‘আমার অবস্থা খুব খারাপ, সুন্দরকাকা।’
‘সে তুই বুঝবি।’
‘তা কী করব বলবে তো?’
‘সেও তোর ব্যাপার।’
‘তা হলে আমাকে হুট করে যা-হোক একটা কিছু করতে হবে…।’
এই মন্তব্যে চমকে উঠলেন অনিন্দ্যসুন্দর। তৃণা ও কিংশুকের সঙ্গে তাঁর কথাবার্তার মতো অভীকের সঙ্গে তাঁর এই আলোচনা আগেও একবার হয়ে গেছে! তাঁর সম্পত্তির বাকি অর্ধেকের উত্তরাধিকারী অভীক—না, অনিন্দ্যসুন্দর ভালোবেসে এই অংশ ওকে দেননি, তাঁর একমাত্র আত্মীয় হওয়ার সুবাদে এই সম্পত্তি অভীকের প্রাপ্য। আর এখন সেই অকালকুষ্মাণ্ড ভাইপো তাঁর কাছে এসে টাকা চাইছে।
খুনের আরও একটা মোটিভ।
‘হুট করে কিছু…করে বসবি…এর…এর মানে কী, অভী?’
‘জানি না। কিন্তু তুমি টাকা না-দিলে যা-হোক একটা কিছু তো আমাকে করতে হবে—আর তার জন্যে পুরোপুরি দায়ী হবে তুমি।’
বিশাল স্তূপটা টেবিল থেকে নেমে দাঁড়াল, এগিয়ে গেল দরজার দিকে, এবং নিষ্ক্রান্ত হল ঘর থেকে। এত মোটা হওয়া সত্ত্বেও তাঁর ভাইপো অভীকের চলাফেরায় কেমন একটা চাবুকের ভঙ্গি রয়েছে। আশ্চর্য, কই আগে তো কখনও অনিন্দ্যসুন্দর এটা খেয়াল করেননি। অবশ্য, আজ তিনি এমন-এমন সব জিনিস আবিষ্কার করছেন, যা আগে কখনও লক্ষই করেননি।
জানলা দিয়ে ছিটকে আসা রোদ হঠাৎই তাঁকে হাতছানি দিয়ে ডাকল। না, এই মুহূর্তে ঘরটা তাঁর একটুও ভালো লাগছে না। বরং বাইরের খোলা হাওয়ায় একটু ঘুরে এলে কেমন হয়! তা ছাড়া শীতের মধ্যে রোদের আমেজটা ভালোই লাগবে—আর ঠান্ডা মাথায় একটু চিন্তা-ভাবনারও প্রয়োজন আছে। এই সিদ্ধান্তে পৌঁছলেন অনিন্দ্যসুন্দর।
বাগানে এসে নির্জনতার পরিবর্তে হীরা সিংকে আবিষ্কার করলেন তিনি। বৃদ্ধ হীরা সিং বাগানের মালি, কেয়ারটেকার, ড্রাইভার—একাধারে সব, এবং কখনও-সখনও সীতা ও সীতার মায়ের অনুপস্থিতিতে রান্নাবান্নাও করে। এ ছাড়া হীরা সিংয়ের আরও-একটা পরিচয় হল, সে জেলখাটা কয়েদি। এখানে এসে অনিন্দ্যসুন্দরকে সে অনেক ভাবে সাহায্যও করেছে। মালিকের দেওয়া তরল নেশা গলায় ঢেলে ঘোরের মাঝে নিজের জীবনের বহু অপকীর্তির কথাই অনিন্দ্যসুন্দরকে শুনিয়েছে। আর অনিন্দ্যসুন্দর সেইসব কীর্তিকাহিনী টুকে নিয়েছেন নিজের ডায়েরিতে। বাড়িয়েছেন তাঁর প্লটের সঞ্চয়। তিনি জানতেন, এর কিছু-কিছু ঘটনা এখনও পুলিশের অজানা, এবং সেই অপরাধগুলোর জন্য কোনও শাস্তি পায়নি হীরা সিং। বহু জায়গাতে এখনও তার নামে হুলিয়া ঝুলছে।
এইমুহূর্তে প্লট সংগ্রহের মরজি অনিন্দ্যসুন্দরের ছিল না। কিন্তু হীরা সিংয়ের মনে বুঝি অন্য অভিসন্ধি ছিল।
‘নানা রকোম কোথা কানে আসছে, বড়েসাব।’
‘কী কথা, হীরা সিং?’
