‘নিতান্তই সস্তা প্যাঁচ,’ সহজ সুরে জবাব দিলেন অনিন্দ্যসুন্দর, ‘সব রহস্য উপন্যাসেই এরকমটা হয়। একেবারে শেষ পরিচ্ছেদে ডিটেকটিভ সন্দেহভাজন সকলকে একটা ঘরে জড়ো করে। তারপর নিজের তদন্তের কাহিনি শোনায়, আর তখন খুনি সাধারণত নিজের দোষ স্বীকার করে, কিংবা বেহিসেবি হয়ে ধরা পড়ে যায়। আপনাকে ওই খাতায় শুধু একটু মোছামুছি করতে হবে।’
‘ঠিক আছে, আপনার কথাই বিশ্বাস করলাম, মিস্টার চৌধুরী। কিন্তু মনে রাখবেন, আপনার হাতে আর মাত্র কুড়িমিনিট সময় আছে।’
অনিন্দ্যসুন্দর ফোন নামিয়ে রাখতেই রণবিলাস মন্তব্য করল, ‘নিশ্চয়ই ওই দেবদূত ফোন করেছিল?’
‘হ্যাঁ।’ অনিন্দ্যসুন্দর বললেন।
রণবিলাস চুপ করে গেল।
‘আমার হাতে যে আর সময় বেশি নেই, সেটাই সে মনে করিয়ে দিল।’ অনিন্দ্যসুন্দর বলতে শুরু করলেন, ‘যাই হোক, আমার গল্প তোমাদের বিশ্বাস হয়নি মানলাম, কিন্তু এবারে আমি তথ্যের দিকে নজর দেব। আশা করি, সেগুলো তোমরা বিনা বিতর্কে মেনে নেবে। এই ঘরে তোমরা পাঁচজন রয়েছ। এবং পাঁচজনের প্রত্যেকেই মনে-মনে চাও, আমার মৃত্যু হোক। কিন্তু তার মধ্যে একজন সেটা এত বেশি করে চায় যে, সে—খুন করতেও পেছপা হবে না।
‘এই যে আমার প্রিয় ভাইপো অভীক। দেনায় ও গলা পর্যন্ত ডুবে গেছে। এ-দেনার হাত থেকে ওর রক্ষা পাওয়ার একমাত্র আশা, আমার উইলের উত্তরাধিকারসূত্রে কিছু অর্থ লাভ করা। মানছি, অভীকের টাকার প্রয়োজনটা এই মুহূর্তে। কিন্তু আমি যদি মারা যাই, তা হলে উইলের প্রবেট নেওয়া হবে, আর ওর পাওনাদাররাও সাময়িক ধৈর্য ধরবে।
‘তারপর রয়েছে কিংশুক, আমার প্রাক্তন সেক্রেটারি। কিংশুকের ধারণা, আমি পথ থেকে সরে গেলে, সুন্দর সান্যালের উন্নতি ও খ্যাতির দায়িত্ব সে একাই নিতে পারবে। আগামীকাল আমার প্রকাশক দেখা করতে আসছে, আর সেটাই হল কিংশুকের মস্ত সুযোগ—যদি আমি মারা যাই, তবেই।
‘এবার আসছে হীরা সিং। ওর বিশ্বাস, আমি লেখা ছেড়ে দিলে ওকে পুলিশে ধরিয়ে দেব। কারণ তখন ওর অতীতের কীর্তিকলাপ আমার গল্পে আর কাজে আসবে না।
‘সবশেষে আমার প্রিয়তমা স্ত্রী তৃণা এবং ওর বন্ধু শ্রীযুক্ত রণবিলাস দত্ত। রণবিলাসবাবুর হাতে যদি সুপ্রচুর অর্থ থাকত, তা হলে তৃণা কবে আমাকে ছেড়ে চলে যেত। আমার সম্পত্তির অর্ধেক যদি ও হাতে পায়, তা হলে আমার কাছে যেমন সুখ-প্রাচুর্যে ছিল, সেরকম ভাবেই ওর জীবন কাটাতে পারবে। সুতরাং ওদের একজনের হয়তো মনে হতে পারে, আমাকে খুন করাটা জরুরি।’
‘তোমার মনমেজাজ দেখছি ভালো নেই, সুন্দরকাকা।’ অভীক শান্ত স্বরে বলল।
‘মনমেজাজ ভালো নেই, তবে মাথার ঠিক আছে, অভী। এটা হল আমার কাগজ-কাটার ছুরি। হিসেব মতো, এই টেবিলে বসে আমার ঘুমিয়ে পড়ার কথা। কাঁটায়-কাঁটায় ঠিক এগারোটায় খুনি—তোদের পাঁচ জনের একজন—এই কাগজ-কাটা ছুরিটা নিয়ে আমার পিঠে বসিয়ে দেবে, আমাকে খুন করবে।’
কিংশুক এখন ভীষণ মনোযোগে সব শুনছে। অনিচ্ছাসত্ত্বেও এই অদ্ভুত রহস্য ওকে মুগ্ধ করেছে। ও বলে উঠল, ‘মিস্টার চৌধুরী, ধরে নিলাম, আপনি যা-যা বললেন সব সত্যি। কিন্তু আপনি কি সময়মতো টেবিলে ঘুমিয়ে পড়ে খুনিকে খুন করার সুযোগ দেবেন?’
