পরদিন সকালে আমরা এমন একটা জায়গায় এসে পৌঁছুলাম যেখানে সমতল ভূমি বলে কিছু নেই, খালি চড়াই আর উত্রাই। কোনো খাবারও নেই। বিলির সঙ্গী সেই ছয়জন সৈনিক বারবার তাদের সর্দারের দিকে তাকাতে লাগল, যেন কিছু বলতে চায়। কিন্তু বলল না কিছুই। দুপুর নাগাদ আমরা হাজির হয়ে গেলাম বরফ ঢাকা, ভোতা এক পাহাড় চুড়োয়। মাত্র চুড়োয় উঠেছি, এমন সময় ওদের চোখে পড়ে গেলাম। বিরাট একটা দল অপেক্ষা করছিল আমাদের জন্যে।
প্রীস্টরা খুব দ্রুত খবর পাঠাতে পেরেছে দেখছি, তেতো গলায় বলল বিলি ফিশ। ওরা আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে।
শত্রুপক্ষ থেকে আকস্মাৎ গুলিবর্ষণ শুরু হয়ে গেল। একটা গুলি এসে লাগল ড্যানিয়েলের পায়ের গুলতিতে। সে মাটিতে আছাড় খেয়ে পড়ে গেল। চারদিকে শত্রু দেখে কাত্রাতে কাত্রাতে বলল, ফিরে যাও, বিলি ফিশ। তোমার লোকদের নিয়ে চলে যাও। তোমার পক্ষে যা করা সম্ভব তা করেছ। এখন প্রাণে বাঁচতে চাইলে কেটে পড়ো। তুমিও কার্নেহান, ওরা হয়তো তোমাকে হত্যা করবে না। আমি একা ওদের মোকাবেলা করব। ঝামেলা আমিই পাকিয়েছি। আমি রাজা। আমার ঝামেলা আমাকেই শেষ করতে দাও।
আমি বললাম, তোমাকে ছেড়ে যাবার প্রশ্নই ওঠে না। বিলি ফিশ, তোমার রাস্তা খালি। তুমি যেতে পার। আমরা দুজন যতক্ষণ পারি ওদের ঠেকিয়ে রাখব।
আমি একজন সর্দার, গম্ভীর গলায় বলল বিলি ফিশ, আমি আপনাদের সঙ্গেই থাকব। আমার লোকেরা ইচ্ছে করলে চলে যেতে পারে।
তার মুখ থেকে কথা খসা মাত্র বাকি, সঙ্গে-সঙ্গে বাশকাইর সৈন্যরা দৌড়ে পালাল। তারপর আমরা তিনজন রুখে দাঁড়ালাম শত্রুদের বিরুদ্ধে সেই ভয়ঙ্কর শীতের মধ্যে সেই শীত এখানো যেন ঢুকে আছে মাথার ভেতরে।
.
প্রেসের লোকজন সবাই ঘুমাচ্ছে। আমার অফিস ঘরে দুটো কেরোসিন বাতি জ্বলছে, টের পাচ্ছি ঘামে ভিজে গেছে শরীর, কপাল থেকে ঘামের রেখা নামছে। কার্নেহানের দিকে ঝুঁকলাম। ও কাঁপতে শুরু করেছে। ভয় হলো অজ্ঞান না হয়ে পড়ে। আমি রুমাল দিয়ে মুখ মুছে জিজ্ঞেস করলাম, তারপর কী হলো?