‘আপনার কিতাবের কোথা—।’
‘আমার বইয়ের কথা? কী হয়েছে আমার বইতে?’
‘শুনেছি কি আপনি আর কিতাব লিখবেন না?’
ও, কিংশুক দেখছি সবাইকে বলে বেড়িয়েছে! রমেন গুপ্তর চিঠির সারমর্ম তা হলে বাড়িতে আর কারও জানতে বাকি নেই। তৃণা জানে, রণবিলাস জানে, এমনকী অভীকও জানে।
‘সে-কথা যদি সত্যিও হয়, তা হলে তোমার কী আসে-যায়, হীরা সিং? চাকরি খোয়া যাবে?’
আড়চোখে তাঁর দিকে তাকাল বৃদ্ধ হীরা সিং। প্রখর সূর্যের আলোয় তার কুৎসিত চেহারা আরও কুৎসিত দেখাচ্ছে। সে উত্তর দিল, ‘নোকরির কোথা ভাবছি না, বড়েসাব, ভাবছি আপনাকে যে-সব কহানী সুনিয়েছি তার কোথা। যতোদিন আপনি কিতাব লিখছিলেন, ততোদিন সব ঠিক ছিল। কিন্তু আভি কিতাব লিখা বন্ধো হয়ে গেলে, আপনি হয়তো পুলিশের সাথে বাতচিত করতে পারেন। তাদের বোলতে পারেন আমার পুরানা কিসসার কোথা—।
‘সে আমি কেন বলতে যাব, হীরা সি? তুমি কবে কী করেছ, তাতে আমার কী? তুমি এখন ভালো হয়ে গেছ, আমার এখানে চাকরি করছ, সৎভাবে জীবনযাপন করছ।’
‘পুলিশ ওসব শুনবে না।’
‘আমি তো আর পুলিশকে কিছু বলতে যাচ্ছি না…হীরা সিং, আমার কথা কি তোমার বিশ্বাস হচ্ছে না?’
স্পষ্টই বোঝা গেল বিশ্বাস সে করেনি। ঘুরে দাঁড়িয়ে বুড়ো লোকটা কোদাল দিয়ে আবার মাটি কোপাতে লাগল। তার কোদাল চালানোর ভঙ্গি বলিষ্ঠ, ক্ষিপ্র, নিখুঁত। আর ভাঁজ-পড়া মুখ অন্ধকার এবং ভয়ঙ্কর।
অদ্ভুতভাবে অনিন্দ্যসুন্দরের আবার মনে পড়ল, এসবই আগে একবার ঘটে গেছে। নিজের বাগানে কবর খুঁড়ে এইমুর্হতে তিনি আবিষ্কার করেছেন এক ভয়ঙ্কর সম্ভাব্য খুনিকে।
স্টাডি-রুমে টেবিলের কাছে আবার ফিরে এলেন তিনি, শ্লথ ভঙ্গিতে বসে পড়লেন চেয়ারে। আশ্চর্য, প্রথমবারে যখন জীবনের শেষ দিনটা এইভাবে তিনি কাটিয়েছিলেন তখন তো এসব কথা তাঁর মনে আসেনি! তখন কেন বুঝতে পারেননি, তাঁকে ঘিরে রয়েছে এমন সব ভয়ঙ্কর মানুষেরা, যারা তাঁর মৃত্যুতে লাভবান হবে? একমাত্র সীতা আর সীতার মা ছাড়া তাঁকে খুন করবার উপযুক্ত মোটিভ প্রত্যেকেরই রয়েছে। এবং তাদের অন্তত একজনের সে-কাজ সম্পন্ন করবার দুঃসাহসও রয়েছে।
টেলিফোন বেজে উঠল। কোনওরকম চিন্তা-ভাবনা না-করেই অনিন্দ্যসুন্দর টেলিফোনটা তুলে নিলেন।
‘সূর্যকান্ত বলছি।’
‘ও…বলুন।’
‘কোনও গণ্ডগোল হয়েছে নাকি, মিস্টার চৌধুরী? আপনার কথা শুনে মনে হচ্ছে, মুষড়ে পড়েছেন?’
‘ভীষণ হতাশ হয়ে পড়েছি।’
‘তাই নাকি?’
‘দুজন ঠিকে কাজের লোক ছাড়া আমার বাড়ির প্রত্যেকে আমি মরলে হাঁফ ছেড়ে বাঁচে।’