দিনে চলে, রাতে ভেলা তীরে ভিড়িয়ে কোন গাছের সঙ্গে শক্ত করে বেধে তারপর ঘুমায় অভিযাত্রীরা। মাঝেসাঝে দু-একটা ভেলা দূর দিয়ে চলে যেতে দেখে। ইনডিয়ানদের ভেলা। নদীর পাড়ে কোন গ্রাম চোখে পড়ে না, খালি জঙ্গল। কোথা থেকে আসে ইনডিয়ানরা, কোথায় যায় ওরাই জানে। অভিযাত্রীদের দিকে ফিরেও তাকায় না।
মিস্টার আমানের অবস্থা আরও খারাপ হলো। উঠতেই পারেন না এখন।
এই সময় একদিন সকালে দেখা গেল শহর।
.
১১.
খুদে শহর, কিন্তু দীর্ঘ দিন শুধু জঙ্গল দেখে দেখে ওটাকেই নিউইয়র্ক নগরী বলে মনে হলো ওদের। শহরটার নাম হকিটোজ।
তাদের যাত্রাপথে এটাই শেষ শহর। সামনে একটানা গহীন অরণ্য, নদীর দুই তীরেই।
জেটিতে ভিড়ে একটা খুঁটিতে ভেলা বাধল ওরা। শতশত ছোটবড় নৌকা। রয়েছে ঘাটে। প্রায় সবাই মাল নিয়ে এসেছে। খালাস করা হচ্ছে রবার, তামাক, তুলা, কাঠ, নানা রকমের বাদাম।
সীমান্ত শহর। বেশির ভাগই কলকারখানা। কাঠের মিল, জাহাজ আর নৌকা মেরামতের ডকইয়ার্ড, সুতার কল, যন্ত্রপাতি মেরামতের কারখানা আছে। আর আছে মদ চোলাইয়ের বিশাল কারখানা-আখের রস থেকে রাম তৈরি করে। কাস্টমস আছে, মিউনিসিপ্যালিটি আছে, একটা সিনেমা হলও আছে। বিকেলের দিকে শহর ঘুরতে গিয়ে ছেলেরা দেখল, তাতে চলছে অনেক পুরানো একটা ছবি। কয়েক বছর আগেই রকি বীচে দেখে ফেলেছে ওটা ওরী।
ভেলায় ফিরে দেখল, নির্জীব হয়ে পড়ে আছেন মিস্টার আমান। ছেলেদের সাড়া পেয়ে চোখ মেললেন। বললেন, আমাদের বোধহয় বাড়িই ফিরে যেতে হবে।
কেন যেতে হবে, বলতে হলো না, বুঝল ছেলেরা। হাসপাতাল ছাড়া ভাল হবেন না মিস্টার আমান।
মঙ্গল, বৃহস্পতি আর শনিবারে প্লেন ছাড়ে ইকিটোজ থেকে। কাল সকালেই একটা ছাড়বে। যেতে হলে কালই যাওয়া দরকার।
মাঝরাত পর্যন্ত গুজগুজ ফিসফাস করল ছেলেরা।
ভোরে সূর্য ওঠার আগেই ছেলেদের ডেকে তুললেন মিস্টার আমান। তাড়াতাড়ি নাস্তা সেরে টিকেট কাটতে যেতে বললেন।
খেতে খেতে মুসা বলল, বাবা, একটা টিকেট কাটলেই চলবে।
মানে? ভুরু কুঁচকে তাকালেন মিস্টার আমান। রক্তশূন্য, ফ্যাকাসে চেহারা। অনেকগুলো ভাজ পড়ল কপালে।
বাবার জন্যে কষ্ট হলো মুসার। আমরা থেকে যাই। শেষ করেই যাই কাজটা।
না, পারবে না। তোমরা সবাই ছেলেমানুষ।
কেন পারব না, আংকেল? কিশোর বলল, আমরা তো চালিয়ে এসেছি। এযাবত। পারব না কেন? কয়েকজন লোক ভাড়া করে নেব শুধু।
হাসলেন মিস্টার আমান। শুকনো ঠোঁটে দুর্বল দেখাল হাসিটা। কিন্তু সামনে গভীর জঙ্গল
তাতে কি? মুসা জিজ্ঞেস করল, যা পেরিয়ে এসেছি, তার চেয়ে বেশি বিপদ হবে? বাবা, ভেবে দেখো, তোমার জমানো টাকা প্রায় সব খরচ করেছ এই অভিযানের পেছনে। কাজ শেষ করে যেতে না পারলে ফকির হয়ে যাবে। অতগুলো টাকা জমাতে কত বছর সময় লাগবে আবার? শোধ করবে কিভাবে? যে কটা জানোয়ার ধরেছি, বিক্রি করে ধারই শোধ করতে পারবে না।
