আমরা চুরি করিনি, কণ্ঠস্বর শান্ত রাখার চেষ্টা করল কিশোর। কোন্ হারামজাদা চুরি করে আমাদের ঘরে রেখে এসেছিল। আলমারির ড্রয়ারে।
ক্ষণিকের জন্যে ধক করে জ্বলে উঠল রোজারের চোখের তারা। তারপরই স্বাভাবিক হয়ে গেল আবার। বেশ, বেশ! তাহলে স্বীকার করছ, মাকড়সাটা ছিল তোমাদের ঘরে। এটাও এক ধরনের অপরাধ। যাকগে। খুব নরম মনের মানুষ আমি। দুটো কিশোরকে মারধর করতে খুব মায়া হবে। মাকড়সাটা কোথায় আছে, বলে দাও। ছেড়ে দেব তোমাদেরকে।
কিশোরের দিকে তাকাল রবিন। দ্বিধা করছে গোয়েন্দাপ্রধান। শেষে বলে ফেলল, আমরা জানি না। কোথায় আছে, বলতে পারব না।
জেমস বণ্ডের ছবি খুব বেশি দেখেছ, না? ভ্রুকুটি করল রোজার। মারের চোটে হেগেমুতে ফেলবে ব্যাটা, তবু মুখ খুলবে না। রবিনের। দিকে তাকাল। তোমার কি ধারণা, বাচ্চা ইবলিস? রূপালী মাকড়সা কোথায়?
জানি না, মাথা নাড়ল রবিন।
জান না! গর্জে উঠল রোজার। দেখেছ, অথচ কোথায় আছে। জান না! কোথাও লুকিয়ে রেখেছ তোমরা। ফাঁকি দিতে চাইছ এখন। জানি না বললেই হল! কোথায় রেখেছ? কাউকে দিয়েছ?…জবাব দাও!
জানি না, বলল কিশোর। সারারাত চেঁচিয়ে যেতে পারবেন, জানি না-র বেশি কিছু বলতে পারব না আমরা।
বাহ্, চমৎকার! একেবারে জেমস বণ্ডের বাচ্চা! চুপ হয়ে গেল হঠাৎ। ধীরে ধীরে আঙুলের টোকা দিতে লাগল চেয়ারের হাতলে। হঠাৎ বলল, তবে ঘাড় থেকে ভূত ছাড়িয়ে নিতে পারব। গোয়ার্তুমি রোগ সেরে যাবে একেবারে। তোমরা তো বাচ্চা খোকা। কত বড় বড় শক্তিশালী মানুষ এসে ঢুকেছে এখানে, পাথরের মত কঠিন। শেষে পানি হয়ে গেছে গলে। কোটা দিয়ে শুরু করব? আয়রন মেইডেন?
ঢোক গিলল কিশোর। চুপ করে রইল।
বেশি বাড়াবাড়ি হয়ে যাবে! বলে উঠল মরিডো। ভ্যারানিয়ার ইতিহাস জানা আছে আপনার, ডিউক। সিংহাসন নিয়ে এর আগেও কাড়াকাড়ি খাবলাখাবলি হয়েছে। কেউই টিকতে পারেনি। তাছাড়া, ব্ল্যাক প্রিন্সের কথাও আপনার অজানা নয়। দেশের লোক খেপে গিয়ে টেনে টেনে ছিঁড়েছিল তাকে। ভুলে যাবেন না কথাটা।
বড় বড় কথা, না? দাঁত বের করে হাসল রোজার। ঠিক আছে, তোমার কথাই মেনে নিলাম। আয়রন মেইডেন ব্যবহার করব না। আগেই বলেছি, মনটা খুব নরম আমার। লোকের কষ্ট সইতে পারি না। তবে, কথা আমি আদায় করবই।
প্রহরীর দিকে চেয়ে আঙুলের ইশারা করল রোজার। জিপসি বুড়ো আলবার্তোকে নিয়ে এস।
জাদুকর আলবার্তো! উত্তেজিত হয়ে উঠেছে মরিডো। ও…ওকে…
চুপ! ধমকে উঠল রোজার।