‘কক্ষনও না, কিংশুক, কক্ষনও না। যখন আমি জেনেই ফেলেছি যে, আমি খুন হব, তখন চট করে ঘুমিয়ে পড়াটা কী খুব সহজ হবে? আমার তো মনে হয়, এই পরিস্থিতিতে ঘুম পাওয়াটা একেবারেই অসম্ভব, কি বলো?’
‘তা হলে আর প্রথমবারের মতো ঠিক এগারোটার সময় আপনার খুন হওয়ার কোনও প্রশ্ন ওঠে না।’
‘এগজ্যাক্টলি, কিংশুক। এই রহস্যের আসল অর্থটা তুমি নির্ভুলভাবে ধরতে পেরেছ। না, খুনটা এখন প্রথমবারের মতো নিয়ম মেনে আর হতে পারে না। খুনের পদ্ধতির সামান্য এদিক-সেদিক করতেই হবে। অবশ্য তোমার নিশ্চয়ই মনে আছে, দেবদূত বলেছিল, প্রয়োজন হলে তার খাতায় একটু-আধটু মোছামুছি করে নেবে।’
ঘরের প্রত্যেকে অধীর কৌতূহলে প্রতিটি কথা শুনছে। স্পষ্টই বোঝা যায়, পরিস্থিতির বৈচিত্র্য ওদের সাময়িকভাবে স্তব্ধ করে দিয়েছে।
‘মিস্টার চৌধুরী,’ কিংশুক বলে চলল, ‘কী করে যে আপনি নিজের খুনের তদন্ত করবেন, সেটা আমি ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না। সাধারণত আমাদের বইতে—মানে, আপনার বইতে—খুন হয়, খুনি সূত্র ফেলে যায়, এবং তারও পরে ডিটেকটিভ এসে তার কাজ শুরু করে। কিন্তু এক্ষেত্রে কোন সূত্র ধরে আপনি এগোবেন? একটা সাদামাটা উদাহরণ আপনাকে দিই—ওই কাগজ-কাটা ছুরিতে খুব সুন্দর হাতের ছাপ পড়বে, কিন্তু খুন করার আগে তো খুনি সে-হাতের ছাপ ফেলবে না। আর যখন ফেলবে, তখন আপনার তদন্তের পক্ষে অনেক দেরি হয়ে যাবে।’
‘ভালো সমস্যা তুলে ধরেছ, কিংশুক। আমার সঙ্গে থেকে-থেকে তোমার উন্নতিই হয়েছে দেখছি। হ্যাঁ, স্বীকার করছি, একেবারে প্রথমে এই অসুবিধেটার কথা আমার মনে পড়েনি। সত্যিই তো, খুন হওয়ার আগে সেই খুনের সমাধান আমি করব কেমন করে?’
‘আর তোমার হাতে মাত্র দশমিনিট সময় আছে, সুন্দরকাকা।’ উত্তেজিত স্বরে বলে উঠল অভীক।
‘বড়েসাব, আপনি কি ভাবছেন, খুন করবার আগে খুনি সব কবুল করবে?’ এ-প্রশ্ন এল হীরা সিংয়ের কাছ থেকে।
‘তা হয়তো করতে পারে,’ সুষম কণ্ঠে বললেন অনিন্দ্যসুন্দর, ‘কিন্তু সে-ভরসায় আমি বসে নেই।’