নিশ্চয়। ব্রেক ঠিক হয়েছে?
ভালভাবে করতে সময় লাগবে। তবে কাজ চালানোর মত হয়েছে।
চলবে তো?
তা চলবে। অন্তত আমি চালাতে পারব।
বিশ্বাস করল কিশোর। অল্পক্ষণের পরিচয়েই লোকটাকে অনেকখানি চিনে। ফেলেছে। জোনস যখন পারবে বলছে, পারবে।
ঠিক আছে, উঠল কিশোর। কাল ভোরে মাঠে হাজির থাকব। খুব ভোরে।
দরজার কাছে দুজনকে এগিয়ে দিয়ে গেল জোনস। বলল, যেতে পারবে? নাকি আমি আসব?
আরে পারব, পারব, হেসে বলল মুসা। হাতের মুঠো পাকিয়ে দেখাল, ও দশটা দিলে আমরা দুজন দুটো তো দিতে পারব। এত সহজে কাবু হব না। চলি। গুড বাই।
নিরাপদেই হোটেলে ফিরে এল দুজনে।
০৩.
সবুজ নরকে যাওয়ার জন্যে সবাই তৈরি? নাটকীয় ভঙ্গিতে বলল জোনস। তাহলে আসুন, উনি আমার পক্ষিরাজে, আদর করে চার সীটের বোনানজা বিমানটার গায়ে চাপড় মারল সে।
উঠল যাত্রীরা। জোনসের পাশে মিস্টার আমান।
পেছনে গাদাগাদি করে বসল তিন গোয়েন্দা, দুজনের জায়গায় তিনজন। দুটো সীটের মাঝে হাতল নেই বলেই বসতে পারল। তাদের মালপত্র আর রাইফেল বন্দুক তোলা হয়েছে লাগেজ কম্পার্টমেন্টে।
অসুবিধে হবে না তো? জিজ্ঞেস করল কিশোর।
নাহ, এঞ্জিন স্টার্ট দিল জোনস। তোমরা তো মোটে তিনজন, তা-ও ছেলেমানুষ। ওই জায়গায় চার-চারজন পূর্ণবয়স্ক ইনডিয়ানকে তুলেছি আমি।
চারজন! জায়গা কোথায়?
মেঝেতে লম্বা হয়ে শুয়ে পড়েছে একজন। তার ওপর পা তুলে দিয়ে সীটে বসেছে তিনজন। সামনের সীটেও দুজন ছিল।
উড়তে অসুবিধে হয়নি?
উড়ব তো আমি। আমার ইচ্ছে না প্লেনের ইচ্ছে?
জোনসের ইচ্ছেতেই যে প্লেনটা চলে, সেটা বোঝা গেল খানিক পরেই। কেন তাকে লোকে পাগলা পাইক বলে, তারও প্রমাণ মিলল।
রানওয়ে নেই। ঘাসে ঢাকা বিশাল এক মাঠ, ওটাই এয়ারফিল্ড। এর ওপর দিয়েই ঝাঁকুনি খেতে খেতে ছুটে চলল বোনানজা।
গতি বাড়ছে দ্রুত। ঘণ্টায় একশো দশ কিলোমিটারে উঠে গেল, এই সময় পাশ থেকে কোণাকুণি এসে ধাক্কা মারল জোর হাওয়া, ঝড়ো হাওয়াই বলা যায়। নিমেষে নাক ঘুরে গেল প্লেনের, তীব্র গতিতে ছুটে গেল ফায়ার ব্রিগেডের একটা লরির দিকে।
দুটো উপায় আছে এখন জোনসের হাতে। ব্রেক কষা কিংবা ওড়ার চেষ্টা করা। ব্রেক কষে সুবিধে হবে না, যা গতি এখন, আটকাতে পারবে না। জোরাজুরি করতে গেলে, ব্রেক যা-ও বা আছে, তা-ও যাবে খারাপ হয়ে। বাকি রইল উড়ে যাওয়া। কিন্তু ক্ষমতার তুলনায় ভার নিয়েছে বেশি, উড়তে পারবে কিনা ঠিক মত তাতেও সন্দেহ আছে। ঘোরানো হয়তো যায় এখনও, তাহলে বিমানের এক পাশের ডানা খোয়াতে হবে। এতবড় ক্ষতি করতে রাজি নয় জোনস, প্রাণ যায়। যাক, সে-ও ভাল।
