আমি ক্লান্ত স্বরে মন্তব্য করলাম, ‘এখন বুঝতে পারছি, বিচারে গভর্নমেন্ট কোনও ভুল করেনি।’
‘যাক, আপনি যে আইনের যুক্তিটা বুঝতে পেরেছেন, এতেই আমি খুশি। তবে আমিও চেষ্টা নেহাত কম করিনি।’
‘ঠিকই বলেছেন। ”খুন”-কে কখনও মেনে নেওয়া যায় না—হোক সে রোবট, যন্ত্র, কল্পনা। আমি অন্যায় করেছি, তাই শাস্তি পেতে হচ্ছে। আমি সত্যিই খুন করেছি। কারণ, সেই খুনের পর থেকে আমি নিজের কাছে কেমন যেন অপরাধী হয়ে পড়েছি। চেয়েছি আমার শাস্তি হোক। ব্যাপারটা অদ্ভুত—নয়? সমাজ তো এভাবেই সকলকে সাজা দেয়। আপনাকে ভাবতে বাধ্য করে যে, আপনি অপরাধী—যদিও তার কোনও জোরালো কারণ থাকে না…।’
‘আমি তা হলে চলি, মিস্টার রায়। আপনার আর কোনও দরকার থাকে তো বলুন।’
‘না। থ্যাংকু ইউ।’
‘গুড বাই, মিস্টার রায়।’
দরজা বন্ধ হল।
গরাদের বাইরে বাড়িয়ে দেওয়া দু-হাত ভিজে জড়সড়। তবুও এ প্রকৃতির অকৃত্রিম স্পর্শ। হঠাৎই দেওয়ালে একটা লাল আলো জ্বলে উঠল। মাইক্রোফোনে ভেসে এল যান্ত্রিক স্বর: ‘মিস্টার রায়, আপনার স্ত্রী আপনার সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন।’
আমি জানলার গরাদ আঁকড়ে ধরলাম সজোরে।
ও মরে গেছে। ওর কোনও অস্তিত্ব নেই।
‘মিস্টার রায়?’ উত্তরের প্রত্যাশায় যান্ত্রিক স্বর প্রশ্ন করল।
‘ও মারা গেছে। আমি ওকে নিজের হাতে খুন করেছি।’
‘আপনার স্ত্রী পাশের ঘরে আপনার জন্যে ওয়েট করছেন। আপনি কি তাঁর সঙ্গে দেখা করতে চান?’
‘আমি ওকে গুলি করে ঝাঁঝরা করে দিয়েছি। ও লুটিয়ে পড়েছে রক্তাক্ত অবস্থায়। আমি নিজের চোখে দেখেছি!’
‘মিস্টার রায়, আপনি এখনও আমার প্রশ্নের উত্তর দেননি—।’
আমি পাগলের মতো দেওয়ালে ঘুসি মারতে লাগলাম। চিৎকার করে উঠলাম, ‘ও মরে গেছে, ও মরে গেছে, আমি ওকে নিজের হাতে খুন করেছি। আমি ওর কাছে শুধু স্বস্তি চাই, একটু একা থাকতে চাই আমি। আমি ওর সঙ্গে দেখা করব না। ও মরে গেছে, আমি ওকে নিজের হাতে খুন করেছি!’
কিছুক্ষণ স্তব্ধতা। তারপর আবার যান্ত্রিক গুঞ্জন, ‘ঠিক আছে, মিস্টার রায়।’
লাল আলোটা নিভে গেল।
আকাশে বিদ্যুৎ ঝলসে উঠল। ঠান্ডা গরাদের গায়ে চেপে ধরলাম আমার উত্তপ্ত গাল। অপেক্ষা করছি। বৃষ্টি পড়ছে। অপেক্ষা করছি।
অনেকক্ষণ পর রাস্তার দিকের একটা দরজা খোলার শব্দ পাওয়া গেল। বর্ষাতি পরা দুটো শরীর আমার চোখে পড়ল। একতলার অফিস থেকে বেরিয়ে পা দিয়েছে রাস্তায়। একটা ভেপার ল্যাম্পের নীচে ওরা থমকে দাঁড়াল। চোখ তুলে তাকাল আমার দিকে।
মালবিকা। আর ওর পাশে দাঁড়িয়ে কিংশুক।
‘মালা!’
