চকিতে মনে পড়ে গেল কথাটা। পিরের বড় শত্রু জাগুয়ার। পিঠে চেপে গলায় নখ বসিয়ে আঁকড়ে ধরে। তাপির তখন ছুটে যায় ঘন কাঁটাঝোপের দিকে, কিংবা নিচু মোটা ডালের দিকে। তলা দিয়ে ছুটে যায় তীব্র গতিতে। শক্ত ডালে বাড়ি লেগে অনেক সময় ছাতু হয়ে যায় জাগুয়ারের মাথা। ছিটকে পড়ে রক্তাক্ত থেতলানো দেহটা।
কিশোরও জাগুয়ারের মতই জীবটার পিঠে চেপেছে। এখানে কাঁটা ঝোপ। নেই, তবে নিচু ডাল অনেক আছে। সে-রকম একটা ডালের দিকেই ছুটছে। তাপির। আতঙ্কিত হয়ে পড়ল সে। আপনাআপনি কেশর থেকে খুলে এল আঙুলগুলো। মাটিতে গড়িয়ে পড়ে গেল।
গতি রুখতে পারছে না তাপিরটা। ছুটে যাচ্ছে।
হাঁপ ছাড়ল কিশোর। যাক, অল্পের ওপর দিয়েই গেছে।
কিন্তু একথা ভেবে আরেকটা ভুল করল সে। নিরীহ মাতা ক্রুদ্ধ হলে। কতখানি ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে, তাপিরটা তা-ই বুঝিয়ে দিল।
কয়েক গজ এগিয়ে ব্রেক কষে দাঁড়াল সে। তারপর চোখের পলকে টক দিয়ে ঘুরল। এত মোটা থলথলে একটা শরীর নিয়ে যেভাবে ঘুরল, অবাক না হয়ে পারা যায় না। ছুটে এল যেন কালবৈশাখীর ঝড়। সেই সঙ্গে একটানা তীক্ষ্ণ শিল!
কিভাবে খাড়া হলো কিশোর, বলতে পারবে না। গুতো লাগে লাগে এই সময় ঝাঁপ দিয়ে পড়ল এক পাশে।
কয়েক গজ গিয়ে আবার ঘুরল জানোনায়ারটা। আবার ছুটে এল। পুরোপুরি। গণ্ডারের স্বভাব। শত্রুকে শেষ না করে স্বস্তি নেই।
এক সাথে দুটো টর্চের আলো এসে পড়ল পিরের চোখেমুখে। গর্জে উঠল রাইফেল। থরথর করে কেঁপে উঠল বনভূমি। পয়েন্ট টু-সেভেন-জিভারো ক্যালিবারের উইনচেস্টার রাইফেল থেকে বেরোনো একশো তিরিশ গ্রেন এক্সপ্যানডিং বুলেটের প্রচণ্ড আঘাতে প্রায় উল্টে পড়ল ভারি জীবটা।
লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল কিশোর। বাচ্চাটা কোথায়? এদিক-ওদিক তাকাল সে? ওই তো। মায়ের দিকে ছুটে যাচ্ছে। ঝাঁপিয়ে পড়ল গিয়ে নিথর দেহটার ওপর। মা যে মারা গেছে, বুঝল না। শুড়ের মত নাক দিয়ে গুতো মারতে লাগল মায়ের। পেটে। মনে করল বুঝি ঘুমিয়ে পড়েছে। ওরকম তো প্রায়ই ঘুমোয় মা। তখন আরামসে শুয়ে শুয়ে দুধ খায় সে। এখনও তাই করল।
নিজের চুল ছিঁড়তে ইচ্ছে হলো কিশোরের। এ-কি করল? তার দোষেই তো মা-হারা হলো অতটুকুন দুধের বাচ্চাটা।
সবাই স্তব্ধ হয়ে দেখছে।
কিশোর চুপ, রবিন স্থির। রাইফেলে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন মিস্টার আমান।
ছুটে গিয়ে হাঁটু গেড়ে এতিম বাচ্চাটার পাশে বসে পড়ল মুসা। আস্তে করে ওটার মখমলের মত মসৃণ চামড়ায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল, ভাবিসনে, খোকা। দুঃখ করিসনে। মা-তো চিরকাল কারও বেঁচে থাকে না। খুব ভাল চিড়িয়াখানায়। নিয়ে যাব তোকে, ভাল ভাল খাবার খেতে দেবে ওরা। তোর একলার জন্যেই। চমৎকার একটা সুইমিং পুল বানিয়ে দেবে। সেখানে জাগুয়ারের ভয় নেই। আল্লার। কসম, তোকে আমরা মরতে দেব না কিছুতেই।
০৭.
