‘তোমার কল্পনাশক্তির তুলনা নেই, ডার্লিং!’
‘ওকে তুমি ভালোবাসো, তৃণা?’
‘মোটেই না।’
‘তুমি মিথ্যে কথা বলছ, তৃণা। কাল আমি সব দেখেছি।’
অনিন্দ্যসুন্দর নিজেকে অবাক করলেন। কথাগুলো মুখ থেকে বেরোনোমাত্র, হঠাৎই তাঁর সব মনে পড়ে গেল। খুন হওয়ার উত্তেজনায় তিনি নিশ্চয়ই এসব ভুলে বসেছিলেন। এ সমস্ত ঘটনা হুবহু আগে একবার ঘটে গেছে!
‘বাগানে তোমাদের আমি দেখেছি। কিন্তু বিশ্বাস করো, আমি ততটা অবাক হইনি। কারণ আগেও তোমরা কখনও তেমন সাবধান হওনি।’
তৃণার সমস্ত রক্ত কেউ যেন শুষে নিয়েছে, ও বসে পড়ল শ্লথ ভঙ্গিতে।
‘অবাক হলে, তৃণা? তা হলে একটা কথা তোমাকে বলে রাখি। রণবিলাস দত্ত আজ দুপুরে নেমন্তন্ন খেতে এলে আমার একটুও আপত্তি নেই। সত্যি বলতে কি, আমার পরামর্শ যদি শোনো, তা হলে দুপুরের খাওয়া-দাওয়ার পর তোমরা দুজনে একটু আলোচনা করে দেখো। আমি যে তোমাদের ব্যাপার সব জানি, সে-কথা ওকে বলো। তারপর দুজনে মিলে ঠিক করো কী করবে। এখন তোমার মাত্র দুটো পথ খোলা আছে। প্রথমটা হল, আমাকে ছেড়ে রণবিলাসের সঙ্গে চলে যাওয়া। অবশ্য, এটা মনে রেখো, ওর পকেটে একটা ফুটো পয়সাও নেই, আর আমি নিজের পয়সা খরচ করে তোমাদের প্রেমকুঞ্জ বানিয়ে দেব, এ-আশা তুমি নিশ্চয়ই করো না। রণবিলাসের সঙ্গে উপোস করে-করে যখন তোমার সমস্ত শখ মিটে যাবে, তখন ইচ্ছে করলে আমার কাছে আবার ফিরে আসতে পারো। আর তোমার দ্বিতীয় পথ হল, এখানে থেকে যাওয়া। সেক্ষেত্রে আমি চাইব তোমার বিশ্বাস, সততা। আর শ্রীরণবিলাস দত্তকে অন্য কোনও আস্তানা থেকে দু-বেলা দু-মুঠোর ব্যবস্থা করতে হবে।’
অনিন্দ্যসুন্দর মনে-মনে ভাবলেন, এতেই রণবিলাস-অধ্যায়ের একটা হেস্তনেস্ত হবে। তৃণা শুধুমাত্র ভালোবাসা অবলম্বন করে বেঁচে থাকার মেয়ে নয়। আয়েস-স্বাচ্ছন্দ্যে থেকে-থেকে ওর অভ্যেস খারাপ হয়ে গেছে—প্রাচুর্য আর বিলাসিতা ওর জীবনের সঙ্গে আন্তরিকভাবে জড়িত। কিন্তু এই চূড়ান্ত নোটিস তিনি আগেও একবার দিয়েছেন। শুধু একটা জিনিস তখন ভাবেননি। এখন ভাবছেন। তৃণার খুন করার মোটিভ।
সারাটা জীবনে লেখক হিসেবে যে-সুপ্রচুর অর্থ-প্রতিপত্তি তিনি অর্জন করেছেন, তার অর্ধেকের উত্তরাধিকারিণী এখন তৃণা। তাঁর উইলে সেই কথাই লেখা আছে। রণবিলাস যদি সে-কথা জানত! তাঁর তৃণা যদি সত্যিই ছেলেটাকে নিজের করে চায়, আর একইসঙ্গে তাঁর উইলে নিজের উত্তরাধিকারও বজায় রাখতে চায়, তা হলে ওর সামনে মাত্র একটা পথই খোলা আছে…।’
‘তুমি আমাদের সঙ্গে খাবে তো?’ তৃণা তাঁকে প্রশ্ন করছে।
‘না,’ উদার স্বরে উত্তর দিলেন অনিন্দ্যসুন্দর, ‘শুধু-শুধু তোমাদের পথে বাধা হয়ে দাঁড়াতে চাই না। তা ছাড়া, এই তো, এত বেলায় জলখাবার খাচ্ছি। তারপর কিছু দরকারি কাজও আছে।’
