পেরোতে যাচ্ছে কে? বলল জোনস, গিরিপথের মাঝখান দিয়ে চলে যাব।
গিরিপথ?
ওই হলো। দুই পর্বতের মাঝের পথকেই তো গিরিপথ বলে? ঠিক আছে, শুধরে দিচ্ছি। আমরা যাব গিরি-আকাশের মধ্যে দিয়ে। নিচে হাঁটাপথ নেই ওখানটায়।
কিন্তু উত্তরে যাচ্ছেন কেন?
তোমাদেরকে বিষুবরেখা দেখানোর জন্যে। ওই যে স্তম্ভটা দেখছ? উনিশশো ছত্রিশ সালে একটা ফরাসী জরিপকারী দল বসিয়েছিল ওটা, বিষুবরেখার নির্দেশক। বুড়ো পৃথিবীটাকে দু-ভাগে ভাগ করার জন্যে বিজ্ঞানীদের কতই না চেষ্টা, আহা! আমরা এখন রয়েছি উত্তর গোলার্ধে, বলেই শাই করে নাক ঘুরিয়ে প্লেনটাকে নিয়ে চলল স্তম্ভটার দিকে। পেরিয়ে এল ওটা। এই ছিলাম উত্তর গোলার্ধে, চলে এলাম দক্ষিণে। মজার ব্যাপার না?
ভীষণ ঠাণ্ডা। ফুঁ দিয়ে হাতের তালু গরম করতে করতে মুসা বলল, বিষুবরেখা না ছাই। আমার তো মনে হচ্ছে বিষুবমেরুতে ঢুকেছি।
বিষুবমেরু বলে কিছু নেই, গম্ভীর হয়ে বলল রবিন।
না থাকলে কি? নাম একটা বানিয়ে নিলেই হলো।
ওটা কোন রাস্তা? নিচে দেখিয়ে বললেন মিস্টার আমান। প্যান-আমেরিকান হাইওয়ে?
হ্যাঁ, মাথা ঝাঁকাল জোনস।
সড়কটার ডাকনাম ওয়ানডার রোড বা বিস্ময় সড়ক, অনেক লম্বা, সেই আলাস্কা থেকে শুরু করে শেষ হয়েছে গিয়ে প্যাটাগোনিয়ায়।
ইস, মুসা বলল, ওই পথে যদি যেতে পারতাম একবার।
পারবে পারবে, আশ্বাস দিলেন তার বাবা। এখন যেখানে যাচ্ছি সেখানেই যেতে পারবে ভেবেছিলে কোন দিন? কিন্তু যাচ্ছি তো। এই নতুন ব্যবসায় যখন নেমেছি, দুনিয়ার অনেক জায়গাই দেখতে পাবে। নেমেছিই তো সেজন্যে। পয়সাও এল, খরচও পোষাল, জায়গাও দেখা হলো।
তা ঠিক, মনে মনে স্বীকার করল কিশোর, এক ঢিলে তিন পাখি। জন্তু জানোয়ার ধরাটা একটা ছুতো আসলে, দেশভ্রমণের জন্যেই এই ব্যবসার ফন্দি এটেছে দুই বুড়ো–তার চাচা আর মুসার বাবা। কিন্তু খুবই দুঃখের বিষয়, প্রথম অভিযানেই আসতে পারেননি রাশেদ পাশা। ইয়ার্ডে নাকি জরুরী কাজ, রিও ডি জেনিরো থেকেই তাকে বগলদাবা করে নিয়ে গেছেন মেরিচাচী, রকি বীচে। কিশোরকে আসতে দিয়েছেন শুধু মুসার বাবা সঙ্গে আছেন বলেই। তা-ও হুশিয়ার করে দিয়েছেন, তিনটে ছেলের একটারও যদি কোন কারণে একটু চামড়া ছিলে, দুই মিনসের সারা শরীরের চামড়া ছিলবেন তিনি। বুড়োদের ভীমরতিতে মুসার মায়েরও যথেষ্ট আপত্তি ছিল, কিন্তু মেরিচাচীর ওই সাংঘাতিক হুমকির পর আর কিছু বলার প্রয়োজন মনে করলেন না। আর রবিনের বাবা-মা আপত্তিই করেননি। তাদের কথা, ছেলে হয়ে যখন জন্মেছে, সারা জীবন কোলে বসিয়ে তো আর রাখা যাবে না। তার চেয়ে এখন থেকেই যাক যেখানে খুশি, সাহস বাড়ুক ছেলের, বেঁচে ফিরে আসতে পারলেই ওঁরা খুশি।
