ম্যাপে আঁকা রহস্যময় বিন্দু রেখা ধরে পাঁচ দিন চলেছে ওরা। নতুন একটা ম্যাপ যখন তৈরি হবে, ওই বিন্দুগুলো আর থাকবে না, পুরোপুরি রেখা হয়ে যাবে। মাঝখানে কিছু সময় বাদে, ম্যাপ আঁকা চালিয়ে গেছে কিশোর। যাতে নষ্ট না হয়, সেজন্যে কাগজটা যত্ন করে একটা ওয়াটারপ্রুফ বোতলে ঢুকিয়ে সেটা আবার ঢুকিয়েছে ওষুধের বাক্সে।
আমাজন, পৃথিবীর বৃহত্তম নদী।
মিস্টার আমান উত্তেজিত, ছেলেরা উত্তেজিত। ক্যানূর অন্য আরোহীদের মাঝেও উত্তেজনা দেখা যাচ্ছে-নদী দেখে নয় হয়তো, নৌকা বড় বেশি দোল খাচ্ছে বলেই।
তাপিরের বাচ্চা গোঁ গোঁ করল, মারমোসেট কিচমিচ করল, এমন কি তন্দ্রালু ভ্যাম্পায়ারও কর্কশ চিৎকার করে উঠল খাঁচার অন্ধকার কোণ থেকে। একমাত্র কিকামু নির্বিকার। আধবোজা চোখ মেলল না। লম্বা চুলে ঝুলে থেকে ঢেউয়ের। তালে তালে খালি মাথা দোলাচ্ছে বিষণ্ণ ভঙ্গিতে।
সত্যিই এটা আমাজন! বিশ্বাস করতে পারছে না মুসা।
হ্যাঁ-না দুটোই বলা যায়, মুখ খুলল কিশোর। তবে হ্যাঁ বলাই ঠিক। আমেরিকান জিওগ্রাফিক্যাল সোসাইটির ম্যাপ খুলে দেখো। দেখবে, এখান থেকে আটলান্টিক পর্যন্ত পুরোটার নামই আছে। যেমন এই অংশটার নাম ম্যারানন, ম্যারানন নদী এসে মিশেছে বলে। পরের অংশটার নাম সলিমোজ। আসলে, সবটাই আমাজন।
তা, ভেলাটা বানাচ্ছি কখন? জিজ্ঞেস করল রবিন।
সরু প্যাসটাজায় ইনডিয়ান ক্যানূ উপযুক্ত জিনিস, সন্দেহ নেই, কিন্তু এই বিশাল পানিতে ওটা মোটেই নিরাপদ নয়। তাছাড়া ছোট্ট ক্যানূতে জানোয়ার। রাখার অসুবিধে, জায়গাই নেই। দরকার, বড়সড় একটা ভেলা।
ভেলার নামও বাছাই করে ফেলেছে রবিন : নূহ নবীর বজরা। আল্লাহর আদেশে মস্ত এক বজরা বানিয়ে নাকি তাতে সব রকমের প্রাণী তুলেছিলেন তিনি। ভেসে থেকেছিলেন ভয়াবহ বন্যায়।
আলাপ-আলোচনার পর নাম ঠিক হলো শুধু বজরা।
যত তাড়াতাড়ি পারো, বানিয়ে ফেলো, দুর্বল কণ্ঠে বললেন মিস্টার আমান। ক্যানূতে থাকা আর ঠিক না।
মাইলখানেক দূরে নদীর অপর পাড় থেকে বয়ে আসছে বিশুদ্ধ হাওয়া। এক পাড় থেকে আরেক পাড়ের দূরত্ব এত বেশি, স্রোত না থাকলে নদীটাকে হদ বলেই মনে হত। এপাড়ে গাছে গাছে যেন বুনোফুলের মেলা বসেছে। মাটির কাছাকাছি। অগভীর পানিতে ডুবছে-ভাসছে অসংখ্য জলমুরগী। ক্যান্ ওগুলোর কাছাকাছি হলেই কক কক করে উড়ে যাচ্ছে ঝাঁক বেঁধে।
শটগানের দিকে হাত বাড়াল মুসা। কিন্তু বাধা দিলেন মিস্টার আমান। নৌকা। দুলছে। নিশানা ঠিক হবে না।
