শেষ হলো দল। কবরের ওপর দিয়ে ধীরে ধীরে চলে গেল, লেজটা। কিভাবে জানি জেনে গেল বাকু মাটি সরিয়ে আস্তে করে উঁকি দিল ওপরে।
হ্যামকে উঠল আবার সবাই। খুব সাবধানে রইল এবার মুসা।
হই-হট্টগোলে জন্তু-জানোয়ারের আনাগোনা থেমে গিয়েছিল কিছুক্ষণের জন্যে, আস্তে আস্তে শুরু হলো আবার।
চুপ করে পড়ে আছে কিশোর। আশা, যদি কেউ আসে এপথে? তবে সে ব্যাপারে সন্দেহ আছে যথেষ্ট। যা, হই-চই হয়েছে, মাথামোটা গরু না হলে এপথে। পানি খেতে আসার কথা নয় আর আজ রাতে কারও।
কিন্তু গরু সব জায়গায়ই আছে, আমাজনের জঙ্গলেও।
ঝোপে ঘষা লাগার খসখস আওয়াজ হলো, পায়ের চাপে মটমট করে শুকনো ডাল ভাঙছে। কোন ভারি জানোয়ার আসছে। উত্তেজনায় টানটান হয়ে রইল কিশোর।
ঝোপ থেকে বেরোল জীবটা। খোলা জায়গা পেরোচ্ছে। পানি খেতে নামবে। নদীতে। ঠিক এই সময় ক্যামেরার শাটার টিপে দিল কিশোর।
স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে গেল জীবটা। তীব্র নীলচে আলোয় ক্ষণিকের জন্যে তার। বোকাবোকা দৃষ্টি দেখতে পেল কিশোর। জীবটার মুখ এখন ক্যামেরার দিকে। ফেরানো। আবার শাটার টিপল সে। আবার।
অ্যাপারচার হোট-বড় করে তিনটে ছবি তুলেছে কিশোর। একটা অন্তত ভাল। হবেই।
কোথায় যেন পড়েছে সে: দক্ষ নেচারালিস্ট প্রথমে ছবি তুলে নেয়, তারপর লক্ষ্য করে জীবটাকে। কারণ, আগে না তুললে পরে আর ছবি তোলার সুযোগ না ও পাওয়া যেতে পারে। তা-ই করেছে কিশোর। টর্চ জেলে আগ্রহের সঙ্গে দেখতে। লাগল জীবটাকে। চোখে আলো পড়ায় অবাক হয়ে চেয়ে আছে ওটা, নড়ছেও না।
এর ছবি অনেক দেখেছে নেচারাল-হিস্টরি বইতে, চিড়িয়াখানায় জীবন্তও দেখেছে। কিন্তু যে কোন জানোয়ারকে বনে তার নিজস্ব জায়গায় দেখার ব্যাপারই আলাদা। তাই ওটাকে দেখে অবাক না হয়ে পারল না কিশোর।
দক্ষিণ আমেরিকার সবচেয়ে বড় বুনো-জানোয়ার তাপির। সামনে যেটা রয়েছে, একশো চল্লিশ কেজির কম হবে না, অনুমান করল কিশোর। ফুট পাঁচেক উঁচু, লম্বা প্রায় ছয় ফুট। বিভিন্ন জানোয়ারের দেহের নানা অংশ জোড়া দিয়ে যেন তৈরি হয়েছে। শরীরটা বিশাল এক শুয়োরের, ঘাড়ে ঘোড়ার কেশর, আর মুখের ওপরে হাতির ছোটখাটো একখান শুড়।
বিজ্ঞানীরা মনে করেন, জীবটা হাতির পূর্বপুরুষ। উড়টা খুবই খাটো, কিন্তু আসল হাতির শুড়ের মতই ব্যবহার করে। কিশোরের মনে হলো, জীবটার নাম তাপির না হয়ে শুঘোহা হওয়া উচিত ছিল, অর্থাৎ শুয়োর-ঘোড়া-হাতি।
