেরিন এটা? এক্কেবারে তো গাড়ি।
আঙুল মটকাল কিশোর। সবচেয়ে প্রথম যে সাবমেরিনটা তৈরি হয়েছিল, তার কথা বইয়ে পড়েছি। সাগরের তলার মাটি দিয়ে গাড়ির মত চাকায় গড়িয়ে চলত ওটা। গাড়ির মতই জানালা ছিল, কাঁচে ঢাকা, যাতে তার ভেতর দিয়ে বাইরে দেখতে পারে দর্শকরা। ভেতরে বিশেষ এয়ার কম্পার্টমেন্টের ব্যবস্থা ছিল, বাইরের পানির চাপ থেকে সাবমেরিনকে রক্ষা করার জন্যে। মনে হয় ওই আইডিয়াটাই কাজে লাগিয়েছে এই ড্রাগনের ইঞ্জিনিয়াররা। অনেকটা ওই রোজ বাউল ফ্লোটসের মত ব্যাপার। গাড়ির চ্যাসিসকে ফুল দিয়ে ঢেকে সাজানো হয়, জানো হয়তো। ভেতরে বসে থাকে ড্রাইভার, লুকিয়ে, তাকে। দেখতে পায় না কেউ। লো গীয়ারে গাড়ি চালায়।
এই ড্রাগনটাকেও অনেকটা ওভাবেই চালানো হয়, উত্তেজিত হয়ে উঠেছে রবিন। দেখে মনে হয় বালির ওপর দিয়ে ভেসে আসে, চাকা চোখে পড়ে না বলে। মিস্টার ক্রিস্টোফারের ওখানে যে সিনেমাটা দেখেছি, তাতে ড্রাগন কিন্তু অন্য রকমভাবে হাঁটে। দুলে দুলে, পায়ের পর পা ফেলে।
ওই ড্রাগন অন্য রকমভাবে বানানো হয়, যাতে পর্দায় আসল ড্রাগনের মত লাগে। কিন্তু এটা বানানো হয়েছে মানুষকে ভয় দেখিয়ে দূরে সরানোর জন্যে।
কেন? প্রশ্নটা করতে গিয়েও থেমে গেল রবিন। বিচিত্র একটা। গোঙানি শোনা গেল, টানা টানা।
চমকে গেল দু-জনেই।
কি-ক্কী? কণ্ঠস্বর খাদে নেমে গেল রবিনের।
ওখান থেকে আসছে, লেজের দিকে দেখাল কিশোর।
চলো, পালাই। জেগে উঠছে সাবমেরিন। পানিতে গিয়ে ডুব দিলে মরেছি। অটোপাইলটে চলে মনে হয়।
আবার শোনা গেল গোঙানি, কেমন যেন বিষণ্ণ, গা-শিরশির করা শব্দ।
কেঁপে উঠল রবিন। আমার একদম ভাল্লাগছে না!
কিন্তু তাকে বিস্মিত করে দিয়ে সরু গলিপথ ধরে ড্রাগনের লেজের দিকে ছুটে গেল কিশোর।
আবার গোঙানি শোনা গেল।
মেঝের দিকে ঝুঁকল কিশোর। কিছু বোঝার চেষ্টা করছে।
কাছে চলে এল রবিন। কী?
জবাব দিল না কিশোর। টর্চের আলো ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেয়াল পরীক্ষা করতে লাগল। তারপর রবিনকে আরেকবার অবাক করে দিয়ে হাসল। আরও একটা রহস্যের কিনারা হলো।
কিনারা?
শুনছ না? রবিনের কথার জবাব দিল না কিশোর।
কান পেতেই আছে রবিন। শুনছি তো। কিন্তু মোটেই ভাল্লাগছে না আমার।
ভয় পেয়েছ বলে লাগছে না। এসো, দেখো, ভয় কাটবে, হাসতে হাসতেই হাতল টেনে ছোট একটা দরজা খুলে ফেলল কিশোর। আলো ফেলল ভেতরে। জোরাল হলো গোঙানি।
কুকুরের গলা মনে হচ্ছে না? বকের মত গলা বাড়িয়ে দরজার ওপাশে তাকাল রবিন। আরে, কুকুরই তো! এক আলমারি ভরতি!
এবার বুঝলে তো? কুকুর-হারানো রহস্যের সমাধান হলো।
ঘটনাটা কি? দেখে মনে হচ্ছে নড়াচড়ার ইচ্ছে নেই বিশেষ। কুকুরের এত ঘুম?
ইচ্ছে করে ঘুমাচ্ছে না। ঘুমের ওষুধ খাওয়ানো হয়েছে।
ওষুধ? কেন?
জেগে থাকলে হয়তো কারও অসুবিধে হয়। কুকুরগুলোকে শান্তও রাখতে চায় সেই লোক, আবার ক্ষতি হোক এটাও চায় না। সেজন্যেই মারেনি, ধরে এনে আটকে রেখেছে।
আবার গুঙিয়ে উঠল একটা কুকুর, ঘুমঘুম চোখে তাকাল। খানিক আগেও এটাই গুঙিয়েছে, স্বর শুনেই বোঝা যায়।
আইরিশ সেটার! চেঁচিয়ে উঠল রবিন। মিস্টার জোনসেরটা না তো?
