ঠিকই আছে সব, বললেন মিস্টার আমান। এবার ছাড়া যায়।
তীরে দাঁড়িয়ে মেহমানদের বিদায় জানাল জিভারোরা।
পথ-প্রদর্শক হিসেবে একজন জিভারো যোদ্ধাকে অভিযাত্রীদের সঙ্গে দিয়েছে সর্দার।
দিনটা ভারি চমৎকার। উজ্জল বোদ। বানরের চেঁচামেচি, টিয়ে আর কাকাতুয়ার ডাকে মুখর হয়ে আছে নদীর দুই তীরের বনভূমি। পশ্চিমে, অনেক দূরে সবুজ বনের মাথা ছাড়িয়ে বিশ হাজার ফুট উঠে গেছে শিমবোরাজো পর্বতের বরফে ছাওয়া চুড়া। দুই পাশে তার দুই মহাসাগর। একপাশে প্রশান্ত, আরেক পাশে আটলান্টিক-যেদিকে এগিয়ে চলেছে অভিযাত্রীরা।
তীক্ষ্ণ বাঁক নিল নদী। জিভারোদের গ্রাম আড়ালে পড়ে গেল। দু-ধারেই ঘন জঙ্গল। নদীটা এখানে শ-খানেক ফুট চওড়া। কারও সঙ্গে যেন দেখা করার কথা, সময় বয়ে যাচ্ছে, তাই তাড়াহুড়ো করে ছুটে চলেছে টলটলে স্বচ্ছ পানি। সেই সাথে ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে নৌকা। পাঁচটা দাড়ের কোন কাজ নেই, নৌকার মুখ সোজা রাখা ছাড়া।
দেখো দেখো, চেঁচিয়ে উঠল রবিন।
ওপরে তাকাল মুসা।
আরে নিচে, নিচে। পানির তলায়।
গভীরতা কম। পরিষ্কার দেখা যায় তলার বালি। কালো রঙের ছোট ছোট কয়েকটা পাখি খাবার খুঁজছে।
পাখিগুলোকে বেশিক্ষণ দেখার সুযোগ হলো না, দ্রুত সরে যাচ্ছে নৌকা।
ওয়াটার উজল, বলল কিশোর। জলগায়ক বলতে পারো।
পানির তলায় উড়ছে, বলল মূসা।
উড়ছে না, সাঁতরাচ্ছে, শুধরে দিলেন মিস্টার আমান। ওড়ার মত করেই ডানা ঝাপটায়। শামুক আর পোকা খুজছে। দমও রাখতে পারে অনেকক্ষণ।
মস্ত কালো একটা ছায়া উড়ে এল মাথার ওপর, ওদের সঙ্গে সঙ্গে চলল।
আরি, কনডর! বলল মুসা।
উত্তেজিত হয়ে উঠল বাকু। খুব খারাপ। আমেরিকান শিংকোনা ব্যবসায়ীদের কাছে ভাঙা ভাঙা ইংরেজি শিখেছে সে। বিচিত্র ভঙ্গিতে মাথার ওপর হাত বুলাল, অশুভ শক্তিকে ঠেকাল যেন।
কুসংস্কার, রবিন বলল। জিভারোদের বিশ্বাস, কনডর মানেই অশুভ সঙ্কেত। মরার গন্ধ পেলে, কিংবা কোন অঘটন ঘটবে বুঝলেই নাকি হাজির হয় ওরা।
খাইছে! তাই নাকি? ভূতের ভয় মুসার বরাবর। পয়েন্ট টু-টু রাইফেলের দিকে হাত বাড়াল। ব্যাটাকে শেষ করে দেয়াই ভাল।
বাধা দিলেন মিস্টার আমান। পয়েন্ট টু-টুর গুলিতে কিচ্ছু হবে না ওর। গুলিই নষ্ট করবে শুধু।
খাওয়া যায় না?
ইনডিয়ানরাও খায় না, মাংস এত বাজে।
মাথার ওপর চক্কর দিচ্ছে বিশাল পাখিটা। এক ডানার মাথা থেকে আরেক ডানার মাথা দশ ফুটের কম নয়।
বিড়বিড় করল মুসা, আরিব্বাপরে, কত বড়।
এটা তো ছোটই, বলল কিশোর। এর চেয়ে অনেক বড় হয়, দুনিয়ার বৃহত্তম উড়ুকু পাখি কনডর। যেমন বড়, তেমন ভারি। অথচ অন্য সব পাখির চেয়ে বেশি ওপরে উঠতে পারে। না খেয়ে কাটিয়ে দিতে পারে একটানা চল্লিশ দিন। খাবার। পেলে একবারেই খেয়ে ফেলে আট-দশ কেজি।
শুনেছি, আস্ত ছাগল-ভেড়া নাকি তুলে নিয়ে যায়? মানুষের বাচ্চাও?
