তার সঙ্গে আর সুবিধে করতে না পেরে অন্যদের দিকে নজর দিল তুরপুনধারীরা।
থাবা দিয়ে ধরার চেষ্টা করলেন মিস্টার আমান। একটাকেও ধরতে পারলেন না। সব পালাল।
ছোট একটা হাতে বোনা জাল বের করল কিশোর। জাল দিয়ে ধরব।
টোপ হচ্ছে কে? ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করল মুসা।
তুমি, কিশোর হাসল।
আমি বাপু এসবে নেই। পারলে তুমি হওগে, তাড়াতাড়ি আবার কম্বলে মুখ ঢাকল সে।
নিজেই টোপ হলো কিশোর। অন্ধকারে শুয়ে শুয়ে ভাবতে লাগল রক্তচোষা বাদুড়ের কথা।
নানারকম কথা প্রচলিত আছে রহস্যময় এই প্রাণীটাকে নিয়ে। শোনা যায়, অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী ভ্যাম্পায়ার। পাখার বাতাসে জাদু করে ঘুম পাড়ায়। শিকারকে। তারপর রক্ত চুষে খেয়ে পালায়।
গল্পটা সত্য কিনা; যাচাই করে দেখার ইচ্ছে কিশোরের। প্রমাণ ছাড়া, যুক্তি ছাড়া কোন কথা মানতে রাজি নয় সে। হাত লম্বা করে ফেলে চুপচাপ পড়ে রয়েছে।
অনেকক্ষণ কিছুই ঘটল না।
তারপর ডানা ঝাপটানোর খুব মৃদু শব্দ কানে এল। কাছে আসছে। হালকা কিছু বুকে এসে নামল বলে মনে হলো কিশোরের। জেগে থেকেই অনুভব করতে পারছে না ঠিকমত, ঘুমের মধ্যে হলে টেরই পেত না।
আর কোন রকম নড়াচড়া নেই।
এসেই যদি থাকে, কিছু করছে না কেন ওটা? নাকি সব তার কল্পনা? কিছুই নামেনি?
কব্জির সামান্য নিচে মৃদু বাতাস লাগল জোরে নিঃশ্বাস ফেলল যেন ওখানে কেউ। ডানার বাতাস? নিশ্চিত হতে পারছে না কিশোর। মুখ ফিরিয়ে দেখতেও পারছে না, নড়লেই যদি উড়ে যায়।
কনুইয়ের দিকে সরে আসছে বাতাসটা। ফুঁ দেয়া হচ্ছে যেন ওখানটায়। বাতাসও হতে পারে।
আরও কিছুক্ষণ কাটল। কনুইয়ের উল্টোদিকে সামান্য একটু জায়গায় ঝিমঝিম শুরু হয়েছে, অসাড় হয়ে আসছে। মনে মনে চমকে গেল কিশোর। ভ্যাম্পায়ার। সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানতে পারেনি বিজ্ঞানীরা। তবে যেটুকু জেনেছেন, তাজ্জব। করে দেয়ার জন্যে যথেষ্ট। কেউ কেউ বলেন, শিকারের গায়ে এত সাবধানে ছিদ্র করে এই বাদুড়, যে শিকার সেটা টেরই পায় না। আসল ব্যাপারটা তা নয়। যেখানে ছিদ্র করে, তার চারপাশে আগেই লালা লাগিয়ে দেয় ওরা, ফলে সাময়িক ভাবে অবশ হয়ে যায় জায়গাটা। ছিদ্র করার ব্যথা টের পায় না তখন শিকার।
কিশোর কল্পনা করল, ছিদ্র হয়ে গেছে। রক্ত চোয়াতে শুরু করেছে। কিন্তু তবু নড়ল না।
একটু পরেই বুঝতে পারল, কল্পনা নয়, সত্যি। যেটুকু জায়গা অবশ হয়েছে, রক্ত গড়িয়ে তার বাইরে চলে আসতেই টের পাওয়া গেল। তার মানে রক্ত খাওয়া শুরু করেছে বাদুড়টা।