কুকুরটার দিকে চেয়ে ডাকল কিশোর, পাইরেট, আয়।
লালচে রোমশ কুকুরটা শরীর টানটান করল, হাই তুলল, আড়মোড়া ভাঙল, তারপর উঠে দাঁড়িয়ে শরীর ঝাড়া দিল আলস্য তাড়ানোর ভঙ্গিতে। লটপট করে উঠল লম্বা লম্বা কান।
আয়, পাইরেট, আবার ডাকল কিশোর। আয়। হাত বাড়িয়ে দিল।
হাত শুঁকল কুকুরটা। লেজ নাড়তে শুরু করল। লাফিয়ে নেমে এল আলমারির তাক থেকে। টলছে মাতালের মত। সামলে নিতে সময় নিল। কিশোরের পায়ে গা ঘষছে, কুঁই-কুঁই আওয়াজ বেরোচ্ছে নাক দিয়ে।
দারুণ কুকুর, মাথা চাপড়ে দিতে দিতে বলল কিশোর। খুব। ভাল।
মিস্টার জোনসও তাই বলেছেন অবশ্য। হাত বাড়াল রবিন। কুকুরটা চলে এল তার কাছে, পায়ে গা ঘষতে লাগল।
আরে, যে ডাকে তার কাছেই তো যায়।
বাড়ি যাবি? কুকুরটাকে বলল কিশোর।
কি বুঝল পাইরেট কে জানে, ঘেউ ঘেউ শুরু করল। তার ডাকে আস্তে আস্তে চোখ মেলল অন্য কুকুরগুলোও। শুরু হলো নানারকম বিচিত্র মিশ্র শব্দ। কেউ কেউ নেমে এসে কুকুরের কায়দায় স্বাগত জানাল দুই গোয়েন্দাকে।
ছয়টা, গুনল রবিন। হারানো সবগুলোই এক জায়গায়।
মাথা ঝাঁকাল কিশোর। প্রতিটি কুকুরের গলার কলারে আটকে দিল এক টুকরো লেখা কাগজ।
কি? জিজ্ঞেস করল রবিন।
মেসেজ। কুকুরের মালিকেরা জানবে, কে, কিভাবে বের করেছে। এগুলোকে। বিজ্ঞাপন হবে আমাদের সংস্থার।
গোঁ গোঁ করে উঠল পাইরেট।
ঝুঁকে তার গলা চাপড়ে আদর করে বলল কিশোর, ও-কে ও-কে, তুইই আগে যাবি।
কোলে করে কুকুরটাকে তুলে নিয়ে এল হ্যাঁচের বাইরে। যা, দৌড় দে, সোজা বাড়ি।
আনন্দে আরেকবার কো কো করল পাইরেট, লাফ দিয়ে মাটিতে নেমে দৌড় দিল দেয়ালের ফাঁকের দিকে।
নিচ থেকে এক এক করে কুকুরগুলোকে তুলে দিল রবিন, ওপর থেকে ধরল কিশোর। ভোলা বাতাসে ওষুধের ক্রিয়া পুরোপুরি কেটে গেছে কুকুরগুলোর, তরতাজা হয়ে উঠেছে। আইরিশ সেটারটার পেছনে ছুটল সব কটা।
কাপড়ে হাত মুছতে মুছতে বলল রবিন, মুসা শুনলে খুব অবাক হবে। তো, আমরা আর এখানে থেকে কি করব? কাজ তো শেষ। চলো, যাই।
এখন যাওয়া যাবে না।
কেন?
সুড়ঙ্গের ভেতরে কিছু নড়ল দেখলাম। আসছে কেউ।
হায় হায়! গেলাম তো আটকে। লুকাই কোথায়?
সাবমেরিনের ভেতরে এসে ঢুকল আবার দু-জনে। রবিনকে নিয়ে আলমারিটার কাছে চলে এল কিশোর, যেটাতে কুকুর রাখা হয়েছিল। টান দিয়ে খুলল আলমারির দরজা।
আঠারো
ঠাণ্ডা বেশি নয়, তবু ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে মুসার হাত। তালুতে তালু ঘষে গরম রাখার চেষ্টা করছে। জায়গামত বসিয়ে ফেলেছে প্রোজেকটর। সুইচ টিপলেই ছবি শুরু হবে এখন।
শেষবারের মত আরেকবার সবকিছু চেক করে নিল সে, দেখল ঠিকঠাক আছে কিনা। তারপর দেয়ালে হেলান দিয়ে পা লম্বা করে বসে। রইল চুপচাপ। সঙ্কেত শুনলেই চালু করে দেবে মেশিন।
শব্দ শুনল, তবে সঙ্কেত নয়। তাছাড়া সামনের দিক থেকেও নয়, পেছন থেকে আসছে খসখস শব্দটা।
স্থির হয়ে গেল সে। ভুল শোনেনি তো? না, আবার শোনা গেল।
ছোট্ট গুহার বাইরে এসে দাঁড়িয়েছে কেউ। প্রবেশ মুখের তক্তার নিচের বালি সরাচ্ছে।
নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরল মুসা। কি করবে? উঠে দৌড়ে বেরিয়ে যাবে বড় গুহায়? কিশোর আর রবিনের কাছে? কিন্তু তাহলে তো সব পণ্ড হবে। জায়গা ছেড়ে নড়তে মানা করে দিয়ে গেছে কিশোর। তার কথা অমান্য করলে আবার না আরও বড় বিপদে পড়ে। এসব ব্যাপারে অতীত অভিজ্ঞতা আছে মুসার। কিশোর পাশার নির্দেশ না মেনে অনেক বড় বিপদে পড়েছে।
সরে যাচ্ছে তক্তা। দ্রুত চিন্তা চলছে তার মাথায়। যা করার জলদি করতে হবে। কিছু একটা অস্ত্রের জন্যে মেঝে হাতড়াল অহেতুক। এই সময় খেয়াল হলো, টর্চটা জ্বলছে।
তাড়াতাড়ি নিভাল ওটা। গাঢ় অন্ধকার গ্রাস করে নিল তাকে। কিন্তু এই অন্ধকার কতক্ষণ আচ্ছাদন দেবে? লোকটার হাতেও তো আলো থাকতে পারে।
বেশি ভাবার সময় পেল না মুসা। দেয়াল ঘেঁষে লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ল।
সরে গেল তক্তা। আবছা আলোর পটভূমিকায় মূর্তিটাকে দেখতে পেল সে। এত মোটা মানুষ, সরু ফাঁক দিয়ে সামনাসামনি ঢুকতে পারবেন না, পাশ ফিরে আসতে হবে। আকার দেখেই তাকে চিনতে পারল। বদমেজাজী হেরিঙ! হাতে শটগান।
গুহার দেয়াল নিচু। মাথা ঠেকে যায়। নুয়ে নুয়ে এগোতে হলো হেরিঙকে। দুই পা এগিয়েই থমকে দাঁড়ালেন। কান পেতে কিছু শুনছেন মনে হলো।
শব্দ মুসাও শুনতে পাচ্ছে। কুকুরের ঘেউ ঘেউ। শিকারী কুত্তা ছেড়ে দেয়া হয়েছে? প্রমাদ গণল সে। মিশে যেতে চাইল দেয়ালের সঙ্গে। কিন্তু খুব একটা লাভ হবে বলে মনে হলো না তার। চোখ নাহয় এড়াতে পারল, কিন্তু গন্ধ?
তীব্র গতিতে ছুটে এল ওগুলো। পাথরের দরজার পাল্লা ফাঁক করে রেখে গেছে কিশোর। সেদিক দিয়ে স্রোতের পানির তোড়ের মত ঢুকল একটার পর একটা।
কিন্তু মুসাকে আক্রমণ করতে এল না ওগুলো। ছুটে গেল গুহামুখের দিকে। গিয়ে পড়ল একেবারে হেরিঙের গায়ে। আঁউ করে উঠলেন তিনি। পড়ে গেলেন মাটিতে।
ঢোক গিলল মুসা। ড্রাগনের ভয় করছিল সে, কিন্তু কুকুর আশা। করেনি। মিস্টার হেরিঙকে বাঁচাতে হলে কিছু একটা করা দরকার। নইলে ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে ফেলবে কুত্তার দল। আর কিছু না পেয়ে হাতের টর্চটাই উঁচু করে ধরল বাড়ি মারার জন্যে।
উনিশ
কিশোর আর রবিনও পড়েছে বেকায়দায়। আলমারিতে বসে দরজায় কান পেতে শুনছে।
ইস, কত কাজ যে করলাম, তিক্ত কণ্ঠ শোনা গেল একজনের। এসব লাইন-টাইন পরিষ্কার–তারপর কি খোঁড়াটাই না খুঁড়লাম।
খামোক কষ্ট করোনি, নিক, জবাবে বলল আরেকজন। বিফলে যাবে না। পুরস্কার শিগগিরই পাবে।
তা ঠিক। কিন্তু, জো, লোকটা খুব হারামী। বিশ্বাস করা যায়?
