দাঁড় বেয়ে নৌকা তীরে নিয়ে এল ওরা। বালিতে ঘ্যাঁচ করে নৌকার তলা লাগতেই তীরে নামল মুসা। ঘাসের অভাব নেই। ভাল দেখে দুই মুঠো ছিঁড়ে নিয়ে। এল। বাড়িয়ে দিল নাকুর মুখের কাছে।
নাক ফিরিয়ে নিল নাকু। খাবে না।
হুঁ, জ্বালাবে দেখছি, চিন্তিত কণ্ঠে বললেন মিস্টার আমান।
আরেকবার ঘাস খাওয়ানোর চেষ্টা করল মুসা।
খেল তো না-ই, চাপাচাপিতে বিরক্ত হয়ে লাফিয়ে নৌকা থেকে পানিতে পড়ার চেষ্টা করল না। তার গলায় বাধা লিয়ানা লতার রাশ টেনে ধরে থামানো হলো অনেক কষ্টে। দুলে উঠল নৌকা। আরেকটু হলেই গিয়েছিল উল্টে।
হয়েছে, ঘাস খাওয়ানোর দরকার নেই, হাত নাড়লেন মিস্টার আমান। থাক উপোস। মরবে না। পরে দেখা যাবে। কাগজের প্যাড, পেন্সিল আর কম্পাস বের করলেন তিনি।
নদীর ম্যাপ আঁকবেন নাকি? জিজ্ঞেস করল কিশোর।
হ্যাঁ।
আমার কাছে দিন, উত্তেজনা চাপতে পারল না কিশোর। আমি দেখি চেষ্টা করে। অজানা জায়গার ম্যাপ আঁকার মধ্যে একধরনের রোমাঞ্চ আছে। হাসলেন মিস্টার আমান। গুড। নাও।
জ্বলজ্বল করছে কিশোরের চোখ। চার দিকে তাকাল। কোনটা থেকে শুরু করি? …জলপ্রপাত। কি নাম দেয়া যায়? মুসার দিকে তাকাল।
আমি কি জানি? দু-হাত শূন্যে তুলল মূসা।
বাকু ফলস! চেঁচিয়ে উঠল রবিন।
উঁহু, নাকুনাপ্রপাত, বলল কিশোর। নাকুর মায়ের সম্মানে। বাকু ব্যাটা তো আমাদের ছেড়ে চলে গেছে। তাকে সম্মান দিতে যাব কেন?
ফলসের বাংলা জলপ্রপাত, না? মাথা ঝাঁকালেন মিস্টার আমান, ঠিক আছে, রাখো।
কাগজের ওপর দিকে একটা চিহ্ন আঁকল কিশোর। পাশে লিখল, নাকুমাপ্রপাত।
গ্রাফপেপারে আঁকছে সে। নীল রঙের ছোট ছোট অসংখ্য বর্গক্ষেত্র আকা। রয়েছে পেপারে। সেগুলোর ভেতর দিয়ে বাকা রেখা একে চলল। নাকুমাপ্রপাতের পর নদীটা যত বার বাক কিংবা মোড় নিল, কিশোরের লাইনও ততবার মোড় আর বাক নিল। কোনদিকে খেয়াল নেই, কাজ করে চলেছে একমনে। মাঝে মাঝে তাকাচ্ছে কম্পাসের দিকে। দিক মিলিয়ে নিচ্ছে। সার্ভেয়াররা কি করে কাজ করে, দেখেছে। মাপও মোটামুটি আকতে জানে সে। অসুবিধে তেমন হলো না।
ইস, যন্ত্রপাতি যদি থাকত, আফসোস করল।
সার্ভে করার যন্ত্রপাতি অনেক ভারি, ওদের পক্ষে আনা সম্ভব ছিল না। মিস্টার আমান বললেন, খসড়া একে নিয়ে গেলে, আর কর্তৃপক্ষকে বোঝানো গেলে হয়তো সাভে টিম পাঠাবে।
টিলা-পাহাড়-পর্বত কিছুই বাদ গেল না কিশোরের ম্যাপ থেকে। আনুমানিক অলটিচিউড় দিয়ে রাখছে। মার্জিনের বাইরে নোট লিখে রাখছে–বন কোথায় ঘন, কোথায় রয়েছে দামী কাঠের গাছ।
সাহায্য করছেন মিস্টার আমান। নিজের অভিজ্ঞতা থেকে জঙ্গলের ব্যাপারে জ্ঞান দিচ্ছেন ছেলেদের।