দরজায় পদশব্দ হতেই মুখ ফিরিয়ে তাকাল কিশোর। রবিন আর মরিডোও তাকাল। বৃদ্ধ একজন লোক এসে ঢুকেছে ঘরে। দুদিক থেকে ধরে তাকে নিয়ে আসছে দুই প্রহরী। এককালে খুব লম্বা ছিল, বয়েসের ভারে কুজো হয়ে গেছে এখন। হাতের লাঠিতে ভর দিয়ে ঠুকঠুক করে এগিয়ে আসছে। উজ্জ্বল রঙের আলখেল্লা গায়ে, কানে সোনার আঙটা। এক ছটাক মাংস আছে কিনা মুখে, সন্দেহ। চামড়া কুঁচকে বসে গেছে হাড়ের গায়ে। বড় বড় দুটো নীল চোখ, ধক ধক করে জ্বলছে যেন। সব মিলিয়ে ঘুমের ঘোরে আঁতকে ওঠার মত চেহারা।
লাঠি ঠুকতে ঠুকতে এসে ডিউক রোজারের সামনে দাঁড়াল বুড়ো।
এই যে, এসে গেছে জিপসি বুড়ো, রোজারের কথার ধরনে মনে হল, আলবার্তোর মালিক মনে করে সে নিজেকে। কণ্ঠস্বরে নির্লজ্জ দাম্ভিকতা। তোমার জাদুক্ষমতা কিছু দেখাও তো, আলবার্তো। এই ছেলেগুলো কথা গোপন করতে চাইছে। বের করে আন পেট থেকে।
বুড়ো জিপসির কুৎসিত মুখে কঠিন হাসি ফুটল। আদেশ মানতে অভ্যস্ত নয় জিপসি, আলবার্তো। দুপাশের দুই প্রহরীকে আশ্চর্য ক্ষিপ্রতায় ঠেলে সরিয়ে দিয়ে ঘুরে দাঁড়াল। গুডনাইট, ডিউক।
স্পর্ধা বটে বুড়োর! মুখ কালো হয়ে গেল রোজারের। কোনমতে দমন করে নিল রাগ। পকেট থেকে কয়েক টুকরো স্বর্ণ বের করল।
ভুল বুঝ না, জাদুকর, মোলায়েম গলায় বলল রোজার। এই যে নাও, তোমার সম্মানী। সোনার টুকরো।
ধীরে ধীরে ঘুরল আলবার্তো। শীর্ণ, ঈগলের নখের মত বাকানো আঙুলে একটা একটা করে টুকরো তুলে নিয়ে ঢোলা আলখেল্লার পকেটে ভরল।
হ্যাঁ, আলবার্তোর সঙ্গে যারা ভদ্র ব্যবহার করে, বলল জাদুকর। তাদের সাহায্য করে সে। তো, ডিউক, কি জানা দরকার?
এই ইবলিসের বাচ্চাগুলো ভ্যারানিয়ার রূপালী মাকড়সা লুকিয়ে রেখেছে, বলল রোজার। কিছুতেই বলতে চাইছে না। সহজেই জেনে নিতে পারি ওগুলো ব্যবহার করলে, নির্যাতনের যন্ত্রপাতিগুলো দেখাল। কিন্তু মনটা আমার খুবই নরম। ওসব করতে চাই না। তোমার প্রচণ্ড ক্ষমতা প্রয়োগ করলে কোন যন্ত্রণা হবে না, ব্যথা পাবে না, অথচ মনের কথা সুড়সুড় করে বলে দেবে ওরা। সেগুলো শুনতে চাই আমি।
ঠিক আছে, ফোকলা হাসি হাসল আলবার্তো। ঘুরে দাঁড়াল তিন বন্দির দিকে। ঝোলা আলখেল্লার পকেট থেকে বের করল একটা পেতলের কাপ আর চামড়ার একটা ছোট থলে। থলে থেকে কয়েক চিমটি কালো পাউডার তুলে নিয়ে ফেলল কাপে। আরেক পকেট থেকে বের করল দামি একটা সিগারেট লাইটার। আগুন ধরাল পাউডারে। নীল ঘন ধোয়া বেরিয়ে এল কাপের ভেতর থেকে।
নাও, শ্বাস নাও বাছারা! গলাটা বকের মত সামনে বাড়িয়ে দিয়েছে জাদুকর। বিড়বিড় করছে অদ্ভুত কণ্ঠে। এক এক করে কিশোর, রবিন আর মরিডোর নাকের কাছে ধরল কাপ! জোরে শ্বাস নাও! জাদুকর আলবার্তোর আদেশ! শ্বাস নাও! বুক ভরে টেনে নাও সত্যি ভাষণের-ধোয়া!