হেসে উঠল নিক। ও একলা, আর আমরা দুজন। নৌকাটাও আমাদের। গিয়ে দেখো, ও-ও হয়তো ভাবছে আমাদের বিশ্বাস করা যায় কিনা।
মই বেয়ে লোক নেমে আসার শব্দ শোনা গেল। সরু গলিপথে পদশব্দ।
জীবন্ত হলো ইঞ্জিন। কেঁপে উঠল সাবমেরিন, একবার ধাক্কা দিয়েই মসৃণ গতিতে চলতে শুরু করল লাইনের ওপর দিয়ে।
অন্ধকারে কিশোরের হাঁটুতে হাত রাখল রবিন। ফিসফিসিয়ে বলল, দুই ডাইভার না তো? সাগরে নামতে যাচ্ছে নাকি?
মনে হয় না। ডুবিয়ে রাখার মত ভার তোলা হয়নি সাবমেরিনে। পানিতে নামার আগে ভার বোঝাই করে নিতে হবে।
না নামলেই বাঁচি, মুখ দিয়ে বাতাস ছাড়ল রবিন।
পেছনে চলেছি। সুড়ঙ্গের গভীরে।
বুঝতে পারছি। কিন্তু কেন যাচ্ছে? কি করবে?
জানতে পারলে ভাল হত। তবে যা-ই করুক, ব্যাপারটা গোলমেলে।
হঠাৎ আবার ঝাঁকুনি খেয়ে দাঁড়িয়ে গেল ড্রাগন। পেছনে ধাক্কা খেল কিশোর আর রবিন।
ড্রাইভার ফিরে এল মইয়ের কাছে। চলো, নিক। মাল বোঝাই করার সময় সাবধান থেকো।
ব্যাটা কোনরকম চালাকি করবে না তো? অস্বস্তি যাচ্ছে না জো-র। করলে কিন্তু বিপদে পড়বে সে। ওই ইট দিয়েই মাথায় বাড়ি মেরে বসব।
মেরো। চালাকি করলে আমিও ছাড়ব না। দুই কোটি ডলারের মামলা, সোজা কথা?
অন্ধকারের দিকে শূন্য চোখে তাকিয়ে রয়েছে দুই গোয়েন্দা। দুই কোটি ডলার? ঠিক শুনছে তো?
মই বেয়ে ওঠার শব্দ হলো। হ্যাঁচ উঠল..নামল…দুই বার। দু জনেই বেরিয়ে গেছে।
রবিনের কাঁধে হাত রাখল কিশোর। বেরোও।
সাবধানে দরজা খুলে বেরিয়ে এল ওরা। কয়েক পা এগিয়েই থমকে দাঁড়াল। বাইরে কথা বলে উঠেছে কেউ, খসখসে কণ্ঠ, কথার মাঝে মাঝে কাশছে।
জলদি করো, বলল সে। গার্ডকে ঠাণ্ডা করে দিয়েছি। কয়েক ঘণ্টা ঘুমিয়ে থাকবে। ও জাগার আগেই সরিয়ে নিতে হবে ইটগুলো।
কনুই দিয়ে কিশোরের গায়ে গুতো দিল রবিন। রোভার মারটিনের গলা চিনতে পেরেছে। তোমার অনুমান ঠিকই ছিল।
ড্রাগনের কাশি রহস্যেরও সমাধান হলো। বাকি রইল আর একটা রহস্য।
ওরা কি করছে এখানে, সেটা তো?
না। বার বার ইটের কথা বলছে। কিসের ইট?
রবিনের পিঠে ঠেলা দিয়ে চলার নির্দেশ দিল কিশোর। ম্লান আলোয় আলোকিত গলি ধরে এসে আস্তে করে বাইরে মাথা বের করল সে।
হাঁ হয়ে গেল দেখে। ড্রাগনের পাশেই কংক্রিটের দেয়াল। মস্ত একটা গর্ত করা হয়েছে ওতে, একজন মানুষ হেঁটে ঢুকে যেতে পারবে ওতে, এতটাই বড়। হাতে পাঁজাকোলা করে কি যেন নিয়ে গর্তের মুখে দেখা দিল একজন লোক, ভারের চোটে পেছনে বাঁকা হয়ে গেছে।
উফ, ভারিও! বলল লোকটা। এক টন হবে।
তুমি কি ভেবেছিলে, শোলার মত পাতলা? বললেন মারটিন। এতই যদি সহজ হবে, তোমাদের ভাড়া করতে যাব কেন?
আমি সে কথা বলছি না। বলছি, বেজায় ভারি।
তা ঠিক। একেকটা ইট সত্তর পাউণ্ড। বাইরে সারি দিয়ে রাখো। পরে ঢোকাবে।
বোঝা নামিয়ে রেখে আবার গর্তের দিকে চলল লোকটা। সে ঢোকার আগেই বেরোল তার সঙ্গী। পাঁজাকোলা করে ইট নিয়ে এসেছে। হাঁপাচ্ছে। ওই অবস্থায়ই হেসে বলল, সাংঘাতিক ভারি, হে, জো।
মারটিনের নির্দেশ মত সে-ও বোঝা নামাল ড্রাগনের পাশে। আরও আনতে ফিরে চলল।
নিঃশব্দে হ্যাঁচ নামিয়ে নেমে এল কিশোর।
একেকটা ইট সত্তর পাউণ্ড, রবিনকে শুনিয়ে শুনিয়ে হিসেব শুরু করল সে। নিক আর জো বলল, দুই কোটি ডলার। কিসের ইট বোঝাই যাচ্ছে। স্বর্ণ।
স্বর্ণ! জোর করেও কণ্ঠস্বর খাদে রাখতে পারল না রবিন। আনছে কোত্থেকে?
সরকারী হঁট, বর্তমানে সবচেয়ে বড় স্ট্যাণ্ডার্ড, সত্তর পাউণ্ড। ব্যাটারা ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক লুট করছে।
নরম সুরে শিস দিয়ে উঠল রবিন।
চুপ! তার মুখ চেপে ধরল কিশোর। শুনে ফেলবে।
কিশোরের হাত সরিয়ে ফিসফিস করে বলল রবিন, চলো, পালাই। দেখলে আমাদের ছাড়বে না ডাকাতেরা, খুন করে ফেলবে।
কিন্তু পালাই কি করে? প্রশ্নটা নিজেকেই করল কিশোর। বেরোতে গেলেই মারটিনের চোখে পড়ব।
সামনের দিকে রওনা হলো কিশোর। রবিন ভাবল, নতুন কোন গুপ্তস্থানের সন্ধান করছে গোয়েন্দাপ্রধান, যেখানে নিরাপদে লুকিয়ে থাকা যায়।
হঠাৎ দাঁড়িয়ে গেল কিশোর। গায়ের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ল। রবিন। কথা বলে উঠল, সরি…
তাড়াতাড়ি তার মুখ চেপে ধরল কিশোর, ফিসফিস করে বলল, তুমি দেখছি ধরা পড়িয়েই ছাড়বে! উত্তেজনায় চকচক করছে তার চোখ। ইগনিশান কী রেখে গেছে!
