‘এতে মন খারাপ করার কিছু নেই, মিস্টার চৌধুরী।’
‘নেই?’
‘যদি বোঝেন পৃথিবীতে কেউ আপনাকে চায় না, তা হলে এখানে ফিরে আসতে আপনার একটুও দুঃখ হবে না।’
‘হুম। ঠিকই বলেছেন।’
‘আর কোনও অসুবিধে হচ্ছে না তো, মিস্টার চৌধুরী?’
‘সত্যি বলতে কি, একটা অসুবিধে হচ্ছে। কোনও সূত্র এখনও পাইনি।’
‘খোঁজার চেষ্টা করুন।’
‘সেইখানেই তো হয়েছে বিপদ। এমনিতে আমার বইয়ে—কিংবা বাস্তবেও—সূত্র পাওয়া যায় খুনের পরে, আগে নয়। খুন করার পরেই খুনি সমস্ত সূত্র ফেলে যায়। এবার বলুন, এখন তা হলে আমি কী করি?’
‘আমি কী-করে বলব, মিস্টার চৌধুরী? এখান থেকে রওনা হওয়ার আগে সে-কথা আপনার ভাবা উচিত ছিল।’
‘সেটা করলেই বোধহয় ভালো হত।’
‘এখন চুপচাপ বসে রাত এগারোটা পর্যন্ত অপেক্ষা করা ছাড়া আপনার উপায় নেই। তা হলে তখনই দেখা হবে। চলি।’
ফোন নামিয়ে রেখে ফ্রিজ থেকে সামান্য হুইস্কি আর সোডা নিয়ে বসলেন অনিন্দ্যসুন্দর। দুর্ভাবনার সময় মদ তাঁকে স্বস্তি এবং শান্তি দেয়। এখন দেবে কি না কে জানে!
দুপুর গড়িয়ে এখন বিকেল চারটে। তাঁর নির্ধারিত পুনর্জীবনের পাঁচ ঘণ্টা ইতিমধ্যেই অতিক্রান্ত। মাত্র আর সাত ঘণ্টা বাকি। বিষণ্ণ মনে জানলার কাছে এগিয়ে গেলেন অনিন্দ্যসুন্দর। আকাশে মেঘ করেছে, বৃষ্টি হতে পারে।
খুন করার পক্ষে উপযুক্ত রাত।
এইভাবে, আকস্মিক এক দুর্ঘটনাচক্রে, জানলায় আনমনা হয়ে দাঁড়িয়ে এক অদ্ভুত দৃশ্য দেখলেন অনিন্দ্যসুন্দর। তৃণা এবং রণবিলাস। তরুণ অ্যাথলিট রণবিলাস তাঁর স্ত্রীকে অটুট মনোযোগে চুম্বন করতে ব্যস্ত।
সেইমুহূর্তে অনিন্দ্যসুন্দর চৌধুরীর মনের গভীরে জন্ম নিল এক নতুন প্রতিজ্ঞা।
সাধারণ আবেগতাড়িত মানুষের মতো জানলার কাচে ঘুষি বসালেন না তিনি, মাথার চুলও ছিঁড়লেন না। পরিবর্তে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন, কপালে সামান্য ভাঁজ পড়ল। ইতিমধ্যে চুম্বন-অধ্যায় শেষ করে রণবিলাস সোজা হয়ে দাঁড়িয়েছে। অনিন্দ্যসুন্দরের এই প্রশান্তির কারণ, তাঁর মনে এক সূক্ষ্ম পরিকল্পনা ক্রমে চেহারা নিয়েছে।
একটু পরে রান্নাঘরের দিকে রওনা হলেন তিনি। সীতার মাকে উদ্দেশ্য করে সরবে ঘোষণা করলেন, ‘সীতার মা, রণবিলাসবাবু রাতে খেয়ে যাবেন। সেইসঙ্গে কিংশুক এবং অভীকও। আর হীরা সিংকে বোলো, রাতের খাবার যেন সে-ই পরিবেশন করে।’
কিংশুকের ঘরে পৌঁছে তিনি দেখেন, সে জিনিসপত্র গোছগাছ করছে।
‘সুটকেসটা এখন রেখে দাও, কিংশুক।’
‘কিন্তু আপনিই তো আমাকে চলে যেতে বলেছেন।’ তাঁর সেক্রেটারি গম্ভীর মুখে জবাব দিল।