তারপর? গুঙিয়ে উঠল কার্নেহান। মরণপন লড়াইয়ে হেরে গেলাম আমরা। বিলি ফিশ, আমাদের সহৃদয় বন্ধুটির গলা কেটে ফেলল ওরা এক কোপে। তারপর ড্যানকে ধরে হেঁচড়াতে-হেঁচড়াতে নিয়ে চলল অনেক দূরে একটা খাদের ধারে। সারাটা রাস্তা ওরা ওকে পেছন থেকে লাথি মারতে মারতে নিয়ে গেল। ড্যান অমন অবস্থার মধ্যেও আমাকে বারবার বলছিল, তোমার এই দুর্দশার জন্যে আমিই দায়ী, পিচি। আমিই তোমাকে তোমার নিরুদ্বেগ জীবন থেকে টেনে এনেছি কাফিরিস্তানে একদল বুনোর হাতে খুন হবার জন্যে। তুমি আমাকে ক্ষমা করে দাও, বলে ভেউ ভেউ করে কাঁদছিল সে।
ওরা ড্যানকে একটা খাদের ওপর দড়ির ব্রিজে নিয়ে তুলল। তারপর এক কোপে ধড় থেকে আলাদা করে ফেলল মুণ্ড। দ্বিখণ্ডিত শরীরটা ছিটকে পড়ে গেল কয়েক শ ফুট নিচে।
এরপর আমার পালা। ওরা আমাকে পাহাড়ের জঙ্গলে নিয়ে যীশুকে যেভাবে ক্রুশে ঝোলানো হয়েছিল, ঠিক সেভাবে একটা গাছে ঝুলিয়ে দিল। হাতে এবং পায়ে কাঠের গজাল ব্যবহার করেছিল ওরা। কিন্তু কি আশ্চর্যের ব্যাপার, অত যন্ত্রণা সহ্য করেও শেষ পর্যন্ত আমি টিকে যাই। পরদিন সকালে ওরা আমাকে জীবিত দেখে খুব অবাক হয়ে যায়। আমাকে ওরা গাছ থেকে নামায়…
এ পর্যন্ত বলে চেয়ারে দুলতে-দুলতে বাচ্চাদের মতো ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল কার্নেহান। দশ মিনিট কেঁদে বোধহয় বুকটা খালি হলো, হাতের চেটো দিয়ে চোখ মুছে আবার শুরু করল সে।
আমাকে ওরা মন্দিরে নিয়ে গেল। কিছু খেতে দেয়নি। ওরা বলাবলি করছিল ড্যানিয়েল মানুষ হলেও আমাকে দেবতার পর্যায়ে ফেলা যায়। কারণ ক্রুশে ঝুলেও আমি বেঁচে গেছি। ওরা আমাকে তারপর বরফের ওপর ছুঁড়ে ফেলে বলল, বাড়ি যাও। আর কখনো এদিকে এসো না।
আমার পুরো একটা বছর লেগেছে বাড়ি ফিরে আসতে। ওরা আমার হাতে ড্যানের কাটা মুণ্ডুটা ধরিয়ে দিয়েছিল সোনার মুকুটসহ। এ কাজটা করেছিল আমি যাতে আর ওদিকে পা বাড়ানোর সাহস না করি। আমি বহুদিন অনাহারে অর্ধাহারে থেকেছি। কিন্তু সোনার মুকুটটা হাত ছাড়া করিনি। কারণ এই মুকুট মাথায় পরত আমার ভাই ড্যান। তার মুকুটের মর্যাদা আমার কাছে অনেক বেশি। ওতো আমার ভাই, বন্ধু, সবই ছিল। এই যে দেখ আমার ভাইয়ের কী দশা করেছে ওরা।
ফোঁপাতে-ফোঁপাতে একটা ঘোড়ার চামড়ার থলে খুলল কার্নেহান, তারপর আমার দিকে ঠেলে দিল শুকনো, বিবর্ণ হয়ে যাওয়া ড্যানিয়েল ড্রাভটের কাটা মুণ্ডুটা। বাতির আলোয় সেই বিখ্যাত লাল দাড়ি যেন আবার ঝলসে উঠল, কোটর দুটো শূন্য, ভাঙা খুলির ওপর ঝকঝকে একটা রত্নখচিত সোনার মুকুট বসিয়ে দিল কার্নেহান।
এই সেই রাজা, বলল কার্নেহান। যত দিন বেঁচে ছিল নিজেকে কাফিরিস্তানের রাজা ভেবেই বেঁচেছে। ভাবলে কষ্টে বুক ফেটে যায় বেচারা ড্যানিয়েল এক সময় রাজা ছিল।
কাটা মুণ্ডুটার দিকে তাকিয়ে আমার গা শিউরে উঠল। এই লোকটার সাথে আমার মারোয়ার জংশনে পরিচয় হয়েছিল ভাবতে কেমন যেন লাগল। কার্নেহান উঠে দাঁড়িয়েছিল চলে যাবার জন্যে। আমি ওকে নিষেধ করলাম যেতে। কারণ বাইরে যাবার মতো শারীরিক সামর্থ ওর নেই।
আমাকে হুইস্কির বোতলটা দাও আর পারলে কয়েকটা টাকা দাও, হাঁপাতে-হাঁপাতে বলল সে। আমি এখন ডেপুটি কমিশনারের কাছে যাব। বলব শরীর সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত যেন আশ্রমে থাকার অনুমতি পাই। না, ধন্যবাদ, গাড়ি ডেকে দিতে হবে না। আমার কাজ আছে দক্ষিণে মারোয়ারে-এক্ষুনি ছুটতে হবে ওখানে।