মানে-তুমি, মানে ড্রাইভ করবে? চালাবে এটাকে? গাড়ি তো চালাতে জানে না। তাছাড়া জানালাও নেই। তাকাবে কোনখান দিয়ে?
দেখি কি করতে পারি। লাইনের ওপর দিয়ে চলবে যখন, দেখার দরকার হবে না বোধহয়। আর গাড়ি চালাতে জানি না বটে, কি করে চালাতে হয় তা তো জানি। ক্লাচ, ব্রেক, অ্যাকসিলারেটর, গীয়ারশিফট, সবই গাড়ির মত।
ছোট ড্রাইভিং সীটে বসল কিশোর। মোচড় দিল চাবিতে।
গর্জে উঠল ইঞ্জিন।
কিন্তু পুরোপুরি চালু হওয়ার আগেই ছোট্ট কয়েকটা কাশি দিয়ে থেমে গেল।
মারটিন না, কিশোর, চেঁচিয়ে উঠল রবিন, উত্তেজনায় আস্তে কথা বলার কথা ভুলে গেছে আবার, মারটিন, কাশেনি! ইঞ্জিনের কাশিই শুনেছি আমরা।
নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরেছে কিশোর। রবিনের কথার জবাব না দিয়ে মরিয়া হয়ে আবার মোচড় দিল চাবিতে। ধরেই রাখল।
আবার ইঞ্জিন চালু হলো। বন্ধ হলো না।
স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে গীয়ার দিল কিশোর, আস্তে করে পা সরিয়ে আনুল ক্লাচ প্যাডাল থেকে।
ঝাঁকুনি দিয়ে এগিয়ে হোঁচট খেয়ে যেন থেমে গেল গাড়ি। কাশি দিয়ে বন্ধ হলো ইঞ্জিন।
ইস্, ক্লাচটা ডোবাল, বলেই আবার ইগনিশনে মোচড় দিতে গেল কিশোর। ঠিক এই সময় হ্যাঁচ খোলার শব্দ হলো।
সর্বনাশ! বড় বড় হয়ে গেছে রবিনের চোখ। হ্যাচ খোলা!
হ্যাঁ, ভুলই হয়ে গেল! ভয় ফুটেছে গোয়েন্দাপ্রধানের চোখেও। হ্যাচ আটকে নেয়া উচিত ছিল!
.
মুসা কাঁপছে। কাঁপছে তার হাতে টর্চ। এই সামান্য টর্চের বাড়ি মেরে কি ওই ভয়ানক কুকুর ঠেকাতে পারবে? হেরিঙ করছেনটা কি? তার হাতে তো শটগান রয়েছে। গুলি করছেন না কেন?
হঠাৎ বুঝতে পারল ব্যাপারটা। আক্রমণ করেনি কুকুরগুলো, তাড়াহুড়ো করে বাইরে বেরোতে চাইছে। ফলে পথ যেটা ভোলা পেয়েছে সেই পথেই ছুটে গেছে হুড়মুড় করে। অন্ধের মত ছুটতে গিয়েই হেরিঙের গায়ের ওপর পড়েছিল, ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েছে তাকে।
ব্যাপার কি? নড়ছে না কেন?
সাহস খানিকটা ফিরে পেয়েছে মুসা। পায়ে পায়ে এগোল। হেরিঙের গায়ে হাত দিয়ে দেখল। নড়ছেন না। শ্বাস-প্রশ্বাস ঠিকই বইছে। নিশ্চয় পড়ে গিয়ে পাথরে বাড়ি খেয়েছে মাথা, বেহুশ হয়ে। গেছেন।
পালাতে চাইলে এই সুযোগ। হেরিঙের হুঁশ ফিরলে আর পারবে বা।
দ্রুত ফিরে এসে প্রোজেকটরটা তুলে নিল মুসা। পাথরের দরজা ঠেলে ফাঁক করে বেরিয়ে এল বড় গুহায়। ফাঁক করার জন্যে গোজ লাগানোর ছোট পাথরটা সরাতে হয়েছে। সেটা আর লাগানোর সময় পেল না। এক হাতে প্রোজেকটর-ওটার ভারেই হিমশিম খাচ্ছে; ফলে অন্য আরেক হাতে দরজাটা ধরেও রাখতে পারল না। জোর পেল না। ছুটে গেল হাত থেকে। বন্ধ হয়ে গেল আপনাআপনি।
যা হয় হোকগে। বাঁচলে পরে খোলার চেষ্টা করতে পারবে। আগে কিশোর আর রবিনকে খুঁজে বের করা দরকার।
ধূসর দেয়ালের দিকে এগোল মুসা। ফাঁক দেখল। কোন রকম ভাবনা চিন্তা না করেই ঢুকে পড়ল ভেতরে। অদ্ভুত একটা শব্দ হতেই ঝট করে পেছনে ফিরে তাকাল। ক্ষণিকের জন্যে থেমে গেল যেন হৃৎপিণ্ড। পাক দিয়ে উঠল পেটের মধ্যে।
পেছনে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে দরজার ফাঁক!
বিচিত্র শব্দ হলো এবার সামনে। ফিরে চেয়েই আরেকটা ধাক্কা খেল মুসা। সামনে লম্বা সুড়ঙ্গ, অন্ধকারে আবছামত দেখা যাচ্ছে মস্ত একটা অবয়ব। চেনে ওটাকে। হলুদ দুই চোখে উজ্জ্বল আলো। হাঁ করা মুখ। গর্জে উঠল ড্রাগন।
টর্চ নিভিয়ে নিজের অজান্তেই পিছিয়ে এল মুসা। পিঠ ঠেকল দেয়ালে। আর পিছানোর জায়গা নেই।
পাশে সরতে শুরু করল সে। চলে এল একটা অন্ধকার কোণে। ভারি প্রোজেকটরটা সামনে তুলে ধরেছে অনেকটা বর্মের মত করে।
অদ্ভুত কাণ্ড করছে ড্রাগনটা। লাফিয়ে লাফিয়ে এগোচ্ছে। খানিকটা এগিয়েই থেমে যাচ্ছে, খানিক পরই গর্জে উঠে আরও খানিকটা এগোচ্ছে। এইই করছে বার বার। কিশোর আর রবিনের চিহ্ন নেই। জোরে ঠোঁট কামড়ে ধরেছে সে, চাপা একটা গোঙানি বেরোল গলা দিয়ে।
নিশ্চয় তার দুই বন্ধুকে গিলে ফেলেছে ওটা। ওরা এখন দানবের পেটে হজম হচ্ছে। ওদেরকে বাঁচানোর আর কোন উপায় নেই। সে নিজে এখন বাঁচতে পারবে কিনা, সেটাই সন্দেহ।
বিশ
খোলা হ্যাঁচ দিয়ে ভেসে এল রোভার মারটিনের চিৎকার, বেরোও! কে ওখানে, বেরিয়ে এসো! যদি ভাল চাও তো বেরোও!
