অংশুমানের ডান কানের দিকে স্তম্ভিত হয়ে তাকিয়ে ছিল কৃষ্ণা। এইরকম একটা অসম্ভব দৃশ্য ওর চোখ অথবা মস্তিষ্ক বাস্তব বলে মেনে নিতে পারছিল না। আতঙ্কে ও কয়েক পা পিছিয়ে যেতে চাইছিল, কিন্তু ব্যাপারটা হয়ে দাঁড়াল অতিপরিচিত সেই দুঃস্বপ্নের মতো যখন লোকে প্রাণভয়ে ছুটে পালাতে চায়, অথচ পারে না।
রিসিভারটা অংশুমান বাঁকানে চেপে ধরেছিল। তখনই ওর ডান কানের ফুটো দিয়ে ধীরে ধীরে বেরিয়ে এসেছে লালায় ভেজা হিলহিলে চকচকে একটা সরীসৃপের লেজ।
লেজটার রং উজ্জ্বল সবুজ–তার ওপরে হলুদ আর কালো বুটি। কৃষ্ণার কড়ে আঙুলের মতো সরু লিকলিকে তার শরীর।
এই রঙের কোনও সাপ সত্যি-সত্যি আছে কি না কৃষ্ণা জানে না। তবে লেজটাকে দেখে প্রথমে ওর সাপের কথাই মনে হয়েছে–অন্য কোনও সরীসৃপের কথা মাথায় আসেনি।
লেজটা অংশুমানের কানের ফুটো দিয়ে প্রায় চার-পাঁচ ইঞ্চি বেরিয়ে এসেছে। সেই অবস্থায় ছুঁচোলো লেজের ডগাটা এপাশ-ওপাশ মোচড় দিয়ে নড়ছে, শূন্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে।
অংশুমান কিন্তু একইরকম নির্বিকার ভঙ্গিতে ফোনে কথা বলে যাচ্ছিল। ফুর্তির গলায় হাসছিল। বোধহয় ওর কোনও বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে কথা বলছিল।
কৃষ্ণা পাথর হয়ে গিয়ে স্বামীকে দেখছিল, আর সেইসঙ্গে ভয়ংকর হিলহিলে সবুজ সাপটা দেখছিল। সাপের লেজটা যেন কোন এক অলৌকিক উপায়ে ওকে বশ করে ফেলেছিল।
একটা প্রাণান্তকর চিৎকার বহুক্ষণ ধরেই কৃষ্ণার নাভির কাছ থেকে উঠে গলা দিয়ে বেরিয়ে আসতে চাইছিল। অংশুমান কথা শেষ করে রিসিভার নামিয়ে রাখার পরই সেটা বাইরে বেরিয়ে এল।
অনেকক্ষণ জলের নীচে ডুবে থাকার পর মানুষ যেভাবে ভেসে ওঠে, ঠিক সেভাবেই তীব্র তীক্ষ্ণ চিৎকারটা বেরিয়ে এল কৃষ্ণার ঠোঁট চিরে।
সাপ! সাপ! সাপ।
কোথায়? প্রশ্নটা করে অংশুমান অবাক হয়ে তাকাল কৃষ্ণার দিকে।
কৃষ্ণা হাঁপাতে-হাঁপাতে কোনওরকমে বলল, তোমার কানে তোমার ওই কানটায়…।
হতভম্ব অংশুমান হাত বাড়াল ওর ডান কানের দিকে।
কিন্তু কৃষ্ণা অবাক হয়ে দেখল, অংশুমানের ছোঁয়া এড়িয়ে সাপের লেজটা সড়সড় করে ঢুকে গেল কানের ভিতরে। ফলে অংশুমান কিছুই টের পেল না। বরং ও কৃষ্ণাকে আশ্বস্ত করতে ডান কানের ভিতরে কড়ে আঙুল ঢুকিয়ে কয়েকবার মোচড় দিল। তারপর দরাজ গলায় হেসে উঠে বলল, লাইব্রেরি থেকে উলটোপালটা সব বই এনে পড়ছ বুঝি?
কৃষ্ণা অবাক চোখে ওর সুপুরুষ স্বামীকে দেখছিল। ভালোবেসে বিয়ে করা এই মানুষটার মানে আজ থেকে কি তা হলে পালটে গেল! এই চার বছরে ও একটুও বুঝতে পারেনি এই মানুষটার ভিতরে একটা সাপ আছে!
