নির্ভুল খুঁটিনাটি সমেত চোখধাঁধানো হয়ে দৃশ্যটা ফুটে উঠল। কিংশুক আর মালবিকা বসে রয়েছে এক রামধনু-রং ফুলের বাগানে। ওদের চুম্বনে ব্যস্ত ঠোঁট অনিচ্ছার ভঙ্গিতে বিচ্ছিন্ন হওয়ার মুহূর্তে আমার অনুপ্রবেশ।
সেই থেকে প্রচণ্ড রাগ। নিজের সঙ্গে এক দুরন্ত যুদ্ধ। কিংশুককে খুন করার চেষ্টা।
আরও দিন যায়। সংখ্যায় ও বিষয়বস্তুতে দুঃস্বপ্ন আরও সমৃদ্ধ হয়ে ওঠে।
অবশেষে মালবিকা—।
ঘুম ভাঙতেই দেখি আমার চোখ জ্বালা করছে। আমার স্বপ্নের কান্না মোটেই স্বপ্ন নয়।
‘উঠুন মিস্টার রায়, আমরা তৈরি।’
অগোছালোভাবে উঠে বসলাম। ওপরের নিঃস্পন্দ শীতল আয়নায় নিজের অপ্রতিভ ছায়া দেখলাম। পঞ্চাশটি ক্লান্তিকর বছরের প্রত্যেকটি যেন আমার অসহায় মুখে স্বতন্ত্র শিলালিপি খোদাই করেছে। ভয়ংকর ভুল করেছি আমি। বহু পুরুষই যুবতী স্ত্রী বেছে নিয়েছে, তারপর জলে আক্রান্ত চিনির দানার মতো তারা উদ্ধত যৌবনের হাতের মুঠোয় অস্তিত্ব ও ব্যক্তিত্বহীন হয়ে গেছে। নিজেকে পরখ করলাম আমি। খুঁতখুঁতে এই জরিপে সূচ্যগ্র মেদিনীর পার্থক্যও ধরা পড়ে। পেটে এখন চর্বির থাক—যারা কখনও রুগ্ন হওয়ার আশ্বাস দেয় না। তেমনই চিবুক। মাথার চুল উদ্বাস্তু হয়ে রওনা হয়েছে কোন দূর অঞ্চলের দিকে। শরীরের প্রতিটি কোষে এক অনিবার্য দুর্বলতার ছায়া।
কালো লোকটি আমাকে অন্য কোনও ঘরের দিকে পথ দেখিয়ে নিয়ে চলল।
গন্তব্যে পৌঁছে চমকে উঠলাম আমি: ‘এ তো মালবিকার ঘর!’
‘আমাদের কাজে কোনও খুঁত পাবেন না, মিস্টার রায়।’
‘সত্যিই তাই! এতটুকু তফাত নেই!’
পকেট থেকে দশহাজার টাকার একটা বান্ডিল বের করে লোকটির হাতে দিলাম। সে সামান্য হেসে বিদায় নিল। সেই হাসির অর্থ: আপনার টাকা খরচ সার্থক হবে।
ঘরটা নিস্তব্ধ এবং উষ্ণ। এ কি মালবিকার উষ্ণতা?
একটা সোফায় বসে পকেটে হাত দিলাম। রিভলভারের শীতল স্পর্শ অনুভবে সাড়া দিল। দশহাজার টাকা। কিন্তু এই মানসিক হত্যাকাণ্ড আমাকে মানসিক যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দেবে। একটা বাস্তব হত্যাকাণ্ডকে এড়াতে গেলে এই খরচের প্রয়োজন আছে। নৃশংস, অথচ নৃশংস নয়। মৃত্যু, অথচ মৃত্যু নয়। হত্যা, অথচ হত্যা নয়।
আমার মনটা হালকা হল, শান্ত হল। লক্ষ করতে লাগলাম ঘরের দরজার দিকে। গত ছ’মাস ধরে দিন-রাত আমি মালবিকাকে খুন করার স্বপ্ন দেখেছি। এখন সেই স্বপ্ন ও আকাঙ্ক্ষার সমাপ্তি হবে। যে-কোনও মুহূর্তে ঘরে এসে হাজির হবে মালবিকার বাস্তব প্রতিবিম্ব—একটি রোবট যাকে ধরা যায়, ছোঁয়া যায়, অথচ…।
‘দেবু—।’
‘মালবিকা!’
