দিবাচরেরা ঘুমিয়েছে, জেগে উঠল নিশাচরেরা। শুরু হলো হাঁক-ডাক। যেন বলছে, এই ওঠো ওঠো, বেলা হয়েছে। আর কত ঘুমাবে।
ঝিঁঝির কানে-জ্বালা-ধরানো ডাক দিয়ে শুরু হলো। কিছুক্ষণ ডেকে ক্লান্ত হয়ে। সুর পাল্টাল ওরা। খাদে নামল শব্দ, দ্রুত লয় থেকে সরে এসেছে টানা লয়ে।
ড্রেইম ড্রেইম করে ডেকে উঠল একটা ব্যাঙ। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই চারদিক থেকে শুরু হয়ে গেল ডাক। সেই সঙ্গে যোগ হলো অন্য প্রজাতির হোউ-হেহা এবং ক্রোক ক্রোক। আরও ব্যাঙ আছে, তাদের কেউ গোঙাল, কেউ বা ঘ্যানর ঘ্যানর। করতে লাগল। সে এক বিচিত্র কলতান।
হঠাৎ বেরসিকের মত বেসুরো গলায় চিৎকার করে উঠল একটা নাইটজার। ভূত বিশ্বাস করে না কিশোর। তার মনে হলো, যদি ভূত থাকত তাহলে হয়তো ওভাবেই কাদত। গায়ে কাটা দিল তার।
আরও নানারকম শব্দ হচ্ছে। বেশির ভাগই অচেনা।
হঠাৎ ভীষণ গলায় কেশে উঠল কে যেন! নিমেষে চুপ হয়ে গেল অন্য সমস্ত শব্দ। ওই কাশি কিশোরের চেনা।
শিকারে বেরিয়েছেন মহাবনের মহারাজা, মহাবীর টিগ্রে!
.
০৬.
দুপ করে একটা শব্দ। মুহূর্ত পরেই কানের পর্দা ফুড়ে দিল যেন তীক্ষ্ণ চিত্তার।
এত চমকে গেল কিশোর, আরেকটু হলেই পড়ে গিয়েছিল। টর্চের আলো ফেলল মাটিতে।
মিস্টার আমান জেগে গেছেন, রবিনও। আরও দুটো টর্চ জ্বলে উঠল।
আবার বুনো চিৎকার। মুসার গলা মনে হচ্ছে? জাগুয়ারে ধরল না-তো! কিন্তু। কই, কাউকেই তো দেখা যাচ্ছে না।
বাচাও! বাঁচাও! চেঁচিয়ে উঠল মুসা।
তিনটে আলো একসঙ্গে ঘুরে গেল সেদিকে।
পাগল হয়ে গেছে যেন মুসা। জংলী-নৃত্য জুড়েছে। শরীরের যেখানে-সেখানে খামচি মারছে, থাপ্পড় মারছে। টেনে-ছিড়ে খুলে ফেলল শার্ট-প্যান্ট, গেঞ্জি আর। জাঙ্গিয়াও গায়ে রাখতে পারল না। একেবারে দিগম্বর। সেই অবস্থাতেই নাচানাচি। ঘাম-চকচকে কালো শরীর। সে-এক দেখার মত দৃশ্য।
হেই, কিছু করো! কেঁদে ফেলবে যেন মুসা। কিছু করো!
লাফিয়ে হ্যামক থেকে নামলেন মিস্টার আমান। অলো ফেললেন মুসার কাছাকাছি মাটিতে। সরো, জলদি সরো ওখান থেকে! খেয়ে ফেলবে তো!
