‘তুমি এসব কথা জিগ্যেস করলে আমি কিন্তু চলে যাব!’ ও বলল।
‘না, না!’
‘তা হলে কাজের কথায় এসো। তুমি কি কিংশুকের বিষয়ে আমাকে জিগ্যেস করতে চাও?’ মালবিকার স্বর হঠাৎই শীতল হয়ে গেছে। এ-কণ্ঠস্বরও কি গলিত ধাতুর তৈরি?
‘একটু সময় দাও, মালা, বলছি।’
‘না, এক্ষুনি।’
আমার সমস্ত ক্রোধ দ্রবীভূত হয়ে গেছে। মালবিকার উপস্থিতি কাজ করছে সর্বদ্রাবী দ্রাবকের মতো।
‘তুমি আমাকে কেন ডেকেছ? কিংশুকের বিষয়ে কথা বলতে, তাই তো? তুমি তো জানো আমি ওকে ভালোবাসি। তোমার চেয়ে বেশি বা কম ভালোবাসার কোনও ব্যাপার নয়। কারণ, একমাত্র ওকেই আমি ভালোবাসি।’ ওর কণ্ঠস্বর বিষাক্ত হয়ে পড়ছে ক্রমশ।
‘ওঃ—থামো, থামো!’ দু-হাতে কান চেপে ধরলাম আমি।
কিন্তু ও থামল না: ‘এখন তো সবসময় কিংশুকের সঙ্গেই আমি ঘুরে বেড়াই। তুমি আর আমি আগে যেখানে-যেখানে যেতাম, এখন সেখানে কিংশুক আমার সঙ্গী। এই তো গত মাসে ওর সঙ্গে মধুপুরে তিনদিন ঘুরে এলাম। ওঃ, দারুণ! আর কিংশুক যা দুরন্ত কী বলব!’
শুকনো ঠোঁটে জিভ বুলিয়ে আমি উঠে দাঁড়ালাম। এগিয়ে গিয়ে মালবিকার হাত ধরলাম একান্ত অনুনয়ে। বললাম, ‘এসব তো তোমার দোষ নয়! তুমি নিষ্পাপ। তুমি পবিত্র। তুমি সেই মালবিকা নও। তুমি আলাদা!’
‘ঠিক তার উলটো,’ রোবট যুবতী বলে উঠল, ‘আমার সঙ্গে মালবিকার কোনও তফাত নেই। আমিই মালবিকা। ও যা-যা করে আমাকেও তাই-তাই করতে হয়। আমরা দুজন সবদিক থেকেই এক।’
‘কিন্তু ও যা পাপ করেছে তুমি তো তা করোনি!’
‘করেছি। সব পাপই করেছি। কিংশুককে আমি চুমু খেয়েছি। ওর সঙ্গে রাতে…।’
‘হতেই পারে না, মালা। কারণ একটু আগেই তোমার জন্ম হয়েছে। তুমি এখনও কোনও পাপ করার সময় পাওনি।’
‘তোমার হৃদয় এবং মালবিকার অতীত থেকে আমার জন্ম।’
আমি ওর দু-কাঁধ ধরে ঝাঁকুনি দিলাম: ‘শোনো, মালা—নিশ্চয়ই কোনও-না-কোনও পথ আছে। আমি দরকার হলে আরও—টাকা দিতে পারি। তোমাকে কিনে নিতে পারি। তারপর আমরা দূরে কোথাও চলে যাব। কেউ জানবে না। শুধু আমরা দুজনে—।’
ও হাসল: ‘তা হয় না। আমরা শুধু ভাড়া দেওয়ার জন্যে। বিক্রির জন্যে নয়।’
‘কিন্তু যে-কোনও অঙ্কের টাকা দিতে আমি রাজি আছি।’
‘এ-চেষ্টা যে আগে হয়নি তা নয়! তার পরিণাম মাথার গোলমাল। বললাম তো, এ সম্ভব নয়। এমনকী এটুকুও বেআইনি, সে তো আপনি ভালো করে জানেন। সরকারকে লুকিয়ে-চুরিয়ে আমাদের এসব কাজ করতে হয়।’
হঠাৎ ‘আপনি’ করে কথা বলছে কেন মালবিকা?
‘আমি তোমাকে নিয়ে থাকতে চাই, মালা!’
