‘মালবিকা।’ ভয়ংকর স্বরে চিৎকার করে উঠলাম আমি।
‘ওর ঠোঁট সত্যিই ফুলের মতো…।’
প্রথম গুলি ছুটে গেল।
‘…ও আমার জন্মান্তরের প্রেমিক…।’
দ্বিতীয় গুলি।
ও পড়ে গেল।
‘মালবিকা! মালা—মালবিকা!’
আরও চারবার ওর শরীর লক্ষ্য করে আমি গুলি ছুড়লাম।
ওর পড়ে থাকা দেহ কেঁপে-কেঁপে উঠছে। ওর চেতনাহীন ঠোঁট অভ্যন্তরীণ কোন এক যান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় নড়ে উঠছে বারবার। বলছে, ‘…জন্মান্তরের প্রেমিক, জন্মান্তরের প্রেমিক, জন্মান্তরের প্রেমিক…।’
আমার মাথা ঝিমঝিম করছে। কোন এক অস্পৃশ্য নেশা শুষে-নিচ্ছে আমার চেতনা—।
ঘুম ভাঙতেই ভুরুর ওপর ভিজে কাপড়ের ছোঁয়া অনুভব করলাম ভুরুর ওপর।
‘সব শেষ।’ কালো লোকটি বলল।
‘শেষ?’ আমি ফিসফিস করে বলে উঠলাম।
নীরবে সম্মতি জানাল লোকটি।
ক্লান্তভাবে নিজের হাত দুটোর দিকে তাকালাম। দু-হাতে যথেষ্ট রক্তের দাগ ছিল। আবছাভাবে মনে আছে, জ্ঞান হারাবার মুহূর্তে আমি পড়ে গিয়েছিলাম মেঝেতে। এবং সত্যিকারের রক্তের এক ফোয়ারা অবিশ্রান্তভাবে মাথা কুটে মরেছে আমার দু-হাতে।
কিন্তু এখন রক্তাক্ত হাতদুটো অপরাধহীন নিষ্পাপ। কেউ সযত্নে ধুয়ে দিয়েছে।
‘আমাকে এখুনি যেতে হবে।’ অস্পষ্ট গলায় বললাম।
‘পারবেন তো?’
‘হ্যাঁ পারব?’ আমি উঠে বসলাম: ‘মালবিকার সঙ্গে এখন আর কোনও যোগাযোগ রাখতে পারব না?’
‘মালবিকা মারা গেছে।’
‘হ্যাঁ। আমিই ওকে খুন করেছি। ওঃ, রক্তটা একেবারে সত্যিকারের ছিল।’
‘এ জন্যেই তো আমাদের কোম্পানির এত সুনাম।’
ওদের অফিস ছেড়ে বেরিয়ে এলাম রাস্তায়। বৃষ্টি পড়ছে ঝিরঝির করে। আমার শুধু হাঁটতে ইচ্ছে করছে। ক্রোধ ও প্রতিশোধের দুরন্ত জ্বালা এখন আর নেই। ওই কাল্পনিক হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে-সঙ্গে বিলীন হয়ে গেছে। কিন্তু সে-স্মৃতি এত ভয়ংকর যে, দ্বিতীয়বার খুন করার ইচ্ছে আমার মোটেও নেই। যদি বাস্তবের মালবিকাও আমার সামনে এসে এখন দাঁড়ায় তা হলে আমি শুধু অচেতন হয়ে হাঁটুগেড়ে বসে পড়ব। ঈশ্বরকে ধন্যবাদ জানাব। মালবিকা মরে গেছে। আমার ইচ্ছে পূর্ণ হয়েছে। আমি অন্যায় করেছি, তবে কেউ তা জানতে পারবে না।
মুখের ওপর ছুটে আসা বৃষ্টির ফোঁটা যেন ঠান্ডা বরফের কুচি। এখুনি আমাকে এদেশ ছেড়ে চলে যেতে হবে। নইলে একটু আগে ঘটে যাওয়া নাটকের উদ্দেশ্যটাই ব্যর্থ হয়ে যাবে। যদি পুরোনো সুতো ধরেই আবার জীবনের মালা গাঁথব তা হলে দশহাজার টাকার বিনিময়ে ওই নাটকীয় অনুভূতি কেনার কী প্রয়োজন ছিল? সত্যিকারের হত্যাকাণ্ডকে রোধ করতেই কালো লোকটির এতো আয়োজন। মনের মধ্যে খুন করার বা কাউকে যন্ত্রণা দেওয়ার প্রতিজ্ঞা থাকলে কোনও রোবটের ওপর সেই নৃশংস ভয়াবহ প্রতিজ্ঞা চরিতার্থ হয়।
এখন ফ্ল্যাটে ফিরে গিয়ে লাভ নেই। সেখানে মালবিকা হয়তো বসে আছে। ওকে আমি আর দেখতে চাই না। আমার কাছে ও মৃত।
ফুটপাথে দাঁড়িয়ে দেখছি চলমান যানবাহন। জীবন গতিময়। বিশুদ্ধ বাতাসে গভীর শ্বাস নিলাম। মন যেন আরও হালকা লাগছে।
