শূন্যে উঠে গেল নৌকা। ধড়াস করে আছড়ে পড়ল আবার পানিতে। মাত্র দশ গজ নিচে পড়ল। তাতে সময় আর কতটা লাগে? কিন্তু গোয়েন্দাদের মনে। হলো, অনন্তকাল ধরে শূন্যে ভেসে থাকার পর যেন পড়ল। তবে মালপত্র বোঝাই ভারি একটা ক্যানূর জন্যে ওইটুকু উচ্চতাও অনেক।
ওদের প্রার্থনায় সাড়া দিয়েই যেন তলিয়ে যেতে যেতেও সোজা হয়ে গেল। নৌকা। হাঁপ ছাড়ল তিন গোয়েন্দা, ঢিল দিল, এবং ভুলটা করল। পাশ থেকে সজোরে এসে ধাক্কা মারল বিশাল ঢেউ, চোখের পলকে কাত করে দিল নৌকা।
একই সঙ্গে কয়েকটা ঘটনা ঘটল। পানিতে পড়েই মাথা তুলল মুসা। ভেসে যাচ্ছেন তার বাবা। পানির মধ্যে ডিগবাজি খেয়ে তার কাছে চলে এল মুসা, দুই বাহুর তলা দিয়ে হাত ঢুকিয়ে আঁকড়ে ধরল। ডুবন্ত মানুষকে কিভাবে উদ্ধার করতে হয় জানা আছে তার, স্কাউটিঙে ট্রেনিং আছে। সাঁতরে চলল তীরের দিকে।
কিশোর আর রবিন নৌকার দুই ধার দুদিক থেকে আঁকড়ে ধরেছে। বেশির ভাগ মালপত্রই বাধা রয়েছে নৌকার সঙ্গে, ভেসে গেল না। ঠেলাঠেলি করে সোজা করার চেষ্টা করল, কিন্তু পারল না, কাত হয়েই থাকল ক্যানূ। সোজা করার চেষ্টা বাদ দিয়ে শেষে ওটাকে ঠেলে নিয়ে চলল ওরা।
নৌকা নিয়ে তীরে পৌঁছে দেখল, বালিতে চিত হয়ে আছে বাপ-বেটা, যেন দুটো লাশ। হাপরের মত ওঠা-নামা করছে মুসার বুক। আস্তে আস্তে মাথা নাড়ছেন। মিস্টার আমান, চোখ আধখোলা।ধাক্কার চোটে ঘুম ভেঙেছে, কিংবা হুশ ফিরেছে।
টেনে নৌকাটা শুকনোয় তুলল তিন কিশোর। জিনিসপত্র সব খুলে ছড়িয়ে দিল। রোদে শুকাতে। তারপর নাকুর কথা মনে পড়ল ওদের।
যার জন্যে এত কাণ্ড, সে-ই গেল হারিয়ে। মন খারাপ হয়ে গেল ছেলেদের।
কিন্তু মন খারাপ করেছে অযথাই। পাওয়া গেল ওকে। বড় একটা পাথরের চাঙড়ের ওপাশে খুদে একটা ডোবায় পড়ে আছে নাকু। ডুবছে-ভাসছে, নাক দিয়ে পানি ছিটাচ্ছে। আছে মহাআনন্দে। এই মুহূর্তে তাকে দেখলে মনেই হবে না সে ডাঙার জীব।
ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে ছোটবড় নানারকম পাথর। ওসবের মাঝে পরিষ্কার। পানিতে গোটা দুই ক্যানূর ধবংসাবশেষ দেখা গেল। নৌকা দুটোয় করে কারা এসেছিল–ইনডিয়ান নাকি শ্বেতাঙ্গ ভ্রমণকারী, বেঁচে ফিরে গেছে, না মারা গেছে, জানা যাবে না কোনদিন।
নাকুকে নিয়ে ফিরে এল ওরা।
সাড়া পেয়ে চোখ মেললেন মিস্টার আমান। থ্যাংক ইউ বয়েজ।
০৯.
