কি? এগিয়ে এল কিশোর। খারাপ খবর?
অ্যাঁ? না, হঠাৎ হেসে ফেললেন তিনি। আমাদের সঙ্গে রসিকতা করছে কেউ।
দেখি তো। কাগজটা নিয়ে পড়ল কিশোর। লেখা রয়েছে?
রাফাত আমান,
কুইটো হোটেল,
কুইটো,
ইকোয়াডর।
আমাজন খুব খারাপ জায়গা দূরে থাকলেই ভাল করবেন
বাড়ির অবস্থা ভাল নয় জলদি ফিরে যান।
কে পাঠিয়েছে নাম নেই।
টেলিগ্রামটা এসেছে লস অ্যাঞ্জেলেস থেকে।
.
০২.
কে পাঠাল? কাগজটার দিকে চেয়ে আছে কিশোর।
হয়তো অ্যানিমেল ক্লাবের কেউ, একটু মজা করতে চেয়েছে, বললেন বটে মিস্টার আমান, কিন্তু নিজের কানেই বেখাপ্পা শোনালো কথাটা।
বাবা, বাড়িতে কিছু হয়নি তো? মুসা বলল।
নাআহ। তাহলে তোমার মা টেলিগ্রাম করত।
নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটছে কিশোর, কোন ব্যাপারে গভীর ভাবে চিন্তা করার সময় এটা করে সে। মনে হচ্ছে, জানোয়ার ধরতে এসেও রহস্যে জড়াতে যাচ্ছি। আমরা। কিন্তু আমাদের বিরুদ্ধে কার এই আক্রোশ? আমরা আমাজনে গেলে কার। কি ক্ষতি? কে থামাতে চায়?
কি জানি, বললেন মিস্টার আমান। ফেলে দাও। সামান্য ব্যাপার। টেলিগ্রামে নাম লেখার যার সাহস নেই, সে আমাদের কোন ক্ষতি করতে পারবে না।
খোঁজ তো করতে পারি? টেলিগ্রাম অফিসে নিশ্চয় নাম-ঠিকানা লিখেছে, রবিন বলল, ফর্মে।
তা-তো নিতেই পারি, কিশোর জবাব দিল। লাভ কি হবে? তোমার কি ধারণা, যে লোক এভাবে লুকোচুরি খেলতে চায় সে আসল নাম লিখবে?
ছেলেদের উদ্বিগ্ন ভাব লক্ষ করলেন মিস্টার আমান। খামোকা ভাবছ। এটা কোনও ব্যাপার? কেউ রসিকতা করেছে আমাদের সঙ্গে। হ্যাঁ, কাল খুব সকালে। রওনা হব। ভোর রাতে উঠতে হবে আমাদের। প্লেনটা ঠিক হয়েছে কিনা কে জানে।
গিয়ে দেখে আসব? প্রস্তাব দিল মুসা।
মন্দ বলোনি, কিশোর সায় জানাল।
ঠিক আছে, আমি যাচ্ছি, বললেন মিস্টার আমান।
তুমি শুয়ে থাকো, বাবা, আমরাই পারব। রবিন, যাবে?