গাছে ফুল যেমন আছে, তেমনি রয়েছে পাখি। নানা জাতের, নানা রঙের, নানা রকম আজব তাদের ডাক। জায়গাটা পাখির স্বর্গ। তীরে পানির ধারে এক আজব পাখি দেখা গেল। এক জাতের সারস, নাম তার জ্যাবিরু স্টর্ক। প্রায় মানুষের সমান লম্বা। তীর ধরে হাঁটছে গভীর রাজকীয় চালে।
মোড় নিল ক্যানূ। মস্ত এক বাক পেরিয়ে এল। তেরছা ভাবে ঝাঁপ দিয়ে এসে। পড়ল যেন ঢেউ, আরোহীদের ভিজিয়ে দিল। স্রোতও এলোমেলো। খানিক দূরে। সরু একটা খাল ঢুকে গেছে ডাঙার ভেতরে। শেষ মাথায় ছোট একটা প্রাকৃতিক পুকুর। খালে নৌকা ঢুকিয়ে দিল মুসা। চলে এল পুকুরের নিথর পানিতে।
এক চিলতে বেলাভূমি রয়েছে পুকুরের পাড়ে। ঝকঝকে মসৃণ বালি। ঘ্যাচ করে তাতে নৌকার আধখানা তুলে দিয়ে লাফিয়ে নামল তিন গোয়েন্দা। দানবীয় এক সিবা গাছের শেকড়ে বাধল দড়ি। এত বড় গাছ সচরাচর দেখা যায় না। প্রায়। এক একর জুড়ে রয়েছে। তলায় ছোট ঘাস ছাড়া আর কিছু জন্মানোর সাহস পায়নি। সুন্দর ছায়াঢাকা একটা পার্কের মত।
ক্যাম্প করার জন্যে তো বটেই, ভেলা বানানোর জন্যেও খুব চমৎকার জায়গা। মালমসলারও অভাব নেই। পুকুরের পাড়ে রয়েছে ঘন বাশবন, আছে লিয়ানা লতা।
ভেলা বানাতে দুই দিন লাগল। পাকা লম্বা বাশ কেটে শক্ত লতা দিয়ে বাঁধা। হলো। ওরকম কয়েকটা ভেলা নদীতে ভেসে যেতে দেখেছে গত দু-দিনে। ইনডিয়ানদের জলযান। আমাজনে এই ধরনের ভেলা বেশ চালু জিনিস।
সব ভেলায়ই তো ঘর দেখলাম, মুসা বলল। আমরাও একটা বানিয়ে নিই।
বাঁশ দিয়েই তৈরি হলো ঘরের খুঁটি, চালার কাঠামো। বেড়া হলো নল খাগড়ায়, তালপাতার ছাউনি। বাঁশের ভেলায় ভাসমান এক মজার কুটির।
বেশ বড় করে বানিয়েছে ভেলা। বড় জানোয়ার কিছুই ধরা হয়নি, জায়গার অভাব আর পরিবহনের অসুবিধের জন্যে, এবার ধরবে।
প্রথমেই ধরা পড়ল এক মস্ত ইগুয়ানা, ছয় ফুট লম্বা।
নিচু গাছের ডালে শুয়েছিল ওটা। একটা পাখিকে নিশানা করতে গিয়ে চোখে পড়ল মুসার। মাত্র বারো-তেরো ফুট দূরে।
তাজ্জব হয়ে গেল মুসা। সিনেমায় দেখা এক প্রাগৈতিহাসিক দানবের প্রতিমূর্তি যেন সবুজ শরীর, লেজে বাদামী ডোরা, পেচিয়ে রয়েছে। পিঠে কয়েক সারি। কাটা, এদিক ওদিক মুখ করে আছে। থুতনির নিচেও এক গুচ্ছ কাটা।
ধীরে ধীরে পিছিয়ে এল মুসা, তারপর ক্যাম্পের দিকে দিল দৌড়।
কি ব্যাপার? জিজ্ঞেস করল কিশোর।
বললে বিশ্বাস করবে না, ফিসফিসিয়ে বলল মুসা। ডাইনোসর। গাছের ডালে।
ডাইনোসর? ঠিক দেখেছ?
মাথা ঝাঁকাল মুসা।
চলো তো, দেখি, রবিন আর কিশোর দু-জনেই আগ্রহী হলো।
নিঃশব্দে এসে দাঁড়াল তিন গোয়েন্দা।
আগের জায়গায়ই রয়েছে জীবটা। টেরই পায়নি যেন। বোধহয় গভীর ঘুমে অচেতন।