বিপদ আঁচ করে ফেলেছে এয়ারফিল্ডের লোকেরা। তীক্ষ্ণ স্বরে চেঁচিয়ে উঠল ক্র্যাশ সাইরেন। গ্যাস-ভরা বোতল থেকে ছিটকে বেরোনো ছিপির মত বেরিয়ে আসছে লরির ভেতরের ফায়ারম্যানেরা, যে যেদিকে পারছে লেজ তুলে দৌড়। যেভাবে ছুটে আসছে বোনানজা, লরি সরানোর সময় নেই।
হাসি ফুটেছে পাগলা পাইকের ঠোঁটে, সোজা ছুটে যাচ্ছে লরির দিকে। এক ধাক্কায় গতিবেগ অনেক বাড়িয়ে দিয়েছে প্লেনের। আত্মহত্যা যেন তার কাছে এক ভীষণ রোমাঞ্চকর ব্যাপার।
স্তব্ধ হয়ে গেছে যাত্রীরা। নিরুপায় হয়ে হাত-পা ছেড়ে দিয়ে বসে আছে সবাই।
গতি আরও বাড়ল। প্রচণ্ড গর্জনে প্রতিবাদ জানাচ্ছে এঞ্জিন। কিন্তু জানিয়ে যে লাভ নেই, সেটাও নিশ্চয় বুঝতে পারছে, এত দিন ধরে গোলামি করছে খেপা লোকটার। কাজেই প্রতিবাদ জানালেও মনিবের নির্দেশ অমান্য করছে না। সাধ্যমত চেষ্টা করছে বাঁচার জন্যে।
সামনে বিশাল লাল ধাতব গাড়িটা পাহাড় হয়ে দাঁড়িয়ে আছে যেন। গুতো লাগাতে ছুটে যাচ্ছে প্লেন।
হঠাৎ কি জানি কি করল পাগলা পাইক, খেয়াল রাখতে পারল না যাত্রীরা। ঝটকা দিয়ে বোনজার সামনের চাকা উঠে গেল ওপরে, মসৃণ গতিতে মাটি ছাড়ল। পেছনের চাকা। শা করে উড়ে চলে এল লরির কয়েক ইঞ্চি ওপর দিয়ে। আর এক মুহূর্ত দেরি করলেই গিয়েছিল।
চেপে রাখা বাতাস ফোঁস করে ছেড়ে ফুসফুস খালি করল যাত্রীরা। কিন্তু। বিপদ পুরোপুরি কাটেনি তখনও।
টলমল করছে প্লেন, সোজা হতে চাইছে না কিছুতেই, লেজের দিকটা খালি ঝুলে পড়তে চায়। মাল বেশি বোঝাই করে ফেলেছে, সেটা একটা কারণ। আরেকটা কারণ, সমুদ্র সমতল থেকে এত উঁচুতে বাতাস খুবই পাতলা, ঠিকমত কামড় বসাতে পারছে না প্রপেলার।
মাতুলামি সামান্য কমলো। ধীরে ধীরে ওপরে উঠতে শুরু করল প্লেন।
কিশোর জিজ্ঞেস করল, ওঠার রেট কি আপনার?
সী লেভেলে মিনিটে নয় শো ফুট, জবাব দিল জোনস। কিন্তু এখানে বড় জোর পাঁচশো।
সার্ভিস সিলিং? আকাশ ছুঁড়ে ওঠা বরফে ছাওয়া পর্বতের চূড়ার দিকে চেয়ে আছে কিশোর, দৃষ্টিতে ভয় মেশানো বিস্ময়।
সতেরো হাজার ফুট। নেহায়েত মন্দ না, কি বলো?
কিন্তু ওই চূড়া তো পেরোতে পারবেন না, সামনে হাত তুলে দেখাল কিশোর। দুই হাঁটুর ওপর বিছানো ম্যাপের দিকে তাকাল। তেরোটা বিশাল আগ্নেয়গিরি মাথা চাড়া দিয়ে আছে ইকোয়াডরে। কয়েকটা প্রায় গায়ে গায়ে ঠেকে গিয়ে ঘিরে রেখেছে কুইটোকে। ওই তো কোটোপ্যাক্সি, পৃথিবীর বৃহত্তম জীবন্ত আগ্নেয়গিরি, উঠে গেছে উনিশ হাজার ফুট উঁচুতে। কেইয়ামবি আর অ্যানটিসানার চুড়াও ওটার চেয়ে খুব একটা কম যায় না।