একটা তাপিরের জন্যে মোটা টাকা অফার করেছে সিনসিনাটি চিড়িয়াখানা। ধরতে পারলে কাজই হয়। ধরাও হয়তো যায়–যদিও খুব কঠিন কাজ, কিন্তু নেবে। কি করে? যা নৌকার নৌকা প্রায় চার মন ওজনের জীবটাকে তোলাই যাবে না। ওতে, থাক তো বয়ে নেয়া। পোর্টেবল সাইজের একটা তাপির পেলে কাজ হত।
কিশোরের ডাকে সাড়া দিয়েই যেন এসে হাজির হলো পকেট এডিশন। পকেটে ধরবে না অবশ্যই, কিন্তু ক্যানূতে জায়গা হবে।
একটা শিও তাপির। হোঁতকা মায়ের মত ভোতা বাদামী রঙ নয় চামড়ার। হালকা হলুদ ডোরা আর সাদা সাদা ছোপ। বড় হলে মুছে যাবে। শিশুসুলভ গো গো, কুতকুত করে মায়ের দিকে ছুটে গেল সে। ভাবসাব দেখে মনে হচ্ছে, দুধের। জন্যে গলা শুকিয়ে কাঠ।
এই বাচ্চাটাকে ধরতে পারলে কাজ হয়, ভাবল কিশোর। ডাকবে নাকি সবাইকে? নাহ থাক। ডাকাডাকিতে যদি বাচ্চাকে নিয়ে চলে যায় মা? তার চেয়ে একা চেষ্টা করাই ভাল। তাপির সম্পর্কে যতখানি জানে কিশোর, খুব নিরীহ জীব। বিশেষ ঝামেলা করবে বলে মনে হয় না। তাছাড়া দৃষ্টশক্তি খুব দুর্বল ওদের। কিশোরকে হয়তো দেখতেই পাবে না।
নিশব্দে হ্যামক থেকে মাটিতে নামল সে। তাপির মায়ের চোখ থেকে আলো সরাল না।
দ্রুত হিসেব করে নিল মনে মনে। ভয় পেলে কোনদিকে পালাতে চাইবে মা? কাছাকাছি নদী থাকলে পানিতে ডুব মারে তাপির। এটাও হয়তো নদীতেই ঝাঁপ দেবে। মায়ের মত তাড়াহুড়ো করতে পারবে না বাচ্চাটা, দৌড়ে গিয়ে ধরে ফেলা যাবে।
পায়ে পায়ে এগোল কিশোর। মট করে ভাঙল একটা শুকনো ডাল।
অনেক অপেক্ষা করেছে তাপির। আর করল না। সামান্য শব্দেই ওর ধৈর্যের। বধ ভাঙল। কিন্তু নদীতে ঝাঁপ দিল না, বরং মাথা নিচু করে ভীমবেগে ছুটে এল। আলোর দিকে। ভুলেই গিয়েছিল কিশোর, নিরীহ মাতাও সন্তানকে রক্ষার সময় ভীষণ হয়ে ওঠে।
চেঁচিয়ে উঠল মা। চেহারা আর আকারের সঙ্গে ডাকটা বড় বেশি বেমানান। মেঘের মত গুড়গুড় নয়, হাতি-কিংবা গণ্ডারের মত খনখনে ডাকও নয়, খেপা ঘোড়ার মত তীক্ষ্ণ চি-চি করে উঠল। শেষ হলো টানা লয়ে, শিসের মত শব্দে। বিচিত্র জানোয়ারটার সব কিছুই অদ্ভুত।
সবাই জেগে গেল। লাফিয়ে হ্যামক থেকে নামলেন মিস্টার আমান। রবিন আর মুসাও নামল। কবর থেকে উঠে এল বাকু, প্রথম বসন্তের সাড়া পেয়ে গর্ত থেকে বেরোল যেন শজারু। তেমন করেই গা ঝাড়া দিয়ে মাটি ফেলল শরীর থেকে।
কেউ কিছু করার আগেই কিশোরের কাছে পৌঁছে গেল চারমনী দানবটা।
টর্চ ফেলে দিয়েছে কিশোর। একটাই উপায় দেখল বাঁচার। লাফ দিয়ে মাথার ওপরের একটা ভাল ধরে উঠে যেতে চাইল। কিন্তু ভার সইল না। ডাল ভাঙল। তাপিরের পিঠের ওপর হাত-পা ছড়িয়ে পড়ল সে। পতন রোধ করার জন্যে ঘাড়ের কেশর আকড়ে ধরল।