পেছনে এগিয়ে আসছে জুতোর মচমচ। এলোমেলো পদশব্দ, থামবে কিনা। ভাবছে বোধহয়, দ্বিধায় ভুগছে। থামল একবার, এগোল..আবার থামল আবার এগিয়ে এসে একেবারে গোয়েন্দাদের পেছনে দাঁড়াল।
হঠাৎ ঘুরে লোকটার মুখে আলো ফেলল কিশোর।
ইকোয়াডরিয়ান নয়। হোঁতকা, বিশালদেহী। ল্যাটিন আমেরিকার লোকেরা সাধারণত হালকা-পাতলা ছোটখাটো হয়। ইনডিয়ানরাও হালকা-পাতলা, তবে ল্যাটিনদের মত ছোট নয়, আর চেহারা বেশ কর্কশ। এই লোকটা তার কোনটাই নয়। কিশোরের মনে হলো, এককালে মুষ্টিযোদ্ধা ছিল, কিংবা শিকাগো শহরের গুণ্ডা-সর্দার। চোখে আলো পড়ায় বিকৃত হয়ে গেল নিষ্ঠুর চেহারাটা! চমকে যাওয়া বাঘের চোখের মত জ্বলছে রক্তলাল দুই চোখ।
মুসার ধারণা হলো, আমাজন জঙ্গলের নরমুণ্ড শিকারীদের চেহারাও এত ভয়ঙ্কর নয়।
আমাদের পেছনে আসছেন কেন? জোর করে কণ্ঠস্বর ঠিক রাখল কিশোর।
চোখ মিটমিট করল লোকটা। তোমাদের পেছনে আসব কেন? হাঁটতে বেরিয়েছি।
আমরা যে যে পথে যাচ্ছি ঠিক সে-পথেই হাঁটা লাগছে আপনার? আর জায়গা। নেই? ভয়ে ভয়ে রয়েছে কিশোর, মেরে না বসে ডাকাতটা।
তোমাদের পথেই এসেছি কেন ভাবছ?
ভাবছি না, জানি। যা জুতো পরেছেন না…
মাশাআল্লাহ। কিশোরের বাক্যটা শেষ করল মুসা। দশ মাইলের মধ্যে। মরাও জেগে যাবে। আপনার কানে খারাপ লাগে না?
খারাপ? কেন? খোয়ায় হাঁটলে সব চামড়ার জুতোই মচমচ করে, কম আর বেশি। ২
তবে আপনারগুলো মিউজিয়ামে রাখার মত।
অনুসরণ করছিলেন কেন? কিশোর বলল। ছিনতাই-টিনতাইয়ের ইচ্ছে?
জ্বলে উঠল লোকটার চোখ। হাত তুলতে গিয়েও কি ভেবে তুলল না। বোধহয় ভাবল, দুটো ছেলেকে এক সঙ্গে কাবু করতে পারবে না। নিগ্রো ছেলেটা আবার গায়েগতরে বেশ তাগড়া। ওকে কাহিল করতে তার মত ফাঁইটারেরও বেগ। পেতে হবে। তাছাড়া এখানে ঘনবসতি। চেঁচামেচি শুনে লোক বেরিয়ে আসবে, আর এলে ছেলেদের পক্ষ যে নেবে না তার কি নিশ্চয়তা আছে?
হাসল লোকটা। জোর করে হাসছে বোঝাই যায়। ঠিকই বলেছ, তোমাদের পিছুই নিয়েছি। তবে চুরি-ডাকাতির জন্যে নয়। দেখলাম তোমরা বিদেশী, আমিও বিদেশী। এখানে তো ইংরেজি জানা লোকের অভাব। তোমরা হয়তো জানো, তাই জিজ্ঞেস করতে এসেছি, স্যানটো ডোমিংগো গির্জাটা কোথায়। আজ রোববার, সারাদিন সময় পাইনি। ভাবলাম, শেষ কয়েকটা মোম জ্বেলে দিয়ে আসি, আকাশের দিকে রক্তলাল চোখ তুলল সে। ঈশ্বর তো দেখছেন।
ভূতের মুখে রাম নাম, বাংলায় বিড়বিড় করল কিশোর। ইংরেজিতে বলল, ঠিক জানি না কোনদিকে। ওদিকে হবে হয়তো, ফ্লোরেস রোডের মোড়ে। ঘণ্টা শুনেছিলাম।
ধন্যবাদ, ভদ্রভাবে বলার চেষ্টা করল লোকটা, কিন্তু স্বভাব-কর্কশ কণ্ঠ কত আর মোলায়েম করা যায়? আবার দেখা হবে।
আমার কোন ইচ্ছে নেই, এই কথাটাও বাংলায় বলে ঘুরল কিশোর। জোনসের দরজায় থাবা দিল।
দরজা খুলল তরুণ পাইলট। ছেলেদেরকে ডেকে নিয়ে গিয়ে বসাল বসার ঘরে। ফায়ার প্লেসে গনগনে আগুন। উষ্ণ বাতাস। খুব আরাম।
কি ব্যাপার? কিছু হয়েছে নাকি? ছেলেদের মুখ দেখেই কিছুটা আন্দাজ করে। নিয়েছে জোনস। চোরাচোড় লেগেছিল পেছনে?
