হঠাৎ পেছন দিকে বাকা হয়ে গেল রনপা পা। ঝুড়িতে ঠোকর মেরে বসল সারসরাজ। দেখে যতখানি চালাক মনে হয় পাখিটাকে, আসলে তা নয়। বোকাই বলা যায়। নইলে দেখা নেই, শোনা নেই, ফেলে রাখা খাবারে এভাবে ঠোকর মারে কেউ? কত রকম বিপদের ভয় আছে।
দেখতে দেখতে খালি হয়ে গেল মাছের ঝুড়ি। মুসার ইচ্ছে ছিল, ফাঁস ছুঁড়ে ধরবে। কিন্তু সে এগোনোর আগেই মাছ খতম। খাওয়া শেষ, আর এখানে থাকার কোন কারণ নেই। ডানা মেলে উড়ে গেল জীবন্ত এরোপ্লেন।
আফসোস করল না মুসা। পাখিটার স্বভাব-চরিত্র দেখে তার যা মনে হয়েছে, অত্যন্ত লোভী, আবার আসবে। এত সহজ খাবারের আশা সহজে ছাড়তে পারবে।
আরও কিছু মাছ ধরে ঝুড়ি ভরল মুসা। ফেলে রাখল ওখানেই। ফাঁস টুডে লকে ধরা যাবে না, বুঝে গেছে। জাল পাতল। ঝুড়ির চার পাশে আট ফুট উঁচু চারটে সরু খুঁটি পেতে তার ওপর বিছিয়ে রাখল জাল। একটা দড়ি বাঁধল জালে, এমন ভাবে, যাতে দূর থেকে ওই দড়ি টেনেই জালটা ফেলতে পারে। সিবা গাছটার অনেক শেকড় আর ঝুড়ি আছে। দড়িটা নিয়ে গেল ওগুলোর কাছে। আড়ালে লুকিয়ে বসে রইল।
এই আসে এই আসে করতে করতে দিনই ফুরিয়ে গেল। পাটে বসল টকটকে লাল সূর্য। বগাটার আশা প্রায় ছেড়েই দিয়েছে মুসা, এই সময় আকাশে দেখা দিল। ছড়ানো ডানা। শা করে উড়ে এসে ঝুড়ির বিশ ফুট দূরে নামল লঘুমান।
আরি! ঝুপড়ি এল কোত্থেকে!ভাবল যেন সারসটা। আগে তো এটা ছিল না। ওখানে? ভাবনা দরকার। আচ্ছা, দেখি ধ্যানে বসে। আশ্চর্য কৌশলে এক পায়ের। ওপর ভারি শরীরের ভর রেখে, লম্বা ঠোঁটের আগা বুকের ফোলানো পালকে গুঁজে ধ্যানমগ্ন হলো সে।
কিন্তু সামনে লোভনীয় খাবার থাকলে ধ্যান আর কতক্ষণ? যখন দেখল, ঝুডিও নড়ে না, ঝুপড়িটাও না, চুলোয় যাক ধ্যান বলে যেন ঠোঁট সোজা করল সে। পলকে বেরিয়ে এল আরেক পা। রনপা-য় ভর দিয়ে এগোল।
একটা মুহূর্ত দ্বিধা করল ঝুপড়ির কাছে এসে, তারপর ঢুকে পড়ল ভেতরে। খ্যাচাং করে মাছের ঝুড়িতে ঢুকে গেল চোখা ঠোঁট।
মুসাও মারল দড়ি ধরে হ্যাঁচকা টান। ঝুপ করে জালের চারদিক খুলে ছড়িয়ে। পড়ল নিচে। উড়তে গেল সারস, এবং দ্বিতীয় ভুলটা করল। জড়িয়ে পড়ল জালে।
আঙুল, ভানার মাথা, ঠোঁট, ঢুকে গেল জালের খোপে। ছুটাতে গিয়ে আরও জড়াল। ছোঁড়া বালিশের তুলোর মত বাতাসে উড়তে থাকল সাদা পালক।
থামল না পাখিটা। যেভাবে ঝাপটা-ঝাঁপটি করছে, জাল ছিঁড়তে দেরি হবে না।
কিশোর আর রবিনও এসে দাঁড়িয়েছে।
দূরে বসে দেখছেন মিস্টার আমান। বললেন, জলদি পা বাঁধো।
ছুটে গিয়ে দড়ির বাণ্ডিল নিয়ে এল মুসা।
কিশোর আর রবিন এগোল তাকে সাহায্য করতে।
প্রথমেই পেটে সারসের জঘন্য লাথি খেল রবিন। বাঁশ দিয়ে তার পেটে খোঁচা মারা হলো যেন। আউফ করে পেট চেপে ধরল।
লাথি খেয়ে তার জেদ গেল বেড়ে। যে পায়ে লাথি মেরেছে, সারসের সেই পাটা দু-হাতে চেপে ধরল।
