কিছুদিন পরে, একদিন সকালে ঢাক-ঢোল পিটিয়ে ড্যান ড্রাভটের আগমন ঘটল আমাদের আস্তানায়। পাহাড় থেকে রীতিমতো মার্চ করে এল সে, সঙ্গে শতাধিক মানুষ। অবাক হয়ে গেলাম, ওর মাথায় চকচক করছে ভারী স্বর্ণ-মুকুট।
মাই গড, কার্নেহান, বলল ড্রাভট, দারুণ কাজ হচ্ছে হে। গোটা দেশের মালিক এখন আমরা। আমার পরিচয় এখানে রানী সেমিরামিসের। পুত্র আলেকজান্ডার, আর তুমি আমার ছোট ভাই এবং একজন দেবতাও। আমি গত ছয় হপ্তা ধরে লড়াই করেছি। সবগুলো লড়াইতে জিতেছি। ওদের রাজা বনে গেছি। তোমার জন্যেও একটা রাজমুকুট এনেছি। শু নামের একটা জায়গায় বসে ওরা সোনার মুকুট জোড়া বানিয়েছে। ওখানে পাহাড়ের নিচে সোনা থকথক করছে, মাংসের মধ্যে চর্বির মতো। আর আছে মহামূল্যবান রত্ন, পাথরের খাঁজে-খাঁজে। নদীর বালুতে প্রচুর খনিজও দেখলাম। এই যে দেখ এক লোক আমার জন্যে অম্বর নিয়ে এসেছে। যাও, সব প্রীস্টদের ডেকে নিয়ে এস। তোমার মাথায় এখন মুকুট পরানো হবে।
এক লোক একটা কালো ব্যাগ খুলে মুকুটটা বের করল। মুকুটটা ছোট কিন্তু খুব ভারী। কমপক্ষে পাঁচ পাউন্ড ওজন হবে, ব্যারেলের ঢাকনির মতো দেখতে।
পিচি, বলল ড্রাভট, আমরা আর মারামারির মধ্যে যেতে চাই না। তারপর সে আমার সাথে বিলি ফিশের হাত মিলিয়ে দিল। বিলি হলো বাষকাই গ্রামের মোড়ল। ওর নাম আমরাই দিয়েছি বিলি ফিশ। ও পরে আমাদের সবচে বিশ্বস্ত সঙ্গী হয়ে ওঠে।
ড্রাভট বলল, কমপক্ষে চল্লিশ জন গ্রাম্য মোড়ল আমার অধীনে। আমরা ওদের নিয়ে ইচ্ছে করলে অনেক কিছু করতে পারব।
এরপর ড্রাভট বলল গ্রাম প্রধান এবং প্রীস্টদের সে বড় একটা সম্মেলন করবে। ইমব্রার মন্দিরটা আপাতত প্রাসাদ হিসেবে ব্যবহার করবে, জানাল সে।
ড্রাভটের ধৈর্য কম। আর সে সব কিছু খুব তাড়াতাড়ি পেতে চায়। সে। সেইরাতেই গ্রামের লোকজন নিয়ে পাহাড়ের পাশে আগুন জ্বালিয়ে সম্মেলনের ব্যবস্থা করল। ড্রাভট আমাদের পরিচয় দিল দেবতা হিসেবে, বলল আমাদের পূর্বপুরুষরা জাদুবিদ্যায় খুবই পারদর্শী ছিল। বলল আমরা এখানে এসেছি কাফিরিস্তানকে এমন একটি দেশে পরিণত করতে যেখানে মানুষ কখনো না খেয়ে থাকবে না। অনাহারে মরবে না, সবাই সুখে শান্তিতে বাস করবে।
বেশ গুরুগম্ভীর একটা বক্তৃতা দেয়ার পরে গ্রাম্য প্রধানরা শ্রদ্ধা জানাতে একে-একে এল আমাদের সাথে হাত মেলাতে। ওদের একেক জনের নাম দিলাম আমরা বিলি ফিশ, হলি ডিলওয়ার্থ, পিক্কি কেরগান ইত্যাদি ইত্যাদি।