‘তা বলেছি। কিন্তু আমার ইচ্ছে, আজকের রাতটা তুমি থেকে যাও। তাতে তোমার ভালোই হবে, কিংশুক।’
অভীক চৌধুরী তখনও দিবানিদ্রায় অচেতন ছিল, অনিন্দ্যসুন্দর তাকে ধাক্কা দিয়ে জাগালেন।
‘আজ রাতে তোর কোথাও যাওয়ার থাকলে, ক্যান্সেল কর, অভী। তোর সঙ্গে অনেক কথা আছে। তাতে তোর লাভই হবে।’
এবার অনিন্দ্যসুন্দর উপস্থিত হলেন বাগানে।
‘দুপুরে আপনার সঙ্গে খেতে বসতে পারিনি বলে মাপ চাইছি, রণবিলাসবাবু,’ তৃণার ঠোঁটে চুমু এঁকে দেওয়া শিল্পীকে লক্ষ করে বললেন তিনি, ‘কিন্তু রাতে আপনাকে না-খাইয়ে ছাড়ছি না।’
রণবিলাসের সুন্দর মুখে বিস্ময় ফুটে উঠল, কিন্তু দ্বিধাভরা অস্ফুট স্বরে সে বলল, এ তো তার সৌভাগ্য। আর তৃণা ঘটনার আকস্মিকতায় হতবাক।
গোপন উত্তেজনায় ওদের দিকে চেয়ে হাসলেন অনিন্দ্যসুন্দর। যদি তাঁর পরিকল্পনা সফল হয়…।
নৈশভোজপর্ব শুরু হল রাত ঠিক সাড়ে আটটায়।
অন্ধকার এবং শীতের তীব্রতা এখন চরম অঙ্কে। সীতা ও সীতার মা চলে যাওয়ার পরই শুরু হয়েছে অপ্রত্যাশিত অঝোর বৃষ্টি। এখনও থামেনি। হীরা সিং নীরবে পরিবেশন করছে। তার মুখে করাল ছায়া থমথম করছে।
একমাত্র অনিন্দ্যসুন্দরই খুশি মনে খেয়ে চলেছেন। অন্যেরা যান্ত্রিকভাবে হাত ওঠা-নামা করলেও স্পষ্ট বোঝা যায়, তাদের মন অন্য দুশ্চিন্তায় ভারাক্রান্ত। তৃণার চঞ্চল চোখ থেকে-থেকেই ছুঁয়ে যাচ্ছে রণবিলাসের মুখ, আর রণবিলাসও সে-দৃষ্টি ফিরিয়ে দিচ্ছে। কিংশুকের শুকনো মুখ ভাবলেশহীন এক মুখোশ। সেই মুখোশ চিরে মাঝে-মাঝে ঝিলিক মারছে বিরূপ মনোভাবের ইশারা। সাধারণত অভীকের খাওয়া ‘পেটুক’ আখ্যা দেওয়ার মতো, কিন্তু আজ তার প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে না। চোরা দৃষ্টিতে সকলেই অনিন্দ্যসুন্দরকে লক্ষ করছে।
নটা নাগাদ খাওয়া-দাওয়ার পাট শেষ হল। উঠে দাঁড়ালেন অনিন্দ্যসুন্দর। ওদের দিকে চেয়ে হাসলেন: ‘ঘণ্টাখানেক পরে তোমরা সবাই স্টাডি-রুমে এসে আমার সঙ্গে দেখা করবে। বিশেষ কিছুই না, বিদায় দেওয়ার আগে সকলের সঙ্গে একটু গল্পগুজব করা—অনেকটা ফেয়ারওয়েল পার্টির মতো।’
এই সাংকেতিক মন্তব্যে সকলেই নিষ্পলক চোখে হতবাক হয়ে চেয়ে রইল। পরিতৃপ্ত ভঙ্গিতে দোতলায় নিজের শোওয়ার ঘরে গেলেন অনিন্দ্যসুন্দর, একটা সুটকেস গুছোতে শুরু করলেন। দু-জোড়া মোজা সবে সুটকেসে ভরেছেন, টেলিফোন বেজে উঠল।
‘সূর্যকান্ত বলছি।’
‘ভাবছিলাম, আপনি বোধহয় এখুনি ফোন করবেন।’
‘শেষ কয়েকটা ঘণ্টা ধরে দেখছি, আপনার মেজাজ একদম পালটে গেছে।’
‘হ্যাঁ তা গেছে।’
‘ওই সুটকেস নিয়ে কোথায় চলেছেন?’
‘একটু পরেই তো আমাকে লম্বা পথ পাড়ি দিতে হবে, তাই না?’