এরপর তৃণা চলে গেল। অনিন্দ্যসুন্দর তাকিয়ে রইলেন ওর অপস্রিয়মাণ তন্বী শরীরের দিকে। তারপর মনোযোগ দিলেন ডিম ও পাঁউরুটির প্রতি, দ্রুতহাতে প্রাতরাশ শেষ করলেন।
মধ্যাহ্নভোজের অতিথির জন্য প্রয়োজনীয় আয়োজনের দায়িত্ব সীতার মায়ের হাতে ছেড়ে দিয়ে বেরিয়ে এলেন ডাইনিংরুম থেকে।
এবার তিনি হাজির হলেন স্টাডি-রুমে—তাঁর রক্তে রঞ্জিত অকুস্থলে।
নিজের মরণ-কামরায় ঢুকে ভয় পেলেন অনিন্দ্যসুন্দর। সমস্ত জানলায় পরদা টানা থাকায় গোটা ঘরটা ছায়াময় রহস্যে ছমছমে। অস্বস্তিভরে পরদাগুলো সরিয়ে দিলেন তিনি। সূর্যের আলো ঠিকরে এল ঘরের ভেতরে। এবার তিনি চারপাশে চোখ বুলিয়ে দেখলেন।
ওই তো তাঁর মজবুত মেহগনি কাঠের টেবিল। নিশ্চয়ই তিনি টেবিলের কাছে চেয়ারে বসে ছিলেন। হয়তো, প্রায়ই যেমন ঘুমিয়ে পড়েন, সেরকমই ঘুমিয়ে পড়েছিলেন—টেবিলে দু-হাত ছড়িয়ে এবং মাথা হাতের ওপরে এলিয়ে। সোজা কথায় খুনিকে হাতছানি দিয়ে ডেকেছেন। আর, ওই তো সেই কাগজ-কাটার ছুরিটা। অনিচ্ছাভরে ছুরিটা তুলে নিলেন তিনি, যেন ওটার ফলায় লেগে রয়েছে শুকনো কালচে রক্ত।
অবশ্য রক্ত থাকার কথা নয়…অন্তত এখন!
না, জিনিসটা খুনের এক কুৎসিত হাতিয়ার, মনে-মনে ভাবলেন অনিন্দ্যসুন্দর। ছুরির হাতলটা মসৃণ ভারি হাতির দাঁতের তৈরি, প্রায় ইঞ্চিচারেক লম্বা। খুনি যদি অসতর্ক হয়, তা হলে তার স্পষ্ট হাতের ছাপ রেখে যাবে এই ছুরির বাঁটে। চকচকে ফলাটা বেশ লম্বা—কিন্তু খুব ধারালো কিংবা ছুঁচলো নয়। তবে অব্যর্থ নিশানায় উপযুক্ত শক্তিতে প্রোথিত হলে কার্যসিদ্ধির পক্ষে যথেষ্ট—কোনও মানুষের হৃৎপিণ্ড সহজেই স্তব্ধ হবে।
শিউরে উঠলেন অনিন্দ্যসুন্দর।
দরজায় কারও নক করার শব্দে তাঁর চিন্তার ঘোর বিচ্ছিন্ন হল। কোনওরকম আমন্ত্রণের অপেক্ষা না-করেই যে নক করেছে সে ঘরে ঢুকল।
‘ব্যস্ত আছ, সুন্দরকাকা?’
‘না, না। আয় অভী, ভেতরে আয়।’
অভীক ভেতরে ঢুকে লাফিয়ে উঠে বসল টেবিলের ওপর। ওর শরীরের ওজনে আর্তনাদ করে উঠল মজবুত মেহগনি টেবিল। অভীকের প্যাঁচার মতো ছোট-ছোট চোখ পুরু চশমার কাচের পিছন থেকে জুল-জুল করে চেয়ে রইল।
‘টাকা-পয়সার অবস্থা কীরকম, সুন্দরকাকা?’
‘এবার কত লাগবে?’ অনিন্দ্যসুন্দর চৌধুরী প্রশ্ন করলেন।
‘তিনহাজার।’
রিভলভিং চেয়ারে শরীর এলিয়ে বসলেন অনিন্দ্যসুন্দর। টেবিলের ওপরে বসা মাংসের স্তূপটিকে লক্ষ করতে লাগলেন। অবশেষে বললেন, ‘অভী, আগেরবারই তো তোকে বলেছি, এভাবে তোর ধার-দেনা আর আমি শোধ করতে পারব না। অন্তত, যদ্দিন না তুই একটা চাকরি-বাকরির চেষ্টা করছিস। সুতরাং আমার সোজা উত্তর হল, না।’