কিশোরের দিকে তাকাল রবিন।
মাথা নাড়ল কিশোর। ঠোঁটে ঠোঁট চেপে বসেছে, দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ। আঙুলগুলো দ্রুত নড়ছে কন্ট্রোল প্যানেলের ওপর। এটাই বাঁচার একমাত্র উপায়, ড্রাগনটাকে চালিয়ে নেয়া।
আবার চালু হলো ইঞ্জিন। ঝাঁকুনি দিয়ে আগে বাড়ল ড্রাগন। হঠাৎ কি জানি কি হলো, ছেড়ে দেয়া স্প্রিঙের মত লাফিয়ে উঠল লম্বা গলাটা।
কিশোর! দেখো দেখো! চেঁচিয়ে বলল রবিন। নিশ্চয় কোন বোতামে চাপ লেগেছে। কিভাবে সোজা হলো দেখলে? ওই যে একটা জানালা, বাইরে দেখা যায়।
মাথা ঝাঁকিয়ে সায় জানিয়ে গ্যাস প্যাডাল চেপে ধরল কিশোর, যতখানি যায়। আগের মতই কিছুদূর এগিয়ে কাশি দিয়ে থেমে গেল ইঞ্জিন। শোনা গেল মারটিনের চিত্তার।
খটাং করে হ্যাঁচ বন্ধ হলো, খোলস বেয়ে কি যেন গড়িয়ে ধুপ করে, পড়ল মাটিতে। যেন ময়দার বস্তা পড়ল।
মারটিন পড়েছে, রবিন বলল। ঝাঁকুনি সামলাতে পারেনি। চালাও, চালাও।
চেষ্টা তো করছি। পারছি না। কিছু একটা গোলমাল আছে, খালি থেমে যায়।
চাবি ঘোরাতেই আবার চালু হলো ইঞ্জিন। ইঞ্জিনের শব্দ ছাপিয়ে শোনা গেল মারটিনের চেঁচামেচি, সাহায্যের জন্যে ডাকছেন নিক আর জোকে।
পেছন দিকে পোর্টহোলের কাছে ছুটে গেল রবিন, কাঁচে নাক চেপে ধরে বাইরে তাকাল। কিশোর, ব্যাটারা আসছে। জলদি কিছু করো। পাগলা কুত্তা হয়ে গেছে ওরা।
গীয়ার দিয়ে ক্লাচ ছাড়তেই লাফ দিয়ে আগে বাড়ল ড্রাগন। অ্যাকসিলারেটরের ওপর প্রায় দাঁড়িয়ে গেল কিশোর, এত জোরে চাপ দিচ্ছে।
ভীষণ ঝাঁকুনি দিয়ে আবার থেমে গেল ড্রাগন, ইঞ্জিন স্তব্ধ।
দাঁতে দাঁত চেপে আবার চালু করল কিশোর। আগে বাড়ল ড্রাগন, আবার থেমে গেল।
এভাবেই চালিয়ে যাও, বলল রবিন। থেমো না।
চালু হলো ইঞ্জিন।
ওরা কদ্দূর? চেঁচিয়ে জিজ্ঞেস করল কিশোর।
ধরে ফেলল। চালাও।
প্রাণপণে ছুটছে দুই ডাকাত, তাদের পেছনে চেঁচামেচি করছেন। আর হাত-পা ছুঁড়ছেন মারটিন।
কয়েক ফুট এগিয়ে থেমে গেল ড্রাগন।
গতি আরও বাড়াল দুই ডাকাত।
ফ্যাকাসে হয়ে গেল রবিন। দেখছে, ড্রাগনের লেজ প্রায় ধরে ফেলেছে ওরা!…ধরল। চেপে ধরে টান দিল পেছনে। দু-জনের গায়েই মোষের জোর। ইঞ্জিন বন্ধ থাকলে টেনেই পিছিয়ে নিয়ে যাবে সাবমেরিনটাকে।
ধরে ফেলেছে! চেঁচিয়ে উঠল রবিন।
প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই আগে বাড়ল ড্রাগন। সেই একই ব্যাপার। কয়েক ফুট গিয়েই ঝাঁকি দিয়ে থেমে গেল।
নাহ্, হবে না। কুটি করল কিশোর। কপালের ঘাম মোছারও অবকাশ নেই। এখন আর ইঞ্জিনই স্টার্ট নিচ্ছে না।
নিলেও আর লাভ নেই, হতাশ ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল রবিন। ধরে ফেলেছে।
লেজ চেপে ধরে গায়ের জোরে টানছে দুই ডাকাত, টানের চোটে পেছনে হেলে পড়েছে দু-জনের শরীর। বুঝতে পারল, টানার দরকার নেই, ইঞ্জিন স্টার্ট নিচ্ছে না। লেজ ছেড়ে দিয়ে দৌড়ে এল একজন। পা-দানী ধরে ফেলল। দেখতে দেখতে উঠে চলে এল হ্যাঁচের কাছে, টান দিয়ে খুলে ফেলল ঢাকনা।
ধরে তো ফেলল, কিশোর! কাঁদো কাঁদো হয়ে গেছে রবিন। কি করি এখন?