‘মিস্টার রায়?’ পেছন থেকে কে যেন বলে উঠল।
আমি চমকে ফিরে তাকালাম।
পেশাদার ক্ষিপ্রতায় একটা হাতকড়া আমার ডানহাতের কবজির ওপর এঁটে বসল।
‘আপনাকে অ্যারেস্ট করা হল, মিস্টার রায়।’
‘কিন্তু—।’
গম্ভীর স্বরটি নির্বিকার ভঙ্গিতে পাশের লোকটিকে বলল, ‘এসো চক্রবর্তী, ওপরের লোকগুলোকে এবার অ্যারেস্ট করা যাক।’
‘শুধু-শুধু আমাকে আপনারা—।’
আমাকে বাধা দিয়ে গম্ভীর কণ্ঠস্বর বলে উঠল, ‘শুধু-শুধু নয়, মিস্টার রায়, মার্ডারের জন্যে আমরা কাউকে রেহাই দিই না।’
কালো আকাশে কোথাও বিদ্যুৎ ঝলসে উঠল। বাজ পড়ল সগর্জনে।
রাত প্রায় ন’টা। গত দশদিন ধরে টানা বৃষ্টি পড়ছে। জেলের পাথুরে দেওয়াল বেয়েও গড়িয়ে পড়ছে জলের ধারা। হাত পাতলেই বৃষ্টির ফোঁটা জমা হয়ে ছোট্ট হ্রদ তৈরি করে ফেলছে। আমার হাত কাঁপছে।
দরজার ধাতব শব্দ শোনা গেল। আমি চুপচাপ দাঁড়িয়ে জলে হাত ভিজিয়ে চলেছি। আমার উকিল দরজায় এসে দাঁড়ালেন। বললেন, ‘আর কোনও আশা নেই। আজ রাতেই আপনাকে নিউক্লিয়ার ফার্নেসে যেতে হবে!’
আমি তখনও বৃষ্টির রিমঝিম শুনে চলেছি।
‘ও বাস্তব ছিল না। স্বপ্ন ছিল। আমি ওকে সত্যি-সত্যি খুন করিনি।’
‘কিন্তু আইন তো আর পালটানো যাবে না! জানেন তো, অন্য সবারও কপালে নিউক্লিয়ার ফার্নেস জুটেছে। রাত ঠিক বারোটায় ওই রোবট কোম্পানির চেয়ারম্যানের মৃত্যু হবে নিউক্লিয়ার ফার্নেসে। তিনজন কর্মচারী মরবে রাত একটায়। আর আপনি দেড়টার সময়।’
আমি উত্তাপহীন সহানুভূতির গলায় বললাম, ‘সত্যি, আপনি অনেক করেছেন। আসলে সত্যি হোক আর মিথ্যে হোক, স্বপ্নে হোক বা বাস্তবে হোক, ব্যাপারটা সরকারের চোখে খুন ছাড়া আর কিছু নয়। কারণ, এখানে খুনের ইচ্ছে রয়েছে, রয়েছে মোটিভ। ঠান্ডা মাথার প্ল্যান রয়েছে। সবই আছে। একমাত্র আসল মালবিকা ছাড়া।’
‘ব্যাপারটা কী জানেন, মিস্টার রায়? আপনার কপাল খারাপ যে, এই সময়টাতে আপনি ধরা পড়লেন। দশবছর আগে হলে আপনাকে এ জন্যে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হত না। দশবছর পরে হলেও না। এই কয়েকটা বছরে কাল্পনিক খুনের ব্যাপারটা হঠাৎ করে এমন বেড়ে উঠেছে যে, গভর্নমেন্ট একেবারে হিমসিম খেয়ে যাচ্ছে। আর এর ফলে আসল খুনের সংখ্যা কমে যাওয়ার বদলে বরং আশ্চর্যভাবে বেড়ে উঠছে। সুতরাং কড়া শাস্তির ব্যবস্থা না করলে রোবট কোম্পানিও থামবে না, আর আপনার মতো ক্লায়েন্টরাও না। আসলে আপনার হয়তো সত্যিকারের খুন করার বুদ্ধি বা সাহস নেই। কিন্তু দেখা গেছে, এই নকল খুন বারকয়েক করলেই আপনার হাত পেকে উঠছে। বেড়ে উঠছে সাহস, কনফিডেন্স, বুদ্ধি। ফলে আপনারই হাতে ঘটে যাচ্ছে সত্যিকারের খুন। তা ছাড়া, এ জাতীয় রোবটদের সরকারি আইনে ঠিক নিষ্প্রাণ জড়বস্তু বলে ধরা হয় না। কারণ, এরা চিন্তা করতে পারে, যুক্তি দিয়ে ভাবতে পারে। আড়াই মাস আগে ”জীবন্ত রোবট” নামে একটা আইন পাশ করা হয়েছে। আপনি সেই আইনের আওয়তায় ধরা পড়েছেন। নেহাতই কপাল, মিস্টার রায়, নেহাতই কপাল।’