সবকিছু আমার প্ল্যানমতো ঘটতে লাগল। আমার ইচ্ছে আছে, তদন্তের ঝামেলা মিটে গেলে মৃতদেহটার একটা বন্দোবস্ত করব।
একদিন এইসব সাত-পাঁচ ভাবছি, এমন সময় ইন্সপেক্টর এলেন দলবল নিয়ে। আমি তাদের নিয়ে সবিতার ঘরে গেলাম। ইন্সপেক্টর আজ সবিতা সম্পর্কে অনেক কথা জিগ্যেস করলেন—বারবার। আমিও সাধ্যমতো জবাব দিয়ে গেলাম। রাখীকেও এ-কথা সে-কথা জিগ্যেস করলেন। তারপর আমার দিকে ফিরে বললেন, মিস্টার বর্মন, এ-কেস সলভ করা আমাদের সাধ্যের বাইরে। হয়তো আপনার ওয়াইফ কোথাও নিজের ইচ্ছেয় লুকিয়ে আছেন, কিন্তু তাঁর যে ভালো-মন্দ কিছু হয়েছে তার কোনও সূত্রই আমাদের হাতে নেই। তবে ভগবান করুন, তাঁর যেন কোনও অমঙ্গল না হয়। আপনার কথা ভেবে আমার সত্যিই খারাপ লাগছে।
বলতে-বলতে উঠে দাঁড়ালেন ইন্সপেক্টর।
রাখী আলনার কাছে বসে-বসে কী যেন করছিল, হঠাৎই উঠে দৌড়ে এল আমার কাছে। ওর ওই ছোট্ট গলায় তীক্ষ্ন স্বরে চেঁচিয়ে উঠল, বাবা, মা যদি শিলং গিয়ে থাকবে তবে মায়ের বারোজোড়া চটিই আলনায় পড়ে আছে কেন?
মা কি কোনওদিন খালি পায়ে বাড়ির বাইরে গেছে?
সমস্ত পৃথিবী আমার সামনে দুলে উঠল। পায়ের নীচে মাটি নড়ে উঠল। টলে পড়ে যাওয়ার আগে শুধু দেখলাম, ইন্সপেক্টর চলে যেতে গিয়েও থমকে দাঁড়িয়ে পড়েছেন।
হত্যাকাণ্ড
‘আপনি আপনার ওয়াইফকে খুন করতে চান?’ কাউন্টারে বসে থাকা কালো চেহারার লোকটি জিগ্যেস করল।
‘হ্যাঁ। না…মানে ঠিক খুন…।’
‘নাম?’
‘ওর—না আমার?’
‘আপনার।’
‘দেবতোষ রায়।’
‘ঠিকানা?’
‘পাঁচের এক বালিগঞ্জ সার্কুলার রোড। কলকাতা।’
যান্ত্রিকভাবে লিখে চলল লোকটির হাত। যেন এরকম নাম ও ঠিকানা সে আগে অসংখ্যবার লিখেছে।
‘আপনার ওয়াইফের নাম?’
‘মালবিকা।’
‘বয়েস?’
‘একত্রিশ।’
তারপরই শুরু হল একের পর এক ধারাবাহিক ও গতানুগতিক প্রশ্নোত্তরের পালা। মালবিকার গায়ের রং, মুখের গড়ন, উচ্চতা, স্বাস্থ্য, ওজন, নাক-মুখ-চোখের বৈশিষ্ট্য, ইত্যাদি কত কী!
‘আপনার কাছে মিসেস রায়ের হলোগ্রাফিক ফটোগ্রাফ আছে? ওঁর ভয়েস রেকর্ড করা আছে?’
‘হ্যাঁ, আছে। এই নিন।’ পকেট থেকে দুটো জিনিসই বের করে দিলাম।
ভালো করে জিনিস দুটো উলটেপালটে দেখল লোকটি। তারপর বলল, ‘আচ্ছা—এবারে শুনুন…।’
দেখতে-দেখতে একটি ঘণ্টা পার হয়ে গেল। টের পেলাম, আমি ঘামতে শুরু করেছি।
‘ব্যস, সব শুনলেন তো? এবার ভেবে দেখুন, শেষ পর্যন্ত আপনার মনের জোর থাকবে তো?’ লোকটি উঠে দাঁড়াল চেয়ার ছেড়ে। প্রচণ্ড একঘেয়েমি ও বিরক্তির অভিব্যক্তি মুখে ফুটিয়ে তুলল। তার প্রমাণ হিসেবে একইসঙ্গে একটা হাই উঠল।
আমি সবিনয়ে জানালাম যে, আমার মনের জোর থাকবে।
‘তা হলে এখানে সই করুন।’ একটা ফর্ম এগিয়ে দিল লোকটা।
সই করলাম।
‘আপনি জানেন এ-কাজটা বেআইনি?’
