ওর স্বভাবের পরিবর্তন ওর ভালোর জন্যেই আমি করেছি। নইলে সেদিন, আটবছর আগে, ওকে আমি খুন করেছিলাম কার ভালোর জন্যে? আর এই আটবছর ধরে যে এত সেবা, যত্ন-আত্তি, সে কার ভালোর জন্যে? এই যে রোজ ওর চোখের কোটর, নাকের গর্ত, শিরদাঁড়া, পাঁজর তেল মেখে ব্রাশ দিয়ে পালিশ করি, এ কার ভালোর জন্যে? হলফ করে বলতে পারি, মেডিকেল ছাত্রদের কাছেও এত সুন্দর, চকচকে, ধপধপে সাদা কঙ্কাল আপনি পাবেন না…কিছুতেই না…।
হঠাৎ বজ্রপাত
এখন আমি আপনাদের যে-খুনটার কথা বলব সেটা কিন্তু যথেষ্ট চাতুর্যপূর্ণ।
সাধারণত হত্যাকারীরা খুনের পেছনে টাকা খরচ করে, কিন্তু বুদ্ধি খরচ করে না। ছোটবেলা থেকেই স্কুলের মাস্টারমশায়রা আমার মেধা লক্ষ করেছিলেন। সেই মেধা আমি লক্ষ করেছি আমার একমাত্র মেয়ে রাখীর মধ্যেও। ক্লাস ফোরে পড়লে কী হবে, সবাই ওর বুদ্ধির প্রশংসায় পঞ্চমুখ। তবে ওর মা—আই মিন আমার ওয়াইফ, সবিতা—কিন্তু মোটেই সুবিধের নয়। যদি এরকম বউ কারও থেকে থাকে, তবে একমাত্র তিনিই বুঝতে পারবেন। মোটকথা ওরকম বউকে খুন করতেও কারও বাধে না—অন্তত আমার নয়।
সত্যিই আশ্চর্য ধাতুতে গড়া সবিতা। দিনরাত পার্টি, ফুর্তি আর কসমেটিকস-এর পেছনে লেগে আছে—তার সঙ্গে বারোজোড়া চটি—আটান্নখানা শাড়ি (এসবই রাখীর দৌলতে আমার জানা—ওর মায়ের কোন জিনিস ক’টা আছে তা ওর মুখস্থ—তা ছাড়া নতুন কিছু কেনা হলেই সবিতারও রাখীকে ডেকে কোলে বসিয়ে দেখানো চাই। ভয় হয়, শেষে রাখীও না ওর মায়ের মতো হয়!), আংটি, ঘড়ি, উইগ ইত্যাদির ঠেলায় আমার প্রাণ বর্তমানে গলার কাছে। আমি মাঝে-মাঝে চোখে অন্ধকার দেখি। পরে ভেবে দেখেছি, অফিসের ক্যাশ ভাঙার চেয়ে বউকে খুন করা অনেক সহজ।
আমার বাড়ির বাগানে পেছনদিকে একটা বড় পিপুল গাছ আছে। তার গুঁড়িটা ফাঁপা চোঙার মতো। মাটি থেকে প্রায় আটফুট উঁচুতে গুঁড়িটায় একটা মাঝারি সাইজের ফোকর আছে। গুঁড়ির ভেতরটা বাইরের জমি থেকেও প্রায় দু-ফুট নীচু। ভাবলাম, এই গাছটাকেই সুন্দরভাবে কাজে লাগানো যেতে পারে।
আনুষঙ্গিক সমস্ত কাজ সেরে নেওয়ার পর পুরোপুরি তৈরি হয়ে একটা দিন ঠিক করলাম। সবিতাকে বললাম, চলো, আজ দুজনে একটা সিনেমা দেখে আসি। ও কিন্তু মুখ বেঁকিয়ে জবাব দিল, অ্যাদ্দিন পর এ কী খেয়াল?