কি করে জানলেন? পাল্টা প্রশ্ন করল কিশোর।
জানা লাগে না। এখানে ওদের অভাব নেই, হাসল বৈমানিক। বিদেশী দেখলেই পেছনে লাগে।
চেহারা যাই হোক, হাসিটা খুব সুন্দর লোকটার।
খুলে বলল সব কিশোর।
মুসা বলে দিল রহস্যময় টেলিগ্রামের কথাটা। বিমান ভাড়া করতে গিয়ে মাত্র সেদিনই পরিচয় হয়েছে জোনসের সঙ্গে। কেন তার কাছে এত কথা বলল, ওরা জানে না। বোধহয় তার হাসিটাই দ্রুত আপন করে নেয় মানুষকে।
হু, সব শুনে মাথা দোলাল জোনস। কিন্তু দুটো ব্যাপারকে এক করছ কেন?
করছি এ-জন্যে, কিশোর বলল, লোকটা ডাকাত হলে ডাকাতি করত। হয়তো শেষ মুহূর্তে ঘাবড়ে গেছে।
উঁহু, হতেই পারে না। ঘুসি মারলেই চিত হয়ে যেতাম আমরা। চুরি ডাকাতির জন্যে নয়, অন্য কোন ব্যাপার আছে।
আচ্ছা, জিজ্ঞেস করল জোনস, লস অ্যাঞ্জেলেসে কি তোমাদের কোন শত্রু আছে?
যে কাজ করি, থাকতেই পারে…
কি কাজ করো?
শখের গোয়েন্দাগিরি। তিন গোয়েন্দা আমরা।
বাহ, শুনে তো দারুণ মনে হচ্ছে, মিটিমিটি হাসছে বৈমানিকের চোখ দুটো। তা খুলেই বলো না। দাঁড়াও, কফি করে নিয়ে আসি। আপত্তি আছে?
না, মুসা বলল। যা ঠাণ্ডার মধ্যে এসেছি। একটু কড়া হলে ভালই হয়।
কফি খেতে খেতে কথা হলো।
সংক্ষেপে তাদের কথা জানাল কিশোর।
চমৎকার! দারুণ! ইস, এখানে যদি থাকতে তোমরা, শিওর তোমাদের দলে যোগ দিয়ে ফেলতাম, ঠেলেও সরাতে পারতে না।…আচ্ছা, কিশোর, ওই লোকটা পিছু নিল কেন কিছু ভেবেছ? সামান্য আলাপেই গোয়েন্দাগিরির শখটা সংক্রমিত হয়েছে জোনসের মাঝে।
বুঝতে পারছি না। তবে, লস অ্যাঞ্জেলেসে আরেকজন জানোয়ার ব্যবসায়ী আছে। আমরা ব্যবসা খুলতে যাচ্ছি শুনে আমার চাচার সঙ্গে দেখা করেছিল। মুসার বাবার সঙ্গেও। এই ব্যবসা ভাল না, হেন না তেন না বলে অনেক রকমে বোঝাতে চেয়েছিল। যাতে আমরা এই ব্যবসায় না নামি।
তার কি অসুবিধে?
প্রতিযোগী হয়ে যাব না? জবাব দিল মুসা। এমনিতেই ওর ব্যবসা মন্দা। আমরা নামলে হয়তো ফেলই মারবে।
হু, তা-ও তো কথা।
হ্যাঁ, প্লেনের কি হলো? আসল কথায় এল কিশোর।
কাল সকালেই রওনা হতে চাও?