‘জানি।’
‘এ-কাজের জন্যে যদি আপনি বিপদে পড়েন তা হলে আমরা কিন্তু একটুও দায়ী হব না!’
এবার বিরক্ত আমিও হলাম। বললাম, ‘ঢের হয়েছে, এবার কাজের কথায় আসুন।’
লোকটি হালকাভাবে হাসল। আমার এই ধৈর্য্যচ্যুতিও ওর বহুদিনের চেনা। তারপর বলল, ‘আপনার ওয়াইফের রিয়েল ইমেজ তৈরি করতে আমাদের ন’ঘণ্টা লাগবে। ততক্ষণ আপনি একটু ঘুমিয়ে নিন, আরাম পাবেন। ডানদিকের তিন নম্বর মিরার-রুমটা খালি আছে। আপনি ওটায় চলে যান।’
আমি শান্ত পায়ে এগিয়ে চললাম তিন-নম্বর আয়নাঘরের দিকে।
ঘরে ঢুকে নীল রঙের ভেলভেটের বিছানায় শুয়ে পড়লাম। বিছানায় শরীরের চাপ পড়তেই মাথার ওপরে লাগানো আয়নার সিলিংটা দুরন্ত গতিতে ঘুরতে শুরু করল। আর একটা নরম কণ্ঠস্বর প্রতিধ্বনি তুলে বলতে শুরু করল, ‘ঘুমোও…ঘুমোও…ঘুমিয়ে পড়ো…।’
আমি অস্ফুট কণ্ঠে মালবিকার নাম উচ্চারণ করে চললাম।
মালবিকা, আমি এখানে আসতে চাইনি। তুমিই আমাকে বাধ্য করলে। তুমিই আমাকে দিয়ে এ অন্যায় কাজ করালে। ওঃ ভগবান! কেন যে আমি এখানে এলাম! যদি এই মুহূর্তে ফিরে যেতে পারতাম! ওঃ…আমি তোমাকে খুন করতে চাই না।
ঘুরন্ত আয়নার জটিল আলোর ঝিলিকের কম্পাঙ্ক ক্রমে বেড়ে চলেছে।
কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি বুঝতে পারিনি।
স্বপ্নে দেখলাম আমি ফিরে গেছি সেই চল্লিশ বছর বয়েসে। খোলা সবুজ মাঠের ওপর উচ্ছল কিশোর-কিশোরীর মতো ছুটে বেড়াচ্ছি আমি আর মালবিকা। রঙিন তোয়ালের ওপরে পড়ে আছে টিফিন ক্যারিয়ার, ট্রানজিস্টার রেডিয়ো, কোল্ড ড্রিংকস-এর বোতল। একটু দূরেই নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে আমাদের প্রিমিয়ার পদ্মিনী। তার ঝকঝকে সবুজ রং ঘাসের সঙ্গে যেন মিশে গেছে।
মালবিকা হাসছে। ওর একরাশ কালো চুল মুখের ওপরে ঝিলিমিলি হয়ে নাচছে। আমার নাম ধরে ডাকছে ও, ‘দেবতোষ…দেবতোষ…।’
আমি কাছে এগিয়ে গেলাম। হাতে হাত। ঠোঁটে ঠোঁট। যৌবনে যৌবন। উত্তাপে উত্তাপ। পশ্চিমের আকাশ তখন লাল কালিতে কবিতার পাণ্ডুলিপি শেষ করে সূর্য-বিদায়ের নাটক শুরু করেছে।
দৃশ্য পালটে যায়। কাশ্মীর, নৈনিতাল, দার্জিলিং। আমরা যেন অপ্রাকৃত গতিতে উড়ে চলেছি দেশ থেকে দেশান্তরে। ১৯৯৭ সালের চিরসতেজ বসন্ত।
আর তারপর—যন্ত্রণাময় দুঃস্বপ্ন। মালবিকা ও কিংশুক। স্বপ্নের মধ্যেই এক অজানা অচেনা আবেগ আমার শরীরটাকে আমূল কাঁপিয়ে দিল। কী করে সব জলছবি ওলটপালট হয়ে গেল? কোথা থেকে এসে হাজির হল কিংশুক? কেন এল ও আমার আর মালবিকার ভালোবাসার মৃত্যু পরোয়ানা হাতে নিয়ে? জীবন কেন এত জটিল, কেন এত দুঃখময়? এ কি শুধু বয়েসের তফাত? উত্তাপের পার্থক্য? আমি, পঞ্চাশ ছোঁয়া প্রৌঢ়, আর মালবিকা যুবতী, এত ভয়ংকর যুবতী। কেন, কেন, কেন এমন হল?