চমকে ঘুরে দাঁড়ালাম: ‘মালা—।’
শ্বাস নিতেও যেন আমার কষ্ট হচ্ছে।
ও দরজায় দাঁড়িয়ে আছে। পরনে পালকের মতো কোমল কচি-কলাপাতা রং শাড়ি। পায়ে সুদৃশ্য সোনালি চটি। চুলের ঢাল এক অদ্ভুত মেঘলা পটভূমি। চোখ আয়ত। এবং তা থেকে বিচ্ছুরিত হচ্ছে ভালোবাসাময় দৃষ্টি।
বহুক্ষণ নীরব রইলাম। শুধু ওকে দেখছি। অবশেষে কথা বলার ক্ষমতা ফিরে পেয়ে অবাক সুরে বলে উঠলাম, ‘তুমি কী সুন্দর, মালা—।’
‘সুন্দর কখনও সুন্দর না হয়ে পারে?’ ও হেসে জবাব দিল।
‘দাঁড়াও, তোমাকে দেখি,’ আমার অস্ফুট স্বর কেমন অলৌকিক শোনাল।
ঘুমিয়ে-চলা মানুষের মতো দুটো আচ্ছন্ন হাত সামনে বাড়িয়ে দিলাম। বুকের ভেতরে অবাধ্য দামামা। গভীর জলের তলায় দাঁড়িয়ে এগিয়ে চলার মতো অনিশ্চিত টলোমলো পায়ে ওকে ঘিরে হেঁটে বেড়াতে লাগলাম। মাঝে-মাঝে ওকে স্পর্শ করেও দেখছি।
‘এত বছরেও আমাকে ভালো করে দেখোনি?’
‘এ দেখা কখনও ফুরোয় না।’ আমার চোখে জল।
‘আমাকে ডেকেছ কেন?’
‘প্লিজ, একটু সময় দাও, মালা, একটু সময় দাও আমাকে।’ ওর পাশে শরীর এলিয়ে বসে পড়লাম। কাঁপা হাত দুটো বুকের ওপর রাখলাম উত্তাপের খোঁজে। আমার অবিশ্বাসী চোখ কিছুতেই বিশ্বাস করতে চায় না।
‘এ অসম্ভব। নির্ঘাৎ দুঃস্বপ্ন। কী করে ওরা তোমাকে তৈরি করল?’
‘সে-কথা আলোচনা করার অনুমতি নেই। তাতে ঘোর কেটে যায়।’
‘এ কি ম্যাজিক?’
‘না, বিজ্ঞান।’
ওর স্পর্শে উষ্ণতা। নখের পালিশ ও বাঁক নিখুঁত। কোনও জায়গায় কোনও গরমিল নেই। বাস্তব সদবিম্ব। ভালো করে ওকে দেখলাম। মনে পড়ে যায় পুরোনো দিনের কবিতা—যখন প্রতিদিন সূর্য উঠত, অথচ অস্ত যেন না।
‘…সময়ের পায়ে একজোড়া ঘুঙুর থাকলে
অবিকল তার রং হত সবুজ
অনায়াসলব্ধ ঘাসেদের মতন
বেড়ে ওঠা দুরন্ত হিজলের মতো তোমার বুকের সবুজও তখন
ধরা থাকতো না শাড়ির ছোট্ট আঁচলে…’
‘দেবু?’ ওর চোখ কাঁচের মতো। বুকজোড়া কি ধরা থাকবে না শাড়ির ছোট্ট আঁচলে?
‘কী?’ ওকে চুমু খেতে ইচ্ছে করছে।
‘…তুমি গীতোক্ত পুরুষের মতো
উদাসীন হলে আমি লজ্জা পাই…’
‘দেবু।’
একটা আগ্রাসী গুঞ্জন শুরু হল কোথাও। ঘরটা যেন বনবন করে ঘুরছে।
‘একমিনিট, একমিনিট।’ এ গুঞ্জন কি আমার মস্তিষ্কের অভ্যন্তরে?
‘…তুমি হলুদ সবুজ সাদা প্রজাপতি দেখ
আমি ফড়িং-এর কাঁচপোকা পাখা
তন্ময় তুমি নির্মম হাতে নির্মোক ভাঙো
আমি নির্ঝর
চূণির্ত শিলা যেন…’
‘কী করে ওরা তোমাকে তৈরি করল?’ আমি অবিশ্বাসে ডুবে যেতে-যেতে চিৎকার করে উঠলাম। এত অল্প সময়ে! মাত্র ন’ঘণ্টায়? যখন আমি ঘুমিয়ে ছিলাম তখন কি ওরা সোনা গলিয়ে ঢালাই করেছে মালবিকাকে? তারপর হিরে-চুনি-পান্না, তরল রুপো আর মেঘের সুতো ব্যবহার করেছে প্রয়োজন মতো? হলদে আগুনকে ছাঁচে ফেলে জমাট বাঁধিয়ে কি তৈরি হয়েছে মালবিকার বরতনু?