মিনিট পনেরো পরেই মুসার চিৎকারে লাফিয়ে উঠল তিনজনে। শাঁ করে। বাতাস কেটে মাথার ওপর দিয়ে উড়ে গেল একটা তীর।
দুধের বোতল হাতে নিয়ে লাফাতে লাফাতে আসছে মুসা। জলদি! তীর ছুঁড়ছে!
চোখের পলকে নৌকায় উঠে দাঁড় বেয়ে ওটাকে মাঝনদীতে নিয়ে এল ওরা। সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিল তীব্র স্রোত। টেনে নিয়ে চলল ক্যাটাকে। আরেকটা তীর উড়ে এল, কিন্তু পড়ল নৌকার পেছনে কয়েক হাত দূরে। দেখতে দেখতে একটা মোড়ের আড়ালে চলে এল ওরা, স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল।
বেশিক্ষণ টিকল না স্বস্তি। বাকের কাছে খানিকটা জায়গার ঝোপঝাড় পরিষ্কার, ঘাটে একটা ক্যানূ বাঁধা।
শাঁই শাঁই করে ক্যানূটার পাশ কাটিয়ে এল ওরা। কিন্তু বড়জোর শ-পাঁচেক গজ এগিয়েই কানে এল উত্তেজিত চিৎকার। ফিরে চেয়ে দেখল, লাফিয়ে ঘাটের ক্যানূতে উঠছে তিনজন ইনডিয়ান। বাকুর গাঁয়ের মানুষের মত পোশাক পরা নয়, প্রায় উলঙ্গ।
নাকুকে দুধ খাওয়াতে গিয়ে মারাত্মক বোকামি করে ফেলেছে, ঠোঁট কামড়াচ্ছে এখন মুসা।
দাড়ের ওপরে ঝুঁকে পড়েছে ওরা, যেন ওগুলোই তাদের এখন বাঁচার একমাত্র অবলম্বন।
তিনজনের বিরুদ্ধে চারজন। সংখ্যায় বেশি বটে, তবে সেটা হাতাহাতি লড়াইয়ের বেলায়। ইনডিয়ানদের কাছে রয়েছে বিষাক্ত তীর, রক্তে ওই বিষ ঢুকলে সর্বনাশ হবে। ওদের তীর কিংবা ডাটগানের রেঞ্জের বাইরে থাকতে হবে। গুলি আপাতত করতে চাইছেন না মিস্টার আমান। মানুষের রক্তে কখনও হাত ভেজাননি, রেকর্ডটা ভাঙার কোন ইচ্ছে তার নেই। তবে তেমন ঠেকায় পড়লে…
দ্রুত দাঁড় বেয়ে চলল চার অভিযাত্রী।
কিন্তু এসব অঞ্চল ইনড়িয়ানদের পরিচিত। এখাকার নদীতে নৌকা চালিয়ে তারা অভ্যস্ত। তাদের সঙ্গে দৌড়ের পাল্লায় পারবে কেন বিদেশীরা? তবু চেষ্টার ত্রুটি করল না।
মাইলখানেক পর্যন্ত আগে আগে রইল ওরা, তারপর গতি কমাতে বাধ্য হলো। নিচে পানি কম, বালিতে ঠেকে যাচ্ছে নৌকার তলা। গায়ের জোরে ঠেলে নিতে হচ্ছে এখন।
প্রায় উড়ে চলে এল ইনডিয়ানদের ক্যানূ। রেঞ্জের মধ্যে পেয়ে গেছে। একজন। দাঁড় ফেলে দিয়ে সাত ফুট লম্বা এক ধনুক হাতে খাড়া হয়ে গেল।
টংকার উঠল ধনুকের ছিলায়। শিস কেটে উড়ে এল তীর।
খ্যাট করে বিধল নৌকার একপাশে। র্যাটল সাপের লেজের হিড়হিড় শব্দ তুলে কাপল কিছুক্ষণ তীরের পালক লাগানো পুচ্ছ, যেন জীবন্ত।
সংগ্রাহক হিসেবে কিশোর পাশা অনন্য। এই বিপদের মাঝেও ভুলে যায়নি, দুর্গম এলাকার নরমুণ্ড শিকারীদের তৈরি এরকম একটা তীর সাড়া জাগাবে শহুরে দর্শকদের মাঝে, লুফে নেবে নেচারাল হিসট্রি মিউজিয়ম। আস্তে করে তীরটা খুলে নিয়ে নৌকার তলায় ফেলল সে, তারপর আবার দাঁড় তুলে নিল হাতে।
