টাকা নিল না জিবা। গোমড়ামুখে বলল, রাত দশটায়ই রওনা দেব, সিনর।
ভেরি গুড। টাকাটা আবার মানিব্যাগে রেখে দিল কিশোর।
জানোয়ার তোলা শেষ। দেখার আর কিছু নেই, একে একে চলে গেল সবাই। ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই একেবারে জনশূন্য হয়ে গেল ঘাট।
নিঃশব্দে নোঙর তুলল তিনটে নৌকা। ভেসে পড়ল আমাজনের ষোতে। পেছনে পড়ে থাকল ভেলাটা, শূন্য, রিক্ত।
ভ্যাম্প মিয়া ভেলা চেয়েছিল, হেসে বলল মুসা। নিয়ে যাক এখন।
মঞ্চে হাল ধরে দাঁড়িয়েছে জিবা। দাঁড় বাইছে চারজন ইনডিয়ান। একজনকে সরিয়ে দিয়ে তার জায়গা নিল কিশোর। অধীনস্থদের বোঝানো দরকার, মনিবেরা কাজের লোক।
ছোট বজরায় গিয়ে দু-জন মান্নার সঙ্গে দাঁড় টানায় যোগ দিল মুসা। রবিন গেল কফি বানাতে।
বড় বজরাটায় টলডোর ভেতরে রাখা হয়েছে জানোয়ারগুলোকে। খাঁচার ছাত থেকে চুপচাপ ঝুলে রয়েছে রক্তচাটা। বসে বসে ঝিমুচ্ছে ময়দা, নৌকা জোরে দুললেই মৃদু কিচকিচ করে উঠছে। খানিক পর পরই এসে দরজার বাইরে নাক বের। করছে না, নৌকার দুলুনী ভাল লাগছে না তার। ভীতু ঘোড়ার বাচ্চার মত চি চি করে প্রতিবাদ জানিয়ে ফিরে যাচ্ছে আবার নিজের ঘাসপাতার বিছানায়। কুঁড়ের। বাদশাহ ডাইনোসর একেবারে চুপ, পাটাতনে শুয়ে গভীর নিদ্রায় অচেতন। এক পায়ে ভর রেখে ঘরের কোণে ধ্যানমগ্ন হয়ে আছে লম্বু দার্শনিক, দুনিয়ার আর কোন খেয়ালই যেন নেই তার। মাস্তুলে ঝুলছে চুলে বাধা কিকামু। তারার দিকে চেয়ে মাথা নাড়ছে যেন আপনমনে।
আবছা অন্ধকার আকাশ থেকে যেন ঝুলে রয়েছে কৃষ্ণপক্ষের একটুকরো ক্ষয় চাঁদ, ক্লান্ত, বিষণ্ণ। ভুতুড়ে হলদে আলো ছড়াচ্ছে, আঁধার তো কাটছেই না, কেমন। যেন আরও রহস্যময় হয়ে উঠেছে। চাঁদের দিকে তাকাতে সাহস করছে না মুসা, গা ছমছম করে। কিশোর দাঁড় টানায় এত ব্যস্ত, তাকানোর সময়ই নেই।
পাশের বন থেকে ভেসে এল রক্ত-জমাট-করা ভয়াক গর্জন। না, টিগ্রে নয়। শুনে মনে হয় মরণযুদ্ধে মেতেছে একপাল ভয়াল নেকড়ে, কিংবা ভীষণ সিংহ। কিন্তু কিশোর জানে, নেকড়েও নয়, সিংহও নয়, ওটা এক জাতের বানরের ডাক। নিশার ফুরফুরে বাতাসে মাতোয়ারা হয়ে দরাজ গলায় গান ধরেছে গুটি কয়েক হাওলার। মাংকি। সাধারণ কুকুরের চেয়ে বড় নয়, অথচ গলায় এত জোর, তিন মাইল দূর থেকেও শোনা যায় চিৎকার।
মানুষের স্নায়ুর ওপর খুব খারাপ প্রতিক্রিয়া করে ওই শব্দ। একজন নেচারালিস্ট-এর কথা মনে পড়ল কিশোরের। তিনি লিখেছেন :
ডাকটা প্রথম যেদিন শুনলাম, মনে হলো, বনের ভেতরে মরিয়া হয়ে লড়াইয়ে মেতেছে আমাজনের সমস্ত জাগুয়ার।