নদীটা কোথায় চওড়া, কোথায় সরু, গভীরতা, ঢালু কতখানি, কিছুই চোখ এড়াচ্ছে না কিশোরের। আন্দাজে কাজ করতে হচ্ছে, তবু যতখানি সম্ভব নিখুঁতভাবে আকার চেষ্টা করছে।
উত্তেজনায় বার বার ভুরু কুঁচকে যাচ্ছে তার। ভাবতে ভাল লাগছে, তার। আঁকা ম্যাপের ওপর ভরসা করে হয়তো আসবে আগামী দিনের অভিযাত্রীরা। তার। কথা বলাবলি করবে। হয়তো রেফারেন্স বইয়ে চিরদিনের জন্যে উঠে যাবে তার নাম। লেখা হবে ও কিশোর পাশা, দা ফাস্ট ইয়াং পাইআনিয়ার ফ্রম দা নাকুমাপ্রপাত…আর ভাবতে পারল না সে। রোমাঞ্চিত হলো শরীর।
অন্যদের যেমন তেমন, দিনটা কিশোরের ভালই কাটল। এতই তন্ময় হয়ে। কাজ করল, ঘনবনে মারাত্মক শত্রু থাকতে পারে, সেকথাও মনে হলো না একবার।
বিকেলের দিকে বেশ চওড়া হয়ে এল নদী। তার মাঝে ছোট্ট একটা দ্বীপে রাত কাটানোর জন্যে ক্যাম্প করল ওরা। ইচ্ছে করেই বেছে নিয়েছে জায়গাটা। বনের ভেতর থেকে নরমুণ্ড শিকারী ইনডিয়ানরা এলে, তাদের অলক্ষে আসতে পারবে না।
রাতে জন্তু-জানোয়ারের কোলাহলের মাঝে ঢাকের শব্দ কানে এল বলে মনে হলো ওদের। তবে নিঃসন্দেই হতে পারল না।
পরের দিনও একটানা চলল ক্যানূ, সেই সঙ্গে চলল ম্যাপ আঁকা। ইনডিয়ানদের দেখা নেই। নাকুকেও খাওয়ানো গেল না। মাঝে মাঝেই কুই কুই করে উঠছে। খিদে পেয়েছে জানাচ্ছে, মাকে ডাকছে। ওর ব্যাপারে আর নির্লিপ্ত থাকা গেল না। এই অবস্থা চলতে থাকলে চিড়িয়াখানা দেখানো যাবে না তাকে।
সমস্যার সমাধান করল বটে মুলা, কিন্তু নাকুকে বাঁচাতে গিয়ে আরেকটু হলে সবাই মরেছিল।
একটা মোড় ঘুরে কাদাপানিতে দুটো ছাগল দাঁড়িয়ে থাকতে দেখল ওরা। পানি খেতে নেমেছে। নদীর পাড়ে খানিকটা খোলা জায়গা, তৃণভূমি। সেখানে। চরছে আরও কয়েকটা ছাগল। কয়েকটা মাদীও আছে, সঙ্গে ছোট বাচ্চা। তারমানে মাগুলো একেকটা দুধের ডিপো।
বনছাগল! চেঁচিয়ে উঠল মুসা। নাকুর দুধ জোগাড় হবে।
পানি খাওয়া বাদ দিয়ে নৌকার দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ছাগলদুটো। নড়ছেও না।
উঁহু, বুনো না, মাথা নাড়ল কিশোর। নৌকা দেখলেই পালাত তাহলে।
গাঁ-টাও তো দেখছি না, রবিন বলল।
আছে হয়তো বনের ভেতরে কোথাও, বললেন মিস্টার আমান।
ওখানেই নামা দরকার, খোলা জায়গা দেখাল মুসা। দুপুরের খাওয়াটা সেরে নিই।
সবাই রাজি।
নৌকা ভিড়িয়ে তীরে নামল ওরা। খাওয়া-দাওয়ার পর সামান্য জিরিয়ে নেয়ার জন্যে ঘাসের ওপরই শুয়ে পড়ল সবাই, মূসা বাদে। একটা পানির বোতল খালি করে নিয়ে পা টিপে টিপে এগোল। চরতে চরতে একটা উঁচু ঢিপির ওপাশে চলে। গেছে ছাগলগুলো।