‘তা হয় না, কারণ আমি সত্যিই মালা, মালবিকা। আমাদের প্রতিটি কণা এক। তা ছাড়া অফিসের বাইরে বেরিয়ে আমরা প্রতিযোগিতায় নামতে চাই না। শরীর কাটা-ছেঁড়া করলে আমাদের সব রহস্যই ফাঁস হয়ে যাবে।…যাক, ঢের হয়েছে, আপনাকে আমি বারবার সাবধান করেছি যে, এ-বিষয়ে আলোচনা করবেন না। তা হলে শুধু-শুধু স্বপ্নের ঘোর কেটে যাবে। আর আপনার টাকা নষ্ট হবে। তার চেয়ে যা করতে এসেছেন তাই করুন। চটপট।’
‘তোমাকে আমি খুন করতে চাই না।’
‘আপনার একটা সত্তা চায়। সেটাকে আপনি চেপে রেখেছেন। এক্সপোজ করতে চাইছেন না।’
পকেট থেকে রিভলভারটা বের করে নিলাম।
‘আমার সত্যিই ভীমরতি ধরেছে। এখানে আসা আমার উচিত হয়নি। তুমি এত সুন্দর!’
‘আজ রাতে আমি কিংশুকের কাছে যাচ্ছি।’
‘কথা বোলো না, প্লিজ।’
‘রাতে ওখানে থাকব।’
‘আমার কথা কানে যায়নি তোমার!’
মিষ্টি করে হাসল ও। আমার চিবুকটা নেড়ে দিল: ‘আহা রে, আমার মোটকু সোনা! রাতে বিছানায় একা-একা শুয়ে খুব ছটফট করবে। তার চেয়ে বরং একটা কোলবালিশ নিয়ে নিয়ো।’
আমার অভ্যন্তরে একটা অজ্ঞাত আলোড়ন শুরু হল। আমার মুখ কি বিবর্ণ হয়ে গেছে? অনিবার্য কিছু একটা ঘটতে চলেছে। বন্দি ক্রোধ, ঘৃণা আর বিরক্তি চিন্তায় ছুঁচ ফুটিয়ে চলেছে। এবং ওর মস্তিষ্কের টেলিপ্যাথিক নেটওয়ার্ক এই মৃত্যু-স্পন্দন অনুভব করতে পারছে। রোবট। টেলিপ্যাথি। মার্ডার।
‘ভাবতে অবাক লাগে, দেবু, কী করে তোমাকে একদিন ভালোবেসেছিলাম।’ ও হাসল—তাচ্ছিল্যের হাসি।
‘থামো, মালা, থামো।’
‘আমি সবে তিরিশ পেরিয়েছি আর তুমি হয়ে উঠেছ পরিপূর্ণ বৃদ্ধ। তোমার তরল আগুন শুকিয়ে গেছে বয়েসের বাতাসে। কী বোকা তুমি, দেবু? দিনের পর দিন টাকা রোজগার করেছ, অক্লান্ত খেটেছ, আর আমাকে দ্বিতীয়বার প্রেমে পড়বার সুযোগ দিয়েছ। আচ্ছা, তোমার কি কিংশুককে পছন্দ হয় না?’
অন্ধভাবে রিভলভার উঁচিয়ে ধরলাম আমি।
‘মালা!’
‘ওর মন পবিত্রতম সোনায় তৈরি—’ ও ফিসফিস করে বলল।
‘মালা, এখনও বলছি, চুপ করো!’ আমি চিৎকার করে উঠলাম।
‘ওর চুলের গুচ্ছ ঘন মেঘের মখমলকেও হার মানায়। ওর হাত শুভ্র নিষ্কলঙ্ক গজদন্তের মতো সুঠাম!’
কী করে এসব কথা ও বলছে? এ তো আমার মনের ছায়া, নিছক কল্পনা। তা হলে কেমন করে ওর ঠোঁট উচ্চারণ করছে এইসব অশ্লীলতম শব্দের মিছিল?
‘মালা, ডোন্ট মেক মি শুট ইউ।’ আমার হাতে আগ্নেয়াস্ত্র কেঁপে ওঠে।
‘কিংশুকের গালে অস্তাচলের সূর্য রক্তিম ছায়া ফেলে রাখে সর্বক্ষণ—’ ওর চোখ বুজে আসে, অস্ফুটে বেরিয়ে আসে কথাগুলো, এবং ও হালকা পায়ে ভেসে বেড়ায় ঘরের সর্বত্র।
‘…ওর পা দুটো যেন তাজমহলের পাথর দিয়ে তৈরি একজোড়া স্মৃতিসৌধ, যেখানে অর্চনা অঞ্জলি কখনও শেষ হয় না। ওর চোখের পাতায় রামধনু রং খেলা করে…।’