ইগুয়ানা! কণ্ঠস্বর যতটা সম্ভব খাদে নামিয়ে বলল কিশোর। ধরতে পারলে কাজ হয়।
কিন্তু ধরি কি করে? রবিন বলল।
চলো, বাবাকে জিজ্ঞেস করি, মুসা বলল।
গলায় ফাঁস আটকাতে হবে, শুনে বললেন মিস্টার আমান।
ফাঁস? কাছে যেতে দেবে? গাল চুলকালো মুসা। তা হয়তো দেবে, তবে ফাঁস পরাতে দেবে না সহজে।
তাহলে? কিশোরের প্রশ্ন।
কাছে গিয়ে গান গাইতে হবে। আর পিঠ চুলকাতে হবে, নির্বিকার কণ্ঠে জবাব দিলেন মিস্টার আমান।
মারছে! আড়চোখে বাবার দিকে তাকাল মুসা। বিষের ক্রিয়া নয় তো? গোলমাল দেখা দিয়েছে মাথায়? গানের কি বুঝবে ওটা?
কি বুঝবে জানি না, তবে ইনডিয়ানরা ওভাবেই ধরে, বললেন মিস্টার। আমান।
ঠিক, মনে পড়ল রবিনের। আমিও শুনেছি… মানে, বইতে পড়েছি। সুরের ওপর নাকি বিশেষ মোহ আছে ইগুয়ানার, গায়ে হাত বোলানো পছন্দ করে।
হাত নয়, লাঠি, বললেন মিস্টার আমান। লম্বা দেখে একটা লাঠি নিয়ে যাও। খুব আস্তে আস্তে বাড়ি দেবে…আমারই যেতে ইচ্ছে করছে…
না না, তুমি শুয়ে থাকো, তাড়াতাড়ি বাধা দিল মুসা।
ভাল অভিনেতা কিশোর, কিন্তু গলা সাধায় একেবারে আনাড়ি। তবু তাকেই গান গাইতে হলো। দড়ির ফাঁস নিয়েছে মূসা, রবিনের হাতে লাঠি।
হেঁড়ে গলায় গান ধরল গোয়েন্দাপ্রধান। মানুষ, জানোয়ার কোন কিছুকেই আকৃষ্ট করার কথা নয় সে গান, তবু দেখা যাক ইগুয়ানার বেলায় কি ঘটে।
দূরে দাঁড়িয়ে জীবটার খসখসে চামড়ায় আলতো খোঁচা দিল রবিন। খুব আস্তে বাড়ি মারল কয়েকবার।
ফাঁস হাতে দাঁড়িয়ে আছে মুসা, উত্তেজনায় কাঁপছে।
নড়ল ইগুয়ানা। চোখ মেলল। মুখ ফিরিয়ে তাকাল অভিযাত্রীদের দিকে। প্রতিটি নড়াচড়ায় কুঁড়েমির লক্ষণ। হাঁ করে হাই তুলল। নিচের দিকে ঝুলে পড়েছে, চোয়াল। আঁতকে উঠল মুসা। সারি সারি ধারাল দাঁত।
গান থেমে গেল কিশোরের।
শক্ত কামড় দেয়, হুঁশিয়ার করল রবিন। তবে খারাপ ব্যবহার না করলে কিছু বলবে না। কিশোর, থামলে কেন? গাও। বাড়ি মারা থামাল না সে। মুলা, তাড়াহুড়ো করো না। ঘাবড়ে দিও না ওকে। লেজ খসে গেলে কোন চিড়িয়াখানাই নেবে না।
ভুরু কুঁচকে গেল মুসার। লেজ খসে যাবে?
হ্যাঁ, টিকটিকির মত।…ওভাবে না, ওভাবে ফাঁস পরাতে পারবে না।
একটা লাঠিতে বেঁধে নাও। তারপর আস্তে করে গলিয়ে দাও ওর মুখের ওপর দিয়ে।…ওকি কিশোর, গান থামাও কেন? গাও গাও।
মুখ ব্যথা হয়ে গেল যে।
চলে যাবে তো। গাও।
লাঠি জোগাড় করে আনল মূসা। গান আর লাঠির বাড়ি সমানে চলছে। লাঠির মাথায় ফাঁসটা ঝুলিয়ে আস্তে সামনে বাড়িয়ে দিল সে। ইগুয়ানা নড়লেই থেমে যাচ্ছে তার হাত, ওটা স্থির হলেই আবার ধীরে ধীরে সামনে বাড়াচ্ছে।
ফাঁস গলার কাছাকাছি নিয়ে সাবধানে টেনে আটকে দিল মুসা। লাঠি ফেলে। চেঁচিয়ে উঠল, দিয়েছি আটকে! আর পালাতে পারবে না।
চুপ! বলল কিশোর। টানাটানি কোরো না! লেজ খসাবে!
