সীট থেকে উঠে জোনসের কাঁধের ওপর দিয়ে অলটিমিটারের দিকে তাকাল কিশোর। সতেরো হাজারের ঘর ছুঁই ছুঁই করছে কাটা। তার মানে পর্বত ডিঙিয়ে যাওয়ার তো প্রশ্নই ওঠে না, ওপর দিকে ফাঁকটা যেখানে বেশি সেখান দিয়েও যেতে পারবে না।
কিন্তু সতেরো হাজারও টিকল না। হঠাৎ করে সরতে শুরু করল অলটিমিটারের কাটা।
আরি! এই, কি করছিস? বোনানজাকে ধমক দিল জোনস। ওঠ ওঠ, এত নামলে চলবে কেন? ওপরে তোলার চেষ্টা করতে লাগল সে।
বোনানজার তো ওঠার খুবই ইচ্ছে কিন্তু ভর রাখতে পারছে না, উঠবে কি করে? বাতাসের ভয়াবহ নিম্নগামী স্রোত প্লেনটাকে দ্রুত নিচে টেনে নামাচ্ছে। অনেক চেষ্টা করল জোনস; ওঠাতে পারল না। নামছে তো নামছেই।
ভয় পেল যাত্রীরা। এইবার বোধহয় রেকর্ড আর টিকল না জোনসের। পাথুরে পাহাড়ে আছড়ে পড়ে ছাতু হয়ে যাবে প্লেন।
কিন্তু টানাহেঁচড়ায় এবারেও জোনসেরই জয় হলো। গিরিপথের পাথুরে মেঝের ছয়শো ফুট ওপরে এসে থামল বিমানের নিম্ন-গতি। ঢুকে পড়েছে দানবের হায়ের মধ্যে।
সোজা যদি চলে যেত পথটা, এক কথা ছিল। বেজায় সরু, তার ওপর রয়েছে নানা রকম বাঁক, মোচড়। কোনটা ইংরেজি S অক্ষরের মত, কোনটা বা U; হাত পা ছেড়ে দিল যাত্রীরা। ম্যাপের দিকে চোখ নেই কিশোরের, গাইডবুক বন্ধ করে ফেলেছে রবিন। মুসার চোখ বন্ধ। তাকাতেই সাহস পাচ্ছে না।
পাগলা পাইক নির্বিকার। স্বচ্ছন্দে এগিয়ে নিয়ে চলেছে বিমানকে। প্রতিটি বাক, মোড়, মোড় তার চেনা। সেটা বড় কথা নয়। সরু পথে যেভাবে। বিমানটাকে সামালাচ্ছে, সেটাই দেখার মত। এই মুহূর্তে আরেকটা নিম্নগামী ট্রেতে যদি পড়ে বিমান, কি হবে বোধহয় ভাবছেই না সে। কিন্তু ভেবে ভেবে এই ভীষণ ঠাণ্ডার মাঝেও দরদর করে ঘামছে যাত্রীরা।
দূধর্ষ পাইলটের কাছে আরেকবার হার মানল বিরূপ প্রকৃতি। নামতে শুরু করেছে পাথুরে মেঝে, ফাঁক হচ্ছে ফাটল। হুশ করে খোলা আকাশে বেরিয়ে এল। বিমান। পেছনে গুটিসুটি মেরে পড়ে থাকল যেন পরাজিত, মার খাওয়া পাহাড় আর গিরিপথ।
নতুন এক পৃথিবীতে বেরিয়ে এসেছে বোনানজা। পেছনে হারিয়ে গেছে প্রশান্ত উপকূলের রুক্ষ, ধূসর অঞ্চল, বৃষ্টি যেখানে প্রায় হয়ই না। নিচে, আশেপাশে আর; সামনে এখন ছড়িয়ে আছে উজ্জ্বল সবুজ বনভূমি, যেখানে পানির কোন অভাব নেই। রোদ চকচকে সবুজের মাঝে জালের মত বিছিয়ে রয়েছে যেন রূপালি নদী নালাগুলো।
দেখো দেখো! উচ্ছাসে চেঁচিয়ে উঠল মুসা, খানিক আগে ভয়ে চোখ বন্ধ করে রেখেছিল যে ভুলেই গেছে। মেঘ! কি টকটকে লাল!
