‘এখানে বাড়তি মোজার দরকার নেই, মিস্টার চৌধুরী। সবকিছুই আমরা দিয়ে দিই।’
‘আপনি আমার পেছনে গোয়েন্দাগিরি করছেন—।’
‘আমার গোয়েন্দাগিরি করবার দরকার হয় না।’
‘আপনি কি ভাবছেন, আপনাকে আমি ঠকাব—ফাঁকি দেব?’
কোনও উত্তর নেই। টেলিফোন নিস্তব্ধ হয়ে গেছে। কিন্তু এটাই একরকম স্পষ্ট উত্তর। দেবদূত চিন্তায় পড়েছে। যদি ঠকানোর কথায় সে দুশ্চিন্তায় পড়ে থাকে, তা হলে তাকে ঠকানো নিশ্চয়ই সম্ভব! গোছগাছ করতে-করতে চাপা হাসিকে প্রশ্রয় দিলেন অনিন্দ্যসুন্দর।
সুটকেসে দিনকয়েকের মতো জামা-কাপড় ভরে নিলেন তিনি। টুথব্রাশ ও শেভিং কিট নিতেও ভুললেন না। একটা দেওয়াল-সিন্দুকের কাছে গিয়ে সেখান থেকে দশ হাজার টাকা বের করে নিলেন। এটা তাঁর বিপদের সঞ্চয়। ড্রেসিং-টেবিলের ড্রয়ার থেকে তুলে নিলেন নিজের অটোমেটিক পিস্তল—পরীক্ষা করে দেখলেন গুলি ভরা আছে কি না। হ্যাঁ, আছে। এই অটোমেটিক পিস্তল তাঁর অতিরিক্ত জীবনবীমা।
কিন্তু প্রতিশ্রুতিমতো ঘণ্টাখানেকের মধ্যে তিনি নীচে নামলেন না। সন্দেহভাজনদের তিনি উৎকণ্ঠার মধ্যে রাখতে চান। তিনি জানেন, ওরা অপেক্ষা করবে। বিশেষ করে খুনি, সে…তাকে তো অপেক্ষা করতেই হবে। নরম সোফায় গা এলিয়ে বিশ্রাম করতে লাগলেন অনিন্দ্যসুন্দর, মুখে ধূমায়িত পাইপ, মনে ভবিষ্যতের নতুন পরিকল্পনা।
প্রায় সওয়া দশটা নাগাদ সুটকেস হাতে নীচে স্টাডি-রুমে এলেন তিনি। উপস্থিত হলেন তৃণা ও অতিথিদের সামনে। আবিষ্কার করলেন, ওরা প্রত্যেকেই তাঁর পছন্দমাফিক কম-বেশি বিচলিত। কিংশুকের ফরসা মুখে লালচে আভা। অভীক বদমেজাজি শুয়োরের মতো মুখ কালো করে এককোণে বসে আছে। একটা সেটিতে নির্লজ্জভাবে ঘন হয়ে বসে আছে তৃণা ও রণবিলাস। আর বৃদ্ধ হীরা সিং বাইরের বারান্দায় থামের আড়ালে ঘাপটি মেরে দাঁড়িয়েছিল, অনিন্দ্যসুন্দর তাকে ভেতরে ডেকে নিলেন। তারপর পকেট থেকে একটা তালা ও চাবি বের করে ঘরের দরজায় ভেতর থেকে তালা দিয়ে দিলেন। এবার তিনি এসে বসলেন নিজের মেহগনি-টেবিলে—ওদের মুখোমুখি।
‘তোমাদের কেউ কি আজকের দিনটায় এক অদ্ভুত জিনিস লক্ষ করেছ,’ বলতে শুরু করলেন তিনি, ‘যেদিনটা আর মাত্র পঁয়তাল্লিশ মিনিট পর শেষ হয়ে যাবে?’
