তা সত্ত্বেও মোহন গল্পটা উলটেপালটে দেখতে শুরু করল। আমি কাড়াকাড়ির চেষ্টা ছেড়ে র্যাকের দিকে ফিরলাম। পয়সা যখন দিয়েছি, তখন দ্বিতীয় এককপি ‘মাসিক ক্রিমিনাল’ পড়বার অধিকার আমার আছে।
কিন্তু স্বাভাবিকভাবেই র্যাকে দ্বিতীয় কোনও কপি দেখলাম না। কলকাতায় ‘মাসিক ক্রিমিনাল’-ভক্তদের সংখ্যা অস্বাভাবিক। হয়তো মোহন সরকারের হাতের কপিটাই এ-শহরের শেষ কপি। হয়তো পৃথিবীরও শেষ কপি।
ঘড়িতে ছঁটা কুড়ি।
সুতরাং আবার কাড়াকাড়ি অধ্যায় শুরু করলাম।
‘ঠিক আছে, ঠিক আছে, দিচ্ছি।’ মোহন বলল, ‘তবে তুই যা চাইছিস, ফষ্টিনষ্টি, সেসব এ-গল্পে নেই। দাঁড়া, ম্যাগাজিনটা প্যাক করে দিই।’
‘না, না, ওসবের দরকার নেই। আমি গল্পটা পড়তে-পড়তে যাব।’
‘আজ বড় পবিত্র দিন।’ হেসে বলল মোহন। আমার ডারউইনের কথা আবার মনে পড়ল। তারপর: ‘তুই আমার দোকান থেকে প্রথম বই কিনলি, সুতরাং এ-বই আমি জন্মদিনের রঙিন মোড়কে না-মুড়ে ছাড়ছি না।’
দোকানে অন্য খদ্দের নেই। সুতরাং মোহনের সব নজর এখন আমারই দিকে। বইটা হাতে করে ও অদৃশ্য হয়ে গেল কাউন্টারের পেছনে। আমার উৎকণ্ঠিত চোখের সামনে ঘড়িতে সময় বয়ে যায়: ছ’টা বাইশ, ছ’টা তেইশ, ছ’টা চব্বিশ।
ছ’টা পঁচিশে আমাকে ডারউইনের কথা তৃতীয়বার মনে করিয়ে দিয়ে মোহন বেরিয়ে এল কাউন্টারের পেছন থেকে। ম্যাগাজিনটাকে গোলাপি ফুল ছাপা কাগজে মুড়ে ও সোনালি ফিতে দিয়ে বেঁধে এনেছে।
‘পত্রিকা কেনার জন্যে অজস্র ধন্যবাদ।’ হেসে বলল মোহন।
ম্যাগাজিনটা ওর হাত থেকে প্রায় কেড়ে নিয়ে আমি বেরিয়ে পড়লাম দোকান ছেড়ে। মোড়কটা ব্যস্ত হাতে ছিঁড়তে-ছিঁড়তে ব্যস্ত পায়ে এগিয়ে চললাম অফিসের দিকে। চঞ্চল বইয়ের পাতায় আমার চোখও চঞ্চল:
‘দাঁড়াও, দাঁড়াও, একটু ভাবতে দাও আমাকে।’ চেয়ারে হেলান দিয়ে চোখ বুজলেন ডি. সি. চক্রবর্তী।
‘ভাবুন স্যার।’ বললেন যুধাজিৎ সেন, ‘আরাম করে ভাবুন।’ তাঁর চোখে দুষ্টুমির হাসি।
সামনের ড়ি সি. এম. শো-রুমের দেওয়াল-ঘড়িতে ছ’টা সাতাশ।
‘কোনও যন্ত্রপাতি সঙ্গে ছিল না বলছ?’ প্রশ্ন করলেন সমীর চক্রবর্তী।
আগেই তো সে-কথা আপনাকে একশোবার বলা হয়েছে, বিরক্ত হয়ে ভাবলাম।
‘না।’ যুধাজিৎ সেন ঠোঁটে হাসলেন—বাচ্চা ছেলের ব্যর্থতায় অভিজ্ঞ শিক্ষকের হাসি:’সাধারণ কোনও মানুষের কাছে সাধারণ যেসব জিনিস থাকে আমার কাছে তার বেশি ছিল না। মানিব্যাগ, চিরুনি আর রুমাল।’
‘মানিব্যাগটা নিশ্চয়ই সাধারণ মানিব্যাগ নয়?’ ধূর্তস্বরে প্রশ্ন করলেন সমীর চক্রবর্তী।
যুধাজিৎ সেন হাসি চেপে বললেন, ‘আপনি ভুল পথে চলেছেন, স্যার।
সরখেল এবং আমি শুধুমাত্র উপস্থিতবুদ্ধি ভাঙিয়ে ওই ভল্ট থেকে বেরিয়ে এসেছি।’
‘দারুণ! তুলনা নেই।’ মনে-মনে বললাম। ম্যাগাজিনটাকে ঢুকিয়ে নিলাম জামার ভেতর। কারণ, আমি এখন অফিসের দরজায় দাঁড়িয়ে। কিন্তু অনন্ত কর ভেতরে আছেন তো?