অংশুমান খাওয়ার টেবিলে ফিরে এসে আবার খবরের কাগজ নিয়ে বসল। তারপর হালকা গলায় বলল, আমার এই কানটা ভীষণ চুলকোচ্ছে। রান্নার ঝামেলা মিটলে একটু কানখোঁচানি দিয়ে দেখে দিয়ো তো।
অংশুমানের কানে ময়লা জমলে কৃষ্ণাই সবসময় পরিষ্কার করে দেয়। এই একটা ব্যাপারে অংশুমান এখনও বাচ্চা ছেলে রয়ে গেছে।
কিন্তু এখন অংশুমান ওর ডান কানটা দেখিয়েছে–যে কানে একটু আগেই ওই সাপটা ঢুকে পড়ে আস্তানা গেড়েছে।
কল্পনায় কান পরিষ্কার করার দৃশ্যটা কৃষ্ণা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিল। ও অংশুমানের কানের সুড়ঙ্গ বরাবর দেখতে চেষ্টা করছে। তারপর তামার তৈরি কানখোঁচানিটা ধীরে ধীরে ঢুকিয়ে দিচ্ছে সুড়ঙ্গের ভিতরে, এদিক-ওদিক নাড়াচ্ছে। ঠিক তখনই সুড়ঙ্গের ভিতর থেকে হিংস্র ফোঁস-ফোঁস শব্দ ভেসে এল। তারপর কানখোঁচানিটা ভিতর থেকে কেউ টেনে ধরল। কৃষ্ণা প্রাণপণে টেনেও ওটাকে বের করে নিতে পারছে না। টানাপোড়েনের সে এক অদ্ভুত লড়াই!
কৃষ্ণার গায়ে কাঁটা দিল। ও শিউরে উঠে বলল, তুমি নিজে দেখে নিয়ো। আমার ভয় করছে, আমি পারব না।
অংশুমান হেসে বলল, তোমার এই মিছিমিছি ভয়ের কোনও মানে হয় না…
ঠিক সেই মুহূর্তে কৃষ্ণার নজর গেল অংশুমানের ডান কানের দিকে। সবুজ লেজের ডগাটা আবার বেরিয়ে এসে উঁকি মেরে ওকে দেখছে, আর থেকে থেকেই সামান্য ভিতরে ঢুকে যাচ্ছে। অনেকটা যেন কোনও বাচ্চা ছেলের টুকি দেওয়ার মতো।
কৃষ্ণা এক ভয়ংকর চিৎকার করে উঠতেই লেজের ডগাটা টুক করে ঢুকে পড়ল কানের ভিতরে।
এই ঘটনার পর থেকেই কৃষ্ণা অংশুমানকে ভয় পেতে শুরু করল। অংশুমান টেলিফোনে কথা বলার সময় ও কিছুতেই সেদিকে তাকাত না। অন্য ঘরে নিজের শোয়ার ব্যবস্থা করল। স্বামীর সঙ্গে কথা বলার সময় ও বারবারই তাকাত তার কানের দিকে। আর ভাবত, সবুজ রঙের ঠান্ডা শরীর নিয়ে লালায় ভেজা সাপটা কখন আবার বাইরে বেরিয়ে আসবে। এইরকম অদ্ভুত একটা ভয় ওকে পাগল করে তুলল।
এরপর আর একদিন কৃষ্ণা সাপটাকে দেখতে পেয়েছিল।
শীতের দুপুরে অংশুমান নিজের বিছানায় ঘুমিয়ে ছিল। মাথার কাছের জানলা দিয়ে একফালি রোদ এসে পড়েছে দেওয়ালে।
ঘুমোলে অংশুমানের সামান্য নাক ডাকে। এখনও তার শব্দ শোনা যাচ্ছিল। কৃষ্ণা ঘরে এসেছিল আলনা থেকে ওর একটা শাড়ি নিতে। তখনই ও দেখতে পেল সাপটাকে।
ধবধবে সাদা বালিশের ওপরে সাপটা ঘুরে বেড়াচ্ছে!
অংশুমান চিত হয়ে শুয়ে ছিল। ফলে অতি সহজেই সবুজ লিকলিকে সাপটা বেরিয়ে এসেছে ওর কানের ফুটো দিয়ে। ওটার শরীরের প্রায় ফুটখানেক বালিশের ওপরে দিব্যি নড়েচড়ে বেড়াচ্ছে। তবে এবারেও সেই লেজের দিকটা। বাকি অংশটা লুকিয়ে রয়েছে অংশুমানের শরীরের ভিতরে।