গায়ে কাঁটা দিল তার। কাছেই বিষুবরেখা, গরম হওয়ার কথা, তা না হয়ে। হয়েছে ঠাণ্ডা। হবেই, কারণ, দুই দেয়ালের মাঝের এই কালো ছায়ায় কোন কালেই রোদ ঢুকতে পারে না। তার কাছাকাছিই রয়েছে আরও তিনজন, কিন্তু তবু মনে হচ্ছে ভীষণ একা সে, অসহায়। মিস্টার আমানের দিকে তাকাল। চোখ বন্ধ করে পড়ে রয়েছেন। ঘুম, গা বেহুশ? মুসা আর রবিনও নীরব। কেউ কারও দিকে তাকাচ্ছে না।
অসহ্য এই নীরবতা আর সইতে পারল না মুসা। দুধের বোতলের মুখ খুলে দুধ। খাওয়াতে বসল নাকুকে। একহাতে হাল ধরে রেখে আরেক হাতে বোতলটা কাত করে ধরল বাচ্চাটার মুখের কাছে। চুকচুক করে বোতলের মুখ থেকে দুধ খেতে। লাগল নাকু, ভেতরে ঢুকছে সামান্যই বেশির ভাগ গড়িয়ে পড়ে যাচ্ছে দুই কম। বেয়ে। খাটো বাকা ডটার জন্যে বোতল থেকে ঠিকমত খেতে পারছে না। বেচারা। তার জিভের প্রতিটি শব্দ দেয়ালে বাড়ি খেয়ে ফিরে আসছে কয়েকগুণ। জোরাল হয়ে, কানে বাড়ি মারছে, যেন অশরীরী কোন প্রেতের ব্যঙ্গ-ঝড়া হাসি।
পথ এখন সোজা। কাজেই হাল ধরে রাখতে বিশেষ অসুবিধে হচ্ছে না মুসার।
ভাবছে কিশোর, ভুল সিদ্ধান্ত নিল না তো? সুড়ঙ্গের বাইরে থেকে জংলীদের। সঙ্গে লড়াই করাটাই কি উচিত ছিল না? ওদের কাছে বন্দুক রয়েছে, নয়জন। ইনডিয়ানকে শেষ করে দিতে পারত।
কিন্তু সত্যই কি পারত? জংলীরাও বসে থাকত না, তীর ছুঁডত। ওই বিষমাখা। তীর গায়ে গাথলে তাদের অবস্থাও হত মিস্টার আমানের মত। ওই তিনটে ক্যানূ। আর নয়জন জংলীই শেষ নয়, গায়ে আরও আছে। নয়জন মরলে শতজন এসে চড়াও হত। খেপে যেত ওরা তখন। যেভাবেই হোক, ধরতই অভিযাত্রীদের।
আবার শোনা গেল দীর্ঘশ্বাস। ওপর দিকে তাকিয়ে কিছু চোখে পড়ল না।
ছোট একটা মোড় পেরোল ক্যানূ। কিশোর আশা করেছিল, ওপাশে চওড়া হবে দেয়াল। তা না হয়ে হলো আরও সরু। সামনে ধীরে ধীরে সরে আসছে, গায়ে গায়ে লেগে যাওয়ার ইচ্ছে হয়েছে যেন। ওপরে ঝোপঝাড় বেশ ঘন, বড় গাছের চারাও আছে অনেক। দেয়াল যতই কাছাকাছি হলো, গাছের গায়ে গাছ ঠেকে গিয়ে চাদোয়া তৈরি করে ফেলতে লাগল। এতক্ষণও যা-ও বা আকাশ দেখা যাচ্ছিল, এখন আর তা-ও দেখা গেল না, অন্ধকার।
দুধ খাওয়ানো অনেক আগেই বাদ দিয়েছে মুসা। শক্ত হাতে হাল ধরেছে। যতই এগোচ্ছে, ঘন হচ্ছে অন্ধকার। হাতের দাঁড়ই ভালমত দেখা যায় না।
কেন আসেনি ইনডিয়ানরা, বোঝা যাচ্ছে এখন। অবাক হয়ে ভাবছে কিশোর, পাতালনদীর সঙ্গে এর তফাৎ কতখানি?
আরি! কি ওটা। চেঁচিয়ে উঠল রবিন।
কি? জিজ্ঞেস করল কিশোর।
কি জানি গায়ে লাগল!