বেল বাজালাম। কোনও উত্তর নেই।
দরজায় দমাদম ঘুষি মারলাম। উত্তর নেই।
এবার চিৎকার করে উঠলাম, ‘মিস্টার কর, মিস্টার কর?’
অরণ্যে রোদন।
রাস্তার ওপারে স্টেট ব্যাংক বিল্ডিংয়ের ঘড়িতে ছ’টা ঊনত্রিশ। বুড়ো নির্ঘাত ভেতরেই আছে, মনকে প্রবোধ দিলাম নীরবে। যদি কোনও লোক সাড়ে পাঁচটায় বলে আমাকে এখনও ঘণ্টাখানেক কাজ করতে হবে, তা হলে ছ’টা ঊনত্রিশে তার কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকারই কথা।
আরও মিনিটখানেক দরজায় ধাক্কা দেওয়ার পর আসল রহস্যটা মাথায় ঝিলিক মারল। আমি ভুলেই গিয়েছিলাম যে, অনন্ত কর কানে শুনতে পান না। তা হলে তিনি নিশ্চয়ই ভেতরে আছেন। সাড়া দিচ্ছেন না আমার ডাক শুনতে পাচ্ছেন না বলে। সুতরাং নতুন আশা নিয়ে এগিয়ে গেলাম চিঠি ফেলার গর্তের কাছে। উঁকি মারলাম। তাঁর টেবিলের আলোর রেশ অফিসের দেওয়াল থেকে ঠিকরে পড়ছে। কিন্তু অফিসের ‘এল’ আকৃতির জন্যে অনন্ত কর আমার নজরের আড়ালে।
‘মিস্টার কর!’ আমি চিৎকার করলাম (ছ’ইঞ্চি চওড়া গর্তে যতখানি জোরে চিৎকার করা সম্ভব) ‘মিস্টার কর, আমি বিশ্বাস!’
‘বিশ্বাস?’ তাঁর কণ্ঠস্বরে উদ্বেগ, বিস্ময়।
‘হ্যাঁ, স্যার, আমি!’ ভোক্যাল কর্ডের অগ্নিপরীক্ষা দিয়ে উত্তর দিলাম।
‘সে কী? আমি তো জানি তুমি অনেকক্ষণ আগে চলে গেছ।’
‘হ্যাঁ, চলে গেছি! এখন আমি অফিসের বাইরে, মিস্টার কর! চিঠি ফেলার গর্তের কাছে!’
‘ও।’ অনন্ত করের গলায় দিশেহারা সুর, ‘তা কী ব্যাপার, ফিরে এলে যে?’
‘আমার ফাউন্টেন পেনটা ফেলে গেছি!’ চিৎকার করে বললাম।
মানসচক্ষে দেখতে পেলাম অনন্ত কর গম্ভীরভাবে বিরক্ত হয়ে মাথা নাড়ছেন। সৌভাগ্যবশত আমার পরিকল্পনার একটা প্রধান অংশ ছিল দিনের-পর-দিন অনন্ত করের কাছে নিজেকে গর্দভ প্রতিপন্ন করা। কবে এই ইমেজ কাজে লাগবে, সে-কথা না-ভেবেই ফাইল উলটোপালটা জায়গায় রেখেছি, হিসেবে ভুল করেছি, অফিসে সুযোগ পেলেই হোঁচট খেয়ে পড়েছি, বোকার মতো মিসেস রাও এবং মিস্টার করকে প্রশ্ন করেছি, এবং নিজের টুকিটাকি জিনিস প্রায়ই ভুল করে ফেলে গেছি অফিসে। এজন্যে বারদুয়েক আমার চাকরি যেতে-যেতে বেঁচে গেছে। কিন্তু আজ, দু-মাস পরে, আমার সেই গর্দভ-ইমেজ কাজে লাগছে। বড় আনন্দের কথা।
‘দাড়াও, নলিনী, দরজা খুলছি।’ মিস্টার কর চেয়ার ঠেলে (শব্দ শুনে অনুমান করলাম) উঠে দাঁড়ালেন।