কি আর করার আছে? সীট থেকে উঠে সরু গলিপথ ধরে এগিয়ে এল কিশোর। আত্মসমর্পণ করব। তাহলে হয়তো আর কিছু বলবে না, কিন্তু কথাটা নিজেই বিশ্বাস করল না সে।
মই বেয়ে উঠে বাইরে হাত বের করে নাড়ল কিশোর। মিস্টার মারটিন, আমরা বেরিয়ে আসছি।
মারটিনের রাগান্বিত চিৎকার শোনা গেল। কি বললেন, কিছু বোঝা গেল না।
এই সময় বদ্ধ গুহা ভরে গেল আরেকটা বিকট চিৎকারে। ভয়ঙ্কর আওয়াজ। অন্ধকার সুড়ঙ্গের পুরু দেয়ালে প্রতিধ্বনি উঠল।
হ্যাচের বাইরে মাথা বের করেছে কিশোর। শব্দ শুনে ঝটকা দিয়ে ফিরে তাকাল। তাদের সামনের দেয়ালটা রুদ্ধ, যেটা ফাঁক ছিল খানিক আগে, যেখান দিয়ে ঢুকেছে ওরা।
খবরদার, জো! চেঁচিয়ে সাবধান করল নিক।
ওদের চেহারায় প্রথমে বিস্ময়, তারপর আতঙ্ক ফুটতে দেখল কিশোর। ওদের দৃষ্টি অনুসরণ করে তাকাল। গুহার দেয়ালে উদয় হয়েছে বিশাল এক পিঁপড়ে, যেন একটা পাহাড়। দূরে রয়েছে এখনও। ছুটে আসছে দ্রুত। বিকট চিৎকার করছে ওটাই, সুড়ঙ্গ জুড়ে যেন এগিয়ে আসছে।
রাক্ষস! খেয়ে ফেলবে! আতঙ্কে কোলা ব্যাঙের ডাক ছাড়ল নিক। টান দিয়ে পকেট থেকে পিস্তল বের করল। পিঁপড়েটাকে সই করে গুলি করল দু-বার।
গুলি খেয়েই যেন আরও বিকট চিৎকার করে উঠল পিঁপড়ে। আরও জোরে ছুটে এল। ওটার পেছনে দেখা যাচ্ছে এখন আরেকটা পিঁপড়ে।
দেখলে কাণ্ড! বিস্ময়ে কোটর থেকে ছিটকে বেরিয়ে আসবে যেন নিকের চোখ। গুলি খেয়েও কিছু হলো না। টেরই পায়নি যেন! একের পর এক গুলি করে গেল সে।
গর্জন থামছে না পিঁপড়ের, অগ্রগতি কমছে না সামান্যতম। আগের দুটোর সঙ্গে আরও পিঁপড়ে এসে যোগ হয়েছে। সারি দিয়ে এগিয়ে আসছে যেন মানুষ ছিঁড়ে খাওয়ার জন্যে।
রবিন দেখল, রোভার মারটিনের চোখে বিস্ময় ফুটেছে, তবে তাতে আতঙ্ক নেই, আছে কৌতূহল।
জো-ও গুলি শুরু করেছে।
আসছে রে, আসছে! চেঁচিয়েই চলেছে নিক। খেয়ে ফেলল রে, বাবা! মেরে ফেলল!
জো-র মাথা নিকের চেয়ে ঠাণ্ডা। গুলি করে ফল হবে না বুঝতে পেরে ছুটে গেল মারটিনের কাছে। পিস্তল উঁচিয়ে ধরে চেঁচিয়ে বলল, জলদি দরজা খোলো! কুইক!।
ঠাণ্ডা চোখে ওর দিকে তাকালেন মারটিন। কাঁধ ঝাঁকালেন হতাশ ভঙ্গিতে। পকেটে হাত দিলেন। বের করলেন হুইসেলের মত একটা জিনিস। ঠোঁটে লাগিয়ে ফুঁ দিলেন।
রবিন আশা করেছিল, তীক্ষ্ণ শব্দ হবে।
কিছুই হলো না, কোন শব্দই নেই। অবাক হয়ে দেখল, ধীরে ধীরে সরে যাচ্ছে ধূসর দেয়ালের দরজা।
ফাঁক বড় হওয়ার আগেই নিকের হাত ধরে টান দিল জো, এসো।
পিঁপড়েগুলোর দিকে ফিরেও তাকাল না আর ওরা, ছুটে বেরিয়ে গেল ফাঁক দিয়ে।
পালাও, গাধার দল, পালিয়ে যাও! পেছন থেকে মুখ বাঁকিয়ে ভেঙচালেন মারটিন, নইলে যে খেয়ে ফেলবে! গবেট কোথাকার! হ্যাঁচ দিয়ে মুখ বের করে রেখেছে কিশোর, তার দিকে তাকালেন ইঞ্জিনিয়ার। খুব দেখিয়েছ যা হোক। কিন্তু এতখানি এসে খালি হাতে ফিরব না আমি। বেরোও, বেরিয়ে এসো। আবার পকেটে হাত দিলেন। বের করলেন চকচকে কালো আরেকটা মারাত্মক জিনিস। কিশোরের দিকে নিশানা করে নাড়লেন, নেমে এসো।
আগ্নেয়াস্ত্রের বিরুদ্ধে কিছু করার নেই। লক্ষ্মী ছেলের মত নেমে এল কিশোর আর রবিন।
অন্ধকার কোণের দিকে ফিরে ডাকলেন মারটিন। আর এই যে, তুমি, প্রোজেকটরওয়ালা, তুমিও এসো।
থেমে গেল পিঁপড়ের চিৎকার। দেয়াল থেকে গায়েব হয়ে গেল ওগুলো।
গু-গুলি করবেন না, অন্ধকার থেকে শোনা গেল মুসার কণ্ঠ। আমি আসছি।
নিথর ড্রাগনের পাশে বন্ধুদের কাছে এসে দাঁড়াল সহকারী গোয়েন্দা। কৌতূহলী চোখে ড্রাগনটাকে দেখে ফিরল কিশোরের দিকে, তাহলে ঠিকই বলেছিলে, আসল নয়।
মাথা নাড়ল কিশোর। তোমার পিঁপড়েগুলোর মতই আসল, ব্যঙ্গ ঝরল মারটিনের কণ্ঠে। পিস্তল নেড়ে বলল, এসো আমার সঙ্গে…
থেমে গেল ঘেউ ঘেউ শব্দ।
ওহ-ন্নো! আবার আসছে। তাড়াতাড়ি পকেট থেকে হুইসেলটা বের করলেন আবার মারটিন। ফুঁ দিলেন। আগের বারের মতই কোন শব্দ শোনা গেল না। কিন্তু মৃদু শব্দ তুলে বন্ধ হতে শুরু করল দেয়ালের ফাঁক।
হাসি ফুটল কিশোরের মুখে। টর্চ জ্বালল, আলো ফেলল ফাঁকের বাইরে। জ্বলজ্বল করে উঠল কয়েকজোড়া চোখ। হাঁ করা মুখে ঝকঝকে ধারাল দাঁতের সারি বিকশিত।
আল্লাহ্ রে! আঁতকে উঠল মুসা। কুত্তাগুলো আবার…
দরজা বন্ধ হলো ঠিকই, কিন্তু দেরিতে। ততক্ষণে ভেতরে ঢুকে পড়েছে কুকুরগুলো। ঘেউ ঘেউ করে লাফ দিয়ে এসে পড়ল একটা মারটিনের ওপর।
পাইরেট! বিড়বিড় করল কিশোর। ডাকল, এই, পাইরেট, এদিকে আয়।
শুনলই না যেন কুকুরটা, দুই পা তুলে দিল মারটিনের বুকে। অন্য কুকুরগুলো এসে অর্ধচন্দ্রাকারে ঘিরে দাঁড়াল তাকে।
ফ্যাকাসে হয়ে গেছে মারটিনের চেহারা। ঘামছেন। পিস্তল নেড়ে ধমক দিলেন কুকুরগুলোকে, সরে যাওয়ার জন্যে।
লাভ নেই, মিস্টার মারটিন, বলল কিশোর। আপনি জানেন, গুলি করতে পারবেন না। কুকুর খুব বেশি ভালবাসেন আপনি, ওরাও আপনাকে ভালবাসে।
হ্যাঁ। বিষণ্ণ ভঙ্গিতে মাথা দোলালেন মারটিন। আমার জন্যে পাগল। মুখ বাঁকালেন। আনমনে বিড়বিড় করলেন, শেষ পর্যন্ত তীরে এসে তরী ডুবল।
ঠিকই বলেছেন, একমত হলো কিশোর। আর কিছু করার নেই। আপনার। সোনা লুট করে পার পাবেন না। সে চিন্তা বাদ দিন।
কি করব তাহলে?
