সর্দারের দাদার মুণ্ড ওটা, দোভাষীর কাজ চালাল জোনস। একটু থেমে বলল, কারও কারও মতে মুণ্ড সংরক্ষণ বর্বরতা। আসলে কি তাই? এরা তো শুধু মাথাটা মমি করে রাখছে, মিশরী রাজারা যে পুরো দেহটাই মমি করে রাখত? মরে যাওয়ার পর লাশটা নিয়ে কি করা হলো না হলো, সেটা কোন ব্যাপারই নয়। এই ইণ্ডিয়ানদের রীতিটা বরং ভালই মনে হয় আমার কাছে। মৃত্যুর পরও প্রিয়জনের স্মৃতি এভাবে ধরে রাখতে পারাটা…দাদা নাকি খুব ভালবাসত সর্দারকে, সর্দারও ভালবাসত দাদাকে। তাই এভাবে সবচেয়ে বড় সম্মান দিয়ে ঝুলিয়ে রেখেছে। দরজার ওপর।
আত্মীয়-স্বজনের মুণ্ড যত খুশি রাখুক, কে বলতে যাচ্ছে, মুসা বলল, কিন্তু। শত্রুর মাথা যে রাখে? নিশ্চয় সম্মান দেখানোর জন্যে নয়?
সেটা অন্য কারণ। ওদের বিশ্বাস, শক্তিশালী একজন যোদ্ধার মাথা কাছে। রাখতে পারলে মৃতের শক্তিটা তার মধ্যে চলে আসবে। দুর্বল লোক, মেয়েমানুষ কিংবা বাচ্চার মাথা তো রাখে না। মুণ্ড সংরক্ষণের পদ্ধতিটাও খুব জটিল, তাই আজেবাজে মাথার পেছনে সময় নষ্ট করতে চায় না।
যদি না সেটা থেকে কিছু আয় হয়, যোগ করলেন মিস্টার আমান, তাই না?
হ্যাঁ। তবে নিজের কুঁড়েতে বাছা বাছা মাথা ছাড়া রাখবে না কিছুতেই।
আমাদেরকে আবার সম্মানিত করার চেষ্টা করবে না তো? তাকের। মুণ্ডগুলোর দিকে বাঁকা চোখে তাকাল মুসা।
বিশ্বাস কি? হাসল জোনস। একটা কথা কিন্তু বলিনি। বিদেশীদের মাথার বিশেষ কদর করে ওরা। ওদের ধারণা, ওসব মাথায় জাদুশক্তি খুব বেশি। তাই অলৌকিক ক্ষমতার লোভে ওগুলো জোগাড় করে।
খাইছে। নিজের মাথা চেপে ধরে সর্দারের দিকে ফিরল মলা : না বাপু.. সর্দারের পো, আমার এটাতে কিছু নেই বাবা। আমি নেহায়েত মুখখ-সুখখু মানুষ। প্রায়ই বোকা, আদা, গর্দভ বলে গাল দেয় কিশোর। টিচাররা তো বলদ ছাড়া কিছুই বলে না। তবে হ্যাঁ, বুদ্ধি যদি বাড়াতেই চাও, ওরটা রাখতে পারো। আর বইয়ের বিদ্যে চাইলে রবিনেরটা।
হেসে উঠল জোনস। কিশোর আর রবিন হাসল। মিস্টার অমানও হাসছেন। কিছুই না বুঝে সর্দারও জোরে জোরে হাসতে লাগল।
হাসার পর, হাসার কারণ জানতে চাইল সর্দার।
বলল জোনস।
আঁতকে উঠল সর্দার। গম্ভীর হয়ে গেছে। জোরে জোরে মাথা নেড়ে কিছু, বলল।
ও বলছে, অনুবাদ করল জোনস, মেহমানদের মাথা কিছুতেই কাটে না জিভারোরা। তাতে নাকি ভীষণ পাপ হয়।
যাক বারা, বাচলাম, এতক্ষণে নিশ্চিন্ত হলো মুসা। এত ভাল ভাল খাবার, গিলতেই পারছিলাম না।
শেষ হলো খাওয়া।
উঠে গিয়ে তাকে সাজানো ট্রফিগুলো দেখতে লাগলেন মিস্টার আমান। ওরকম একটা মুণ্ডের জন্যে হাজার ডলার দিতে রাজি আছে লস অ্যাঞ্জেলেসের মিউজিয়াম অভ নেচারাল হিস্ট্রি।
কিশোর এসে দাঁড়িয়েছে পাশে। আংকেল, একটা কিনে নিলে কেমন হয়?