কথাটা বলে ও লিপস্টিক নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। আমি জোরজবরদস্তি করে ওকে রাজি করালাম। তখন ঘড়িতে সাড়ে সাতটা বাজে। রাখীকে এসব কিছু না জানিয়ে বোঝালাম, তোর মা একটু পরে রাত আটটার ট্রেনে একজন বন্ধুর সঙ্গে (এসব ব্যাপার রাখীও জানত) শিলং বেড়াতে যাবে—আমি পৌঁছে দিয়ে আসতে যাচ্ছি—তুই ভেতরের ঘরে খিল দিয়ে সাবধানে থাকিস—।
শিলং বলার অনেক কারণ ছিল। প্রথমত, সবিতার অসংখ্য বন্ধুদের মধ্যে একজন—ইন্দ্রজিৎ দস্তিদার—শিলং যাবে সেদিনই রাতের ট্রেনে। আর দ্বিতীয়ত, এটা জানতে পেরে আমিও ওই একই ট্রেনে একটা বার্থের রিজার্ভেশান টিকিট কেটে নিয়ে এসেছি (অনেক বুদ্ধি, পয়সা ও পরিশ্রম খরচ করে)।
আমাদের এলাকাটা তেমন জনবহুল নয়, তাই রক্ষে। রাখীকে মনোযোগ দিয়ে পড়াশোনা করতে বলে দরজাটা বন্ধ করে বাইরের ঘরে এলাম। এ-ঘরটাই সবিতার। ওর বন্ধুবান্ধবের অভ্যর্থনার সুবিধের জন্যে ও এই বাইরের ঘরটাই থাকার জন্যে বেছে নিয়েছিল। ঘরে আলমারি, আলনা, টেবিল, চেয়ার, ড্রেসিংটেবিল ইত্যাদি সাজানো। সবই সবিতার প্রয়োজনীয় আসবাবপত্র।
সবিতা আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে শাড়িটা ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখছিল। আমি দরজাটা ভেজিয়ে দিয়ে ওর ঠিক পেছনে গিয়ে দাঁড়ালাম। ওকে বললাম, তোমার জন্যে একটা নেকলেস এনেছি—।
আমার দু-হাত তখন আমার পেছনে।
সবিতা নেকলেসের কথায় একেবারে লাফিয়ে উঠল—আনন্দে দু-একবার ‘ডার্লিং’ পর্যন্ত বলে ফেলল।
আমি ওকে বললাম, চোখ বোজো, পরিয়ে দিচ্ছি।
ও গয়নার নামে সরল মনে চোখ বন্ধ করল।
আমি শক্ত দড়িটা ওর গলায় পেঁচিয়ে টেনে ধরলাম।
আয়না দিয়ে দেখলাম, ওর চোখ ঠিকরে বেরিয়ে উঠল—আপ্রাণ চেষ্টা করল দড়িটা ছাড়ানোর—পারল না। ওর দেহটা ধপ করে মাটিতে পড়ে যেতেই আমি উত্তেজিত হয়ে পড়লাম। একটা অজানা ভয় আমাকে ঘিরে ধরল।
নিজেকে শক্ত করে এবার মূল নাটকের প্রধান অংশে হাত দিলাম। তাড়াতাড়ি ওর দেহটা টেনে নিয়ে গেলাম বাগানে—পাশের দরজা দিয়ে। তারপর গ্যারেজ থেকে গাড়ি বের করলাম। সবিতার দেহটাকে খাড়া করে পাশে বসিয়ে স্টিয়ারিং ধরলাম। গাড়ি স্টার্ট করার আগে ওর চোখে একটা সানগ্লাস বসিয়ে দিলাম (যাতে মৃত বলে বোঝা না যায়) আর ওকে বাঁ-হাতে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলাম, যাতে দেহটা টলে না পড়ে যায়।
সদর দরজা পার হয়ে আমি গাড়ি থেকে নামলাম। সদর দরজায় তালা দিয়ে আবার ফিরে এসে গাড়িতে বসলাম। মৃতদেহটাকে যতটা স্বাভাবিকভাবে বসিয়ে গাড়ি স্টার্ট দিলাম।
এইভাবে রেলস্টেশন পর্যন্ত গেলাম। সেখানে একটা নির্জন জায়গা দেখে গাড়ি দাঁড় করালাম। তারপর কায়দা করে সবিতার বডিটাকে সিটের নীচে ঠেলে দিলাম। সবশেষে গাড়ি চালালাম বাড়ির দিকে।
বাড়ির সদর দরজায় পৌঁছে দরজা খুললাম। তারপর গাড়ি গ্যারেজে তুললাম। সবিতার বডিটা টেনে বের করলাম—ওর চোখ থেকে সানগ্লাসটা খুলে নিয়ে পকেটে ভরলাম। তারপর ওর মৃতদেহটা গ্যারেজ থেকে পিপুল গাছ পর্যন্ত টেনে নিয়ে গিয়ে অতিকষ্টে ফোকর দিয়ে ফাঁপা গুঁড়ির মধ্যে ঢুকিয়ে দিলাম। বাগানের যত জঞ্জাল, গুঁড়ো মাটি, সব নিয়ে এসে ঢাললাম ওই গুঁড়ির ভেতরে।