ওর নাম রক্তচাটা হওয়া উচিত, বলল সে।
অন্য দুজনের আপত্তি নেই।
মালপত্র গুছিয়ে আবার ক্যানূ ভাসাল ওরা।
সেদিন আরেকটা জীব ধরা পড়ল।
দুপুরে খাওয়ার জন্যে নৌকা থামিয়ে নেমেছিল ওরা।
মুসা দেখল জীবটাকে। মাথার ওপর গাছে বসে চেয়ে রয়েছে ওদের দিকে খুদে, লেজ বাদ দিলে ইঞ্চি তিনেক হবে। কয়েক আউন্স ওজন। নরম, সোনালি রোমে ঢাকা শরীর, চোখের চারপাশ আর মুখটা বাদে। সেখানটা সাদা, যেন চুরি করে র্টিন থেকে ময়দা, খেতে গিয়ে ময়দা লাগিয়েছে।
ইশারায় কিশোর আর রবিনকে দেখাল সে। বাবাকেও দেখাল।
পিগমি মারমোসেট, ফিসফিসিয়ে বললেন মিস্টার আমান। ধরতে পারো। কিনা দেখো। ভাল টাকা পাওয়া যাবে।
বসেই আছে জীবটা। বাতাসে ডাল দুলছে, আঁকড়ে ধরে ওটাও দুলছে ধীরে ধীরে।
ব্যাগ খুলে ডার্টগান বের করল কিশোর। ডার্ট ভরল।
আগের জায়গাতেই রয়েছে মারমোসেট। অন্যান্য বানরের মতই কৌতূহলী, মানুষের কাজকর্ম দেখছে। তবে আর সব জাতভাইয়ের মত বানর নয়, দুষ্টুমি নেই, লাফালাফি নেই, শান্ত-সুবোধ-লক্ষ্মী ছেলে।
নাও, মারো, ডার্টগানটা মুসার দিকে বাড়িয়ে দিল কিশোর। গোয়েন্দা সহকারীর নিশানার ওপর এখন অগাধ আস্থা তার।
তুমিই মারো, মুসা বলল।
অনেকক্ষণ লাগিয়ে ভালমত সই করল কিশোর। ট্রিগার টিপল। ভেবেছিল লাগবে না। কিন্তু লাগল।
পাখির মত কিচির মিচির করে উঠল বানরটা। সুচের মত জিনিসটা ধরে টানাটানি শুরু করল। মুখে বিরক্তি। যেন বলছে, আহ, কি জ্বালাতন! মানুষের। জালায় একটু শান্তিতে বসার জো নেই।
ক্রিয়া শুরু করেছে ঘুমের ওষুধ। টলে উঠল বানরটা। মাথা উল্টে দিল, ডাল থেকে ছুটে গেল আঙুল, খসে পড়তে শুরু করল। পেছনে সোজা হয়ে রইল লেজটা।
এতই হালকা, প্রায় নিঃশব্দে ঘাসের ওপর পড়ল জীবটা। দৌড়ে গিয়ে তুলে নিল মুসা।
ঘুম ভাঙতে বেশি সময় নিল না। চোখ মেলল মারমোসেট। চোখের ঘোলাটে তারা ধীরে ধীরে উজ্জ্বল হলো। লেজের সোনালি রোম ফুলে উঠল কাঠবেড়ালীর লেজের মত। কিচমিচ শুরু করল। বিচিত্র ভঙ্গিতে মুখের ভেতর থেকে বেরোচ্ছে। অদ্ভুত সাদা জিভ। গাল দিচ্ছে যেন মানুষের বাচ্চা মানুষ, জীবনে আর বানর হবি না তোরা। একেবারে বখে গেছিস।
হেসে আদর করে ওটার মাথায় হাত বোলাল কিশোর, কেমন লাগছে, ময়দাখেকো?
