আমার কাজ ছিল দক্ষ সেনাবাহিনী গড়ে তোলা। কমপক্ষে পাঁচ শ মানুষকে আমি ড্রিল করা শিখিয়েছি, দুশ জনকে অস্ত্র বাহন করতে শিখিয়েছি। হাতে তৈরি গাদা বন্দুক তাদের কাছে আজব বস্তু বলে মনে হত। ড্রাভট স্বপ্ন দেখত এক সময় বিশাল এক সেনাবাহিনী গড়ে তুলবে সে, একদিন গোটা পৃথিবীর মালিক হয়ে বসবে।
সবকিছু ঠিকঠাক চলছিল। রাজা হবার স্বপ্ন দেখেছিল ড্রাভট, এখন সে সম্রাটের সমান ক্ষমতার অধিকারী। কিন্তু সুখে থাকতে ভূতে কিলায় বলে একটা কথা আছে, ঠিক সেটাই একদিন ঘটল ড্রাভটের জীবনে, আর তার সব কাজের সাগরেদ ছিলাম বলে একই নিয়তির শিকার হতে হলো আমাকেও।
আমরা যাত্রা শুরুর আগে একটা চুক্তিপত্র করেছিলাম। তাতে দ্বিতীয় ধারায় স্পষ্ট উল্লেখ ছিল আমরা কখনোই সাদা কিংবা বাদামী কোনো নারীর দিকে নজর দেব না। কিন্তু সেই শর্তের কথা বেমালুম ভুলে গিয়ে ড্রাভটের মনে বিয়ের শখ চাগিয়ে উঠল। বলল, আমি বিয়ে করতে চাই পিচি, এদেশের মেয়েগুলো ইংরেজ মেয়েদের চেয়েও সুন্দরী। তবে শুধু আমিই সুখ ভোগ করব কেন? তুমিও বিয়ে করবে, পিচি। তোমাকেও সুন্দরী একটি মেয়ের সাথে বিয়ে দেব।
আমাকে লোভ দেখিও না।বললাম আমি। নারী সঙ্গের আমার কোনো প্রয়োজন নেই।
আরে আমি তো স্রেফ বিয়ে করার জন্যে বিয়ে করব না, বলল ড্রাভট। আমার চাই একজন রানী যে আমাকে পুত্র সন্তান উপহার দেবে। হবে এ রাজ্যের ভবিষ্যৎ রাজা। আমার জন্যে সবচেয়ে শক্তিশালী উপজাতিদের মাঝ থেকে কনে খুঁজে আনবে, পিচি। এই শীতেই আমি বিয়ের কাজটা সেরে ফেলতে চাই।
আমি ড্রাভটকে বোঝাতে চাইলাম, বললাম মেয়েরা বিশ্বসঘাতিনী হয়, কোনো মেয়ে আমার সাথে কবে ভালবাসার অভিনয় করে দাগা দিয়ে গেছে এবং সে-ক্ষত আমার এখনো শুকায়নি, সে গল্পও শোনালাম। বললাম, তোমাকে মিনতি করছি, ড্যান। এমন কিছু করতে যেয়ো না। তা হলে আমাদের ক্ষতি হতে পারে। বাইবেলে বলেছে, রাজাবাদশারা তাদের সময় নারীদের পেছনে নষ্ট করতে পারবে না, বিশেষ করে যে রাজার রয়েছে। নতুন রাজ্য গঠনের গুরু দায়িত্ব।
আমি যা বলেছি তাই করব, গম্ভীর গলায় কথাটা বলে পাইনের বনে গেল ড্রাভট পায়চারী করতে। এখানে হাঁটাহাটি করার সময় সে সব মাস্টার প্ল্যান করে।
আমি হাল ছেড়ে দিলাম। তবে ড্যান যতটা সহজ ভেবেছিল কনে খুঁজে পাওয়া ততটা সহজ মোটেই হলো না। পরিষদ সভা ডাকল ড্যান ড্রাভট, নিজের বিয়ের প্রস্তাব রাখল সেখানে। কিন্তু কেউ এ ব্যাপারটা নিয়ে মুখ খুলল না, বলা ভালো খুলতে চাইল না। শুধু বিলি ফিশ বলল, সে মেয়েদের জিজ্ঞেস করে দেখবে। শুনে ভয়ানক ক্ষেপে গেল ড্রাভট। আমার দোষটা কোথায়?খ্যাক-খ্যাক করে উঠল সে। আমি বাঘ না ভালুক যে মেয়েদের খেয়ে ফেলব। বরং তোমাদের ফালতু মেয়েছেলেদের চেয়ে আমার জায়গা অনেক উঁচুতে। আমি কি এই দেশটাকে ছায়ার মতো আগলে রাখছি না? গতবার আফগানদের হামলা থেকে কে বাঁচিয়েছিল তোমাদের? (আসলে কাজটা করেছিলাম আমি, রাগের চোটে ড্রাভট ভুলে গেছে সে কথা।) কে তোমাদের জন্য বন্দুকের ব্যবস্থা করে দিয়েছে? কে তোমাদের ভাঙা সেতু নির্মাণ করেছে? সমানে এভাবে গাঁক গাঁক করেই যেতে লাগল সে। বিলি ফিশসহ অন্যান্যরা চুপ হয়ে রইল।
পরে আমি বিলি ফিশকে একান্তে ডেকে নিয়ে শুধালাম, সমস্যাটা কী, বিলি ফিশ? আমাকে সত্যি কথাটা বল তো?
