প্রথমে পরিচিত বন্ধুবান্ধব কয়েকজনকে ফোন করলাম, যারা এ ধরনের পত্রিকা পড়ে। কেউ-কেউ বাড়ি নেই, আর বাকিরা গল্পটা পড়েনি। তাদের বললাম দৌড়ে গিয়ে এককপি পত্রিকা কিনে গল্পটা পড়ে নিতে। মুখে ‘হ্যাঁ’ বললেও আমি জানি পত্রিকা কিনতে ওরা কেউই যাবে না। তারপর একটা বইয়ের দোকানে ফোন করলাম, কিন্তু ওরা বলল টেলিফোনে গল্প পড়ে শোনানো ওদের ধর্ম নয়।
মোহনকে ফোন করলাম। আমার গলা শুনেই ও হাসল। তারপর ফোন নামিয়ে রাখল। আত্মীয়স্বজন দু-একজনকে ফোন করতেই তারা জিগ্যেস করল, আমি কোথা থেকে ফোন করছি। আমার কোনও বিপদ হয়েছে কি না। পুলিশে কি খবর দিতে হবে?
নীরবে ফোন নামিয়ে রাখলাম।
এবার ‘ক্রিমিনাল’টা উলটেপালটে দেখলাম। কোনও ফোন নম্বর দেওয়া নেই। দুটো নাম রয়েছে: সহদেব সাহা ও স্বপন সাহা। যথাক্রমে প্রধান উপদেষ্টা ও সম্পাদক। ডিরেকটরিতে তাঁদের নামে কোনও ফোন নম্বর খুঁজে পেলাম না যে ফোন করব। চিন্তাহরণ চাকলাদারের নাম ধরে ফোন নম্বর খোঁজার কোনও চেষ্টা করলাম না। কারণ, ছদ্মনাম দেখলেই আমি বুঝতে পারি।
স্বীকার করছি, একটু নার্ভাস হয়ে পড়লাম। তারপর শেষ চেষ্টা হিসেবে ফোন করলাম লালবাজারে। না, ডি. সি. সমীর চক্রবর্তী বা ইন্সপেক্টর যুধাজিৎ সেনের নাম তারা কখনও শোনেনি। তবে প্রশান্ত সরখেল বলে একটা লোক বর্তমানে তাদের হাজতে আছে। সে অভিযুক্ত জালিয়াতির অপরাধে, চুরির অপরাধে নয়।
এবার ধীরে-ধীরে নিজেকে শান্ত করলাম। পত্রিকার বাকি গল্পগুলো (মোহনের কৃপায় যেগুলো অটুট আছে) পড়ে শেষ করলাম। বেরোনোর ব্যাপারটা নিয়ে আমি মোটেও আর ভাবছি না। সোমবারে সকাল সাড়ে নটা পর্যন্ত আমার হাতে সময় আছে। তার মধ্যে ফোনে এমন কাউকে নিশ্চয়ই পেয়ে যাব যে ওই গল্পটা পুরোটা পড়েছে। শুধু এখন ঈশ্বরকে ডাকছি, যুধাজিৎ সেন শেষ পর্যন্ত আমাকে ধোঁকা না-দেয়। কারণ, গল্পের রহস্যের কায়দা এবং চালাকি মেশানো সমাধান আমি একটুও পছন্দ করি না।
সাবধান! সাপ আছে (২)
চায়ের কাপে লম্বা এক চুমুক দিয়ে বিনু বলল, আজ তোকে একটা সাপের গল্প শোনাব…। ওর কথায় আমার গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল। একইসঙ্গে মনে হল, ছোট্ট খোলা জানলাটা দিয়ে কুলকুল করে ঠান্ডা হাওয়া ঘরে ঢুকে পড়ল। তারপর সাপের মতো এঁকেবেঁকে ছড়িয়ে পড়তে লাগল স্যাঁতসেঁতে ঘরটায়।
বিনুর কাণ্ডই এইরকম। হুটহাট করে উদ্ভট সব মন্তব্য করে বসে। সবসময় বলে ওর গল্পগুলো নাকি সত্যি। কে জানে! তবে ওর গল্পগুলো বেশিরভাগ সময়েই অস্বস্তিকর। অথচ শুনতেও মন চায়।
সন্ধে পেরিয়ে রাত হয়ে গেছে। সেইসঙ্গে নিশাচর সরীসৃপের মতো শীতেরও তেজ বেড়েছে। বিনুদের পুরোনো ধাঁচের বাড়িতে দুজনে বসে আড্ডা মারছিলাম। ও দিন দশেকের জন্য কলকাতায় এসেছে। এসেই আমাকে টেলিফোন : ডে অ্যান্ড নাইট আড্ডা মারবি তো চলে আয়…।
আমি জিগ্যেস করলাম, অ্যাদ্দিন কলকাতা ছেড়ে কোথায় ছিলি?