দড়ির এক মাথায় গিঁট দিয়ে ফাঁস বানিয়ে ফেলেছে কিশোর। সেটা সারসের পায়ে পরিয়ে টেনে আটকে দিল মুসা।
জাল ছিঁড়ছে। ঝাড়া দিয়ে রবিনের হাত থেকে পা ছুটিয়ে নিয়ে লাফিয়ে শূন্যে উঠল সারস।
সড়াৎ করে মুসার হাত থেকে অনেকখানি দড়ি চলে গেল। জ্বালা করে উঠল। হাত, চামড়া ছিলে গেছে। কিন্তু দড়ি ছাড়ল না।
রবিনও দড়ি চেপে ধরল।
ক্ষণিকের জন্যে মনে হলো ওদের, সিন্দবাদ নাবিকের রুক পাখির মত উড়িয়ে নিয়ে যাবে লম্বু বগা! আঙুল ঢিল করে দড়ি ছাড়তে লাগল।
শাঁই শাঁই করে উড়ে গেল সারস। পঞ্চাশ ফুট উঠে শেষ হয়ে গেল দড়ি, ঝটকা দিয়ে টানটান হয়ে গেল।
ইতিমধ্যে দড়ির অন্য মাথাটা নিয়ে গিয়ে ভেলার একটা খুঁটিতে বেঁধে ফেলেছে। কিশোর। উঁচুতে আর উঠতে না পেরে চক্কর দিয়ে উড়তে লাগল পাখিটা। ভয় আর বিস্ময় ঠাণ্ডা মাথায় ভাবতে দিচ্ছে না যেন তাকে।
কিন্তু খানিক পরেই ভয়-ডর সব চলে গেল। অবাক হয়ে যেন ভাবল সারস, আমি না জ্যাবিরু? এত ভয় পাওয়া কি আমার সাজে? দ্রুত নামতে শুরু করল সে। ভেলা আলো করে জুড়ে বসল। গম্ভীর ভঙ্গিতে একবার এদিক একবার ওদিক তাকিয়ে আশপাশের সবাইকে তুচ্ছজ্ঞান করল। যেন বলল, ভয় আমি পাইনি, তোমাদেরকে চমকে দিতে চেয়েছিলাম। যাকগে, অনেক হয়েছে। এবার খানিক ধ্যানমগ্ন হই। খবরদার, আমাকে বিরক্ত করবে না।
বেশবাস ঠিক করল সে। ঝাড়া দিয়ে আলগা পালক ঝড়িয়ে ফেলল, ঠোঁট দিয়ে ডলে সমান করল এলোমেলো হয়ে থাকা পালক। একটা পা গুটিয়ে লুকিয়ে ফেলল ডানার তলায়। তারপর আরেক পায়ে ভর রেখে দাঁড়িয়ে ঠোঁট গুজল বুকের পালকে। ধ্যানমগ্ন হলেন দার্শনিক।
পরদিন সকালে আমাজনে বজরা ভাসাল অভিযাত্রীরা।
কিশোর সাজল ক্যাপ্টেন, মূসা ফার্স্ট মেট, আর রবিন স্টুয়ার্ড। মিস্টার আমানের দুর্বলতা কাটছে না চিন্তিত হয়ে পড়েছে ছেলেরা। বিষের ক্রিয়া কাটেনি যে এটা পরিষ্কার। তাকে নিয়ে কি করবে বুঝতে পারছে না ওরা।
সাগরে চলেছে স্রোত, ভেলাও চলেছে সেদিকে।
বিচিত্র সব যাত্রী ও তাপিরছানা, ভ্যাম্পায়ার, পুঁচকে বানর মারমোসেট, দানব। ইগুয়ানা, দার্শনিক জ্যাবিরু, চারজন হোমো স্যাপিয়েনস (মানুষের বৈজ্ঞানিক নাম), আর মহাবীর কিকামুর মমি করা শুকনো মাথা।
নাকু এখন ঘাসই খায়, কচি পাতাও খায়। রক্তচাটা বেশ ঝামেলা করে, গরম রক্ত না হলে তার চলে না। ফলে দিনে অন্তত একবার তীরে নেমে ছোট জানোয়ার। শিকার করতে হয় মুসাকে। জাতভাই অন্য বানরের মত শজি আর ফল ভালবাসে না ময়দা, পোকামাকড় আর ছোট গিরগিটি না পেলে মুখ ভার করে রাখে। ডাইনোসরকে (ইগুয়ানাটার নাম) নিয়ে ভাবনা নেই। পাতা, ফল মাংস সবই খায়। আর লম্বুর জন্যে তো রোজই ঈদ। মাছের অভাব নেই নদীতে। ভেলার কিনারে দাঁড়িয়ে নিজেও ধরে, বড়শি ফেলে মুসাও ধরে দেয়।