প্রথমে রাজি হলো না সর্দার।
কিন্তু নাছোড়বান্দা জোনসের কবলে পড়েছে। নানা রকম ভাবে বোঝানোর চেষ্টা করল সে। বোঝাল, বিশাল কুঁড়েতে নিয়ে দরজার কাছে রাখা হবে মাথাটা। এত বড় কুঁড়ে ইনডিয়ানদের কোন গ্রামে নেই। হাজার হাজার মানুষ দেখতে আসবে রোজ। দেখে জিভারোদের প্রশংসা করবে। এত বড় সম্মান কি ছেড়ে দেয়া, উচিত?
গলে গেল সর্দার, প্রথমেই চোখ তুলে তাকাল তার দাদার দিকে। কিন্তু না, দাদাকে কাছছাড়া করতে পারবে না সে, বড় বেশি ভালবাসে। তাক থেকে আরেকটা সুন্দর ট্রফি নিয়ে এল। আমাদের সব চেয়ে বড় যোদ্ধাদের একজন। খুব। জ্ঞানী আর ভাল লোক। ও যাবে তোমাদের দেশে।
নাম কি?
কিকামু।
দাম কত?
দ্বিধায় পড়ে গেল সর্দার। উপহারের দাম নেয়াটা ভাল দেখায় না। মাথা নাড়ল সে।
জোনসও ছাড়বে না।
শেষে জোর করে কিছু টাকা সর্দারের হাতে গুঁজে দিলেন মিস্টার আমান। বললেন, এটা মেহমানদের তরফ থেকে উপহার।
এরপর সর্দার জানতে চাইল, মেহমানরা কেন এসেছে।
শুনে মুখের ভাব বদলে গেল সর্দারের। অনেক কথা বলল।
সর্দার বলছে, জোনস জানাল, ওদিকে যাওয়া ঠিক হবে না আপনাদের। মারা পড়বেন। ভাটির ইনডিয়ানরা নাকি মোটেও সুবিধের নয়। সাংঘাতিক বুনো, মাথা কাটার বাছবিচার নেই, বিদেশীদের একদম দেখতে পারে না।
কিন্তু ফিরে যেতে রাজি নন মিস্টার আমান। ওদের কাছে বন্দুক নেই।
নেই। কিন্তু ব্লো-গান আছে, বিষাক্ত চোখা কাঠি ছোড়ে। তাছাড়া বল্লম। আছে, বিষমাখা তীর আছে, নিশানা মিস করে না।
জানি। ওদের সঙ্গে ভাব করে নেব।
ভাব করার আগেই যদি বিষ ঢোকায় আপনাদের রক্তে?
ঝুঁকি নিতেই হবে। আমেরিকান জিওগ্রাফিক্যাল সোসাইটিকে কথা দিয়ে। এসেছি, প্যাসটাজার ভাটি অঞ্চলের একটা খসড়া ম্যাপ করে নিয়ে যাব। চুক্তি মোতাবেক বেশ কিছু টাকাও দিয়েছে খরচের জন্যে। চিড়িয়াখানা আর সার্কাস পার্টির কাছ থেকেও আগাম টাকা নিয়ে এসেছি, দুর্লভ জানোয়ার জোগাড় করে দেব। বলে। এখন তো আর পিছিয়ে যেতে পারি না। সর্দারকে জিজ্ঞেস করুন, একটা নৌকা বিক্রি করবে কিনা।
তাতে আপত্তি নেই সর্দারের। কিন্তু বিষণ্ণ মুখে বার বার বলল, মেহমানদের কিছুতেই যাওয়া উচিত হচ্ছে না ওদিকে। বোকা বিদেশীগুলোকে কিছুতেই নিরস্ত করতে না পেরে, শেষে রাতটা অন্তত তার সঙ্গে কাটিয়ে যাওয়ার দাওয়াত করল সর্দার।
এতে রাজি হলো অভিযাত্রীরা। সর্দারকে অখুশি করতে চাইল না।