ও মুখ ঘুরিয়ে নিল। কিংশুক ওর হাত ধরল। তারপর দ্রুতপায়ে রাস্তা পার হয়ে দুজনে উঠে বসল একটা কালো গাড়িতে।
‘মালবিকা!’ আমি গরাদের রড ধরে ঝাঁকুনি দিতে চাইলাম। চিৎকার করে চললাম। ঘুসি মারতে লাগলাম পাথরের দেওয়ালে। জানলাটাকে সর্বশক্তিতে উপড়ে নিতে চাইলাম।
‘গার্ড! গার্ড! ও বেঁচে আছে! এইমাত্র আমি ওকে দেখেছি। ও মরেনি, আমি ওকে খুন করিনি, তোমরা আমাকে ছেড়ে দাও! আমি কাউকে খুন করিনি। সব অভিনয়, স্বপ্ন, কল্পনা। আমি ওকে এইমাত্র দেখলাম, ও বেঁচে আছে! মালা, ফিরে এসো, মালা! ওদের বলো, তুমি বেঁচে আছ! বলো, আমি তোমাকে খুন করিনি! ওরা আমাকে ভুল করে ধরে রেখেছে। মালবিকা, প্লিজ…।’
প্রহরীরা ছুটে এল ঘরে।
‘তোমরা আমাকে আর শাস্তি দিতে পারবে না! আমি কোনও অন্যায় করিনি! মালবিকা বেঁচে আছে—আমি নিজের চোখে দেখেছি।’
‘আমরাও দেখেছি, স্যার।’
‘তা হলে আর আমাকে আটকে রেখেছ কেন? ছেড়ে দাও!’ আমার গলা বুজে এল। প্রচণ্ড কাশির দমকে শরীর বারবার ঝাঁকুনি দিয়ে উঠল বারবার।
‘ট্রায়ালের সময় তো এসব অনেকবার বলেছেন, স্যার—।’
‘না, না, এ ভীষণ অন্যায়! একজন ইনোসেন্ট লোককে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া! ছি-ছি—’ আমি জানলায় মুখ উঁচিয়ে দেখতে চেষ্টা করলাম। হিংস্র থাবা দেওয়ালে বসাতে চাইছি ক্ষণে-ক্ষণে।
কালো গাড়িটা দূরে মিলিয়ে যাচ্ছে। ওর ভেতরে রয়েছে মালবিকা আর কিংশুক। ওরা কাশ্মীর, নৈনিতাল, দার্জিলিং, মধুপুর, সব ঘুরে বেড়াবে। ওদের কাছে সারা বছরই বসন্তকাল। প্রেমের কাল। ভালোবাসার কাল। আর আমার কাছে তা কালবসন্ত।
‘মালা, ফিরে এসো মালা। বিশ্বাস করো, আমি তোমাকে ভালোবাসি! এভাবে আমাকে নিরাশ্রয় করে যেয়ো না, মালা!’
ঠান্ডা বৃষ্টির ফোঁটায় গাড়ির লাল রঙের টেল-লাইট জোড়া হারিয়ে গেল। প্রহরীরা হঠাৎই পেছন থেকে এসে আমাকে সজোরে জাপটে ধরল। অবাক হয়ে লক্ষ করলাম, আমি বিকৃতকণ্ঠে চিৎকার করে চলেছি। *
– – –
* কাহিনির কবিতার অংশ অসিত সরকারের ‘আমরা দুজনে একা’ কবিতা থেকে সংকলিত।