ওরা স্বাভাবিকভাবেই কিছু বুঝে উঠতে পারল না। কয়েকমুহূর্ত তাঁর প্রশ্নের উত্তর দিল বাড়ির গায়ে আছড়ে পড়া বৃষ্টির ফোঁটার ধারাবাহিক শব্দ, এবং কখনও-কখনও বজ্রপাতের তীব্র সংঘাত।
‘কীসব বলছ, ডার্লিং, আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না!’ তাঁর স্ত্রী তৃণা। ও সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে তাঁর দিকে এক-পা এগিয়ে এসেছে।
শীতল দৃষ্টিতে ওকে জরিপ করলেন তিনি। ওর পরনে আঁটোসাঁটো স্বচ্ছ জাপানি জর্জেট শাড়ি। সুগভীর নাভির ওপরে ও নীচে তিন ইঞ্চিব্যাপী মসৃণ ত্বক উন্মুক্ত। ব্লাউজের আকৃতি ও প্রকৃতি দেখে মনে হয়, শুধুমাত্র তৃণার শরীরের গঠন সেটাকে স্বস্থানে বজায় রেখেছে। এসবই নিঃসন্দেহে রণবিলাস দত্তের উপকারের জন্য।
‘বোসো, তৃণা, উত্তেজিত হোয়ো না।’ তাঁর স্বরে এমন কিছু ছিল যাতে তৃণা পিছিয়ে গেল, ‘ভেবেছিলাম, অন্য কেউ না-পারলেও তুমি হয়তো ব্যাপারটা লক্ষ করবে। মেয়েদের সহজাত ষষ্ঠেন্দ্রিয়ের অনুভূতি দিয়ে।’
‘কী লক্ষ করব, অনিন্দ্য?’
‘আজকের দিনটায় এক অদ্ভুত ব্যাপার তুমি খেয়াল করোনি? একবারও তোমার মনে হয়নি, আজ সারাদিন ধরে তুমি যা-যা করছ, বলছ, সবই তোমার খুবই চেনা? হুবহু এসব কাজ তুমি আগেও একবার করেছ, বলেছ এই একই কথা?’
মুখভাবে স্পষ্টতই বোঝা গেল উপস্থিত সবাই তাঁকে মাতাল ভাবছে, কিংবা ভাবছে তিনি ওদের সঙ্গে রসিকতা করছেন।
একচিলতে হাসি ঠোঁটের কোণে ফুটিয়ে বলে চললেন অনিন্দ্যসুন্দর, ‘গতকাল রাতে আমি…না, হয়তো কাল রাতে নয়। কারণ, মরণোত্তর জগতে সময়ের হিসেব রাখা খুব শক্ত—অবশ্য আমি সেখানে খুব বেশিক্ষণ ছিলাম না, সুতরাং আমার বিশ্বাস, হয়তো কাল রাতেই হবে। কাল রাতেই আমি খুন হয়েছি।’
এক রুদ্ধশ্বাস অস্ফুট আর্তনাদ বেরিয়ে এল তৃণার ঠোঁট চিরে।
‘বাঃ, তোমার তা হলে মনে পড়েছেন সোনা?’ প্রশ্ন করলেন অনিন্দ্যসুন্দর।
‘মনে পড়েছে?’
অর্থাৎ, অনিন্দ্যসুন্দর কী বিষয়ে কথা বলছেন, সেটা তৃণা একটুও বুঝতে পারছে না। ওর মুখভাব দেখে তাঁর মনে হল, না, অভিনয় নয়। তিনি অন্যান্যদের দিকে তাকালেন, ওরা সকলেই অবাক অবুঝ চোখে তাঁর দিকে তাকিয়ে।
সুতরাং তিনি খুলে বললেন। বললেন, সূর্যকান্তের কথা, কেন তিনি আবার পৃথিবীতে ফিরে এসেছেন, সেই কথা। ওরা গভীর মনোযোগে শুনল, মাঝে-মাঝে এ-ওর দিকে তাকাতে লাগল।
তাঁর কাহিনি শেষ হলে অভীক বলে উঠল, ‘সুন্দরকাকা, তোমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে। ডাক্তার দেখাও।’
‘রমেন গুপ্ত বলেছে আপনার কিছুদিন বিশ্রামের দরকার,’ প্রতিহিংসার ব্যঙ্গে তীক্ষ্ন হল কিংশুকের কণ্ঠস্বর, ‘এখন দেখছি ঠিকই বলেছে!’
‘এ নেহাত পাগলের আড্ডাখানা!’ সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়াল রণবিলাস দত্ত: ‘আমি চললাম।’
‘বোসা সবাই।’ পকেট থেকে অটোমেটিকটা বের করে উঁচিয়ে ধরলেন অনিন্দ্যসুন্দর। তাঁর অভিব্যক্তিতে স্থির প্রতিজ্ঞা।
ওরা সবাই আবার বসল। একইসঙ্গে টেলিফোন বেজে উঠল।
অনিন্দ্যসুন্দর ফোনটা তুলতেই অপর প্রান্তে কেউ বলতে শুরু করল, ‘কী হচ্ছে এসব, মিস্টার চৌধুরী?’