অপেক্ষা করতে রাজি হয়নি লোকটা। পরে আসবে বলে নৌকা নিয়ে চলে গেছে।
লোকটার চেহারার বর্ণনা চাইল কিশোর।
কনস্টেবল যা বলল, তাতে বোঝা গেল, লোকটা বিশালদেহী, খারাপ চেহারা এবং নো জেন্টলম্যান। ইংরেজির টানে স্প্যানিশ বলে।
কনস্টেবলের হাতে একটা ডলার গুঁজে দিল কিশোর। খুশিতে ময়লা দাঁত সব বেড়িয়ে পড়ল লোকটার।
মুসা আর রবিনকে ভেলা পাহারায় রেখে থানায় গেল কিশোর ডায়রি করাতে।
থানার লোকেরা হেসেই উড়িয়ে দিল।
ভুল করেছে আরকি, বলল চীফ। যাও তুমি, আবার কোন গোলমাল হলে এসে বলো।
পরিষ্কার বুঝল কিশোর, আবার কিছু হলে তাদেরকেই সামলাতে হবে, পুলিশের সাহায্য পাওয়ার আশা নেই। ইউ এস কনসালের সঙ্গে দেখা করল সে। খুলে বলল সব।
শুধু চেহারার ওই বর্ণনা দিয়ে এখানে ধরা যাবে না কাউকে, কনসাল বললেন। ওরকম চেহারার অনেক আছে। দেখো, তোমরা যদি খুঁজে বের করতে। পারো। কিন্তু তাহলেও কিছু করার নেই। ওর বিরুদ্ধে কোন কিছু খাড়া করতে পারবে না, কোন প্রমাণ নেই তোমাদের হাতে। দড়ি খুলতে এসেছিল, কনস্টেবল। মানা করায় চলে গেছে। জেলে যাওয়ার মত কিছুই করেনি সে। কোন অ্যাকশন না। নিয়ে ঠিকই করেছে পুলিশ। ধরলেও আবার ছেড়ে দিতে হত। সেক্ষেত্রে আরও বেপরোয়া হয়ে যেত তোমাদের ভিলেন।
ঠিকই বলেছেন কনসাল। কিশোর জিজ্ঞেস করল, তাহলে আপনার পরামর্শ কি?
বলব? মিস্টার আমানের পথ ধরো। প্লেনে চড়ে সোজা বাড়ি চলে যাও। বুঝতে পারছি, তোমাদের শত্রু আছে এখানে। জানোয়ারগুলোর অনেক দাম। চোর-ডাকাতের চোখ তো পড়বেই। এখানে ওদের অভাবও নেই। গলাকাটা। ডাকাত অনেক আছে। ইকিটোজে যতক্ষণ আছ, আইনের সাহায্য পাবে, সে ব্যবস্থা করতে পারব। কিন্তু জঙ্গলে পুলিশ যাবে না। সেখানে একটাই আইন ও হয়। মারো, নয় মরো। সেটা অভিজ্ঞ পুরষমানুষের কাজ, তোমরা ছেলেমানুষ, টিকতে পারবে না।
ছেলেমানুষ শুনতে শুনতে কান পচে গেছে কিশোরের। মনে মনে রেগে গেল। পেয়েছে কি বুড়োরা? বয়েস কম হতে পারে, কিন্তু যে কোন বড়মানুষের চেয়ে কম কি ওরা? আর শিখতে শিখতেই ছেলেরা বড় হয়, অনভিজ্ঞরা অভিজ্ঞ হয়।
অনেক ধন্যবাদ, গম্ভীর হয়ে বলল কিশোর। কারও সাহায্য পাই আর না পাই, কাজ চালিয়ে যাব আমরা, কেউ ঠেকাতে পারবে না। আজতক পারেনি কেউ।
স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছেন কনসাল। হাসি ফুটল ধীরে ধীরে। খুব জেদি ছেলে। ওরকম মনোবল থাকা ভাল। গুড লাক।
কনসালের অফিস থেকে বেরোল কিশোর।
জেটিতে পৌঁছে দেখল ভেলায় টহল দিচ্ছে রবিন আর মুসা। দুজনের হাতেই রাইফেল। মূসার কোমরের ডান পাশে ঝোলানো খাপে ভরা পিস্তল, তার বাবার কোল্ট :৪৫, বাঁ পাশে বিরাট ছুরি। রবিনের কোমরে শুধু ছুরি। ভেলার কাছে খালি এসে দেখো, দেখাব মজা!-এমনি ভাবভঙ্গি।
আসলে ভয়ে কাতর হয়ে আছে দু-জনে। কিশোরকে দেখে হাঁপ ছাড়ল।
কাজ হলো? জিজ্ঞেস করল মুসা।
না। যা করার আমাদেরই করতে হবে।
সে-ভয়ই করছি। পারব?