ডানা ঝাপটানোর শব্দ শোনা যাচ্ছে চারপাশে, সেই সঙ্গে অনেকগুলো দীর্ঘশ্বাস।
বাদুড়-টাদুর হবে।
একটা দুটো নয়, ডানার আওয়াজেই বোঝা যায়, শয়ে শয়ে। মাথা নিচু করে রাখল কিশোর, যাতে বাড়ি না লাগে। জানে যদিও, ইচ্ছে করে যদি বাড়ি না লাগায় বাদুড়েরা, লাগবে না। রাডারের মত যন্ত্র রয়েছে তাদের শরীরে, নিকষ। অন্ধকারেও পথ চিনে নিতে পারে সেই যন্ত্রের সাহায্যে। কোথায় একটা খুদে পোকা লুকিয়ে রয়েছে, তা-ও বুঝতে পারে।
এই সময় কথাটা মনে পড়ল কিশোরের–ভ্যাম্পায়ার ব্যাটা নয়তো? বুকের ঢিপঢিপানি বেড়ে গেল। শুনেছে, দক্ষিণ আমেরিকার- এসব এলাকায় রক্তচোষা। বাদুড়ের বাস। উষ্ণ-রক্তের প্রাণীদের দিকেই ওদের ঝোঁক।
মসৃণ কিচকিচ আওয়াজে ভরে গেছে সূড়ঙ্গ। এরই মাঝে শোনা যাচ্ছে। আরেকটা শব্দ, বেশ ভারি। দুর থেকে আসা গর্জনের মত।
পানির গর্জন, কোন সন্দেহ নেই। দূরে রয়েছে এখনও।
তবে কি পাতালনদীতে পড়তে হবে, শেষ অবধি? বিপদের যোলোকলা পূর্ণ না করে ছাড়বে না দেখা যাচ্ছে পাহাড়ী নদী!
হঠাৎ মোড় নিল সুড়ঙ্গ। খ্যাঁচ করে দেয়ালে ঘষা লাগল নৌকার ধার। ধাক্কা। দিয়ে ঠেলে সরাতে গিয়ে কিশোরের হাত পড়ল নরম কিছুর ওপর। ফুরফুর করে উড়ে পালাল ওগুলো। ছোট আকারের বাদুড়।
ক্যানূটাকে ফুটিয়ে নিয়ে চলেছে স্রোত।
দূরে আবছা আলো চোখে পড়ল। মাথার ওপর আর আশপাশে উড়ন্ত বাদুড়গুলোর আকৃতি বোঝা যাচ্ছে এখন। যতই এগোচ্ছে নৌকা, আলো বাড়ছে, সেই সঙ্গে বাড়ছে পানির গর্জন।
বেরোতে পারব মনে হচ্ছে, আশা হলো রবিনের। সামনে যা-ই থাক, পেছনের ওই মৃত্যুফাঁদ থেকে ভাল, ভাবল সে।
মাথার ওপরে ফাটল শুরু হয়েছে, চোখে পড়ছে আকাশ। ওদের মনে হলো, কতযুগ পরে যেন আবার দেখা পেল ওই নীল আকাশের।
আরেকটা তীক্ষ্ণ মোড়। হুস করে হঠাৎ খোলা জায়গাটা বেরিয়ে এল নৌকা। চোখ ধাধিয়ে দিল তীব্র আলো। খোলা মুখে আদর করে চাপড় মারল যেন ভেজা বিশুদ্ধ বাতাস। বড় বড় এলোমেলো ঢেউ একে অন্যের সঙ্গে বাড়ি খেয়ে ইলশেগুড়ির মত মিহি পানির কণা ছিটিয়ে ভিজিয়ে দিচ্ছে গা।
সামনে মুখ বাড়াল মুসা। যাচ্ছি কোথায়?
নদীটা যেন হঠাৎ শেষ হয়ে গেছে সামনে। খেপা ঘোড়ার মত সেদিকে ছুটে চলেছে ক্যানূ। আর বড় জোর বারো-চোদ্দ গজ। তীরের দিকে নৌকা যোরানোর উপায় নেই।
জলপ্রপাত! চেঁচিয়ে উঠল কিশোর। পানির গর্জনে ঢাকা পড়ে গেল চিৎকার।
রবিন আর মুসাও অনুমান করতে পেরেছে। জোরে জোরে উল্টো দিকে দাঁড় বাইছে ওরা, নৌকাটাকে টেনে সরিয়ে রাখতে চাইছে।
চট করে একবার বাবার দিকে তাকাল মুসা। চোখ বন্ধ করে পড়ে আছেন, চেতনা নেই যেন।