মাঠের শেষে কতগুলো কুঁড়ে। এধরনের কুঁড়ে তিন গোয়েন্দার পরিচিত। জিভারো ইনডিয়ানদের বাড়িঘর, ইয়াপুরায় দেখেছে। আস্ত গাছের বেড়া। শুধু ঘাসের বেড়াও আছে কিছু কিছু ঘরের।
বিমানের নাক নামাল জোনস, চিলের মত ছোঁ মারল যেন। মাটিতে হোঁচট খেল চাকা, প্রচণ্ড ঝাঁকুনি দিয়ে ছুটতে শুরু করল। একটা বড় কুঁড়ের ঘাসের বেড়া ভেঙে হুড়মুড় করে ঢুকে পড়ল ভেতরে। গতি এমনিতেই কমে এসেছিল, বাধা পেয়ে ধাক্কা দিয়ে থেমে গেল। ঘরে কয়েকজন ইনডিয়ান শুয়ে-বসে আরাম করছিল নিশ্চিন্তে। তাতে ব্যাঘাত ঘটাল বেরসিক বোনানজা। লাফিয়ে উঠে যে যেদিকে পারল দৌড় দিল ওরা। গলা ফাটিয়ে চিৎকার করছে।
বিচিত্র কায়দায় নরমুণ্ড শিকারীদের স্বাগতম জানাল, যেন পাগলা পাইক। ভাগ্যিস ইনডিয়ানদের কেউ আহত হয়নি। তাহলে কুঁড়ের তাকে সাজিয়ে রাখা খুদে মুণ্ডগুলোর সঙ্গে নির্ঘাত যোগ হত আরও পাঁচটা মাথা।
.
০৪.
মনে হলো ভীমরুলের চাকে ঢিল পড়েছে। ছুরি-বল্লম নিয়ে ছুটে এল ইনডিয়ানরা। যোদ্ধাদের বিকট চিৎকার তো আছেই, সেই সঙ্গে চেঁচিয়ে গ্রাম মাথায় করেছে। মেয়েমানুষ আর বাচ্চারা।
ককপিটের দরজা দিয়ে মাথা বের করে দিল জোনস। মুখে হাসি। জিভারোদের কায়দায় স্বাগত জানাল বুড়ো সর্দারকে। চেঁচামেচি কমল না তাতে, কিন্তু নিমেষে রাগ মুছে গিয়ে জন্ম নিল উল্লাস। পাগলা পাইক তাদের অতিপরিচিত। সিংকোনা আর কুইনিন সংগ্রহকারীদের নিয়ে আগেও অনেকবার এসেছে।
যাত্রীদের পরিচয় করিয়ে দিল জোনস।
স্বাগত জানাল ইনডিয়ানরা। মেহমানদের নিয়ে চলল সর্দারের কুঁড়েতে। খুব পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন গ্রাম, ঝকঝকে তকতকে, হামুর গ্রামটা এত পরিষ্কার ছিল না। ইনডিয়ানদের একই উপজাতি, কিন্তু গ্রামে গ্রামে কত তফাৎ।
গ্রাম দেখে মানুষগুলোকে মনেই হয় না। এরা ভয়াবহ নরমুণ্ড শিকারী। গ্রামের বাইরে ভুট্টা আর সীমের খেত, কলা বাগান। কিছু কিছু কুঁড়েতে রয়েছে তাত, কাপড় তৈরি হয়। খরস্রোতা প্যাসটাজীর ঘাটে বাঁধা রয়েছে সারি সারি নৌকা, আস্ত গাছ কুঁদে তৈরি।
বুদ্ধিমান লোক ওরা বলল জোনান, আমার খুব সাহসী! ইনকারা কোন দিন। হারাতে পারেনি ওর। নয়াড়রা জোর করে কিছুদিন শাসন করেছিল বটে, কিন্তু পরে সব ইনডিয়ানরা এক হয়ে শুয়োর খেদান খেদিয়েছে তাদের। ইকোয়াডর সরকারও ওদের ঘাটায় না, হার যার মত থাকতে দেয়।
শার্ট-প্যান্ট পায় কোথায়? সভ্য জগতের পোশাক? জিজ্ঞেস করল মুসা।
তাঁত আছে, বানিয়ে নেয়। এমনিতে কাপড়-চোপড় পরেই থাকে ওরা, কিন্তু লড়াই বাধলে অন্যরকম। উলঙ্গ হয়ে গায়ে রঙ মেখে সঙ সাজে, একেকটা যোদ্ধা। তখন একেকটা ভূত। বিকট করে ফেলে চেহারা।
শার্ট-প্যান্ট পরা অবস্থায়ও কিছু লোককে বুনো দেখাচ্ছে। কালো ঝাঁকড়া চুল এলোমেলোভাবে নেমেছে ঘাড়ের কাছে। মাথায় টিউকান পাখির পালকে তৈরি মুকুট।
প্রতি দু-জন জিভারোর একজন সভ্য, আরেকজন বুনো, বলল জোনস। সে এক মজার ব্যাপার। কোন্জনের পাল্লায় পড়লে কি ঘটবে নিশ্চয় আন্দাজ করতে পারছ।
সর্দারের কুঁড়ের বেড়ায় ঝুলছে রাশি রাশি ব্লো-গান,বল্লম, ধনুক আর তীর। আছে রাজকীয় টিগ্রে আর কুটিল চিতাবাঘের চামড়া।
খাবারের সময় হয়েছে। খাবার এল।
আরিব্বাবা, এত বড় ডিম! বলল রবিন। মুরগীগুলো কত বড়?