আপনাকে সত্যি কথাই বলছি, বলল বিলি ফিশ। আমাদের মেয়েরা কী করে একজন দেবতা বা শয়তানকে বিয়ে করবে? এটা মোটেই উচিত হবে না।
আমি ভুলেই গিয়েছিলাম ওরা আমাদের দেবতা জ্ঞান করে। এখন ভুলটা ভেঙে দিলে হিতে বিপরীত হতে পারে। তাই বললাম, একজন দেবতা যা খুশি করতে পারে। রাজা যদি কোনো মেয়েকে পছন্দ করেন তা হলে তিনি আর তাকে মরতে দেবেন না।
তাকে অবশ্যই মরতে হবে, দৃঢ় গলায় বলল বিলি ফিশ। এই পাহাড়ে আরও অনেক দেবতা এবং শয়তান আছে। এদেরকে যে মেয়ে বিয়ে করছে পরবর্তীতে তার আর কোন সন্ধান পাওয়া যায়নি। তা ছাড়া, আপনারা দুজনেই পাথরের সেই কাটা চিহ্ন রহস্যের কথা জানেন। দেবতা ছাড়া মানুষের পক্ষে ওই রহস্য জানা সম্ভব নয়। আমরা আপনাদের শুরুতে মানুষই ভেবেছিলাম। কিন্তু ওই পাথরের চিহ্ন দেখার পর থেকে জানি আপনারা মানুষ নন, দেবতা।
আমি আর বলার মতো কথা খুঁজে পেলাম না। সে রাতে আমার ঘুম হলো না দুশ্চিন্তায়। বারবার মনে হচ্ছিল ভয়ানক কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে। আমাদের জীবনে।
সে রাতে পাহাড়ের ওপরের ছোট্ট মন্দিরটা থেকে বারবার ভেসে এল শিঙা ফোকার আওয়াজ। শুনলাম গুঙিয়ে-গুঙিয়ে কাঁদছে একটি মেয়ে। পরে শুনেছি রাজাকে বিয়ে করার জন্যে ওই মেয়েটিকে প্রস্তুত করা হচ্ছিল এ কারণে সে বারবার জ্ঞান হারিয়ে ফেলছিল।
ড্যান অবশ্য অত কথা শুনতে চাইল না। সে সাফ-সাফ বলে দিল, আমি অমন ভীতু মেয়ে চাই না, তবে তোমাদের রীতিনীতির ওপর হস্তক্ষেপ করার ইচ্ছেও আমার নেই। প্রয়োজনে আমি নিজেই মেয়ে বেছে নেব।
মেয়েটা আসলে একটু ভয় পেয়েছে, বলল এক প্রীস্ট। তার ধারণা হয়েছে সে মরে যাবে।
আগামী কাল সকালের মধ্যে মেয়ে যোগাড় করে না আনতে পারলে তোমরাও কেউ বাঁচতে পারবে না, গরগর করে উঠল ড্রাভট। প্রীস্টকে রীতিমতো হুমকি দিয়ে তাড়িয়ে দিল ড্রাভট। তারপর অনেক রাত পর্যন্ত হাঁটাহাঁটি করে বেড়াল পরদিন সকালের সুখ-কল্পনাকে আশ্রয় করে।