মেহমান এল সে-রাতে। অভিযাত্রীরা আশা করেছিল জিভারোরা আসবে, কিন্তু এল। অন্য অতিথি। নরমুণ্ড শিকারীদের চেয়ে এরা কম ভয়ঙ্কর নয়।
শুরুতেই এল সৈনিক পিঁপড়ের খুদে একটা দল। মার্চ করে এগোতে গিয়ে থমকে গেল, মুখ ঘুরিয়ে রওনা হলো মুসার দিকে। কোন কোনও মানুষের দেহে এক ধরনের রাসায়নিক পদার্থের পরিমাণ বেশি থাকে, কীটপতঙ্গকে আকৃষ্ট করে তার গন্ধ। মুসার গায়েও এই জিনিস বেশি।
মাটিতে আর শোয়া গেল না, বাধ্য হয়েই চরার কাছ থেকে ভেতরের দিকে সরে যেতে হলো সবাইকে। গাছে হ্যামক টাঙিয়ে শোয়ার জন্যে।
হ্যামকে শোয়ার পর বড় জোর ঘণ্টাখানেক ঘুম, তারপরই আবার জেগে যেতে হলো। ডান পায়ের আঙুলের মাথায় খুব হালকা চিনচিনে ব্যথা অনুভব করল। মুসা। তাতেই ঘুমটা ভাঙল তার। ছুঁয়ে দেখল আঠা আঠা লাগে।
টর্চ জ্বেলে দেখল, তুরপুন দিয়ে যেন নিখুঁতভাবে করা হয়েছে ছোট্ট একটা ছিদ্র। সেখানে থেকে রক্ত চুঁইয়ে পড়ছে।
খাইছে! চেঁচিয়ে উঠল মুসা, জ্যান্তই খেয়ে ফেলবে নাকি!
দুঃস্বপ্নে মানুষখেকো জংলীরা তাড়া করছিল কিশোরকে, হঠাৎ মিলিয়ে গেল। সব। জেগে উঠে দেখল, ঘামে জবজবে শরীর। তাতে কোন দুঃখ নেই তার, জংলীদের কবল থেকে যে বেঁচেছে এতেই খুশি।
মুসার ক্ষতটা দেখে মাথা ঝাঁকিয়ে বলল রবিন, হু, কাঁটা ফুটেছিল।
গম্ভীর হয়ে গেছে কিশোর, কাঁটা কই এখানে?
হ্যামক থেকে দুর্বল কণ্ঠে ডেকে জিজ্ঞেস করলেন মিস্টার আমীন, এই, শুনতে পাচ্ছ তোমরা?
অসংখ্য, অগুনতি ডানার মৃদু শব্দ শোনা যাচ্ছে।
অন্ধকার সুড়ঙ্গের বাদুড়গুলোর কথা মনে পড়ে গেল কিশোরের। মুসার ক্ষতটার দিকে তাকিয়ে থেকে শঙ্কিত ভঙ্গিতে মাথা নেড়ে আপনমনেই বলল, বাদুড়, না তো!
তাতে কি? রুমাল দিয়ে রক্ত মুছছে মুসা। বাদুড়ে কামড়ালে আর কি হয়?
তাতে? নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটছে কিশোর। সাধারণ বাদুড় যদি না হয়? যদি ভ্যাম্পায়ার হয়?
এইবার ভয় পেল মুসা। শিউরে উঠল ভূতের ভয়ে। সাংঘাতিক রক্তচোষা ভ্যাম্পায়ার পিশাচ ড্রাকুলার গল্প সে পড়েছে। রুমালটা পুটুলি বানিয়ে শক্ত করে। ঠেসে ধরল ক্ষতস্থানে। ককিয়ে উঠল, রক্ত বন্ধ হচ্ছে নাতো!
রবিন, আয়োডিনের বোতল বের করতে পারবে? মুসার হাত থেকে রুমাল নিতে নিতে অনুরোধ করল কিশোর।
রুমাল দিয়ে ক্ষতের নিচে আঙুলটা শক্ত করে পেচিয়ে বাধল সে। ঘষে ঘষে আয়োডিন লাগাল।
আবার শুয়ে পড়ল সবাই।
দশ মিনিটও গেল না, চেঁচিয়ে উঠল মুসা। আল্লাহরে, আজ শেষ করে ফেলবে আমাকে।
কম্বল মুড়ি দিয়েই শুয়েছিল মুসা। ঘুমের মধ্যে সরে গেছে কম্বল। নিতম্বের কাছে খানিকটা জায়গার প্যান্ট ছেঁড়া। তুরপুন ফুটিয়ে দেয়া হয়েছে সেখানেই।
রক্ত বন্ধ করে আবার আয়োডিন লাগিয়ে দিল সেখানে কিশোর।
ডবল ভাঁজ করে কম্বল মুড়ি দিল এবার মুসা।