আমি স্থির চোখে উঁকি মেরে দেখতে লাগলাম। কর অফিসের বাঁক ঘুরে আমার নজরবন্দি হলেন, এবং আমিও লেটার বক্স ছেড়ে এগিয়ে গেলাম বন্ধ দরজার কাছে।
দরজাটা সামান্য খুলে তিনি আমার দিকে চেয়ে হাসলেন, ‘এই সেদিন ম্যানিব্যাগ ফেলে গিয়েছিলে, আজকে আবার পেন?’
অবাক হতে যাচ্ছি, খেয়াল হল নিজের একটু আগে বলা মিথ্যে কথাটা: অফিসে পেন ফেলে গেছি।
‘হ্যাঁ, স্যার,’ সলজ্জ হাসলাম।
‘আজ রাতটা পেন না-হলে চলছিল না?’
‘মানে, একজনকে চিঠি লিখতে হবে, স্যার। তাই…’
অদ্ভুতভাবে হাসলেন কর, বললেন, ‘প্রেমপত্র?’
চুপ করে রইলাম। জানি না, এসব প্রশ্নরাশির মহান কারণটা কী। তবে আমার মুখে বোধহয় একটা হতাশ বোকা-বোকা ছাপ স্পষ্ট হয়েছিল। কারণ, কর হঠাৎই সদয় হয়ে বললেন, ‘এসো।’ দীর্ঘশ্বাস ফেলে তিনি একপাশে সরে দাঁড়ালেন। আমাকে ভেতরে ঢুকতে জায়গা দিলেন।
দ্রুতপায়ে এগিয়ে গেলাম আমার টেবিলের কাছে। বিভিন্ন ড্রয়ার ফাইলপত্র ঘাঁটতে শুরু করলাম। মিস্টার অনন্ত কর দরজায় দাঁড়িয়ে পেচকজাতীয় চোখে আমাকে লক্ষ করতে লাগলেন। আমার পরিকল্পনায় তাঁর দরজার কাছে দাঁড়িয়ে থাকার কথা ছিল না।
‘কোথায় যে গেল পেনটা!’ উচ্চগ্রামে স্বগতোক্তি করলাম, ‘ওটা না-পেলে আজ ভীষণ মুশকিল হবে।’ আরও একটা ড্রয়ারকে ব্যবচ্ছেদ করতে শুরু করলাম: ‘পেনটা একজন আমাকে জন্মদিনে দিয়েছিল।’ অকারণেই যোগ করলাম।
মিস্টার করের মুখমণ্ডলে এবার যে অভিব্যক্তি ফুটে উঠল অল্প আলোয় সেটাকে বিরক্তি ও করুণার মিশ্রণ বলে চিনে নিতে ভুল হল না। তিনি থপথপ করে অফিসের বাঁক ঘুরে নিজের টেবিলের দিকে এগিয়ে গেলেন। যাওয়ার আগে ক্লান্ত স্বরে বললেন, ‘যাওয়ার সময় দরজাটা বন্ধ করতে ভুলো না, বিশ্বাস।’
বললাম, ভুলব না এবং ড্রয়ার ইত্যাদি নিয়ে আরও মিনিটখানেক খটাখট করার পর চিৎকার করে উঠলাম, ‘এই তো পেয়েছি! আলপিনের বাক্সের পেছনে পড়ে ছিল!’ গলার স্বর তুঙ্গে রেখেই বললাম, ‘আমি চললাম, মিস্টার কর!’