ভুল। নখে খুব ধার, কিন্তু বেশি ভারি জিনিস তোলার মত করে তৈরি নয়। সাংঘাতিক পাজি, আর দুঃসাহসী। বাগে পেলে ঘোড়াকেও আক্রমণ করতে ছাড়ে না।
অবশ্য যদি ঘোড়াটা রোগা কিংবা দুর্বল হয়, যোগ করল রবিন।
দুর্বল ঘোড়া এখানে না পেয়েই যেন কিছুটা হতাশ, কিছুটা মনের দুঃখেই যেমন এসেছিল, তেমনি নিঃশব্দে উড়ে চলে গেল উত্তরে।
কিন্তু বাকুর ভয় কাটল না। বারে বারে তাকাচ্ছে পাখিটা যেদিকে গেছে সেদিকে, মাথা নাড়ছে আর বলছে, ভাল না, ভাল না! ফিরে যাব, ফিরে যাব!
কিন্তু যাব বললেই তো আর যাওয়া যায় না। ঢালু বেয়ে তীব্র গতিতে নামছে স্রোতধারা, শুধু সামনেই এগোনো সম্ভব। পিছানো আর যাবে না।
.
অযথাই ভয় পেয়েছে রাকু। নিরাপদেই কাটল দিনটা। কোন অঘটন ঘটল না। অনেক পথ পেরিয়ে এল ওরা।
বিকেলের দিকে নোঙর ফেলল। রাত কাটাবে।
জায়গাটা ভারি সুন্দর। নদীর এক পারে সাদা বালির চর। তার পর ছোট একটা পুকুর। তাতে মাছ ঘাই মারছে। পুকুরের ওপাশ থেকে শুরু হয়েছে জঙ্গল; হঠাৎ করে যেন গজিয়ে উঠেছে কালচে গাছের দেয়াল। গাঢ় হলুদ আর টকটকে লাল বুনোফুল পড়ন্ত আলোয় জ্বলছে।
মাথার ওপর দিয়ে ধীর গতিতে ভেসে যাচ্ছে সাদা বক।
নদীর পারে বড় বড় কয়েকটা গাছ, তার নিচে ক্যাম্প করবে ঠিক করেছে। ওরা। তলাটা পরিষ্কার, ঝোপঝাড় নেই।
খালি জায়গার পরে যেখানে বন শুরু হয়েছে, সেখানে ঠাসাঠাসি ঝোপঝাড়ের মধ্যে সরু একটা ফাঁক দেখা গেল।
পথ মনে হচ্ছে? বাকুর দিকে ফিরলেন মিস্টার আমান, ইনডিয়ান?
দ্বিধা দেখা দিল বাকুর চোখে। সে নিজে একবার পরীক্ষা করে দেখল। নরম বালিতে পায়ের ছাপ দেখিয়ে মাথা নাড়ল। ইনডিয়ান নয়।
ছেলেদেরকে ডেকে এনে দেখালেন মিস্টার আমান। এগুলো পেকারির খুরের দাগ।
আমাজনের বুনো শুয়োর তো? কিশোর বলল, দল বেঁধে নাকি চলে। মানুষকে আক্রমণ করতেও দ্বিধা করে না।
হ্যাঁ।
আমিও পড়েছি, রবিন বলল। একবার নাকি একজনকে তিন দিন তিন রাত। গাছের ডালে আটকে রেখেছিল পেকারির দল, নামতে দেয়নি।
তারমানে এক নম্বর হারামী, মুসা মন্তব্য করল।
আশপাশে আরও পায়ের ছাপ দেখালেন মিস্টার আমান। রাতে এখানে পানি খেতে আসে জানোয়ার। এই দেখো, ক্যারিবারার পায়ের দাগ। দুনিয়ার সব চেয়ে বড় ইঁদুর, ভেড়ার সমান একেকটা। আর এই যে, হরিণের পায়ের ছাপ।