রাশেদ চাচা, মেরিচাচী, মুসার মা, রবিনের বাবা-মা, জিনার বাবা-মা আর রাফিয়ান এক সঙ্গেই চলে গেছে লস অ্যাঞ্জেলেসে। এই অভিযানে আসার খুব ইচ্ছে ছিল জিনার, কিন্তু তার বাবা-মা রাজি হননি।
পথটা কি একটানা গেছে, না ভেঙে ভেঙে? জিজ্ঞেস করল মুসা।
তিনটে ভাঙা আছে, রবিন বলল। তবে অসুবিধে নেই। ভাঙাগুলো জোড়া দিয়েছে সংক্ষিপ্ত নৌ কিংবা রেলপথ। গাড়ি সঙ্গে থাকলেও ঝামেলা হবে না। জাহাজে কিংবা রেলগাড়িতে তুলে সহজেই পার করে নিতে পারবে ওসব জায়গা।
সত্যি, আশ্চর্য এক সড়ক, অনেক নিচে আঁকার্বাকা ফিতের মত পথটার দিকে তাকিয়ে বললেন মিস্টার আমান। দুই আমেরিকাকে জোড়া দিয়েছে।
যত যা-ই বলুন, আকাশপথের জুড়ি নেই, আদর করে কন্ট্রোল প্যানেলে হাত রাখল জোনস। শুধু আমেরিকা কেন, সারা পৃথিবীকেই তো জোড়া দিয়ে দিয়েছে বিমান।
প্রতিবাদ করলেন না মিস্টার আমান। পৃথিবী জোড়া দেয়ার ব্যাপারে নৌ পথেরও কৃতিত্ব কম নয়, কিন্তু সে-কথা তুললেন না, খেপে যাবে পাগলা পাইক। বিমান ছাড়া আর কিছু বোঝে না সে। দুর্গম এই পাহাড়ী অঞ্চলে বিমান চালাচ্ছে পাঁচ বছর ধরে। দূরদুরান্তে চলে যায়, কোন বাধাই তাকে ঠেকিয়ে রাখতে পারেনি। আজ পর্যন্ত। কুইটো থেকে উপকূলের গোয়োইয়াকইলেই যেতে চায় না অনেক, বৈমানিক, কিন্তু জোনসের কাছে ওটা ছেলেখেলা। মনের আনন্দে অ্যান্ডিজ। পর্বতমালা পেরিয়ে সীমাহীন জঙ্গল ছাড়িয়ে তারও পরের দুর্গম অঞ্চলে চলে যায় সে, যেখানে রয়েছে অগুনতি রবার বাগান, যেখান থেকে জোগাড় হয় কুইনিন। ভেবে। অবাক হতে হয়, আজতক একটা দুর্ঘটনা ঘটায়নি সে। আকাশছোঁয়া পাহাড়ের দেয়াল, বরফে ছাওয়া পর্বত-চূড়া, ভীষণ জঙ্গল, প্রতিকূল আবহাওয়া কোন কিছুই পরাজিত করতে পারেনি তাকে, সব কিছুই হার মেনে পথ ছেড়ে দিয়েছে। তার এই রেকর্ড এ-অঞ্চলে এখনও কেউ ভাঙতে পারেনি।
এসব কথা তিন গোয়েন্দাও জানে, মিস্টার আমানই বলেছেন। দেখা যাক এবার কি খেল দেখায়, ভাবল সবাই।
সামনের পাহাড়ের দেয়ালে একটা সরু ফাটল দেখা গেল। ওটাই বোধহয় জোনসের গিরি-আকাশ। কি একখান জায়গা। দুই ধারে দুই পাহাড়ের চুড়া, হাঁ করে রয়েছে, যেন প্রকাণ্ড এক দৈত্য চোখা চোখা পাথর ঠেলে বেরিয়ে রয়েছে, যেন হায়ের মাঝে দৈত্যের দাঁত। ওসব দাঁতের যে কোন একটাতে শুধু ছোঁয়া লাগলেই ছিন্নভিন্ন হয়ে যাবে খুদে বিমানটা। সাংঘাতিক বিপজ্জনক পথ।