‘আচ্ছা—’ তাঁর আনমনা উত্তর শোনা গেল। রেলিংটা একলাফে টপকে দরজার কাছে গেলাম। দরজাটা খুলে সশব্দে আবার বন্ধ করে দিলাম। তারপর পা টিপে-টিপে ফিরে এসে লুকিয়ে রইলাম আমার টেবিলের তলায়। জায়গাটা যেন একটা ছোট্ট গুহা, তবে সামান্য আলোর রেশ রয়েছে। সুতরাং ‘মাসিক ক্রিমিনাল’টা বের করে পড়তে শুরু করলাম। ডি. সি. সমীর চক্রবর্তী এখনও হালে পানি পাচ্ছেন না।
‘আমি হার মানলাম, সেন।’ ডি. সি. মাথার টাকে হাত বুলিয়ে বললেন। মুখে তাঁর এখনও কৌতূহলের ছায়া।
‘কী যে বলেন—’ হাসলেন যুধাজিৎ সেন: ‘আমি আর প্রশান্ত সরখেল পারলাম, সেখানে আপনি পারবেন না! বিশেষ করে আপনার এত বছরের পুলিশি অভিজ্ঞতা রয়েছে। দাঁড়ান, পুরো ব্যাপারটা আর-একবার আপনাকে গুছিয়ে বলি। আপনি একটা ভল্টে বন্দি হয়ে রয়েছেন—।’
মিস্টার করের আলোর নিভে গেল। শুনতে পেলাম তাঁর এগিয়ে আসা পায়ের শব্দ। চারদিক ভীষণ চুপচাপ। আমিও শব্দহীন, যদিও জানি তাঁর পেছনে দাঁড়িয়ে ট্যাঙ্গো নাচ নাচলেও মিস্টার করের মৃত কর্ণদ্বয় বিন্দুমাত্রও বিচলিত হবে না। চুপিচুপি গিয়ে তাঁর কানের কাছে আচমকা এক চিৎকার করতে ভীষণ ইচ্ছে হল। দেখতাম, বুড়ো কীরকম চমকে ওঠে। কিন্তু এখন বোকামি করার সময় নয়।
রুদ্ধশ্বাসে শুনলাম শীততাপ যন্ত্র বন্ধ করে দেওয়ার শব্দ। শুনলাম বিপদঘণ্টি চালু করার শব্দ। দরজা খোলা ও বন্ধ করার শব্দ। এবং সবশেষে তালার চাবি ঘোরানোর মিষ্টি আওয়াজ।
আরও একমিনিট ঘাড় গুঁজে টেবিলের তলায় বসে রইলাম—অতিরিক্ত সাবধানতায়। তারপর একলাফে বাইরে এলাম। কলকাতার অন্যতম ধনী নাগরিক হতে আর মাত্র দু-পৃষ্ঠা (মাসিক ক্রিমিনালের) এবং দশমিনিট বাকি।
অফিসে কোনও জানলা নেই। সুতরাং একটা আলো জ্বালতে বাধা নেই। ইচ্ছে হলে সবকটা আলোই জ্বালাতে পারি, কিন্তু সে-আলো শীততাপ যন্ত্রের ফাঁক দিয়ে বাইরের লোকের নজরে পড়তে পারে। এছাড়া প্রতিফলিত আলোকেও বিশ্বাস নেই। তার ওপর চিঠি ফেলার গর্ত তো রয়েছেই। হয়তো দেরিতে আসা কোনও দ্বিতীয় বিশ্বাস সেই গর্ত নিয়ে দেখছে এবং টাকা লুঠের মতলব ভাঁজছে। এখন অতিরিক্ত সাবধান হওয়ার সময়। আলিপুর জেল ও কলকাতার মুক্ত বাসিন্দাদের মধ্যে ফারাক শুধু এই অতিরিক্ত সাবধানতাটুকুর। সুতরাং শুধুমাত্র দেশলাই জ্বালানোর ঝুঁকি নেব ঠিক করলাম।
নিজের পকেট ও টেবিলের ড্রয়ার হাতড়ে স্পষ্ট বুঝলাম, সে-ঝুঁকিও আমাকে আর নিতে হবে না। কারণ দেশলাই কোথাও নেই। এই দুঃখের মুহূর্তে মনে পড়ল, একটা পকেট-টর্চ আমি কিনেছিলাম। তখন আমি সবেমাত্র সিন্দুক লুঠ করবার তোড়জোড় শুরু করেছি। সযত্নে সংগ্রহ করেছি হিন্দি-সিনেমাজাতীয় পোশাক, (কালো প্যান্ট, কালো জামা, কালো মুখোশ—তাতে শুধু চোখের কাছে দুটো ফুটো এবং কালো রবারের জুতো) যাতে কেউ আমাকে অফিস-বাড়ি থেকে বেরুতে দেখলেও ‘আমি’ বলে সন্দেহ না করে। মনে পড়ছে, টর্চ লাইট ও পোশাকগুলো কিনেছিলাম নাকতলা অঞ্চল থেকে, যাতে কেউ পরে মধ্য কলকাতার অপরাধের দায়ে আমাকে শনাক্ত করতে না-পারে। এখন সেই চুরির সাজপোশাক, টর্চলাইট, সব পড়ে আছে খাটের নীচে।
আমার মতো প্রতিভাধর পুরুষও একমুহূর্তের জন্যে হতাশ হল। সূক্ষ্ম ভাবনাচিন্তার মাঝে শুনতে পাচ্ছি ওপরতলার টি-ভি কোম্পানির লটঘট কাণ্ড। কোম্পানির মালিক সুরোলিয়াকে সেক্রেটারি পামেলা হয়তো এই নিয়ে তৃতীয়বার ‘অবৈধ সুরোলিয়া, জুনিয়ার’ উপহার দিতে চেষ্টা করছে। তাই বোধহয় এত গানবাজনার আওয়াজ, খিলখিল হাসির শব্দ।