আমার কথা শুনবেন? পিস্তলটা সরান।
পিস্তলের দিকে তাকালেন একবার মারটিন, ভাবলেন। দ্বিধা। করলেন, তারপর ঢুকিয়ে রাখলেন পকেটে। বলো।
এ-শহরের সবাই জানে, জোক করতে ভালবাসেন আপনি। ধরে নিন, এই সোনা লুটের ব্যাপারটাও একটা জোক।
কিভাবে?
এই যে, এত কিছু করার পর, নেয়ার সমস্ত সুযোগ থাকা সত্ত্বেও নিলেন না।
কই সুযোগ? তাহলে তো নিতামই।
সেটা তো আমরা জানি। আমরা যদি কাউকে কিছু না বলি, চেপে যাই, বেঁচে যাবেন আপনি। দরকার হলে আমরাই ঘোষণা করে দেব, আপনি জোক করেছেন। লোকেও বিশ্বাস করবে। এত সোনা হাতের কাছে পেয়েও নেননি আপনি, এটাই তো আপনার সততার প্রমাণ।
হাসি ফুটল মারটিনের ঠোঁটে, খুব চালাক ছেলে তুমি।
একুশ
দুই দিন পর।
চিত্রপরিচালক মিস্টার ডেভিস ক্রিস্টোফারের অফিসে তার বিশাল ডেস্কের অন্য পাশে বসে আছে তিন গোয়েন্দা।
ড্রাগনের কেসের ওপর লেখা রবিনের নোটটা গভীর মনোযোগে পড়ছেন তিনি।
পড়া শেষ করে মুখ তুললেন। হু, অবিশ্বাস্য! গমগম করে উঠল। ভারি কণ্ঠস্বর। নকল ড্রাগনকে আসল বলে চালিয়ে দেয়া, খুব বুদ্ধিমান লোকের কাজ। হ্যাঁ, কয়েকটা প্রশ্নের জবাব দাও দেখি এবার, নোটে লেখোনি এগুলো।
সামনে ঝুঁকল রবিন, অর্থাৎ, কি প্রশ্ন?
স্বভাব-চরিত্রে তো মনে হয় না ক্রিমিন্যাল টাইপের লোক রোভার মারটিন, বললেন পরিচালক। ডাকাতদের সঙ্গে জুটল কিভাবে?
জবাবটা কিশোর দিল, সী-সাইডের গুহা আর সুড়ঙ্গগুলোর প্রতি আগ্রহ ছিল মারটিনের, আকর্ষণ ছিল। প্রায়ই ঢুকতেন গিয়ে ওগুলোতে, নতুন গুহা আর সুড়ঙ্গ আবিষ্কারের আশায়। ঘুরতে ঘুরতেই একদিন আবিষ্কার করে বসলেন, ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকের নিচ দিয়ে গেছে। একটা সুড়ঙ্গ। সুড়ঙ্গগুলোর ম্যাপ এঁকে রাখতেন, কোনটা কিসের তলা দিয়ে গেছে বোঝার চেষ্টা করতেন, এভাবেই জেনেছেন ব্যাংকের তলা। দিয়ে গেছে সুড়ঙ্গ।
সাগরের পাড়ে বাস। সৈকতে দেখা হলো নিক আর জো-র সঙ্গে। ওরা স্যালভিজের কাজ করে, স্যালভিজ রিগ আছে একটা, পুরানো। ওদের সঙ্গে পরিচয় হলো তার, আলাপে আলাপে ঘনিষ্ঠতা। কথায় কথায় একদিন বলে ফেললেন ব্যাংকের নিচ দিয়ে সুড়ঙ্গ গেছে যে সে কথা।
ব্যস, ধরে বসল ওরা। বোঝাতে শুরু করল মারটিনকে। শেষে রাজি করিয়ে ফেলল সোনা লুট করতে। মার্টিনের দুঃসময় চলছে, টাকার খুব অভাব। এত টাকার লোভ ছাড়তে পারলেন না। তিনজনে মিলে পরামর্শ করে ঠিক করলেন, সাবমেরিনের সাহায্যে লুট করবেন সোনা। পানির তলায় থাকবে সাবমেরিন, সেটাকে রিগের সঙ্গে বেঁধে টেনে নিয়ে যাওয়া হবে মেকসিকোতে, তখন কেউ আর ধরতে পারবে না।
তবে ড্রাগন তৈরির বুদ্ধিটা মারটিনের। তাঁর মাথায় সব সময়ই উদ্ভট সব বুদ্ধি খেলে। এক ঢিলে দুই পাখি মারার সিদ্ধান্ত আরকি। ড্রাগন দেখলে লোকে ভয় পাবে, গুহার কাছে ঘেঁষবে না। যে দেখবে, সে অন্য কাউকে বলতে পারবে না, কারণ তার কথা লোকে বিশ্বাস করবে না, বরং পাগল ঠাওরাবে।
গুহায় বসেই ড্রাগন বানিয়েছেন তিনি, নিক আর জো সহায়তা করেছে। গুহার মুখ খোলা থাকলে লোকে যখন-তখন ঢুকে পড়তে পারে, তাই ওটাকে আগে বন্ধ করে নিয়েছেন কৃত্রিম উপায়ে, বাইরে থেকে দেখতে আসলের মত লাগে। কোনরকম লিভার রাখেননি, খোলার ব্যবস্থা করেছেন সাউণ্ড সিসটেম দিয়ে, সোনিক বীমের সাহায্যে।
হুঁ, হাসলেন পরিচালক। বাদ সেধেছে কুকুরগুলো। কুকুরের বাঁশি আর দরজা খোলার সিসটেম এক হয়ে গিয়েছিল।
তা-ই, মাথা ঝাঁকাল কিশোর। দরজা খোলার জন্যে হুইসেল বাজালেই কুত্তার দল ছুটে চলে আসে। লোকের চোখে পড়ে যেতে পারে ব্যাপারটা! তাহলে গুহার গোপনীয়তা আর থাকবে না। সুতরাং কুত্তাগুলোকেই আগে সরানোর মতলব করলেন মারটিন। বাঁশি বাজিয়ে। ওগুলোকে গুহায় ডেকে নিয়ে গেলেন। সাবমেরিনের মধ্যে ঘুম পাড়িয়ে রেখেছিলেন। কাজ শেষ হলেই ছেড়ে দিতেন, বলেছেন আমাদের।
মারেনি কেন?