হাসল জোনস। মুরগীগুলো? একেকটা কম পক্ষে দশ ফুট লম্বা। যা দাঁত আর চোয়ালের যা জোর, আমাদেরই চিবিয়ে কিমা বানিয়ে দিতে পারে।
অ্যালিগেটরের ডিম, রবিন, হেসে বলল কিশোর। কেমন লাগছে?
মুখ বিকৃত করে ফেলল রবিন। এতক্ষণ তো ভালই লাগছিল। জেনেও খেতে খারাপ লাগছে না তোমার?
এখানে খাওয়ার বাছবিচার করলে মারা পড়ব। মনকে মানিয়ে নিয়েছি। স্বাদ যখন ভাল, অসুবিধে কি?
কাবাবটা কিসের মাংসের? জিজ্ঞেস করল মুসা। নিশ্চয় জংলী ছাগল?
জংলীই, তবে ছাগল নয়, ইগুয়ানা, জবাব দিল জোনস। পাঁচ-ছয় ফুট লম্বা এক জাতের গুইসাপ, এদিকের জঙ্গলে অভাব নেই। চিড়িয়াখানার জন্যে নিতে পারো। খাচ্ছ যে, কিসের মাংস বলো তো ওটা?
বনগরু, রবিন বলল। এত অখাদ্যের মধ্যে এটা মোটামুটি ভাল খাদ্য মনে হচ্ছে তার, অন্তত রুচিসম্মত। আরেক টুকরো কেটে নিয়ে কামড় বসাল।
উঁহু। সিংহ, পার্বত্য সিংহ।
মানে…পুমার মাংস! ওয়াক, থুহ! চিবানো মাংস থুথু করে ফেলে দিল। রবিন।
ও কিছু না। দু-দিনেই অভ্যাস হয়ে যাবে, বললেন মিস্টার আমান। কিশোর বলল না, মনটাকে তৈরি করে নিলেই হলো।
কিন্তু পারল না রবিন। আমিষ খাওয়া বাদ দিয়ে নিরামিষের দিকে ঝুঁকল। ভুট্টার। আটার মোটা রুটি আর কলা-পেঁপে। কিন্তু ঘিনঘিনে ভাবটা দূর করতে পারল না। রুচি আরও নষ্ট করল তাকে সাজানো অসংখ্য নরমুণ্ড। একটা মাথা ঝুলছে দরজার ঠিক ওপরে। রবিন যেখানে বসেছে সেখান থেকে খুব বেশি চোখে পড়ে।
রবিনের দৃষ্টি অনুসরণ করে সেদিকে তাকালেন মিস্টার আমান। বললেন, ওটাকে বেশি সম্মান দেয়া হয়েছে।
ইংরেজি বোঝে না সর্দার। কিন্তু মুণ্ডটার দিকে মেহমানদের ঘনঘন তাকাতে দেখে অনুমান করে নিল, ওটার আলোচনাই হচ্ছে। জোনসকে কিছু বলল।
জিভারোদের সবারই ভাষা মোটামুটি এক হলেও অঞ্চলে অঞ্চলে কিছু রদবদল রয়েছে। ইয়াপুরার যে ভাষাটী তিন গোয়েন্দা জানে, তার সঙ্গে পুইয়োর ভাষার পার্থক্য আছে, তাই পুরোপুরি বুঝতে পারল না।