তার বিশ্বাস, হিংস্রতার দিক দিয়ে বেবুনের পরেই হাওলার মাংকি। এমনিতে মানুষকে ভয় করে, কিন্তু আক্রান্ত হলে ভয়ানক হয়ে ওঠে ওরা। চোয়ালে অসাধারণ জোর। একবার নাকি এক ভ্রমণকারীর শটগানের নল কামড় দিয়ে চ্যাপ্টা করে দিয়েছিল একটা হাওলার।
হাওলারের গর্জন থামলে কানে আসে হাজারো; লাখো ব্যাঙের কোলাহল। এরই মাঝে খুব আবছা শোনা যায় নিঃসঙ্গ কুমিরের কান্নার মত ডাক, শিংওলা পেঁচার তীক্ষ্ণ কর্কশ চিৎকার, পিরের হেষারব, পেকারির ঘোৎ-ঘোৎ। আরও নানা রকম অজানা জীবের বিচিত্র সব ডাকও শোনা যাচ্ছে।
সব কিছুকে ছাপিয়ে মাঝে মাঝে কেশে উঠছে, কিংবা ধমক দিচ্ছে জাগুয়ার। ক্ষণিকের জন্যে চুপ হয়ে যাচ্ছে সবাই। খানিক পরে আবার শুরু করছে হট্টগোল।
বাতাসের বেগ বাড়ল। পাল তোলার নির্দেশ দিল কিশোর।
প্রতিবাদ জানাল জিবা। অন্ধকার নদীর বাঁকে বাঁকে ঘাপটি মেরে আছে বিপদ, কালো পাথরের চোখা চাঙর, বালির ডুবোচরা, ভেসে যাওয়া কাঠের গুঁড়ি।
ওসব জানা আছে কিশোরের। ওগুলোতে লাগলে কি সর্বনাশ হবে, তা-ও বুঝতে পারছে। কিন্তু ভ্যাম্পের কাছ থেকে সরে যেতে হলে ঝুঁকি না নিয়ে উপায় নেই।
ফুলে উঠল পাল। সেই সঙ্গে দাঁড় বাওয়া চলছে। তারওপর ভাটিয়াল স্রোত। তরতর করে ছুটে চলল নৌ-বহর।
দু-বার ঘষা লাগল বালির চরায়। আটকে যেতে যেতে, কোনমতে পার হয়ে এল নৌকা। একবার ধাক্কা লাগল বিরাট এক গাছের গুঁড়ির সঙ্গে। কিন্তু চোখের। পলকে জীবন্ত হয়ে উঠল গুঁড়িটা, কান্নার মত ডাক দিয়ে পানিতে আলোড়ন তুলে, ডুবে গেল।
ঘোলাটে জ্যোৎস্নার, চেয়ে তারার আলোই যেন বেশি।
সাদার্ন ক্রসের গায়ে বুঝি শিশির জমেছে। ভেজা বাতাস কনকনে ঠাণ্ডা।
মাঝরাতের দিকে কমতে কমতে একেবারে থেমে গেল বনের চিৎকার, ভোর রাতে শুরু হলো আবার। ঘড়ির দরকার হয় না। ওই শব্দ শুনলেই বুঝতে হবে, ভোরের আর মাত্র আধঘণ্টা বাকি।
উঠতি সুর্যের সোনা-রোদে যেন জ্বলে উঠল বুনো ফুলের স্তবক। সবুজ বন সোনালি, নদীর ঘোলা পানিও সোনালি, তরল সোনা গুলে দেয়া হয়েছে যেন সব কিছুতে। পাখির কলরবে বনভূমি মুখর। ঝলমলে রঙিন ডানা মেলে উত্তরে উড়ে চলেছে এক ঝাঁক শুনবিল।
রোদ চড়ল। গাছের মাথা থেকে নামতে নামতে গোড়ায় পৌঁছল। দুটো দ্বীপের। মাঝের খাল দিয়ে চলল নৌবহর। দু-দিকেই ঘন বন। পাল নামিয়ে ফেলা হলো। দাঁড় বাওয়াও বন্ধ। তোতের টানে আপন গতিতে ভেসে চলল তিনটে নৌকা।
নাস্তা করতে বসল যাত্রীরা। মানুষের জন্যে কফি, ম্যানডিওকার তৈরি মোটা রুটি আর শুকনো গরুর মাংস। জানোয়ারগুলোরও খিদে পেয়েছে, একেকটার জন্যে একেক রকম খাবারের ব্যবস্থা হলো।