নিচে, সবুজের ঠিক ওপর দিয়ে ভেসে চলেছে ছোট্ট এক টুকরো: হ্যাঁ, মেঘই বলা যায়।
প্রজাপতি, হেসে বলল জোনস। বেশি না, এই কয়েক হাজার কোটি হবে। একসঙ্গে রয়েছে তো, মেঘের মত লাগছে। ওই যে দেখো, আরেকটা সবুজ মেঘ।
টিয়ে না? বলল রবিন।
হ্যাঁ।
ইয়াপুরা নদীর ওদিকে কিন্তু এতসব দেখিনি।
ওটা তো মরু জঙ্গল। এদিকে সেরকম না। এখানে শুধু রঙ আর রঙ। উজ্জল সবুজ, হলুদ, লাল। মিশ্র রঙ যে কত আছে। কাকাতুয়া আর টিউকান পাখির রাজ্যে। তো যাইনি এখনও। বিশ্বাস করতে পারবে না। মনে হবে বুঝি ছবি দেখছ, কাঁচা রঙ গুলে লাগিয়ে দিয়েছে কেউ।
ওই যে নিচে একটা নদী, মুসা বলল। ওটাই আমাজন?
আমাজনের দাদীর মা বলতে পারো। ওটার নাম প্যাটেট, কিছু দূরে গিয়ে জন্ম দিয়েছে আমাজনের দাদী প্যাসটাজাকে। প্যাসটাজার মেয়ে ম্যারানন, এবং ম্যারাননের ছেলে হলে গিয়ে আমাজন।
খুব সুন্দর বলেছেন, আন্তরিক প্রশংসা করল কিশোর।
প্রশংসায় লজ্জা পেল জোনস, লজ্জিত হাসি হাসল। অবাক হলো কিশোর-পাগলা পাইকও লজ্জা পায় তাহলে?
আশ্চর্য কি জানো? মিস্টার আমান বললেন, প্যাটেটের উল্টো দিকে মাত্র। একশো মাইল দূরে প্রশান্ত মহাসাগর। অথচ সেদিকে ফিরেও তাকাল না নদীটা। মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে তিন হাজার মাইল পাহাড়-জঙ্গল পাড়ি দিয়ে, ঘুরে-ফিরে গিয়ে পড়েছে আটলান্টিকে।
আমরাও তাকেই অনুসরণ করতে যাচ্ছি, হাসল কিশোর, তাতে ভয়ের। ছোঁয়া। কত বিপদ আর রহস্য অপেক্ষা করছে কে জানে!
নদীর ওপর দিয়ে উড়ে চলেছে প্লেন।
অবশেষে শ্যাম্বো নদীর সঙ্গে মিলিত হলো প্যাটেট, জন্ম দিল প্যাসটাজার।
ওই যে প্যাসটাজা, হাত তুলল জোনস। বিড়বিড় করল, রহস্যময় নদী। জিভারোদের নদী।
টপো নামের ছোট্ট একটা সীমান্ত ঘাটি পেরোল ওরা, তার পর মেরা ছাড়াল। সভ্যতার সামান্যতম ছোঁয়া যা ছিল, তা-ও এখন শেষ। পুরোপুরি অসভ্য এলাকার ওপর এসে পড়েছে ওরা।
সামনে ইনডিয়ানদের একটা গ্রাম, নাম পুইয়ো।
গাইডবুক দেখে বলল রবিন, পুইয়োর পর থেকে শুরু হয়েছে ঘন জঙ্গল। পথ। এত বেশি দুর্গম, হেঁটে যাওয়াও সম্ভব না। উপায় একটাই, নৌকা।
হ্যাঁ, হাঁটুতে রাখা ম্যাপে টোকা দিল কিশোর। বিন্দু বিন্দ বসিয়ে চিহ্ন দিয়েছে। অর্থাৎ, এখানটায় সার্ভে হয়নি এখনও।
ছোট একটা পাহাড়ী নদী দেখা গেল। সেটা পেরোনোর জন্যে তৈরি হয়েছে। দড়ির ঝোলানো সেতু। সেতুর পরে খানিকটা ভোলা জায়গা।
গন্তব্য এসে গেছে। নামার জন্যে তৈরি হলো জোনস।
স্টলিং স্পীড কত? জিজ্ঞেস করল কিশোর।
পঁচানব্বই কিলোমিটার, জবাব দিল জোনস।
আরিব্বাবা। চমকে গেল কিশোর। নিচে মাঠটা খুবই ছোট 1 মিনিটে দেড় কিলোমিটারেরও বেশি গতিবেগ। এই অবস্থায় ল্যাণ্ড করবে কি করে প্লেন? তার ওপর ঠিকমত ব্রেক কাজ করে না। আরেকটা কেরামতি দেখাতে হবে জোনসকে।