কালো একটা সারি এগিয়ে চলেছে পিলপিল করে, ফুটখানেক চওড়া। শুরুও নেই, শেষও নেই।
কী? জিজ্ঞেস করল রবিন।
সৈনিক পিঁপড়ে। জবাব দিল কিশোর। দেখো দেখো, অফিসারগুলোকে দেখো।
ওদের সম্পর্কে পড়েছে রবিন। মাঝে মাঝে মাইলখানেকেরও বেশি লম্বা হয়। একেকটা দল। চলার পথে জীবন্ত কিচ্ছু রাখে না, খেয়ে সাফ করে ফেলে। ভাল করে তাকাল দলটার দিকে। সারির পাশে ছুটাছুটি করছে কিছু পিঁপড়ে। সামনে দৌড় দিচ্ছে, পেছনে যাচ্ছে, মনে হয় দলছুট। আসলে তা নয়, খবরদারি করছে। সৈনিকদের।
অগ্নিকুণ্ড থেকে জ্বলন্ত একটা চ্যালাকাঠ তুলে নিলেন মিস্টার আমান। চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতে বললেন মুসাকে।
বললেই কি আর চুপ থাকা যায়? তবু সাধ্যমত স্থির রইল মুসা।
পিঁপড়ের গায়ে জ্বলন্ত কয়লা ঠেসে ধরলেন মিস্টার আমান।
শক্ত, ধারাল বিশাল চোয়াল মাংসে গভীর ভাবে ঢুকিয়ে কামড়ে ধরে আছে পিঁপড়ে, গরম ছ্যাকা লাগতেই চোয়াল খুলে খসে পড়ছে। দু-চারটা ছ্যাকা মুসার। চামড়ায়ও লাগছে। কিন্তু কামড়ের জ্বলুনির চেয়ে ছ্যাকার জ্বালা অনেক কম।
টেনে, খামচে অনেকগুলো শরীর ছিঁড়ে ফেলেছে মুসা। চোয়ালগুলো গেঁথে। রইল গায়ে। ওগুলো ভোলাই মুশকিল হলো। ছুরির মাথা দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে অতিসাবধানে একটা একটা করে চোয়াল তুললেন মিস্টার আমান। তারপর ওষুধ। লাগিয়ে দিলেন আহত জায়গাগুলোতে। ছোপ ছোপ দাগ পড়েছে, বিচিত্র আলপনা কাটা হয়েছে যেন মুসার শরীরে।
মুখ টিপে হাসল কিশোর ও রবিন, অবশ্যই আরেক দিকে চেয়ে।
যাও কাপড় পরে ফেলো, বললেন মিস্টার আমান। হ্যামক থেকে নামলে কেন?
নামিনি তো, লজ্জা পাচ্ছে এখন মুসা। পড়ে গিয়েছিলাম। ইবলিসগুলোও যাওয়ার আর জায়গা পেল না, একেবার আমার নিচে দিয়েই: আচ্ছা,বাকুকে ধরল না কেন?
তাই তো? উত্তেজনায় তার কথা ভুলেই গিয়েছিল সবাই। আলো ফেলা হলো। কবরটা আছে, কিন্তু বার মাথাটা নেই।
খেয়ে ফেলল নাকি! আঁতকে উঠল মুসা।
না, খায়নি। কবরের ওপর দিয়েই যাচ্ছে পিঁপড়ে। আশেপাশে ছড়িয়ে পড়ে কিলবিল করছে কিছু। বাকুর মাথাটা যেখানে ছিল, সেখানে সামান্য ফুলে আছে। মাটি। তারমানে মুখটাও নিয়ে গেছে মাটির তলায়।
আহত জায়গা ডলল মুসা। ইস, কামড়ও মারে! যা জ্বালা।
জানো, ওই পিঁপড়ে দিয়ে শরীরের কাটা সেলাই করে ইনডিয়ানরা, বললেন মিস্টার আমান। কাটার দুটো ধার টিপে এক করে ধরে সেখানে কামড়াতে দেয় পিঁপড়েকে। চোয়াল মাংসে গম্ভীর হয়ে গেঁথে গেলে টেনে শরীরটা ছিঁড়ে ফেলে। আটকে থাকে চোয়াল। কাটা জায়গা শুকিয়ে জোড়া না লাগার আগে আর খোলে না।
জানি, মাথা ঝাঁকাল কিশোর। মুসা তো ছোট দলের সামনে পড়েছে। বড় দলগুলো যখন যায়, সাফ করে ফেলে সব। সামনে গ্রাম পড়লেও পথ পরিবর্তন করে না।
হ্যাঁ, গ্রামের ওপরই চড়াও হয়, বললেন তিনি। পিপডের বিরুদ্ধে কিছুই করার নেই, গ্রাম ছেড়ে পালায় ইনডিয়ানরা। জঙ্গলে নিরাপদ জায়গায় সরে যায়। তবে পিঁপড়ের সামনে যাদের গ্রাম পড়ে তারা ভাগ্যবান। ফিরে এসে দেখে সব পরিষ্কার। পোকামাকড় সাপ-ব্যাঙের গোষ্ঠী সাফ।