সামনে দীর্ঘ যাত্রা। তিন গোয়েন্দা উত্তেজিত। ভেলার পাশে বজরা বেঁধে ওগুলোতে মাল আর জানোয়ার তুলতে শুরু করল। সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। আলো থাকতে থাকতেই কাজ শেষ করতে চায় কিশোর। পরদিন খুব ভোরে উঠে রওনা দেবে।
ঘাটে অনেক দর্শক জমেছে। জানোয়ার তোলা দেখছে ওরা, মাঝেসাঝে দু একটা পরামর্শও দিচ্ছে। পিরের বাচ্চা, বানর আর বাদুড় তোলাটা কিছুই না। ঝামেলা করল ইগুয়ানা। নড়তে চায় না। ওটাকে বেশি চাপাচাপিও করা যায় না, লেজ খসে যায় যদি?
যা-ই হোক, তোলা গেল অবশেষে।
হাঁকডাকে জ্যাবিরু গেল ঘাবড়ে। উড়ে গেল ওটা। পায়ে বাধা পঞ্চাশ ফুট দড়িতে হ্যাঁচকা টান লাগতেই ওপরে উঠা থামিয়ে চক্কর দিয়ে উড়তে শুরু করল। দড়ি ধরে ধীরে ধীরে টেনে নামিয়ে আনা হলো ওটাকে।
কাজ প্রায় শেষ, ভিড় ঠেলে এগিয়ে এল বিশালদেহী এক লোক। ভেলায় এসে উঠল।
দেখামাত্র চিনল ওকে কিশোর আর মুসা। অন্ধকার হয়ে গেছে। আরও ভালমত দেখার জন্যে লোকটার মুখে টর্চের আলো ফেলল কিশোর। না, কোন ভুল নেই। সেই লোকটাই। চোখা কান। কুৎসিত নিষ্ঠুর চেহারা।
হাল্লো, বলল কিশোর। আপনাকে কোথাও দেখেছি মনে হয়?
হ্যাঁ। কুইটোতে। গির্জা খুঁজছিলাম।
মোম নিশ্চয় জেলেছেন?
মিছে কথা বলেছি। আসলে তোমাদের পিছুই নিয়েছিলাম।
আজ ভেলার দড়ি কে খুলতে এসেছিল? আপনি?
ভুল করেছিলাম। আমাদের ভেলা ভেবেছিলাম।
নিশ্চয়, টিটকারির ভঙ্গিতে মাথা দোলাল কিশোর। তা আপনার নামই তো। জানা হলো না এখনও।
হাসল লোকটা। নাম? নাম জেনে আর কি হবে? বন্ধু বলে ডাকতে পারো। দাঁত বের করে হাসল আবার লোকটা। সরু চোখা দাঁত, ওপরের পাটিতে দুদিকের দুটো দাঁতের মাথা এত চোখা ও লম্বা, শ্বদন্ত বলেই ভুল হয়।
হু, মাথা দোলাল আবার কিশোর। নাম একটা আমিই দিই আপনার। ভ্যাম্পায়ার। সংক্ষেপে ভ্যাম্প। তা কি করতে পারি আপনার জন্যে?
দেখো, কণ্ঠস্বর বদলে গেল লোকটার, হাসি হাসি ভাবটা আর নেই, গোলমাল করতে চাই না। একটা চুক্তিতে আসা যাক।
কার তরফ থেকে? মার্শ গ্যাম্বল? অন্ধকারে ঢিল ছুঁড়ল কিশোর। ওই লোকটাই লস অ্যাঞ্জেলেসে তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী জানোয়ার ব্যবসায়ী।
চমকে উঠল ভ্যাম্প, চোখে বিস্ময়। কার কথা বলছ?
ভালমতই জানেন, কার কথা বলছি। আপনার মত আরেকটা ভ্যাম্প। নিজের মুরোদ নেই, জানোয়ার ধরার জন্যে লোক রেখেছে। বোঝাই যাচ্ছে, ঠকায় ওদেরকে, ফলে পছন্দসই জানোয়ার পায় না। এখন আরও একটা ব্যাপার পরিষ্কার হলো, অন্যের জিনিস ছিনিয়ে নেয়। ডাকাত পোষে সে জন্যে।
জুলে উঠল ভ্যাম্পের চোখ। দেখো, কণ্ঠস্বর স্বাভাবিক রাখতে কষ্ট হচ্ছে তার, ছিনিয়ে নেব বলিনি আমি…
না, চুরি করতে এসেছিলেন আরকি দুপুরবেলা।
বেশি ফ্যাঁচফ্যাঁচ কোরো না, ছেলে। যা বলছি, শোনো। জানোয়ারগুলো বিক্রি করে দাও আমার কাছে।
কত দেবেন?