আমি? নাহ তোমরাই যাও। ততক্ষণে আমি এই চ্যাপটারটা শেষ করে। ফেলি, রেফারেন্স বই খুলে বসল আবার রবিন।
হোটেল থেকে বেরোল কিশোর আর মুসা। প্লাজা ইনডিপেনডেনসিয়ায় গানের জলসা হচ্ছে, ব্যাও বাজাচ্ছে একটা দল। রাস্তার ওপাশের বিশাল গির্জা আর পাদ্রীর প্রাসাদে বাড়ি খেয়ে প্রতিধ্বনি তুলছে ঢোলের দ্রিম দ্রিম। প্লাজায় লোক গিজগিজ করছে। বেশির ভাগই ধোপদুরস্ত পোশাক পরা নাগরিক, স্পেন থেকে এসেছিল। তাদের পূর্বপুরুষরা। বেশ কিছু স্থানীয় ইণ্ডিয়ানও রয়েছে তাদের মাঝে, ছড়ানো কানাওয়ালা চ্যাপ্টা হ্যাট মাথায়, গায়ে জড়ানো কম্বলের মত পোশাক–পনচো।
রহস্যঘেরা অতি সুন্দর একটা শহর, ভাবল কিশোর। পর্বতের কোলে বিশাল উপত্যকায় শুয়ে রয়েছে যেন। চাঁদের আলোয় ঝিলমিল করছে পর্বতের বরফে ছাওয়া চুড়া। কুইটোর লোকেরা যে বলে, কুইটো থেকে স্বর্গ এত কাছে, হাত বাড়ালেই নাগাল পাওয়া যায়, ভুল বলে না।
খানিক হেঁটেই হাপিয়ে পড়ল দুই গোয়েন্দা। গতি কমাতে বাধ্য হলো। সমুদ্র সমতল থেকে সাড়ে নয় হাজার ফুট ওপরে রয়েছে ওরা, তাই পরিশ্রম বেশি। লাগছে। হাত বাড়ালেই স্বর্গ নাগাল পাওয়া যায় বলার আরেকটা কারণ অনেক উঁচুতে এই শহর। পৃথিবীর সবচেয়ে উঁচু শহরগুলোর একটা। কিন্তু উচ্চতার তুলনায় শীত বেশি নয়, কারণ, শহরের ঠিক গা ঘেঁষে চলে গেছে বিষুবরেখা, তবে যেটুকু শীত আছে তাতেই হাড় কাঁপিয়ে ছাড়ে। ওভারকোটের বোম এটে দিল। কিশোর। উজ্জ্বল আলোকিত প্লাজা থেকে নেমে এল পুরানো শহরের সরু অন্ধকার গলিতে।
খুব সাবধানে হাঁটতে হচ্ছে। খোয়া বিছানো পথের দু-ধারে সারি সারি পুরানো বাড়িঘর, রোদে শুকানো ইটে তৈরি। মাথার লাল টালির হাত কোকালে ঢেকে গেছে সবুজ শ্যাওলা আর লতাপাতায়, দু-দিক থেকে এসে পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে প্রাকৃতিক বানিয়ে দিয়েছে। ফলে মনে হয় একটা সুড়ঙ্গের ভেতর দিয়ে হাঁটছে।
পথের মাঝে মাঝে আলো আরও ঘন করেছে অন্ধকারকে। বাড়িঘরের ছায়াগুলো নিঃশব্দ পায়ে সরে যাচ্ছে যেন ওদের পাশ দিয়ে। গা ছমছমে পরিবেশ।
নিঃশব্দতার মাঝে তাই শব্দটা বড় বেশি কানে বাজছে কিশোরের, অনেকক্ষণ থেকেই পাচ্ছে। জুতোর মচমচ। শুরুতে বিশেষ গুরুত্ব দিল না। কিন্তু ভেনিজুয়েলা রোড থেকে ডানে মোড় নিয়ে সুক্রিতে পড়ার পরও যখন শব্দটা আসতেই থাকল, মনযোগ না দিয়ে আর পারল না। বাঁয়ে মোড় নিয়ে পিচিনচা গলিতে পড়ল। শব্দের কোন ব্যতিক্রম নেই, আসছে।
মুসাও শুনতে পাচ্ছে জুতোর শব্দ। তার গায়ে কনুই দিয়ে আলতো গুতো। মেরে ইশারা করল কিশোর, পাশে সরে দাঁড়িয়ে গেল একটা বাড়ির ছায়ায়। মুসা। দাঁড়াল তার গা ঘেঁষে।
সঙ্গে সঙ্গে থেমে গেল জুতোর আওয়াজ।
কোন সন্দেহ নেই, অনুসরণই করছে।
ছায়া থেকে বেরিয়ে আবার এগোল দুই গোয়েন্দা। আবার শুরু হলো অনুসরণ। আরও শ-খানেক গজ পর আরেকটা বাড়ির সামনে এসে থামল দু-জনে। দরজার সামনেটা অন্ধকারে ঢাকা। পকেট থেকে টর্চ বের করে সদর দরজার কপালে বসানো নেমপ্লেটের ওপর আলো ফেলল, কিশোর। হ্যাঁ, এই বাড়িটাই। সকালে এখানেই এসেছিল। এক আইরিশম্যান থাকে, পাইক জোনস তার নাম। কুইটোর লোকেরা বলে পাগলা পাইক। প্রায়ই নাকি বিমান নিয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করে এই খেপা বৈমানিক। বাড়িয়ে বলাটা অবশ্য লোকের স্বভাব, সে যে কোন দেশেরই হোক না কেন।