একটু পরে চুপিচুপি ফিরে এসে চাবি দিয়ে দরজা খুলে টুক করে বসবার ঘরে ঢুকে পড়লাম। তারপর বাথরুমে গিয়ে দরজা বন্ধ করলাম। হাত-পা ধোয়ার পর চেঁচিয়ে রাখীকে ডাকলাম (এটা বোঝাতে যে, গ্যারেজে গাড়ি ঢুকিয়ে আমি সোজা এসে বাথরুমে ঢুকেছি)। বললাম, আমার তোয়ালে আর সাবান দিয়ে যা…।
ও এসে বলল, তুমি কখন ফিরলে?
আমি নির্বিকার গলায় জবাব দিলাম, তা অনেকক্ষণ হল। গাড়ির আওয়াজ শুনিসনি তুই? শরীরটা ভালো লাগছে না বলে এসেই সোজা বাথরুমে ঢুকেছি—হাত-পা ধুয়ে চান করতে।
ও—, জবাব দিল রাখী, মা বুঝি চলে গেল?
আমি কোনওরকমে জবাব দিলাম, হ্যাঁ—আমি আর স্টেশনের ভেতর পর্যন্ত যাইনি।
একটু পরে ও এসে তোয়ালে আর সাবান দিয়ে গেল।
এরপর কয়েকদিন ধরে হাতের ছাপ, পায়ের ছাপ প্রয়োজন মতো কাপড় দিয়ে মুছে সাফ করেছি। গাছের ফাঁপা গুঁড়ির ভেতরে বেশ কয়েক বোতল ফর্ম্যালিন ঢেলে দিয়েছি। সত্যি বলতে কী এখন অনেক নিশ্চিন্তে আছি।
রাখী মাঝে-মাঝেই জিগ্যেস করে, বাবা, মা কবে আসবে?
আমি বলি, সে তো বলে যায়নি। তুই-ই বল না, কোনওবার তোর মা আমাকে বা তোকে বলে কোথাও গেছে?
এ-কথায় ও চুপ করে থাকত।
অবশ্য অস্বীকার করতে পারব না, বাড়িটা এখন বেশ ফাঁকা-ফাঁকাই লাগে। সবিতা সবসময় সেজেগুজে টিপটপ হয়ে থাকত—নিত্য বাইরে যেত-আসত। বলত গেলে গাড়িটা ও-ই ব্যবহার করত সর্বক্ষণ।
এইভাবে প্রায় পনেরোদিন যাওয়ার পর আমি ইন্দ্রজিৎ দস্তিদারের ঠিকানা জেনে তাকে একটা চিঠি দিলাম। অবশ্যই সবিতার খবর জানতে চেয়ে। কেন সে এখনও চিঠি দেয়নি? ইত্যাদি-ইত্যাদি। চিঠির শেষে রাখীও কয়েক লাইন সবিতাকে লিখেছিল।
চিঠির উত্তর কী এল আপনারা আশা করি বুঝতেই পারছেন।
ইন্দ্রজিৎ লিখল যে, সে আমার চিঠি পেয়ে খুব অবাক হয়েছে সবিতা তার সঙ্গে মোটেই যায়নি। সবিতা কোথায় তাও সে জানে না।
চিঠি পেয়ে অবাক হওয়ার ভান করলাম। সম্ভব-অসম্ভব সব জায়গাতেই সবিতার খোঁজ করলাম। কিন্তু কোথাও ওর খোঁজ পাওয়া গেল না।
ইতিমধ্যে নিয়মিত ফর্ম্যালিন ঢেলে মৃতদেহটাকে ঠিকঠাক রাখার চেষ্টা করেছি—আর মনমরা হয়ে থাকার ভান করেছি। এমনকী দু-চারদিন অফিসও কামাই করে ফেলেছি। শেষে পাড়ার কয়েকজন প্রতিবেশীর অনুরোধে আমি গেলাম পুলিশে খবর দিতে। সঙ্গে কয়েকজন হিতাকাঙ্ক্ষীও গেলেন। সেখানে ডায়েরি করে ক্লান্ত পায়ে বেরিয়ে এলাম থানা থেকে।
