না না, ওকাজও করো না। জলদি ভাগতে হবে এখান থেকে। ভেব না, আমি ঠিক হয়ে যাব।
দেহের স্নায়ু আর মাংসপেশীর যোগাযোগ নষ্ট করে দেয় কিউরেয়ার। ফলে আজকাল ইউরোপ আমেরিকার বড় বড় হাসপাতালে ব্যবহার হচ্ছে এই জিনিস, রোগীর পেশীর পীড়ন দূর করে তাকে ঘুম পাড়ানোর জন্যে। মিস্টার আমানেরও ভীষণ ঘুম পাচ্ছে। কতখানি বিষ ঢুকেছে শরীরে, বোঝা যাচ্ছে না। ঘুম থেকে আর, জাগবেন তো?
মাথা আর ঘাড়ের মাংসপেশী প্রথমে অসাড় হবে। হলোও তাই। মাথা ঘোরাতে পারছেন না মিস্টার আমান। ধীরে ধীরে নিচের দিকে নামছে অসাড়তা, ছড়িয়ে পড়ছে বুকে, পিঠে, বক্ষপিঞ্জরের ফাঁকে ফাঁকে মাংসপেশীতে। শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু যত ব্যথাই করুক, অসুবিধে হোক, জোর করে শ্বাস টানতে হবে। ফুসফুসকে বাতাস-শূন্য হতে দেয়া চলবে না কিছুতেই। তাহলে নিশ্চিত মৃত্যু।
অবস্থা কতখানি সঙ্গিন, কিছুটা বুঝতে পারছে রবিন। কিশোর পারছে। পুরোপুরিই। কিউরেয়ারের মারণ-ক্ষমতার কথা ভালমতই জানা আছে তার। মুসা। জানে না। মুখ খুলতে যাচ্ছিল রবিন, কিন্তু চোখ টিপে তাকে নিষেধ করল কিশোর। ভয় পেয়ে যাবে মুসা। যা হওয়ার হয়ে গেছে, এখন তাদের কিছু করার নেই।
জংলীদের চেঁচামেচি কানে আসছে। বাড়ছে আস্তে আস্তে। তারমানে লোক জড় হচ্ছে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সরে যেতে হবে দূরে।
.
০৮.
ধ্রিম-ধ্রিম-ধ্রিম-ধ্রিম! ছড়িয়ে পড়েছে একটানা শব্দ।
ঢাক! চেঁচিয়ে উঠল কিশোর। সতর্ক করে দিচ্ছে গায়ের লোককে।
শঙ্কিত হয়ে পেছনে ফিরে তাকাল সে, কিন্তু আর কোন ক্যা দেখা গেল না। কে কত তাড়াতাড়ি পানিতে দাঁড় ফেলতে পারে, সেই প্রতিযোগিতা লাগিয়েছে যেন তিনজনে। তার ওপর সাহায্য করছে স্রোত।
স্রোত অবশ্য জংলীদেরকেও সহায়তা করছে।
উত্তেজিত অশ্বশাবকের মত ফুঁসছে নাকু।
চুপ থাক, খোকা, মুসা বলল। তোকে দেখার সময় নেই এখন।
দুধের বোতলটার ওপর নজর পড়ল তার। কড়া রোদে পড়ে আছে। গরমে নষ্ট হয়ে যাবে দুধ। অনেক মূল্য দিতে হয়েছে ওর জন্যে। আরও কত দিতে হবে। কে জানে। মালপত্রের ছায়ায় বোতলটা ঠেলে দিল মুসা। ভেজা রুমাল দিয়ে ঢেকে দিল।
ম্যাপের কথা ভোলেনি কিশোর। কিন্তু এখন যা অবস্থা, প্রাণ বাঁচানোই মুশকিল, থাক তো ম্যাপ আঁকা। তার সমস্ত হতাশা আর ক্ষোভ গিয়ে পড়ল যেন দাড়ের ওপর, গায়ের জোরে ঝপাত করে ফেলল পানিতে।