ভুবনবটুয়া ও হেসে জবাব দিল।
ও যে দেশের কোথায় কোথায় ঘুরে বেড়ায় সে ও-ই জানে! যেমন নাম-না-শোনা ওই ভুবনবটুয়া থেকে দশদিনের জন্যে কলকাতায় এসেছে, দশদিন পর তেমনই কোনও নাম-না-শোনা জায়গার দিকে রওনা হয়ে যাবে। ও ভারি বিচিত্র। মাঝে-মাঝে মনে হয়, ওর ভিতরে বোধহয় কোনও গোলমাল আছে। কিন্তু এত সত্ত্বেও আমার এই উড়ে বেড়ানো, ঘুরে বেড়ানো বন্ধুকে আমার চমৎকার লাগে। আবার ওকে আমি ভয়ও পাই–ওর অদ্ভুত সব গল্পের জন্যে।
গোটা বাড়িতে আমরা একা। বিনুই একটু আগে চা-জলখাবারের ব্যবস্থা করেছে। বলেছে, যদি এখানে রাতটা থেকে যাস তাহলে রসেবশে থাকার ব্যবস্থা করব।
আমি হাতজোড় করে হেসে বলেছি, মাফ করো, ভাই, আমি তোমার মতো রসিক নই। তারপর হাতঘড়ির দিকে একনজর তাকিয়ে আরও বলেছি, রাত বাড়ছে, তুমি তাড়াতাড়ি তোমার গপ্পোটা শুরু করো।
বিনু সেদিন যে-গল্পটা আমাকে বলেছিল সেটা শোনার পর থেকে আমি একেবারে বদলে গেছি। আমার বুকের ভিতরে কেমন একটা ভয় ঢুকে গেছে। মাঝরাতে ঘুম ভেঙে জেগে উঠি, সারা শরীরের কুলকুল করে ঘাম দেয়। কেন জানি না, বিনুর কথাগুলো আমি আজগুবি বলে উড়িয়ে দিতে পারিনি বিশেষ করে ওর শেষ কথাগুলো।
বিনু ওর গল্পটা বলতে শুরু করল।
.
কৃষ্ণা প্রথম যেদিন ব্যাপারটা দ্যাখে সেদিন ও দিশেহারা পাগল হয়ে গিয়েছিল। নিজের চোখকে ও বিশ্বাস করতে পারেনি। সারা গা শিউরে উঠেছিল আতঙ্কে ঘৃণায়। গলা শুকিয়ে কাঠ, আর একইসঙ্গে দমবন্ধ হয়ে গিয়েছিল। মুখের ভিতরে জিভটা মনে হচ্ছিল নেহাতই খসখসে শুকনো চামড়ার একটা টুকরো।
সবচেয়ে আশ্চর্যের এই যে, বিয়ের চার বছরে কোনওদিন ব্যাপারটা ওর নজরে পড়েনি। অথবা অংশুমান কখনও ওকে এ-বিষয়ে কিছু বলেনি।
কৃষ্ণা বরফে গড়া মূর্তির মতো তিন হাত দূরে দাঁড়িয়ে থাকা অংশুমানকে দেখছিল। অংশুমান টেলিফোনে কথা বলছে, আর মাঝে মাঝেই গলা ছেড়ে হেসে উঠছে।
একটু আগেই যখন ফোনটা বেজে উঠেছিল তখন কৃষ্ণাই ফোন ধরেছিল। তারপর অংশুমানের দিকে রিসিভার এগিয়ে দিয়ে বলেছে, তোমার ফোন।
আজ রবিবার ছুটির দিন। তাই ওরা দুজনেই বেলা করে উঠেছে। তারপর রোজকার কাজ সেরে ব্রেকফাস্ট নিয়ে বসতে বসতে সাড়ে নটা বেজে গেছে। ব্রেকফাস্ট খেতে খেতে খবরের কাগজ পড়ছিল অংশুমান। সেই সময়েই টেলিফোনটা বেজে উঠেছে।