সবই বুঝি। কিন্তু তোমরা ছেলেমানুষ।
ছেলে ছেলে করছ কেন? এতখানি যখন আসতে পেরেছি বাকিটাও যেতে পারব, দৃঢ়কণ্ঠে বলল মুসা।
কিন্তু কিশোরের চাচী আর তোমার মাকে কি বলল? রবিনের বাবা-মাকে হয়তো বোঝাতে পারব…
কি আর বলবে? মা বকবক করবে, তুমি চুপ করে থাকবে।
হ্যাঁ, হাসল কিশোর। আমরা ঠিকমত ফিরে গেলেই তো হলো। তখন সব ঠিক হয়ে যাবে। আর মেরিচাচীর বকা আপাতত আপনাকে খেতে হবে না। চাচার ঘুম হারাম করে দেবে। দিকগে, আপনার কি? তাছাড়া এখনই আপনাকে পাচ্ছে। কোথায় ওরা? আপনি তো থাকবেন হাসপাতালে।
ঝকঝকে সাদা দাঁত বেরিয়ে পড়ল মিস্টার আমানের। হাসিটা অবিকল মুসার মত। বাপ-ছেলে দু-জনেই একরকম করে হাসে। গভীর ষড়যন্ত্র! হাহ হা…কিন্তু দেখো ছেলেরা, আমাকে কথা দিতে হবে, জ্যান্ত ফিরে যাবে তোমরা। যদি তা না পারো, আমাকে খামোকা ফেরত পাঠিও না। হাসপাতাল থেকে হয়তো বেঁচে ফিরব, কিন্তু আমি শিওর, তারপর খুন করা হবে আমাকে।
হাসল সবাই।
.
সেদিন সকালের প্লেনেই চলে গেলেন মিস্টার আমান।
.
১২.
চেয়েই রইল ছেলেরা। দিগন্তে বিন্দু হয়ে মিলিয়ে গেল প্লেনটা।
ফিরে তাকাল ওরা পরস্পরের দিকে। বিষণ্ণ। বড় একা লাগছে। ভীষণ অরণ্যের বিরুদ্ধে ওরা তিন কিশোর। খানিক আগে মিস্টার আমানকে বলা বড় বড় কথাগুলো এখন অর্থহীন মনে হচ্ছে ওদের।
কিছু হবে না, বলল কিশোর, নিজেকেই সান্তনা দিচ্ছে। মুশিকারীদের সামনে না পড়লেই হলো। কয়েকটা জন্তুজানোয়ার ধরা তো। পারব। আমাজনের অনেকখানি চেনা হয়ে গেছে আমাদের।
ঘাটে ফিরে এল ওরা।
আগের জায়গায়ই বাঁধা রয়েছে ভেলাটা। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল কিশোর। কেন যেন মনে হচ্ছিল তার, জায়গামত পাবে না ওটা।
ওরা ভেলার দিকে যেতেই এগিয়ে এল একজন পুলিশ।
উত্তেজিতভাবে চেঁচিয়ে আর হাত নেড়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করল।
ভাঙা ভাঙা স্প্যানিশ আর পর্তুগীজ শিখে ফেলেছে এতদিনে কিশোর। লোকটার কথার তুবড়ি থেকে যতটুকু উদ্ধার করতে পারল তা হলো, ওদের অনুপস্থিতিতে নৌকা করে কয়েকজন লোক এসে ভেলার দড়ি খুলতে শুরু করেছিল।
লোকগুলোর হাবভাবে সন্দেহ হয়েছিল পুলিশ কনস্টেবলের, চ্যালেঞ্জ করেছিল। নৌকার একজন জবাব দিয়েছে, সে ভেলার একজন মালিক। এখানে সুবিধে হচ্ছে না, নিরাপদ জায়গায় সরিয়ে নিতে চায়। সন্দেহ আরও বেড়েছে পুলিশম্যানের। তর্কাতর্কি করেছে। শেষে সাফ বলে দিয়েছে, অন্য মালিকরাও আসুক, তারপর ভেলার দড়ি খুলতে দেবে।