সামনে আরেক বিপদ। পানির গর্জনেই বোঝা যায় হঠাৎ ঢালু হয়ে গেছে নদীটা, অনেক গুণ বেড়ে গেছে স্রোতের তীব্রতা। রোদে লাফিয়ে উঠছে সবুজ সাদা ঢেউ। খুব সুন্দর, কিন্তু সৌন্দর্য অনেকখানি মলিন করে দিয়েছে ঢেউয়ের নিচ থেকে হঠাৎ হঠাৎ বেরিয়ে পড়া বড় কালো পাথরের বিষণ্ণ ভোতা মুখ।
ফেরার সময় নেই। আর ফিরে যাবেই বা কোথায়? হড়াৎ করে এক টানে সেই তা-থৈ ঢেউয়ের মধ্যে ক্যানূটাকে ফেলল স্রোত।
প্রচণ্ড ঘূর্ণিতে চরকির মত পাক খেল নৌকাটা, তারপর নাক নিচু করে ছুটে চলল ভীষণ গতিতে, আকাবাকা পথ ধরে। দানবীয় এক অজগরের মত বার বার একে বেকে গেছে নদী, সেই পথ অনুসরণ করল নৌকা। যে কোন মুহূর্তে উল্টে যাওয়ার ভয়কে যেন তোয়াক্কাই করছে না।
বিশাল দুই পাথরের চাইয়ের মাঝে যেন ডাইভ দিয়ে পড়ে শেষ হয়েছে ঢাল। সরু পথ, দু-ধারে পাথরের দেয়াল। সামান্যতম এদিক ওদিক হলেই দেয়ালে বাড়ি। খেয়ে চুরমার হয়ে যাবে নৌকা।
সামনের গলুইয়ের কাছে বসেছে কিশোর, মাঝে রবিন, পেছনে মুসা–নৌকা। বাওয়ায় দক্ষ বলে একই সঙ্গে হাল ধরা এবং দাঁড় বাওয়ার কঠিন দায়িত্বটা নিয়েছে সে।
আতঙ্কিত চোখে গিরিপথের দিকে তাকাল কিশোর। কি করবে? দাঁড় আড়াআড়ি ধরে ঠেকানোর চেষ্টা করবে? কয়েকটা ঘটনা ঘটতে পারে তাহলে। প্রচণ্ড তাপ সইতে না পেরে দু-টুকরো হয়ে যেতে পারে দাঁড়। ধাক্কা দিয়ে চিত। করে ফেলতে পারে তাকে। কিংবা ছুটে এসে বুকে বাড়ি মেরে ফেলে দিতে পারে। পানিতে। তারমানে, দাঁড় দিয়ে ঠেকানোর চেষ্টা করে লাভ হবে না।
কিশোর সিদ্ধান্ত নেয়ার আগেই লাফ দিয়ে গিয়ে গিরিপথের মুখে পড়ল নৌকা। শা করে ঢুকে গেল, ভেতরে। ভাগ্য আরেকবার পক্ষ নিল তাদের, কোন দেয়ালেই ধাক্কা লাগল না, এমনকি সামান্যতম ঘষাও নয়। স্রোতের ঠিক মাঝখান দিয়ে। তীরবেগে ছুটে চলল নৌকা।
ভীষণ গর্জন, দু-পাশ দিয়ে ঝঞ্ঝার বেগে ছুটে চলেছে যেন দুটো এক্সপ্রেস ট্রেন। চাপে পড়ে পাগল হয়ে গেছে বুঝি মাতাল ভোত, গা ঝাড়া দিয়ে পথ পরিষ্কারের চেষ্টা করছে, ফলে বৃষ্টির মত ছিটাচ্ছে পানির ছাট, অন্ধ করে দিতে চাইছে যেন অভিযাত্রীদের। এত ঘন ছাট, মনে হচ্ছে পথ জুড়ে রয়েছে সাদাটে অসংখ্য চাদর। ওই চাদরকে ছিঁড়ে সুড়ঙ্গ তৈরি করে তার ভেতর দিয়ে ছুটে চলেছে ক্যানূটা।
ঢালু জায়গা সোজা হয়ে গেছে অনেক আগেই। কমতে শুরু করল স্রোতের। তীব্রতা। সামনে সামান্য উঁচু হয়েছে পথ, তার গোড়ায় পানির ফেনা।
পাথরের চাঙড় পেছনে ফেলে এল নৌকা। গর্জন হঠাৎ করে অনেক কমে গেছে। সামনে পথ উঁচু, তাই তেও খুব কম। দাঁড় বাইতে হচ্ছে। পানির। আওয়াজ কমে যেতেই এখন আবার শোনা যাচ্ছে ঢাকের শব্দ।
দারুণ দেখিয়েছ, নৌকার তলায় শুয়ে দুর্বল কণ্ঠে বললেন মিস্টার আমান।