আমার এই অভিনয় চালাতে খুব একটা কষ্ট হচ্ছিল না। বরং রাখীর কাছ থেকে সহানুভূতি পাওয়ার আশায় একদিন রাখীকে না দেখার ভান করে বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে ফুলে-ফুলে কাঁদছিলাম। রাখী এসে আমার পিঠে হাত দিল। জানি না, বোধহয় আমাকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করছিল। ওইটুকু মেয়ে, কিন্তু আমার মতোই মেধা পেয়েছে—এটাও বুঝেছে যে, ওর মা-কে কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না।
পরদিন সকালবেলা পুলিশ এল। বলা নিষ্প্রয়োজন যে, আমি তৈরি ছিলাম—তাই এতটুকু ছটফটে ভাব প্রকাশ পেল না আমার ব্যবহারে। ওদের অভ্যর্থনা করে বাইরের ঘরে নিয়ে গিয়ে বসালাম। কিছুক্ষণ আলোচনার পর একজন অফিসার আমাকে সবিতার বিষয়ে প্রশ্ন করলেন। আমি অবিচলিত কণ্ঠে বলে গেলাম যে, সবিতার কাছে শিলং যাওয়ার একটা রিজার্ভেশান টিকিট দেখেছিলাম, এবং এ-ও জানালাম যে, ও আমার কাছে বলেছিল ইন্দ্রজিতের সঙ্গে শিলং যাবে। কথাসূত্রে ইন্দ্রজিতের পরিচয়, ঠিকানা, ইত্যাদি বললাম এবং আমার চিঠির উত্তরে পাওয়া ওর চিঠিটাও দেখালাম। একইসঙ্গে বললাম যে, আমি নিজে গাড়ি করে সবিতাকে স্টেশান পৌঁছে দিয়েছি।
ইন্সপেক্টর সবিতার ঘর সার্চ করলেন, কিন্তু দরকারি বিশেষ কিছুই পেলেন না। বোধহয় এরকম অদ্ভুত নিরুদ্দেশের কেস তিনি আগে পাননি। যাওয়ার সময় তিনি বললেন, এই অন্তর্ধান রহস্য সমাধান করার জন্যে আমি আটমোস্ট চেষ্টা করব—তবে আমার মনে হয় আপনার স্ত্রী আর বেঁচে নেই—।
ইন্সপেক্টর এ-কথা বলামাত্র আমি খুব অবাক হওয়ার ভান করে বললাম, না—না, অফিসার, এ কখনওই হতে পারে না। এ যে আমি চিন্তাও করতে পারছি না…ইত্যাদি-ইত্যাদি।
পরের সপ্তাহে ইন্সপেক্টর আবার এলেন। তিনি বললেন, ‘আপনার ইনফরমেশানের ওপরে বেস করে আমি খোঁজ করেছি, মিস্টার বর্মন। কিন্তু সমস্ত জায়গায় এনকোয়ারি করেও আপনার মিসেসের খোঁজ আমরা পাইনি। এটা আমাদের পক্ষে সত্যিই খুব লজ্জার কথা। তবে একটা বিষয়ে আমার একটু সন্দেহ জেগেছে। আশা করি আপনি সে-বিষয়টার এক্সপ্লানেশান দিতে পারবেন—।’
আমার ভুরু কুঁচকে উঠল। একটু চিন্তিত হলাম, বললাম, কী ব্যাপার?
মিস্টার বর্মন, একটি লোক আমাদের বলেছে যে, সে যখন আপনাকে আর আপনার স্ত্রীকে গাড়ি করে স্টেশানের দিকে যেতে দ্যাখে, তখন সে লক্ষ করে যে, আপনার ওয়াইফের চোখে একটা কালো চশমা ছিল…।
আমি বললাম, হ্যাঁ, ঠিকই দেখেছে লোকটি। সবিতা চায়নি যে, ওর বাইরে যাওয়ার খবর আর-কেউ জানুক—বোঝেনই তো, বিবাহিতা হয়ে অন্য একজন পুরুষের সঙ্গে বেড়াতে যাওয়া…।
আপনি বাধা দেননি?
আমি চোয়াল শক্ত করে বললাম, না বাধা দিইনি। কারণ, দিয়ে কোনও লাভ হত না।
ইন্সপেক্টর এবার রাখীকে নিয়ে পড়লেন। কিন্তু রাখী আমার ধারণামতোই সুন্দরভাবে সব জবাব দিয়ে গেল। ইন্সপেক্টর কোনও হদিশ করতে না পেরে চলে গেলেন।