দু-জনে মিলে খুব নরম হাতে দড়ি ধরে টান দিল।
গ্যাঁট হয়ে রইল ইগুয়ানা। দড়িতে টান বাড়ছে। মাথা ঘোরাতে শুরু করল, সে। এত কুড়ে, নড়তেই চাইছে না। অনিচ্ছাসত্ত্বেও গাছ বেয়ে নেমে এল মাটিতে। পেছনে লেজের খানিক ওপরে বাড়ি মেরেই চলেছে রবিন।
চাপাচাপি করল না ওরা, কিন্তু দড়িতে ঢিলও দিল না। টেনেটুনে ক্যাম্পের কাছে নিয়ে এল ইগুয়ানাটাকে ভেলায় তুলতে হবে।
কাজটা অনেকখানি সহজ করে দিল ইগুয়ানা। মুসা ভেলায় উঠে টানছে। অনেক সহ্য করেছে এতক্ষণ ইগুয়ানা, আর করল না। পায়ে কামড় বসাতে ছুটে গেল। লাফ দিয়ে সরে গেল মূসা। ততক্ষণে শরীরের বেশির ভাগটাই ভেলায় উঠে গেছে জীবটার। বাকিটুকু তুলতে বিশেষ কষ্ট হলো না ছেলেদের।
ভেলা থেকে মাটিতে নেমে বসে পড়ল মুসা। যথেষ্ট পরিশ্রম হয়েছে। ধরলাম তো। খাওয়াব কি?
সবই খায় ব্যাটা, কিশোর বলল, নরম পাতা, ফল, পাখি, ছোট জানোয়ার, সব।
তারমানে ইগুয়ানার খাবারের জন্যে ভাবতে হবে না।
সেদিনই আরেকটা প্রাণী ধরা পড়ল। ইগুয়ানার মতই ছয় ফুট লম্বা, তবে লেজ থেকে মুখ নয়, পায়ের আঙুল থেকে চাদি পর্যন্ত। বড়শি দিয়ে অনেকগুলো মাছ ধরে জমিয়েছে মুসা, সেগুলোর গন্ধেই পায়ে পায়ে এসে হাজির হয়েছে। জাবিরু স্টর্ক, মুসার ভাষায় লম্বু বগা, অর্থাৎ বক।
পাখিটাকে এগোতে দেখেই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল মুসা। মাছগুলো যেখানে। আছে রেখে উঠে চলে এল।
লম্বা লম্বা পায়ে যেন রনপা-য় ভর করে এগিয়ে এল বিরাট পাখিটা। মাথা কাত করে গম্ভীর চোখে তাকাল মাছের ঝুড়ির দিকে। জ্যাবিরুর চেহারায় একটা ঋষি ঋষি ভাব আছে, প্রায়ই ধ্যানমগ্ন হয়ে থাকে–যদিও এই ধ্যানের বেশির ভাগটাই মাঝের ভাবনায়-তাই একে দার্শনিক পাখি বলে অনেকে।
না, কিছু না, মাছ কেমন পড়েছে দেখছি শুধু এরকম চেহারা করে মাছগুলো দেখল পাখিটা। নদী থেকে ধরার চেয়ে এখান থেকে খেয়ে ফেলা যে অনেক সহজ, বুঝতে বিন্দুমাত্র সময় লাগল না।
সত্যিই একটা রাজকীয় পাখি, ভাবল মুসা। দুধের মত সাদা পালকে ঢাকা শরীর। মাথাটা কুচকুচে কালো। লম্বা গলায় লাল রঙের আঙটি। পাখা সামান্য তুলে রেখেছে, লড়াইয়ের আগে কুস্তিগীররা যেমন বাহু তুলে রাখে অনেকটা তেমনি। মুসা আন্দাজ করল, ওটার এক ডানার মাথা থেকে আরেক ডানার মাথা সাত ফুটের কম হবে না। মানসচক্ষে দেখতে পেল, দুনিয়ার সবচেয়ে বড় সারসটা লস অ্যাঞ্জেলেস চিড়িয়াখানায় হেঁটে বেড়াচ্ছে রাজকীয় চালে, আর তাকে দেখার জন্যে ভিড় জমিয়েছে অসংখ্য দর্শক।