মনে হয় ওদিক দিয়ে ঘুরে আসবে ব্যাটারা, বলল কিশোর। অনেক সময় লাগাবে। a.
ওই যে, আসছে। চেঁচিয়ে উঠল রবিন।
ঝট করে পেছন ফিরে তাকাল কিশোর আর মুসা। ঘুরে নয়, চাঙড়ের ভেতর দিয়েই আসছে ওরাও।
অভিযাত্রীদের দেখে পানির গর্জন ছাপিয়ে চেঁচিয়ে উঠল জংলীরা। সোজা ছেড়ে দিয়েছে তাদের ক্যানূ, ঢাল বেয়ে পড়ছে। চাঙড় দুটোর মাঝে পড়ে ক্ষণিকের জন্যে হারিয়ে গেল নৌকাটা, আবার যখন ভাসল, দেখা গেল উল্টে গেছে। ঢেউয়ে হাবুডুবু খাচ্ছে তিনটে কালো মাথা।
আনন্দে চেঁচিয়ে উঠল ছেলেরা।
কিন্তু তাদেরটা ডুবল না, ইনডিয়ানদেরটা ডুবল কেন? ওরা তো ক্যানূ চালানোয় অনেক বেশি দক্ষ। কিশোর অনুমান করল, মালের বোঝা-ই তাদের নৌকাটা বাঁচিয়ে দিয়েছে। তার ওপর তলায় শুয়ে রয়েছেন মিস্টার আমান। তুলা ভারি হয়ে যাওয়ার ভারসাম্য ভাল হয়েছে নৌকাটার, গড়াগড়ি করছে কম, কাত প্রায় হচ্ছেই না।
ঢালের ওপরে আরেকটা ক্যানূ দেখা গেল। তার পেছনে আরেকটা। দুটোই নেমে এল ঢালের নিচে। চাঙড়ের মাঝে ঢোকার আগের মুহূর্তে শাই করে পাশ কেটে সরে গেল পাশের প্রণালীতে। অভিযাত্রীদের পিছু না দিয়ে আশ্চর্য দক্ষতায় পাথরে ঠেকিয়ে নৌকা আটকাল জংলীরা। উল্টে যাওয়া ক্যামূটা তুলতে শুরু করল, আর পড়ে যাওয়া তিনজনকেও।
জোরে জোরে দাঁড় বাইতে লাগল তিন গোয়েন্দা। খানিকটা সময় পাওয়া গেছে, এই সুযোগে সরে যেতে হবে যত দূরে পারা যায়।
সমান জায়গাটা পেরিয়ে এল। আবার ঢালু হতে শুরু করেছে পথ। অনেক দীর্ঘ একটা মোড় নিয়েছে, নদী। তারপরে আরেক সমস্যা।
বিশাল পাহাড়ের মাঝে একটা সরু সুড়ঙ্গ, ওপরে ছাত নেই, তার মাঝে ঢুকে গেছে নদীটা। জায়গাটা ওখানে ঢালু, ফলে স্রোতের বেগ বেড়েছে। এগিয়ে গেলে ওটার মধ্যেই ঢুকতে হবে, আর কোন পথ নেই। মস্ত ঝুঁকি হয়ে যাবে সেটা। একবার সুড়ঙ্গে ঢুকে গেলে আর পিছিয়ে আসা যাবে না, পেছনে উজান। নামতে হবে ভাটির দিকে। চলে যেতে হবে শেষ মাথা পর্যন্ত। সেখানে কি আছে জানে না ওরা।
তীরে ভেড়ানোর সময় আছে এখনও। কিন্তু তাতে লাভটা কি হবে? জঙ্গলের মধ্যে ইনডিয়ানদের ফাঁকি দিয়ে একশো গজও যেতে পারবে না, তার আগেই ধরা পড়বে। ফিরে চেয়ে দেখল কিশোর, উল্টানো নৌকাটা সোজা করে ফেলেছে জংলীরা, আরোহী তিনজনও তাতে উঠে বসেছে। তাড়া করে আসবে আবার।
নাহ, তীরে ভেড়ানো যাবে না। বেশি ভাবারও সময় নেই। দাঁড় বেয়ে এড়িয়ে চলল ওরা সুড়ঙ্গমুখের দিকে।
দূর থেকেই শোনা গেল সুড়ঙ্গের পানি ঢোকার গর্জন। পাহাড়ের পাথুরে দেয়ালে বাড়ি খাচ্ছে শব্দ, তাতে শব্দ আরও বেশি মনে হচ্ছে।