একটা পিঁপড়ে মারার ক্ষমতাও নেই তার। তাছাড়া কুকুর দারুণ ভালবাসেন, কুকুররাও তাকে পছন্দ করে। কদিনেই ভক্ত হয়ে গিয়েছিল। লোক হিসেবে খারাপ নন তিনি। অভাবে স্বভাব নষ্ট, আর অসৎসঙ্গে সর্বনাশ-দুটো প্রবাদ বাক্যই একসঙ্গে আসর করছিল মারটিনের ওপর। খারাপ লোক হলে সেদিন এত সহজে আমাদের ছেড়ে দিতেন না। কোন না কোনভাবে সোনা নিয়ে পালানোর চেষ্টা করতেনই, প্রয়োজনে আমাদের খুন করে হলেও।
বুঝলাম। মাথা কাত করলেন পরিচালক। সে-ই তোমাদের সেদিন ফোন করেছিল? ভূতের ভয় দেখিয়েছিল?
হ্যাঁ, জবাব দিল মুসা। কিশোর চাপাচাপি না করলে ওই গুহায় আর যেতামই না আমি, ভূতের ভয়ে।
ভয় আরও নানারকমভাবে দেখিয়েছেন, বলল কিশোর। স্যালভিজ রিগ থেকে ডুবুরির পোশাক পরে সাগরে নামত নিক আর জো, হাতে স্পীয়ারগান থাকত, যাতে লোকে দেখলে মনে করে মাছ। মারতে নেমেছে। ওরা সেদিন সাগর থেকে ওঠার সময়ই আমরা দেখেছি। আমাদের দেখে খানিকটা ভয় দেখানোর লোভ ছাড়তে পারেনি ওরা। তারপর আমরা গুহায় ঢুকে পড়লাম, ওরাও ঢুকল। আসলে গুহায় ঢুকতেই আসছিল। ডুবুরির পোশাক পরার আরও একটা কারণ ছিল ওদের। ওই যে, যে গর্তটায় পড়ে গিয়েছিল রবিন, ওটা একটা সুড়ঙ্গমুখ। শুরুতে অনেকটা গ-এর মত বাঁকা, তারপর সোজা। ফলে গ-এর তলার দিকে থাকে পানি আর কাদা, ওপরের অংশটা শুকনো। টানেলে ঢোকার ওটা আরেকটা গোপনপথ। ওখান দিয়েই ঢুকেছিল ওরা, তাই পরে আমরা আর ওদের দেখতে পাইনি। মনে হয়েছে, যেন গায়েব হয়ে গেছে।
এক মুহূর্ত চুপ করে কিছু ভাবলেন পরিচালক। বললেন, আচ্ছা, হেরিঙের ব্যাপারটা কি? শটগান নিয়ে তিনি এত রাতে কি করছিলেন ওখানে?
মারটিনের মত তিনিও প্রায়ই সৈকতে বেড়াতে যেতেন। গুহায়ও ঢুকতেন মাঝে মাঝে। আমরা প্রথম যে গুহাটায় ঢুকেছিলাম, ওটা তার পরিচিত। তক্তা সরিয়ে যেটাতে ঢুকতে হয়, ওটাও। পুরানো তক্তাগুলো প্রাচীন ডাকাতেরা লাগিয়েছিল, তার দুয়েকটা ভেঙে গিয়েছিল। নতুন করে আবার লাগিয়েছেন হেরিঙ। মাঝে মাঝে গুহার ভেতরে পিকনিক করতে যেতেন তিনি। চুপ করল কিশোর।
তার মানে তার চোখে কিছু পড়েছিল। কিছু সন্দেহ করেছিলেন।
হ্যাঁ। রাতের বেলা ড্রাগনটাকে তিনিও দেখেছেন। ডাইভারদের আনাগোনা দেখেছেন। সেদিন রাতে সী-সাইডের আলো দেখে তদন্ত করতে এসেছিলেন। বোধহয় নিক আর জো-র টর্চের আলো চোখে পড়েছিল তার। তিনি বেহুশ হয়ে না গেলে কপালে খারাপি ছিল নিক আর জো-র। মারটিনেরও।
তিনি তাহলে জানেন না কিছু?
না। সোনাগুলো আবার ব্যাংকের ভল্টে ভরে রেখেছেন মারটিন। উল্টোপাল্টা করে রেখেছেন। যাতে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ বুঝতে পারে কিছু একটা গড়বড় হয়েছে।
হুঁ, বেশ ভালই জোক হয়েছে। বুদ্ধিটা ভালই করেছিলে, কিশোর। আর কেউ জানে?
না, স্যার, শুধু আপনাকে বললাম।
চুপচাপ কিছু ভাবলেন মিস্টার ক্রিস্টোফার। মুখ তুললেন। ভাবছি, ওকে আমার স্টুডিওতে একটা কাজ দেব। ওর মত গুণী ইঞ্জিনিয়ার..কাজে আসবে আমার।
উজ্জ্বল হলো কিশোরের মুখ। খুব ভাল হবে, স্যার। আপনি তো হরর ফিল্ম তৈরি করেন। মারটিনকে খুব কাজে লাগবে আপনার। তবে আগেই হুঁশিয়ার করে রাখবেন, যাতে কোন জোক-টোক না করে।
আচ্ছা, ড্রাগনটা কি করেছে? ভেঙে ফেলেছে?
না, আছে। কেন?
ভাবছি, ওটা একদিন লস অ্যাঞ্জেলেসের পথে নামাব। লোকে দেখলে কি করবে ভাব একবার।
আপনি নামাবেন, স্যার? বদনাম হয়ে যাবে তো।
না, আমি না। তুমি চালাবে। তোমরা তিনজন থাকবে ওতে, চাইলে মারটিনকেও সঙ্গে নিয়ে নিও।
দারুণ মজা হবে। খুশিতে সৌজন্য ভুলে লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল মুসা। হাততালি দিল জোরে।
কিশোরের দিকে চেয়ে মুচকি হাসলেন পরিচালক, এক কাজ কোরো, কি করে ক্লাচ ছাড়তে হয় ওটার, শিখে নিও মারটিনের কাছে। আমার ধারণা, ক্লাচের মধ্যেই কিছু একটা ব্যাপার আছে। বড় বাসের মত যানবাহনে যেভাবে ডাবল-ডিক্লাচ করতে হয়, তেমন কিছু। আর সেজন্যেই ক্লাচ ছাড়া সত্ত্বেও ঝাঁকি দিয়ে দিয়ে থেমে গেছে ওটা বার বার।
ঠিক, ঠিক বলেছেন, স্যার। আঙুল তুলল কিশোর। তাই তো বলি, ক্লাচ ছাড়ি আর বন্ধ হয়ে যায়, ছাড়ি আর বন্ধ হয়ে যায়, কেন?