মিস হয়েছে দেখে রাগে চেঁচিয়ে উঠল ইনডিয়ানরা। আরেকটা তীর ধেয়ে, এল। গলা বাঁচাতে হাত তুললেন মিস্টার আমান, তীরটা গাথল তার ডান বাহুতে।
আর উপায় নেই। রাইফেল তুলে নিলেন তিনি। পয়েন্ট টু-সেভেন-জিভারো নয়, অন্য আরেকটা। পয়েন্ট থ্রি-জিভারো-জিভারো। ভোতা-মাথা প্রচণ্ড শক্তিশালী বুলেট, ধ্বংস-ক্ষমতার জন্যে কুখ্যাতি আছে।
হাত কাঁপছে মিস্টার আমানের। ডান বাহুতে তীক্ষ্ণ ব্যথা।
আমাকে দাও, বাবা, হাত বাড়াল মুসা। আগে এয়ারগান দিয়ে একটা ঘুঘুকে মারলে পড়ত তার তিনহাত দূরে বসা ঘুঘুটা, কিন্তু শুটিং ক্লাবে ভরতি হওয়ার পর হাত অনেক সোজা হয়ে গেছে তার। ছোটখাটো বাজিও জিতেছে কয়েকটা শুটিঙে।
মেরো না, রাইফেলটা বাড়িয়ে দিলেন তিনি।
না, মারব না। ক্যানূর কিনারায় রাইফেলের নল রেখে প্রায় শুয়ে পড়ল মুসা। জংলীদের নৌকার এক পাশে পানির সমতলের একটু নিচে সই করে টিপে দিল ট্রিগার।
নীরবতা খানখান করে দিল ভারি রাইফেলের কানা-ফাটা শব্দ। নৌকার পাশে পানি ছিটকে উঠল, চেঁচিয়ে উঠল জংলীরা। ফুটো দিয়ে পানি ঢুকেছে, ডুবতে শুরু করল নৌকা।
তাড়াহুড়ো করে ডুবন্ত নৌকাটা তীরের দিকে নিয়ে চলল ইনডিয়ানরা।
আংকেল, বেশি ব্যথা করছে? কিশোর জিজ্ঞস করল। কিছু করতে হবে?
দাঁড় বাও। মুসা, খানিকটা লবণ দাও তো।
অবাক চোখে তাকাল মুসা। পাগল হয়ে যাচ্ছে নাকি বাবা।
হ্যাঁ, হ্যাঁ লবণের কথাই বলছি।
মুসা, দাও জলদি, দাঁড় বাইতে বাইতে বলল কিশোর।
হ্যাঁচকা টানে তীরটা খুলে অন্য তীরটার কাছে ফেললেন মিস্টার আমান। দুটো তীরের মাথায়ই কালচে আঠামত জিনিস মাখানো। কিউরেয়ার বিষ।
আস্তিন গুটিয়ে ওপরে তুলে দিলেন তিনি। সামান্য ক্ষত, কিন্তু যেটুকু হয়েছে। তা-ই যথেষ্ট। বিষ ঢুকছে শরীরে। বেশি ঢুকলে কয়েক মিনিটের মধ্যেই মৃত্যু ঘটাবে। ইনডিয়ানরা লবণ বিশেষ খায় না, জন্তু-জানোয়ারেরা তো আরও কম। খায়। তাই তাদের শরীরে কিউরেরায় ক্রিয়া করে বেশি। কিন্তু লবণ-খেকো শহুরে। মানুষকে কতখানি কাবু করতে পারবে, বলা যাচ্ছে না।
ছুরি দিয়ে কেটে ক্ষতটা বড় করলেন মিস্টার আমান। তাতে লবণ ডলতে শুরু করলেন। খানিকটা লবণ মুখে ফেলে পানি দিয়ে গিলে নিলেন।
তোমরা বাও, থেমো, না, প্রচণ্ড ক্লান্তি বোধ করছেন তিনি। আমি আর বসতে পারছি না।
নৌকার তলায় শুয়ে পড়লেন লম্বা হয়ে।
নৌকা তীরে ভেড়াব, আংকেল? উদ্বিগ্ন কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল রবিন। ভালমত শুতে পারবেন।