এক হাজার ডলার।
মুচকি হাসল কিশোর। জবাব দিল না।
দু-হাজার?
দশ হাজারেও না। বিশ হাজার দিতে যে কেউ রাজি হবে।
আর একটা আধলাও দেবো না। দুই, ব্যস।
পথ দেখতে পারেন তাহলে।
পস্তাবে, খোকা, এই বলে দিলাম। ভাল চাও তো দিয়ে দাও।
শার্টের হাতা গুটিয়ে এগিয়ে এল মুসা। আরেক পাশ থেকে রবিনও এগোল, হাতে শটগান।
ব্যাটাকে পানিতে ফেলে দেব? কিশোরের দিকে চেয়ে জিজ্ঞেস করল মুসা।
ভ্যাম্পের লাল চোখ টকটকে হয়ে গেল। ইঁদুরের বাচ্চারা, দেখাব… রাগে কথা ফুটছে না। দাঁড়া, দেখাব তোদের মজা! সোজা আঙুলে ঘি যখন উঠল না,
থাবা দিয়ে রবিনের হাত থেকে শটগানটা ছিনিয়ে নিল মুসা। নামো। নইলে খোঁড়া হয়ে যাবে জন্মের মত।
দুপদাপ করে নেমে গেল ভ্যাম্প। জনতার ভিড় ঠেলে হারিয়ে গেল ওপাশে।
নিচুস্বরে রবিন বলল, আবার আসবে। সকালের আগেই।
আমিও তাই ভাবছি, কিশোর বলল। রাতেই আসবে। কিংবা আমাদের পিছু নেবে সকালে।
কি করব তাহলে? মুসার প্রশ্ন।
উপায় একটাই?
কী?
এগিয়ে থাকো। ভিড় সরে গেলেই নৌকা ছাড়ব। রাতের মধ্যেই এগিয়ে থাকব। অনেকখানি। ভ্যাম্প রওনা হতে হতে অর্ধেক দিনের পথ এগিয়ে যাব আমরা।
কিন্তু আমরা যখন জানোয়ার ধরব, ওই সময় আবার এগিয়ে আসবে, রবিন বলল।
হারিয়ে যাব আমরা। খুঁজে পাবে না, বলল কিশোর।
মানে?
নদীটা কয়েক মাইল চওড়া, মাঝে ছোট-বড় অনেক দ্বীপ আছে। অসংখ্য খাল আছে ওগুলোর ভেতরে ভেতরে। কোটা দিয়ে আমরা ঢুকেছি, কোন দিকে গেছি, কি করে জানবে?
হ্যাঁ, তা ঠিক, মেনে নিল রবিন
জিবাকে ডেকে বলল কিশোর, এক ঘণ্টার মধ্যেই রওনা দেবে। লোকজন যেন তৈরি রাখে।
না না, সিনর, প্রবল আপত্তি জানাল জিবা। সকালের আগে যাওয়া যাবে না।
আজ রাতে ঠিক দশটায় বজরা ছাড়ব, সিদ্ধান্তে অটল রইল কিশোর।
বিপদে পড়বে, সিনর। রাতে যাওয়া যাবে না।
কিশোর বুঝল, অহমে লাগছে লোকটার। বয়স্ক, এদিককার নদী-বন সম্পর্কে। অভিজ্ঞ তাকে কিনা আদেশ দিচ্ছে এক পুঁচকে ছেলে। মানবে কেন?
কিন্তু জিবাকে বুঝিয়ে দেয়া দরকার, কে মনিব। পকেট থেকে মানিব্যাগ বের করে টাকা গুণলো কিশোর। বাড়িয়ে দিয়ে বলল, এই নাও।
কি?
বিকেলে যে কাজ করেছ, তার টাকা। নিয়ে বিদেয় হও।
হাঁ হয়ে গেল জিবা। বলে কি ছেলেটা? আমাকে ছাড়া যেতে পারবে না। এই নদীর কিচ্ছু চেনো না তুমি।
পারব পারব, হাসল কিশোর। তোমাকে ছাড়া এতখানি যখন আসতে পেরেছি, যেতেও পারব।