প্রথমবারেই অনেক জ্ঞান হয়েছে, অনেক কিছু জেনেছে। আর বেশি জানার চেষ্টা করল না। রক্ত খেয়ে পেট ভরে গেলে উড়ে যাবে বাদুড়, তার আগেই ধরতে হবে।
মনের আর বাঁ হাতের সমস্ত জোর এক করে জালটা ঘুরিয়ে এনে ফেলল সে। ডান হাতের ওপর। এমন ভাবে চেপে ধরল, যাতে কোন ফাঁক না থাকে, বেরিয়ে যেতে না পারে শিকার। খুব সাবধানে আস্তে করে ডান হাতটা সরিয়ে আনল জালের তলা দিয়ে। তারপর জালের মুখের দড়ি টেনে ফাঁস আটকে বন্ধ করে দিল থলের মুখ বন্ধ করার মত করে।
টর্চ জ্বালল।
না, কল্পনা নয়, ঠিকই। হাতের ইঞ্চি দুয়েক জায়গা জুড়ে রক্ত। থাকুক, কিছু হবে না। পরে মুছে নিলেই চলবে। জালের ভেতরে কি আছে দেখল।
ছটফট করছে কুৎসিত চেহারার একটা প্রাণী।
ধরেছি! ধরেছি! চেঁচিয়ে উঠল কিশোর।
লাফ দিয়ে হ্যামক থেকে নেমে এল রবিন আর মুসা।
আরে, এ যে দেখছি একেবারে সেই লোকটার চেহারা। ওই ব্যাটাই ভূত হয়ে এল না তো! বলে উঠল মুসা।
কার কথা বলছ? জিজ্ঞেস করল কিশোর।
রাতে কুইটোতে যে লোকটা আমাদের পিছু নিয়েছিল।
ভুল বলেনি মুসা, লোকটার সঙ্গে এই জীবটার চেহারার অনেক মিল।
ভ্যাম্পায়ারকে নিয়ে অনেক রোমাঞ্চকর গল্প, পিশাচকাহিনী লেখা হয়েছে। খুব জনপ্রিয় হয়েছে সেগুলো। বাদুডটাকে দেখে সে-সব মনে পড়ছে কিশোরের। সবচেয়ে সাড়া জাগানো ভ্যাম্পায়ারের গল্প ড্রাকুলা। জীবটার চেহারা দেখে মনে হয় না, গল্পগুলোতে বাড়িয়ে বলা হয়েছে কিছু। অন্ধকারের জীব, যেন অন্ধকারে মিশিয়ে রাখার জন্যেই কালো রোমশ চামড়া দিয়েছে ওকে প্রকৃতি। লাল লাল চোখ, ছবিতে দেখা শয়তানের চোখের কথা মনে করিয়ে দেয়। ভোতা নাক, খাড়া চোখা কান, চূড়ার কাছে কয়েকটা লম্বা রোম। নিচের চোয়াল ঠেলে বেরিয়ে আছে। সামনের দিকে, কুৎসিত, ভীষণ কুৎসিত।
এই, আনো তো দেখি, ডাকলেন মিস্টার আমান। দেখেটেখে বললেন, হু, শয়তান আর বুলডগের মাঝামাঝি চেহারা।
হঠাৎ বিকট ভঙ্গিতে হাঁ করে তীক্ষ্ণ চিৎকার করে উঠল জীবটা। বেরিয়ে পড়ল। লম্বা চোখা জিভ, টকটকে লাল, তাতে রক্ত লেগে রয়েছে। দাঁত মাত্র কয়েকটা, ছোট ছোট কিন্তু ধারাল। ওপরের পাটিতে দুই দিকে দুটো শ্বদন্ত-সরু, চোখা, একেবারে যেন ড্রাকুলা ছবিতে দেখা ড্রাকুলার দাঁত, যেগুলো দিয়ে মানুষের গলা ফুটো করে রক্ত খায় ভূতটা।
বাদুড়টার মুখে রক্তের পাশাপাশি চটচটে পিচ্ছিল এক ধরনের পদার্থ লেগে রয়েছে। নিশ্চয় তার দেহ-কারখানায় তৈরি কোন সাংঘাতিক ক্রিয়াশীল অবশকারী পদার্থ মিশে আছে ওই লালায়। যা লাগলে দেহ তো অবশ হয়ই, রক্তও বেরিয়ে জমাট বাঁধতে পারে না।
হাতের দিকে তাকাল আবার কিশোর। জমাট বাঁধছে না রক্ত। টুইয়ে চুঁইয়ে ফোঁটা ফোঁটা এখনও বেরোচ্ছে।