ব্যস, নাম একটা হয়ে গেল মারসোসেটেরও।
ওই খেকো-টেকো বাদ দাও, প্রতিবাদ করল মুসা। খালি ময়দা।
মুচকি হাসল কিশোর। ঠিক আছে, তাই সই।
রবিন কিছু বলল না। জানে, বলে লাভ নেই। একবার মুসা বলে যখন ফেলেছে, আর পাল্টাবে না। নাম রাখার ব্যাপারে মুসার কিছু জেদ আছে। ভুল করে পুরুষ ভেবে একবার একটা কবুতরের নাম রেখে ফেলেছিল টম। যখন জানা গেল ওটা মেয়ে, তারপরও ওটার নাম টমই রইল, কিছুতেই পাল্টাতে রাজি হলো না সে।
পৃথিবীর সবচেয়ে খুদে বানর, বিড়বিড় করল রবিন। হ্যাপেইল পিগমেইয়াস।
কি বললে? ভুরু কুঁচকে তাকাল মুসা।
ওটার ল্যাটিন নাম। বৈজ্ঞানিক…
চুলোয় যাক ল্যাটিন। বাংলা অনেক সোজা, ময়দা। ওই হ্যাপেল-ফ্যাপেল মুখে আসবে না আমার।
আবার ভাসল ক্যানূ।
গুণ আর রূপ দিয়ে দেখতে দেখতে সবাইকে আপন করে নিল ময়দা। পাখির মত কিচমিচ করে বড় বড় লাফ মারে। একবার এর ওপর গিয়ে পড়ে, একবার ওর ওপর। কিন্তু এত হালকা সে, কারও কোন অসুবিধে হয় না।
ওর সবচেয়ে আনন্দ, কিকামুর সঙ্গে খেলা করা। ভিজে যাওয়ার পর নষ্ট হওয়ার ভয়ে বস্তা থেকে খুলে ফেলা হয়েছে ওকে। নৌকায় একটা খুটি বেধে তাতে ওর চুল বেঁধে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। লম্বা কালো চুলে ঝুলে ঝুলে যেন বাতাস খায় মহাবীর। তার চুল নাড়াচাড়া করতে খুব ভালবাসে বানরটা।
নাকুর সঙ্গে ভাব হয়ে গেছে ময়দার। রক্তচাটাকে দু-চোখে দেখতে পারে না। খানিক পর পরই লাফ দিয়ে গিয়ে তার খাঁচার ওপর উঠে কয়েকটা করে গাল দিয়ে আসে।
দুধের অভাবে থাকতে থাকতে বিরক্ত হয়েই যেন ঘাস খাওয়া শুরু করেছে নাকু। তার খাবার নিয়ে আর দুশ্চিন্তা নেই কারও।
বিকেলের দিকে রোদ যেন আগুন হয়ে উঠল। আর নৌকায় থাকতে পারল না নাকু। লাফিয়ে পড়ল পানিতে। কেউ কিছু বলল না। নৌকায় বাধা রয়েছে তার। গলার লম্বা দড়ি। ক্যানূর পাশে-পাশে সাঁতরে চলল।
গম্ভীর হয়ে ব্যাপারটা দেখল কিছুক্ষণ ময়দা। তারও গরম লাগছে কিনা যেন বোঝার চেষ্টা করল। তারপর দিল লাফ। পানিতে পড়েই বুঝল, মহাভুল হয়ে গেছে। এই জায়গা তার জন্যে নয়। তাড়াহুড়ো করে গিয়ে উঠল নাকুর নাকে, তারপর পিঠে, সেখান থেকে লাফ দিয়ে এসে একেবারে মুসার কোলে।
গা ঝাড়া দিয়ে রোম থেকে পানি ঝাড়ল ময়দা। ঠাণ্ডা কমছে না দেখে হামাগুড়ি। দিয়ে ঢুকে গেল মুসার শার্টের ভেতরে। গায়ে গা ঠেকিয়ে রইল, উষ্ণতা খুঁজছে। এই দুটো ছেলে পেলে, নৌকার তলায় শুয়ে থেকে হাসিমুখে বললেন মিস্টার আমান।
দুটো না, তিনটে, শুধরে দিল রবিন। বাদুড়টা বাদ কেন?
দূর! মুখ বাকাল মুসা, ওই ইবলিসের বাপ হতে যায় কে?
হেসে ফেলল সবাই।
.
১০.
আমাজন! আমাজন! চেঁচিয়ে উঠল রবিন।
অনেক বড় একটা মোড় ঘুরেই বিশাল জলরাশিতে ঝাঁপ দিল ক্যানূ। মোহনায় পৌঁছে গেছে। পাক খেয়ে খেয়ে বইছে বাদামী স্রোত। কোথাও ঢেউ উটের পিঠের মত কুঁজো, কোথাও ফুলে ফুলে উঠছে সিংহের কেশরের মত। দেখেই অনুমান করা যায় স্রোতের প্রচণ্ডতা।