দেখা যাক পারি কিনা। আগে থেকেই কেঁচো হয়ে গিয়ে লাভ নেই।
যাত্রার জন্যে তৈরি হতে লাগল ওরা।
নদীর উজানে ভেলা দিয়ে মোটামুটি কাজ চলেছে। কিন্তু ভাটিতে যেখানে স্রোত বেশি, ঝড়তুফানেরও ভয়, সেখানে এই জিনিস টিকবে না। ভাল, বড় নৌকা। দরকার। জাগুয়ার কিংবা অ্যানাকোণ্ডার মত বড় ভারি জীব রাখতে হলে অনেক বেশি জায়গা প্রয়োজন। আর বড় নৌকা চালানোর জন্যে মাল্লাও লাগবে।
সেই পুলিশ কনস্টেবলকে আবার দেখা গেল জেটির কাছে। বোধহয় আবার। ডিউটি পড়েছে এদিকে। মুসা আর রবিনকে ভেলায় রেখে তীরে উঠল কিশোর। পুলিশম্যানকে ভেলার দিকে নজর রাখতে বলে চলল ডকইয়ার্ডের অফিসে, নৌকা কিনতে।
ম্যানেজার লোক খুব ভাল সহজেই বোঝানো গেল তাকে, কি জিনিস চায় কিশোর। একটা নৌকা দেখাল।
নৌকা বা জাহাজের ব্যাপারে বাস্তব ধারণা প্রায় নেই কিশোরের, শুধু বই পড়ে যা জেনেছে। তবু দেখেই বুঝল, এই জিনিসই তাদের দরকার।
নৌকাটা পঞ্চাশ ফুট লম্বা। খুবই মজবুত। এর স্থানীয় নাম ব্যাটালাও। সামনের গলইয়ের কাছে কিছুটা বাদ দিয়ে পুরো নৌকার ওপরেই ছাত, ঘরের। মত। একে বলে টলডো। বাংলাদেশী বজরার ছবি দেখেছে কিশোর, এই নৌকাটাও অনেকটা বজরার মতই। তাই এর নাম রাখল বড় বজরা।
বেশ চওড়া বড় বজরা, পেটের কাছে প্রায় দশ ফুট। পেছনে হালের কাছে। একটা উঁচু মঞ্চ। ওখানে দাঁড়িয়ে হাল ধরে মাঝি। আশপাশ তো বটেই, ছাতের। ওপর দিয়ে সামনের দিকেও নজর রাখা যায় ওখানে থেকে। চারটে দাড়ের ব্যবস্থা। রয়েছে, একসঙ্গে দাঁড় টানতে পারবে চারজন মাল্লা। বাড়তি পাটাতনমত রয়েছে। নৌকার দুই ধারে। ওগুলো থাকাতে অল্প পানিতে লগি বেয়ে যাওয়া যাবে।
নৌকাটা কিনল কিশোর পঁচিশ ফুট লম্বা আরেকটা ছোট নৌকা কিনল, ওটার। স্থানীয় নাম মনট্যারিয়া। সে নাম দিল ছোট বজরা। বড় বজরার মত এর ওপরেও টলডো রয়েছে। হালকা বলে বড়টার চেয়ে জোরে ছুটতে পারে।
ডকইয়ার্ডের ম্যানেজারই মান্না জোগাড় করে দিল। ছয় জন। নৌকা বাইবে। ওরা, জানোয়ার ধরায়ও সাহায্য করবে। পাঁচজন ইনডিয়ান, আর অন্য লোকটা ক্যাবোক্লো-ইনডিয়ান ও পর্তুগীজের মিশ্র রক্ত; তার নাম জিবা।
ভেলার আর দরকার নেই, কিন্তু ক্যানূটা ফেলল না কিশোর। ওটাতে করেই এতদূর এসেছে। কাজের জিনিস। ভবিষ্যতে কাজে লাগবে। দুই বজরার সঙ্গে। বেঁধে নিল ওটাও।