পরদিন সকালে আবার নৌকা ভাসাল ওরা।
ধীরে ধীরে বাড়ছে স্রোত, ঢালু হচ্ছে নদী। খানিক পরেই বোঝা গেল কারণটা। সামনে জলপ্রপাত। কাজেই বয়ে নিতে হলো নৌকা আর মালপত্র।
জলপ্রপাতের নিচ থেকে আবার শুরু হয়েছে নদী। প্রথমে মালগুলো বয়ে এনে নদীর পাড়ে রাখল ওরা। তারপর নৌকাটা বয়ে নিয়ে এল। আবার ভাসল। পানিতে। মাল সাজিয়ে রেখে নৌকায় উঠল সবাই, বাকু বাদে।
পাড়ে দাঁড়িয়ে আছে বাকু। দৃঢ়কণ্ঠে ঘোষণা করল, ফিরে যাব!
বোঝাতে চাইলেন মিস্টার আমান, তর্ক করলেন, কোন লাভ হলো না। বাকুর এক কথা, ফিরে যাবে। তার চেনা অঞ্চল এখানেই শেষ। জলপ্রপাতের পর কি আছে জানে না সে, যায়নি কখনও। কোন রহস্যময় আতঙ্ক লুকিয়ে আছে ওখানে, জানে না। লোকজনকে চেনে না। শুধু শুনেছে, ওখানকার লোকেরা নাকি খুব খারাপ।
নদীর ধার বরাবর উজানে হেঁটে গেলে তার গায়ে পৌঁছতে দিন দুই লাগবে।
পাওনা টাকা মিটিয়ে দিলেন মিস্টার আমান। কিছু খাবার দিতে চাইলেন।
নিল না বাকু। হেসে কাঁধে ঝোলানো ধনুকে চাপড় দিল। আমি খাব। খাবার অভাব হবে না তার। নদী আর বন থেকে জোগাড় করে নিতে পারবে।
নৌকাটা বেশি পানিতে ঠেলে দিল বাকু। দাঁড়িয়ে রয়েছে। বন্ধুদের চলে যেতে দেখে যেন খারাপ লাগছে তার।
এক টানে ক্যানূটাকে নদীর মাঝখানে নিয়ে এল স্রোত। ভাসিয়ে নিয়ে চলল। হাত নেড়ে জিভারো ভাষায় গুড বাই জানাল বাকু, তারপর ঘুরে দাঁড়াল। উঠতে শুরু করল প্রপাতের ধারের পাথুরে ঢাল বেয়ে। ওপরে উঠে ফিরে তাকাল আবার। আরেকবার হাত, নাড়ল। তারপর লম্বা লম্বা পা ফেলে হারিয়ে গেল বনের ভেতরে।
নিজেদের বড় একা মনে হলো অভিযাত্রীদের। একজন মাত্র চলে গেছে, ওরা রয়েছে চারজন, অথচ একা লাগছে। ভারি অদ্ভুত। বার বার প্রপাতের দিকে ফিরে, তাকাচ্ছে। এই জঙ্গল, এই প্রকৃতি ওদের অচেনা। বাকু যতক্ষণ ছিল, কিছুটা ভরসা অন্তত ছিল। এমন এক জায়গায় রয়েছে ওরা এখন, যেখানে সভ্য মানুষ আর আসেনি। ওরাই প্রথম। সেজন্যে কিছুটা গর্বও বোধ করছে।
কথা শুরু করল মুসা।
নাকু খেতে চাইছে।
শুড়ের মত লম্বা নাকের জন্যে পিরের বাচ্চার নাম রেখেছে কিশোর, নাকু।
খায় কি? রবিনের প্রশ্ন।
কি আর খাবে? কিশোর বলল। লতাপাতা, মূল, রসাল শাকসজি। তবে বাচ্চাদের বোধহয় দুধ দরকার।
দুধ পাব কোথায়? কচি ঘাসই খাওয়াতে হবে।