তবে সবচেয়ে অবাক করা ঘটনাটা ঘটল পরদিন রাতে, মন্দিরে। বুড়ো বটগাছের মতো প্রাচীন ধর্মযাজকরা তীক্ষ্ণ চোখে আমাদের লক্ষ করে চলছিল। আমার বেশ অস্বস্তি হচ্ছিল ভেবে এরা যদি কোনোভাবে বুঝতে পারে আমাদের সবই বুজরুকি, তা হলে না জানি কি দশা হবে। তবে ভাগ্যই বলতে হবে তেমন কিছু ঘটল না।
ড্রাভট গ্রামের মেয়েদের হাতে বানানো বেশ দামি একটি আলখেল্লা পরে বড় একটা পাথরের ওপর বসল। ওরা এটাকে বলে স্টোন অভ ইমব্রা। বাশকাই গ্রামের সবচে বুড়ো প্রীস্ট লোকটা কেন যেন পাথরটাকে উল্টে দেয়ার চেষ্টা করছিল। না পেরে শেষে ওটার তলা ঘষতে থাকে হাত দিয়ে। ধুলো আর মাটি সরে গিয়ে পাথরের গায়ে দৃশ্যমান হয়ে ওঠে একটা চিহ্ন। কাকতালীয় ব্যাপারটা আমাদের জন্যে যেন সাপে বর হয়ে দাঁড়াল। ড্রাভট আমার দিকে তাকিয়ে ফিসফিসিয়ে বলল, আবার সৌভাগ্যের দ্বার উন্মোচিত হতে যাচ্ছে। প্রীস্টরা বলছে এটি নাকি একটি হারানো চিহ্ন। এর অর্থ এদের কারো জানা নেই। এখন বরং আমাদের দুশ্চিন্তা আরও কমল। আমরা যে দেবতা এই বিশ্বাসটা ওদের ভেতরে এবার বদ্ধমূল হবে। তারপর খামোকাই বন্দুকের বাট দিয়ে পাথরে একটা বাড়ি মারল ড্রাভট, তারপর গ্রামবাসীদের দিকে ফিরে বজ্র নির্ঘোষে বলতে লাগল, মহাপুরুষদের যে আর্শীবাদ রয়েছে আমার ওপর তার ওপর নির্ভর করে এবং পিচির পক্ষে আমি ঘোষণা করছি, কাফিরিস্তানের সকল ফ্রি মিসোনারীর রাজা আজ থেকে আমি এবং পিচি। এই বলে মাথায় মুকুট পরল সে, আমার মাথায়ও চাপিয়ে দিল একটা। তারপর বলল, আগামী সে মাসের মধ্যে আমরা দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থার আরও উন্নতি সাধন করব। দেখব তোমরা কে কীভাবে কাজ করছ।
পরবর্তীকালে দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির জন্যে অনেক কাজ করলাম। আমি গ্রামবাসীদের চাষাবাদ শেখালাম, কীভাবে দড়ির ব্রিজ তৈরি করতে হয় শেখালাম। বড়-বড় গিরিখাদের মাঝখানে সেতুগুলো ঝুলান হলো।
ড্রাভট আমার কাজে সন্তুষ্টই ছিল। তবে আমার কোনো পরামর্শ সে কানে তুলত না, নিজের মর্জি মাফিক চলত। অবশ্য লোকের সামনে ও আমাকে কখনো অসম্মান করেনি। লোকজন ভয় পেত আমাদেরকে। ভয় পেত আমাদের নিজের হাতে গড়া সেনাবাহিনীকে। তবে ওরা ড্রাভটকে ভালও বাসত। প্রীস্ট আর গ্রাম প্রধানদের সাথে দারুণ বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল ড্রাভটের। পাহাড়ের ওপরে থেকে কেউ নালিশ নিয়ে এলে চার প্রীস্টের কাছে পরামর্শ চাইত ড্রাভট, কী করা যায় সে ব্যাপারে। এরা ছিল বাশকাইর বিলি ফিশ, শু-র পিচি কেরগান, কাফুজেলামের এক গ্রাম প্রধান এবং মাডোরার প্রীস্ট। গ্রামে যদি মারপিট বেধে যেত তার সমাধান দিত এই চার প্রীস্টই।