পেছনে আর একশো গজ দূরেও নেই জংলীরা, দাঁড় বেয়ে এগিয়ে আসছে দ্রুত। একনাগাড়ে চেঁচাচ্ছে। তীর ছুঁড়তে শুরু করেছে, কেউ কেউ। কিন্তু রেঞ্জ, পাচ্ছে না, অভিযাত্রীদের অনেক পেছনে পড়ছে তার।
সুড়ঙ্গমুখ তো নয়, যেন হা করে রয়েছে এক মহাদানব। তার কালো মুখগহ্বরে গলগল করে ঢুকছে রাশি রাশি পানি। ভাবনা-চিন্তার সময় নেই। দানবের মুখে ঢুকে পড়ল অভিযাত্রীরা, ছুটে চলল তার কণ্ঠনালী ধরে।
পেছনে আবার শোনা গেল উত্তেজিত চিৎকার। চকিতের জন্যে একবার মুখ ফেরাল কিশোর। সুড়ঙ্গে ঢোকার আগের মুহূর্তে নৌকার মুখ ঘুরিয়ে ফেলেছে জংলীরা, ভেতরে ঢুকছে না।
আসছে না! আনন্দে চেঁচিয়ে উঠল রবিন। ভয় পেয়েছে।
কিন্তু কিশোরের মুখ কালো হয়ে গেল। তলপেটে শূন্য এক ধরনের অনুভূতি, শীত শীত লাগল। কড়া রোদ থেকে আচমকা সুড়ঙ্গের ঠাণ্ডা ছায়ায় ঢোকার কারণে নয়, ভয় পেয়েছে সে। ভীষণ ভয়। ইনডিয়ানরা যেখানে ঢুকছে সাহস পায়নি, সেখানে নিশ্চয় লুকিয়ে রয়েছে ভয়ঙ্কর কিছু। হয়তো সামনে রয়েছে নিশ্চিত মৃত্যু।
কাউকে কিছু বলল না সে। চুপ করে কান পেতে শুনছে। দ্রুত পেছনে পড়ছে। পানির গর্জন, সুড়ঙ্গমুখের পর থেকে আর শব্দ করছে না পানি, নিঃশব্দে বয়ে চলেছে ঢাল বেয়ে। সামান্যতম কলকল শব্দও নেই। স্নায়ুর ওপর দশ মন ভারি চাপ, সৃষ্টি করতে থাকে যেন এই অদ্ভুত নীরবতা।
পাহাড়ের দুই দেয়ালের মাঝে মাত্র তিরিশ ফুট মত ফাঁক। খাড়া প্রায় দু-শো ফুট উঠে গেছে দেয়াল। ফিতের মত এক চিলতে নীল আকাশ চোখে পড়ে সেই ফাঁক দিয়ে। আকাশটা যেন অপরিচিত, অন্য কোন পৃথিবীর।
সোজা এগোলে এক কথা ছিল। অভিযাত্রীদের বিপদ বাড়ানোর জন্যেই যেন জায়গায় জায়গায় বাঁক নিয়েছে গিরিপথ, ছোট বড় মোড় নিয়েছে, হাল ধরে নৌকার নাক ঠিক রাখতে হিমশিম খেয়ে যাচ্ছে মুসা। দেয়ালের সঙ্গে নাকের একটা বাড়ি লাগলেই শেষ।
বড় আরেকটা মোড় পেরোল নৌকা।
জোরে দীর্ঘশ্বাসের মত শব্দ হলো। চমকে উঠল ওরা। ঝট করে তাকাল। ওপরে। বাতাস, না পানির শব্দ? না, বাতাস নয়। অনেক ওপরে পাহাড়ের মাথায় গজিয়েছে পাতলা ঝোপ, লতাপাতা। নিথর হয়ে আছে। দুলছে না। তারমানে বাতাসও নয়। ফাঁকের ওপর দিয়ে সারি বেধে উড়ে চলেছে একদল রক্তলাল আইবিস পাখি। শব্দটা হয়তো ওরাই করেছে।
রোদ-চকচকে সেই নীল আকাশের দিকে চেয়ে কিশোরের মনে হলো, জেলহাজতের লোহার গরাদের ফাঁক দিয়ে লোলুপ দৃষ্টিতে মুক্ত দুনিয়া দেখছে। কয়েদীদের কেমন লাগে, অনুভব করতে পারল। এই জায়গাটা আসলেই যেন একটা জেলখানা। তাড়াতাড়ি দাঁড় ফেলল পানিতে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বেরিয়ে। যেতে চায় এই পাথরের কারাগার থেকে। সামনে যা থাকে থাকুক, পরোয়া করে না মরলে মরবে। এই মানসিক যন্ত্রণার চেয়ে সেটা অন্তত ভাল।