হ্যাঁ, হরিণের খুরের দাগ মুসাও চেনে। বাবার সঙ্গে কলোরাডোতে শিকারে গিয়েছিল, তখন দেখেছে। বাবা, এটা কিসের দাগ? এরকম তো জীবনে দেখিনি।
বড় বড় পিরিচের চাপে যেন তৈরি হয়েছে দাগগুলো।
টিগ্রে! ভয়ে ভয়ে বনের দিকে তাকাল বাকু। খারাপ জায়গা, খারাপ জায়গা।
এই টিগ্রেটা কি জিনিস? জানতে চাইল মুসা।
স্প্যানিশ ভাষায় টাইগারকে টিগ্রে বলে, জবাব দিল কিশোর। মেক্সিকো আর সমস্ত দক্ষিণ আমেরিকায় জাগুয়ারের নাম টিগ্রে। বাঘই এটা। তবে ডোরাকাটা নেই, আছে কালো গোল গোল ছাপ। ব্রাজিলিয়ান সীমান্তের কাছের পর্তুগীজেরা বলে ওনকা,। যে নামেই ডাকা হোক, আমাজন বনের ওরা রাজা।
ভালো না, ভালো না, কেঁদে ফেলবে যেন বাকু। ফিরে যাব, ফিরে যাব!
আরে কি মুশকিল, বিরক্ত হয়ে বলল মুসা। খালি ফিরে যাব ফিরে যাব। করে। কে আসতে বলেছিল?
ভালো জায়গা পাওয়া গেছে, দু-জনের কারও কথায়ই কান না দিয়ে বলল। কিশোর। পানি খেতে এলে আজ রাতেই জাগুয়ারের ছবি তুলব।
এসে যদি মানুষের মাংসও খেতে চায়? রবিন বলল।
না, সে ভয় তেমন নেই, আশ্বাস দিলেন মিস্টার আমান। আমরা কিছু না। করলে ওরাও কিছু বলবে না। তাছাড়া আমরা থাকব অনেক ওপরে, হ্যামকে।
তাঁবু-টাবু আর স্লীপিং ব্যাগের ঝামেলা নেই, দশ মিনিটেই ক্যাম্প তৈরি হয়ে গেল। প্রয়োজনের অতিরিক্ত একটা জিনিসও জঙ্গলে সঙ্গে নেয় না অভিজ্ঞ শিকারীরা। নিলে শুধু বোঝাই বাড়ে, চলার অসুবিধে হয়, কাজে তেমন লাগে না।
মোট চারটে হ্যামক টানানো হয়েছে।
হ্যামক এক ধরনের বিছানা 1 আমাজন জঙ্গলের ইনডিয়ানরা তো বটেই, দক্ষিণ আমেরিকার শহর অঞ্চলের অনেক বাড়িতেও হ্যামকই একমাত্র বিছানা। দিনের বেলা গায়েব, দেয়ালে দেয়ালে শুধু দেখা যাবে লোহার হুক গাঁথা। রাতে লিভিং রুম হয়ে যাবে বেডরুম। ওই হুক থেকেই ঝুলবে ঝুলন্ত বিছানাগুলো। জায়গা নষ্ট হয় না, বাড়তি বিছানা বিছিয়ে রাখার ঝামেলা নেই, মেহমান এলে কোথায় শোয়ানো যায়–ভেবে ভেবে যন্ত্রণা পাওয়ার কারণ নেই, সঙ্গে করে নিয়ে আসে যার যার হ্যামক। জিনিসটা অনেকটা ইজিচেয়ারে শোয়ার মত। ওই রকমই এক টুকরো কাপড় ঝুলিয়ে বিছানা হয়ে যায়। বাড়িঘরে যেগুলো ব্যবহার হয়, ওগুলোর চার কোণায় চারটে ফাঁস থাকে, ফাঁসগুলোকে হুকে আটকে দিতে হয়। আর জঙ্গলে ব্যবহারের সময় চার কোণার চারটে দড়ি গাছে বাধতে হয়। দুই দড়ির। হ্যামকও আছে। সেগুলোতে ইজি চেয়ারের ভাণ্ডার মতই কাপড়ের দুই প্রান্তে ডাণ্ডা ঢোকানো থাকে।
আমাজন জঙ্গলের সর্ব ইনডিয়ানরা অবশ্য হ্যামক ব্যবহার করে না, যেমন জিভারোরা। বাকু তাই অন্য ব্যবস্থা করল। মাটিতে ছোটখাটো একটা কবর খুড়ল। রাতে তার মধ্যে ঢুকে শুধু মাথাটা বাইরে রেখে গায়ের ওপর মাটি চাপা দিয়ে দেবে। দিনের বেলা অসহ্য গরম, রাতে তেমনি হাড়কাঁপানো ঠাণ্ডা। রোদ-তপ্ত মাটি। রাতে গরম কম্বলের কাজ দেয়।
বিছানা তৈরি শেষ। তীর-ধনুক নিয়ে বাকু চলল মাছ মারতে। ছেলেরাও চলল। সঙ্গে। তীর দিয়ে কিভাবে মাছ শিকার করে, দেখেনি কখনও।
পুকুরে মাছের অভাব নেই। ঝাকে ঝাকে ভেসে রয়েছে। দেখতে দেখতে গোটা দুই বেশ ভাল সাইজের মাছ ধরে ফেলল বাকু, পাঁচজনেরই চলবে।
শিকার নিয়ে ক্যাম্পে ফিরে এল ওরা।
আগুন ধরিয়ে ফেলেছেন মিস্টার আমান। শুকনো ডাল-পাতা ফেলতেই দাউ দাউ করে জ্বলে উঠল।
রাঁধতে বসল বাকু। ইনডিয়ান রান্না। নদীর পার থেকে পরিষ্কার কাদা তুলে এনে দুটো মাছের গায়েই পুরু করে মাখাল, বড় বড় দুটো কাদার পিণ্ড হয়ে গেল। কয়লার গনগনে আগুনে ফেলে দিল ওগুলো। তারপর বস্তা থেকে আলু বের করে মাছের মত একই ভাবে কাদা মাখালো। ওগুলোও ফেলল আগুনে।
কাদা শুকিয়ে শক্ত হয়ে গেল এক সময়। পিণ্ডগুলোকে আগুন থেকে বের করে পিটিয়ে কাদার আস্তরণ ভাঙল বাকু। ছুরি দিয়ে কেটে মাছ আর আলু বেড়ে দিল সবার পাতে।
ভোজনরসিক মুসা আমানকেও স্বীকার করতেই হলো, চমৎকার রান্না, ভাল স্বাদ।
রাত নেমেছে। আর বসে থেকে লাভ নেই। হ্যামকে উঠল অভিযাত্রীরা। বাকু গেল তার কবরে।
হ্যামকের ওপরে ঝোলানোর জন্যে মশারি আছে, কিন্তু সেগুলো খোলার দরকার হলো না। মশা নেই এখানে। তবে বিষাক্ত কীট, এই যেমন পিঁপড়ে, শতপদী, বিচ্ছু, এসব আছে এন্তার। গাছ থেকে দড়ি বেয়ে বিছানায় উঠে আসতে পারে। তাই দড়িতে তাগন্ধী কীটনাশক মাখিয়ে দেয়া হয়েছে।
তিন গোয়েন্দার কেউই আগে কখনও হ্যামকে শোয়নি। খাট তো নয় যে ধড়াস করে তাতে শুয়ে পড়লেই হলো। দুটো দড়ির ওপর ভার, ভারসাম্য ঠিক রাখার ব্যাপার আছে। একটু এদিক-ওদিক হলেই বিছানা যাবে উল্টে, ধুপুত করে গড়িয়ে তখন একেবারে মাটিতে।
সোজা শুয়ো না, হুঁশিয়ার করলেন মিস্টার আমান। কোণাকুণি শোও। নাহলে থাকতে পারবে না।
দ্রুত অভ্যাস করে নিল ছেলেরা। কঙ্কল টেনে দিল গায়ের ওপর।
মিস্টার আমান আর মুসার নাক ডাকানোর শব্দ শোনা গেল। রবিনও ঘুমিয়ে পড়ল। কিশোর জেগে রইল ক্যামেরা নিয়ে। বেশি নড়াচড়ার উপায় নেই। সাবধানে কাত হয়ে বাকুর দিকে তাকাল সে।
খুব ভালমত জায়গা বেছে গর্ত করেছে বাকু। জন্তু-জানোয়ারের চলার পথ। থেকে দূরে উঁচু জায়গায়। আগুনের আলোয় তার মুখটা আবছা দেখা যাচ্ছে। ঘুমিয়েছে কিনা বোঝার উপায় নেই।